আমার জন্মটা অন্যদের সময়ে
পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারী-পুরুষ সম্পর্ক
সিমোন দ্য বুভ্যোয়া
ভাষান্তর শরীফ আতিক-উজ-জামান
কিন্তু যখন প্রমাণিত হবে যে, নারীরা ঐরকম মার্কামারা নয়, তখন পুরুষেরা বলতে গেলে ব্যক্তিগতভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হবে৷ তাদের একটা চিন্তা হচ্ছে নারীকে 'লাভ'-করা৷
তাহলে 'প্রেম-করা একটি শিল্প এবং প্রেমিকই শ্রেষ্ঠ শিল্পী' এই মিথটার কী হবে, যা সব ফরাসী বিশ্বাস করে, যদিও ব্যাপারটা সত্য নয়?
সমাজের কিছু পরজীবী স্তর ব্যতীত এই 'মিথ'টা কিন্তু অচল৷ ফরাসীরা এখন আমেরিকান ও ইটালিয়ান পুরুষদের মত আচরণ করছে৷ তারা শুধু 'স্কোর' করতে চায় এবং স্বল্পসংখ্যক পুরুষ যারা তাদের লিঙ্গবৈষম্যকে আয়ত্তে রাখার চেষ্টা করে তারা ব্যতীত বাকিরা যে দৃষ্টিভঙ্গি বহন করে তা হ'ল: একজন মহিলা নিজেকে যতবেশি স্বাধীন বলে দাবী করে অর্থাত্ একজন নারী তার ভবিষ্যত্ প্রসঙ্গে নিজের বা পুুরুষের জগতে বস্তুতান্ত্রিকভাবে যতবেশি সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তাকে তত সহজে বিছানায় পাওয়া যায়৷
নারী স্বাধীন হচ্ছে_এ সম্পর্কিত কথাবার্তা আমাকে বেশ ধন্দায় ফেলে দেয়৷ আমাদের সমাজে স্বাধীনতা অর্জিত হয় টাকা ও ক্ষমতার মাধ্যমে৷ প্রায় একদশক ধরে নারী আন্দোলনের ফলে এখন কি নারীরা অধিক ক্ষমতা অর্জন করেছে?
যে-অর্থে আপনি জানতে চেয়েছেন, সে-অর্থে নয়৷ বুদ্ধিমতি নারী, তরুণী, যারা প্রান্তিক হওয়ার ঝুঁকি নিতে ইচ্ছুক, ধনীর কন্যারা যারা তাদের পিতামাতার মূল্যবোধকে অগ্রাহ্য করতে চায়, এই নারীরা, হঁ্যা, এখন তারা মুক্ত৷ অর্থাত্ শিক্ষা, জীবনযাপনের ধরন, অর্থনৈতিক সম্পদের কারণে এই মহিলারা রূঢ় প্রতিযোগিতামূলক সমাজ থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে নিয়ে কমিউন বা সঙ্ঘ গড়ে প্রান্তিক এলাকায় বসবাস করতে পারে এবং তাদের সমস্যা সম্পর্কে সহমর্মী এমন মানসিকতার অন্য নারী-পুরুষের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে৷
অন্য অর্থে, স্বতন্ত্রভাবে যেসব মহিলাদের সামর্থ্য আছে, কারণটা যা-ই হোক না কেন, নিজেদেরকে তারা স্বাধীন ভাবতে পারে৷ কিন্তু নিম্ন শ্রেণীর নারীরা অবশ্যই মুক্ত নন্, কারণ এই যেমন আপনি বললেন, তাদের আর্থিক ক্ষমতা নেই৷ এখন নারী আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, ডাক্তার, বিজ্ঞাপননির্বাহী ইত্যাদির সংখ্যা বাড়ছে, যা প্রমাণ করবার জন্য হাতের কাছে সবধরনের পরিসংখ্যান মওজুদ রয়েছে৷ কিন্তু এই পরিসংখ্যান বিভ্রান্তিমূলক৷ কারণ প্রকৃত ক্ষমতাবান নারী আইনজীবী বা নির্বাহীর সংখ্যা একেবারেই শূন্য৷ ক'জন নারী আইনজীবী ফোন তুলে কোনো বিচারক বা সরকারী কর্মকর্তাকে হাত করতে বা বিশেষ সুবিধা দাবী করতে পারেন? এই মেয়েরা সবসময় প্রতিষ্ঠিত পুরুষ সমকক্ষের মাধ্যমে এসবের সমাধান করে থাকেন৷ আর নারী ডাক্তার? ক'জন শৈল্যবিদ, হাসপাতাল পরিচালক আছেন? সরকারে নারীরা? হঁ্যা, নামমাত্র আছেন কয়েকজন৷ ফ্রান্সে আছেন মোট দু'জন৷ একজন হলেন রাশভারী, কঠোর পরিশ্রমী সিমোন উইল৷ অন্যজন ফ্রাঙ্ক গিরাউড, যিনি মহিলা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন৷ তবে তিনি