আস সালাম - আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক
বিদ্যুৎ কথা: এসি না ডিসি?
বিদ্যুতের সাথে আমাদের জীবন পুরোপুরি জড়িয়ে গিয়েছে। আজকের দিনে বিদ্যুৎ না হলে আমাদের এক মুহুর্তও যেন চলেনা। দৈনন্দিন জীবনেই শুধু নয়, সাথে সাথে রাজনীতিতে বিদ্যুৎ নিয়েছে অন্যতম নীতি নির্ধারন ভূমিকা। বাংলাদেশে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের কিংবা ২০০৯ এর নির্বাচনে জোট সরকারের ভরাডুবির পেছনেও ছিল এই বিদ্যুৎ। দিন দিন এমনই গুরুত্ববহ হয়ে উঠেছে এই শক্তিটি।
দুই ধরনের বিদ্যুতের সাথে আমরা পরিচিত - এসি, বা অল্টারনেটিং কারেন্ট । এবং ডিসি, বা ডিরেক্ট কারেন্ট। ডিসি কারেন্ট সোজা সাপ্টা। নিরবিচ্ছিন্ন তার প্রবাহ, সময়ের সাথে এর মানের পরিবর্তন হয় না। টর্চ লাইটে পাচ ভোল্টের ব্যাটারী যে বিদ্যুৎ দিয়ে থাকে তা হল ডিসি কারেন্ট।
অন্যদিকে এসি কারেন্ট এর উল্টো। সময়ের সাথে বাড়ে কমে। বাসা বাড়ীতে ট্রান্সমিশন লাইন দিয়ে যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয় তা হচ্ছে এসি কারেন্ট। নীচের ছবিতে এসি ও ডিসি কারেন্ট।
ধরা যাক আপনার কাছে প্রশ্ন রাখা হল:
আপনি কোন ধরনের বিদ্যুতের সমর্থক? এসি না ডিসি?
বিদ্যুতের পেছনের ইতিহাস জানা না থাকলে আপনি অবাক হবেন।
ভাববেন, এ কি কোন প্রশ্ন হল? প্রশ্নকারী কি পাগল নাকি? বিদ্যুত নিয়ে যুদ্ধ করার কি আছে!
না, প্রশ্নকারী পাগল নন, তিনি ইতিহাস ভালই জানেন। আজ বাসা বাড়ী কিংবা শিল্প কারখানায় যে এসি কারেন্ট সরবরাহ করা হয়, তার পেছনেও এক বড় যুদ্ধ আছে বৈকি। যা "কারেন্ট যুদ্ধ" নামে পরিচিত। আর এই যুদ্ধ যাদের মধ্যে সংগঠিত হয়েছিল তাদের এক পক্ষ ছিলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন, এবং অন্যপক্ষ ছিলেন ওয়েস্টিংহাউস ও টেসলা। এডিসন নেতৃত্ব দেন ডিসি কারেন্টের পক্ষে, অন্যদিকে টেসলা-ওয়েস্টিংহাউস এসি কারেন্টের পক্ষে লড়েন।
এসি ডিসির এই যুদ্ধে কে জয়ী হন? যুদ্ধের ফলাফল আগে ভাগে বলে দিলে মজা ফুরিয়ে যায়। সেটা জেনেও বলছি, এই যুদ্ধে হেরে যান এডিসন, যার ফলে ওয়েস্টিংহাউস-টেসলা তাদের প্রস্তাবিত এসি কারেন্টকে জনপ্রিয় এবং বাজারজাত করতে পেরেছিলেন। এসি কারেন্টের এই জয় খুব সহজে আসেনি, এডিসন সর্বাত্মক চেষ্টা করেন ডিসির পক্ষে। তাহলে সে গল্পটাই আজ আপনাদের শোনাই।
যেভাবে এসি/ডিসির যুদ্ধ শুরু:
আজকের দিনে বাসা বাড়ীতে এসি কারেন্ট সরবরাহ করা হলেও প্রথমে পরিস্থিতি কিন্তু ছিল উল্টো।
ডিসি কারেন্টই তখন সরবরাহ করা হত আমেরিকাতে। সেসময়টাতে কোন এসি-মটর উদ্ভাবিত হয় নি। ডিসি কারেন্ট দিয়ে বৈদ্যুতিক বাতি, স্টোরেজ ব্যাটারী এবং ডিসি মটর চালানো যেত। বৈদ্যুতিক বাতির নীতি বেশ সোজা - বাতির ভেতরের ফিলামেন্ট খুব বেশী গরম হয়ে যায় যদি কারেন্ট প্রবাহিত করা যায়। এই ফিলামেন্ট গরম হয়ে এরপর জ্বলতে থাকে।