পুরোপুরি একটি 'শো-পিস', রাষ্ট্রকাঠামোয় বুর্জোয়া নারীদের অন্তর্ভুক্তির চাপ প্রশমিত করার জন্য তাঁকে রাখা হয়েছে৷ কিন্তু ক'জন নারী নিরাপত্তা বা জনকল্যাণ তহবিল সম্পর্কিত সিনেট কমিটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে? ক'জন নারী খবরের কাগজের সম্পাদকীয় নীতিমালা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন? ক'জন আছেন বিচারক? ক'জন নারী ব্যাঙ্ক প্রেসিডেন্ট, যাঁরা শিল্পোদ্যোগে আর্থিক ঝুঁকি নিতে পারেন? সাংবাদিকদের তথ্য মতে, মধ্যবর্তী স্তরে অনেক মহিলা পাওয়া যাবে, তার মানে এই নয় যে, তাঁদের হাতে ক্ষমতা আছে৷ এমনকি ঐসব নারীরা সাফল্যের জন্য পুরুষের মতই খেল খেলে থাকেন৷ তার মানে অবশ্য এই নয় যে, সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নারীরা এগুতে সক্ষম হয়েছে বলে আমি তা বিশ্বাস করি না৷ এই অগ্রগতি জনগণের কর্মোদ্যোগের ফসল৷ সিমোন ভেইল-প্রস্তাবিত নতুন গর্ভপাত আইন-এর কথাই ধরুন৷ জাতীয় স্বাস্থ্য কার্যক্রমে গর্ভপাত অন্তর্ভুক্ত হবে না এটা সত্য, তা সত্ত্বেও গরীবদের থেকে ধনীদের কাছে তা অধিক লভ্য হবে; এই আইন অবশ্যই বড় এক ধাপ অগ্রগতি৷ কিন্তু যে-গুরুত্ব দিয়ে সিমোন ভেইল এই আইনের পক্ষে লড়াই করেছেন তার কারণ হিসাবে তিনি উল্লেখ করতে পারেন যে, হাজার হাজার নারী এমন একটা আইনের জন্য সারা ফ্রান্স জুড়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন, হাজার হাজার নারী প্রকাশ্যে দাবী করেছেন যে, তাঁরা গর্ভপাত ঘটিয়েছেন, এভাবে সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করেছেন যে, হয় তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হোক, নয়তো বিদ্যমান আইন বদলানো হোক, বলতে পারেন শত শত ডাক্তার ও ধাত্রী এই কাজ করিয়েছেন বলে স্বীকার করে মামলার ঝুঁকির মধ্যে পড়েছেন, আর এই কারণে ইতিপূর্বে কয়েকজনের বিচার হয়েছে এবং তাঁদেরকে আদালতে লড়তে হয়েছে৷
আমি বলতে চাচ্ছি যে, জনতার কর্মকাণ্ডে নারীদের ক্ষমতা বাড়তে পারে৷ যত বেশিসংখ্যক নারী ঐ ধরনের গণ-আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠবে তত বেশি অগ্রগতি সম্ভব হবে এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যে-বেশি অর্থ যোগাতে পারে সে-ই নারীর কাছে যেতে হবে, মেয়েরা যতবেশি তাদের বোন বা বান্ধবীদের প্রভাবিত করতে সক্ষম হবে ততবেশি সচেতনতা ছড়িয়ে পড়বে, যে-সচেতনতা পর্যায়ক্রমে প্রচলিত পদ্ধতিতে হতাশ হওয়ার দরুন গণ-আন্দোলনের পথে এগোবে৷ অবশ্যই যত বেশি সচেতনতা ছড়িয়ে পড়বে তত বেশিসংখ্যক পুরুষ আগ্রাসী ও হিংস্র হয়ে উঠবে৷ তখন যত বেশি পুরুষ আগ্রাসী হয়ে উঠবে তত বেশি নারীর প্রয়োজন পড়বে অর্থাত্ আরো জোরালো গণআন্দোলনের দরকার হবে৷ পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বের বেশিরভাগ কর্মী আজ শ্রেণী-সংগ্রামের বিষয়ে অবগত, তা তাঁরা নিজেদেরকে মার্কসবাদী মনে করুন চাই না করুন৷ এমনকি তাঁরা মার্কসের নাম শুনেছেন কিনা সে-বিষয়েও সন্দেহ থাকবে৷ তবে এই সংগ্রামকে শ্রেণী-সংগ্রামের ভেতরেই হতে হবে এবং তাই হবে৷
গতবছর আপনি আমাকে বলেছিলেন যে, ঞযব The Second Sex এর ধারাবাহিকতায় আপনি আর একটা বই লেখার কথা ভাবছেন৷ লিখছেন কি?