অর্থ্যাৎ বিদ্যুৎ শক্তি প্রথমে তাপ শক্তি এবং এর পরে আলোক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে থাকে। ডিসির প্রবক্তা এডিসন তার এই ডিসি নেটওয়ার্ককে এগিয়ে নিতে থাকেন। এই ধারাবাহিকতায় ১৮৭৬ সালে টমাস আলভা এডিসন ডায়নামো এবং আরো কিছু ইলেক্ট্রিক্যাল যন্ত্র পরীক্ষা নিরীক্ষার জন্য নিউ জার্সিতে একটি গবেষনাগার খোলেন। এর পরে ১৮৯০ সালে এডিসন প্রতিষ্ঠা করেন জেনারেল ইলেক্ট্রিক, যা আজকের পৃথিবী অন্যতম বৃহৎ মাল্টিন্যাশনাল বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। ফোরবস পত্রিকার র্যাংকিং অনুযায়ী ২০০৯ এ জেনারেল ইলেক্ট্রিক ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ প্রতিষ্ঠান।
সার্বিয়ান বিজ্ঞানী টেসলা কাজ করতেন এডিসনের সাথে। তিনি ঘূর্নায়মান চৌম্বক ক্ষেত্রের উপর কাজ করতে গিয়ে এসি কারেন্টের দেখা পান। সাথে সাথে তিনি এসি কারেন্ট কি করে উৎপাদন, সরবরাহ এবং ব্যবহার করা যায় - সেটার উপরেও কাজ করেন। দুভার্গ্য এডিসনের। তিনি টেলসার কাজকে যথাযথ মূল্যায়ন করেন নি।
টেসলার এসি পাওয়ার ট্রান্সমিশনের আইডিয়া এক কথায় উড়িয়ে দিয়ে এডিসন বললেন, "আইডিয়া বেশ চমৎকার। তবে তা বাস্তবতার সাথে বেমানান। " টেসলা ক্ষোভে চলে যান এডিসনকে ছেড়ে ওয়েস্টিংহাউসের কাছে, যোগ দেন ওয়েস্টিংহাউসের সাথে। ওয়েস্টিংহাউস এসিকে বাজারজাত করতে থাকেন। টেসলার polyphase system, ট্রান্সফর্মার, এবং অন্যান্য আবিষ্কার দিয়ে শুরু হয় এসি সিস্টেমের যাত্রা।
ওয়েস্টিংহাউস টেসলার গবেষনাকে সঠিক ভাবে মূল্যায়ন করে এসি কারেন্ট সিস্টেমকে এগিয়ে নিতে থাকেন। ১৯৮৮ সালের মধ্যেই টেসলার সহায়তায় ওয়েস্টিংহাউস থ্রী ফেজ ৬০ হার্টয এসি কারেন্টের মোটামুটি একটি ডিজাইন চূড়ান্ত করে ফেললেন।
কেন এডিসন টেসলার এসি কারেন্টকে গুরুত্ব দেন নি? কারন, এডিসন আসলে ম্যাথমেটিশিয়ান ছিলেন না। ম্যাথমেটিকস এবং ফিজিক্সের উপর ভালো দখল না থাকলে এসি কারেন্টের মূলনীতি বোঝা অসম্ভব। পরবর্তীতে এডিসন অনুতপ্ত হন টেসলার কাজকে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ হবার কারনে।
আগেই বলেছি, প্রথম দিকে বিদ্যুৎ নেটওয়ার্ক ছিল ডিসি কারেন্ট ভিত্তিক। তা যদি কেউ এসি কারেন্ট দিয়ে বদলে দিতে চায়, তবে আম জনতাকে প্রভাবিত করতে হবে যে এসি প্রকৃতপক্ষে ডিসির চেয়ে উন্নত। এসি প্রনেতাদেরকে সেরকম উদ্যোগ নিতে হল। তারা ডিসি কারেন্টের সমস্যা গুলো নিয়ে কাজ করে আমজনতাকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হলেন যে, এসি কারেন্ট ডিসি কারেন্টের সব চ্যালেন্জ্ঞ মোকাবেলা করতে সক্ষম।
এসি যেভাবে ডিসিকে চ্যালেন্জ্ঞ দিল:
এডিসনের ডিসি ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমে ডিসি পাওয়ার প্ল্যান্ট মানুষের বাসায় বাসায় ১০০ ভোল্টের বিদ্যুৎ সরবরাহ করত।
মুশকিলটা হল মোটা কপার কনডাকটর বা লাইনের খরচ। সে খরচ বাচাতে তিন লাইনের ব্যবস্থা করা হল, ১০০ ভোল্ট, -১০০ ভোল্ট আর মাঝখানের নিউট্রাল বা গ্রাউন্ড ০ ভোল্টের লাইন। এতে কপার লাইনের খরচ কিছুটা কমে আসলেও বেড়ে যায় লাইন লস। যার ফলে ২ কিলোমিটারের বেশী দূরে আর বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্ভব হয় না। ডিসি কারেন্ট আবার কমানো বাড়ানো যায় না, ফলে প্রতিটা ভোল্টেজের জন্য আলাদা লাইন লাগে।
যার ফলে একজন গ্রাহক বাতির জন্য বিদ্যুৎ নেন যে লাইন দিয়ে, সেই একই গ্রাহককে মোটরের জন্য অন্য লাইন দিয়ে বিদ্যুৎ নিতে হচ্ছিল, কারন মোটর আর বাতি চলে দুই ভোল্টেজে। এসব নানা অসুবিধা ডিসির জন্য বড় চ্যালেন্জ্ঞ হয়ে দাড়ায়।
এসি কারেন্টের মূল সুবিধা ছিল ট্রান্সফর্মার, যা ভোল্টেজের মান বাড়াতে ও কমাতে পারে। ১০০০ ভোল্টেজের বিদ্যুৎ স্টেপ ডাউন ট্রান্সফর্মার দিয়ে খুব সহজে ১০০ ভোল্ট করা যায়। আবার উল্টোটাও সত্য - ১০০ ভোল্টের বিদ্যুতকে ট্রান্সফর্মার দিয়ে ১০০০ ভোল্ট করা যায়।
এই ট্রান্সফর্মারের জন্যই ডিসি কারেন্টের সমস্যাগুলো এসি কারেন্টের ক্ষেত্রে রইল না। ট্রান্সফর্মার দিয়ে ভোল্টেজকে অনেক গুন বাড়িয়ে হাই ভোল্টেজ গ্রীড দিয়ে খাম্বা থেকে খাম্বায় পরিব হন করা হয়। অন্যদিকে গ্রাহককে বিদ্যুৎ সুবিধা দেয়া হয় আরেকটি ট্রান্সফর্মার দিয়ে, যাতে ভোল্টেজের মান কমিয়ে নিরাপদে গ্রাহকের বাড়ীতে সরবরাহ করা হয়। গ্রীড লাইনে হাই ভোল্টেজ থাকার ফলে কারেন্ট কম হয়। সাথে সাথে কমে আসে লাইন লস এবং কপারের পুরুত্ব।
এই সুবিধাগুলো ডিসি কারেন্ট দিতে পারছিল না, কারন ট্রান্সফর্মারের মূল কার্যপ্রনালীর পেছনে রয়েছে এসি। ডিসি কারেন্ট এরকম পরিবর্তনশীল চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরী করতে পারেনা, যা কিনা ট্রান্সফর্মারের মূল অপারেশন নীতি।
এডিসন এসির অগ্রযাত্রা ভালভাবে নিলেন না। তিনি দাবী করতেন, "ডিসি কারেন্টের তুলনা হচ্ছে নদী যে শান্তভাবে জলরাশিকে সাগরে ফেলে, অন্যদিকে এসির তুলনা হচ্ছে সেই ঘূর্নি যা বিপদের কিনারার দিকে ধাবিত হয়। " ১৮৮৭ সালে এডিসন নিউজার্সিতে এক জনসমাবেশে ১০০০ ভোল্টের এসি জেনারেটর থেকে প্রস্তুতকৃত বিদ্যুতে স্পর্শ লাগিয়ে বেশ কিছু প্রানীকে ইলেকট্রিফাইড করে হত্যা করেন।