না৷ প্রথমতঃ ঐ-ধরনের একটি কাজে সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার৷ তারপর এটাকে তত্ত্বের চেয়ে অনুশীলনের ভেতরেই বেশি করে প্রোথিত করতে হবে৷ The Second Sex এর ক্ষেত্রে উল্টোটা ঘটেছে৷ এখন তা করা আর আদৌ যৌক্তিক নয়৷ প্রায়োগিক ক্ষেত্রে এসে একজন দেখতে পাচ্ছে যে, কিভাবে লৈঙ্গিক আন্দোলন ও শ্রেণী-সংগ্রাম একে অপরের সাথে জড়িত বা নিদেনপক্ষে কিভাবে একটার সাথে অপরটাকে গ্রন্থিত করা যায়৷ কিন্তু এখন সব আন্দোলন সম্পর্কেই কথা এটা সত্য যে, অনুশীলনের মধ্য দিয়েই আমরা তত্ত্বের উদ্ভব ঘটাতে সক্ষম হব, অন্যভাবে নয়৷ আসলে যা প্রয়োজন তা হ'ল, সবদেশের নারী-সংগঠনগুলো থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা এক জায়গায় জড়ো করা এবং তা থেকেই জানতে হবে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় নারীরা কোন্ কোন্ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে৷ আরো যা দরকার তা হ'ল সমস্ত শ্রেণী থেকে এইসব তথ্য সংগ্রহ করতে হবে, যেটা খুবই কঠিন কাজ৷ সবের্াপরি আজকের দিনে যেসব মেয়েরা মুক্তি-আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে তারা সবাই বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী৷ মোট কথা, শ্রমিকদের স্ত্রীরা এবং নারী শ্রমিকরা দৃঢ়ভাবে মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের প্রতি অনুরক্ত৷ যেমন, নারী শ্রমিকদের কাছে গণিকাদের অধিকার ও তাদের প্রাপ্য সম্মান নিয়ে কথা বলে দেখুন, ধারণাটি তাদের জন্য মর্মপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়াবে৷ নারী শ্রমিকদের সচেতনতা বাড়ানো একটি ধীর প্রক্রিয়া, যার জন্য প্রচুর কৌশল প্রয়োজন৷ আমি জানি অনেক গখঋ চরমপন্থী পুরুষ নির্যাতনকারী চিহ্নিত করে শ্রমিকদের স্ত্রীদেরকে তাদের স্বামীদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে৷ আমি মনে করি কাজটা ভুল; কারণ জিজ্ঞাসা করলেই একজন শ্রমিকের স্ত্রী, নিদেনপক্ষে এই ফ্রান্সে, ঝটপট উত্তর দেবে, 'আমার স্বামী আমার শত্রু নয়, সে আমার নিয়ন্ত্রক৷' এমনকি সারাদিন তাকে কোনো কারখানায় শ্রম-দেওয়ার পরও তাকে তার স্বামীর মোজা ধুয়ে পরিষ্কার করতে হয়, তার জন্য সু্যপ তৈরী করতে হয়৷ ব্যাপারটা আমেরিকাতেও একইরকমের, যেখানে নিগ্রো মহিলারা নারী স্বাধীনতার দীক্ষাদানকারীদের কথা শুনতে অসম্মতি জানিয়েছিল, কারণ দীক্ষাদানকারীরা সবাই ছিল শ্বেতাঙ্গ৷ এইসব নিগ্রো মহিলারা শোষণ-নির্যাতন সত্ত্বেও তাদের স্বামীর প্রতি পরিপূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছে, শুধুমাত্র এই কারণে যে, যারা তাদের এই শোষণ সম্পর্কে সচেতন করার চেষ্টা করছে তারা সবাই শ্বেতাঙ্গ৷