যা পরবর্তিতে "ইলেট্রোকিউশন" নামে পরিচিত হয়। এতে করে এসি কারেন্টের বিপদ তুলে ধরাই ছিল উদ্দেশ্য, যা ডিসি কারেন্টের ক্ষেত্রে নেই। জন নিরাপত্তাকে কারন দেখিয়ে এডিসন চেষ্টা করলেন ৮০০ ভোল্টের বেশী বিদ্যুৎ সরবরাহের বিরুদ্ধে আইন প্রনয়নের যায় কিনা। কিন্তু ব্যর্থ হলেন। ওয়েস্টিংহাউস সবাইকে আশ্বস্ত করলেন, বিপদজনক হলেও এসি তা মোকাবেলা করতে সক্ষম বিশেষত যেখানে এসির উপকারী দিকগুলো অনেক বেশী।
যুদ্ধ এগিয়ে যেতে লাগল এবং এসি কারেন্ট এই যুদ্ধে বিজয়ের দিকে যাচ্ছে। নায়াগ্রা ফলস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হল। এডিসনের বিপরীতে দরপত্র জিতে নেন ওয়েস্টিংহাউস।
এদিকে নিউ ইয়র্ক স্টেট প্রশাসন থেকে এডিসনের কাছে জানতে চাওয়া হল, মৃত্যুদন্ডের কোন পদ্ধতি সবচাইতে উৎকৃষ্ট। এডিসন শেষ বারের মত আশার আলো দেখলেন।
তিনি স্টেটকে বললেন, মৃত্যদন্ডের সবচেয়ে কার্যকরী পন্থা হল এসি কারেন্ট, কেননা তা এত মারাত্মক যে সাথে সাথে হত্যা করে। তার উজ্জ্বল ইমেজের কারনে স্টেট এই পন্থা গ্রহন করল। ডিসি কারেন্টের প্রবক্তারাই স্টেটকে ইলেক্ট্রিক চেয়ার সরবরাহ করল মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার জন্যে। এডিসন চেয়েছিলেন এই ইলেক্ট্রিক চেয়ারের মাধ্যমে "ওয়েস্টিংহাউস" নামটি মিলিয়ে দিতে। কিন্তু বিধি বাম।
প্রথম কয়েদীকে ১৭ সেকেন্ড ইলেকট্রিক শক দেবার পরেও সে বেচে রইল। এদিকে এই ইলেক্ট্রিক চেয়ারের বীভৎসতা জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং এডিসন সমালোচিত হন।
ডিসি আর টিকতে পারল না এসির সাথে। পরাজয় চূড়ান্ত হয়ে যায় ১৯০০ সালের মধ্যে, যখন এডিসনের জেনারেল ইলেক্ট্রিক এসি কারেন্ট উৎপাদন ও সরবরাহের সিদ্ধান্ত নেয়। সমাপ্তি ঘটে দশক ব্যাপী কারেন্ট যুদ্ধের।
============================================
এডিসনের কিছু কোট:
"আমার যদি এত বেশী উচ্চাভিলাস না থাকত এবং আমি যদি জীবনে এত বেশী কাজের চেষ্টা না করতাম, তবে হয়ত আমি অনেক বেশী সুখী থাকতাম, যদিও বা তাতে আমার মূল্য কম হত। "
-- এডিসন
"প্রকৃতি কি তা আমরা জানি। ধর্মের গড কি তা আমরা জানি না। প্রকৃতি দয়ালু, অমায়িক কিংবা প্রেমময় নয়। যদি গড আমাকে সৃষ্টি করে থাকেন, যিনি দয়াবান, অমায়িক কিংবা প্রেমময়তা গুনে ভূষিত - তাহলে তিনি তো মাছও সৃষ্টি করেছেন যাকে আমি ধরে খাই।
তাহলে মাছের জন্য কোথায় তার দয়া, মায়া এবং ভালবাসা রইল? "
-- এডিসন (যে কথার জন্য তাকে নাস্তিক বলে সন্দেহ করা হত)
"আমি এজন্য গর্বিত যে আমি কখনও মারনাস্ত্র তৈরী করিনি। "
-- এডিসন
http://en.wikipedia.org/wiki/General_Electric
http://en.wikipedia.org/wiki/Thomas_Edison
Click This Link
Click This Link
http://www.ge.com/company/history/edison.html
http://en.wikipedia.org/wiki/War_of_Currents
http://www.pbs.org/tesla/ll/ll_warcur.html
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।