শ্রেণী-সংগ্রাম কিছু সুনির্দিষ্ট পথে লৈঙ্গিক-সংগ্রামকে উত্সাহিত করতে পারে এবং করেও থাকে; আর সাথে সাথে লৈঙ্গিক সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যায়৷ যেমন, গত কয়েক বছর ধরে ফ্রান্সের বিভিন্ন উত্পাদন প্রতিষ্ঠানে প্রচুর ধর্মঘট হয়েছে, যেখানে কর্মীরা প্রায় সবাই নারী৷ যদি আমরা উত্তরের টয়েজ, কিংবা থিয়োনভিলের নুভেলা গ্যালারীর বস্ত্র-কারখানার ধর্মঘট কিংবা লিপের সেই বহুল-আলোচিত ধর্মঘটের কথা চিন্তা করি তাহলে দেখবো যে, প্রত্যেক ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকরা শুধুমাত্র যে নতুন এক সচেতনতা লাভ করেছে তাই নয়, নিজেদের ক্ষমতা সম্পর্কে এক নতুনতর ও জোরালো বিশ্বাস জন্মাতে পেরেছে এবং বাড়িতে যে পুরুষতন্ত্রের মুখোমুখি তারা হয়েছে এই সত্য তাদেরকে চিন্তিত করেছে৷ যেমন, লিপে নারীরা কারখানা দখল করে নিয়েছিল এবং বল-প্রয়োগের মাধ্যমে তাদেরকে বের করে দেওয়ার পুলিশি হুমকির মুখেও তারা স্থান ত্যাগ করতে অসম্মতি জানিয়েছে৷ প্রথম প্রথম পুরুষ শ্রমিকরা তাদের জঙ্গি স্ত্রীদের কারণে গর্ববোধ করছিল৷ তারা স্ত্রীদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছিল, খুঁটি পুতে সীমানা ঠিক করতে সাহায্য করেছিল, কিন্তু গোল বাধলো তখন যখন মহিলারা লিপে-কর্মরত কতিপয় পুরুষ সহকর্মীর সমকক্ষতা দাবী করলো; ঐ কর্মকর্তারাও ধর্মঘটে ছিল৷ ধর্মঘটীরা পুলিশি আক্রমণের ভয়ে পালাক্রমে কারখানা পাহারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো, যার মানে রাতে দায়িত্ব-পালন৷ ওহ্! হঠাত্ করেই ধর্মঘটী মহিলাদের স্বামীরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো, বললো, 'তুমি ধর্মঘট, পিকেটিং যা খুশী করো, তবে তা শুধুমাত্র দিনের বেলায়, রাতে নয়৷ নৈশ-প্রহরীর দায়িত্ব? কখনোই না৷ বড় ঘরে সবার সাথে ঢালাও বিছানায় একত্রে শোওয়া ? কখনোই না৷' স্বভাবতই নারী শ্রমিকরা বাধা দিল৷ তারা সাম্যের জন্য লড়াই করছিল, তারা তাই ছাড় দিতে রাজি হ'ল না৷ এখন সংগ্রামটা হয়ে দাঁড়াল দ্বিমুখী : একদিকে লিপ কতর্ৃপক্ষ, পুলিশ, সরকার প্রমুখের বিরুদ্ধে শ্রেণী-সংগ্রাম; অন্যদিকে স্বামীদের বিরুদ্ধে লৈঙ্গিক আন্দোলন৷ লিপের ইউনিয়ন সংগঠকরা অভিযোগ করেছিল যে, ধর্মঘটের পরে মহিলা শ্রমিকরা একেবারে পাল্টে গেছে, তারা বলতে শুরু করেছে, 'অনেক শিক্ষা হ'ল, বাড়িতে আর কখনো মিনসেকে খবরদারি করতে দিচ্ছি না, আমি এখন সব ধরনের খবরদারির বিরুদ্ধে৷'
বৃদ্ধবয়স সম্পর্কে আপনার সচেতনতা পাল্টে গিয়েছিল কি? এ ব্যাপারে আপনি লিখেছেন যে, The Second Sex লেখার সময় নারী-হওয়া সম্পর্কিত আপনার সচেতনতা পাল্টে গিয়েছিল৷
না, তা নয়৷ আমি অনেক কিছু আবিষ্কার করেছিলাম৷ আমি বৃদ্ধ মানুষদের সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছি, কিন্তু আমি কোন নতুন সচেতনতা লাভ করি নি, কারণ প্রথমতঃ আমি বৃদ্ধ_এই উপলব্ধি থেকেই আমি বইটা লিখতে উদ্যোগী হয়েছিলাম৷ এখন আমি আগের থেকে আরো ভালোভাবে বৃদ্ধদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারি৷ আগে আমি অধিক মাত্রায় কঠোর ছিলাম৷ এখন বুঝতে পারি কখন একজন প্রবীণ মানুষ অধিক সংবেদনশীল বা অধিক স্বার্থপর হয়, কেন তিনি নিজের চারপাশে প্রতিরক্ষাবূ্যহ রচনা করে শুধু গা বাঁচিয়ে চলেন৷ কিন্তু আপনি দেখুন, একজন মহিলা মূল্যবোধ, অভিজ্ঞতা ও জীবনবোধে তিনি মৌলিকভাবে পুরুষদের থেকে আলাদা এই সত্যের মুখোমুখি হতে অস্বীকৃতি জানিয়ে জীবন কাটাতে পারেন, কিন্তু এই সচেতনতাটা এড়ানো কঠিন যে, তিনি বুড়ো হচ্ছেন৷ একটা সময় আসে যখন আপনি জানতে পারেন যে, আপনি সীমারেখা স্পর্শ বা অতিক্রম করছেন৷ এখন যেমন আমি জানি যে, পায়ে হেঁটে আর কখনো পাহাড়ে যেতে পারবো না, বাইসাইকেল চালাতে পারবো না, কোন পুরুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবো না৷ বৃদ্ধ হওয়ার আগেই আমি বৃদ্ধ বয়স সম্পর্কে আতঙ্কিত ও উত্কণ্ঠিত ছিলাম৷ এরপর যখন সময় এলো, যখন জানলাম আমি সেই সীমারেখা অতিক্রম করেছি, তখন যা আশা করেছিলাম তার থেকে সহজেই ব্যাপারটা ঘটলো৷ অবশ্যই আপনাকে পিছনে তাকানো বন্ধ করতে হবে৷ আমি দেখলাম বেশিবয়স হলে বেঁচে থাকাটা যা ভেবেছিলাম তার থেকে সহজ৷ কিন্তু আমি জেনেছিলাম যে, বৃদ্ধবয়স সম্পর্কিত আমার বইয়ের গবেষণার ঐ সীমারেখা আমি স্বাধীনভাবে অতিক্রম করেছি৷ বইয়ের কাজ করতে গিয়ে আমি শিখেছি কিভাবে বৃদ্ধদের বুঝতে হয়, বেশি সহিষ্ণু হতে হয়৷
এখন কী নিয়ে কাজ করছেন?
বলতে গেলে কিছুই না৷ বৃদ্ধবয়স সম্পর্কিত একজন সুইডিশ চিত্রপরিচালককে একটি চলচ্চিত্রের ব্যাপারে সাহায্য করছি৷ সার্ত্র'কে তার টেলিভিশন প্রকল্পের ব্যাপারে সহযোগিতা করছি৷ জানেন নিশ্চয় যে, এই শতাব্দীর ৭৫ বছর ও এর প্রধান ঘটনাপ্রবাহের সাথে নিজের সম্পর্ক নিয়ে সার্ত্র জাতীয় টেলিভিশনের সাথে এক ঘণ্টা করে দশটি অনুষ্ঠানের এক চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন, যা এই অক্টোবর থেকে শুরু হতে যাচ্ছে৷ বিশেষ কোন প্রকল্প হাতে নেওয়ার ইচ্ছা আমার আপাতত নেই৷ এটা আমার জন্য বেশ নতুন ব্যাপার, কারণ নির্দিষ্ট কোন বই নিয়ে কাজ করার সময়ও আমার মাথায় অনেক প্রকল্পের ঝামেলা থাকতো৷
আপনি লিখেছেন যে, আপনার একটি সন্তোষজনক জীবন ছিল এবং কোন ব্যাপারে আপনার কোন আফসোস নেই৷ আপনি কি জানেন অনেক দম্পতি সার্ত্রের সাথে আপনার জীবনকে মডেল হিসাবে বিশেষ দৃষ্টিতে দেখে, বিশেষ করে এই অর্থে যে, একে অপরের প্রতি আপনারা আদৌ ঈর্ষাকাতর নন্, আপনাদের মাঝে একধরনের, যাকে বলে খোলামেলা সম্পর্ক বিদ্যমান এবং এটা ৪৫ বছর ধরে চলছে৷
কিন্তু আমাদের মডেল হিসাবে গণ্য করাটা হাস্যকর৷ মানুষকে তার নিজস্ব প্রাণাবেগ, নিজস্ব পরিকাঠামোর অনুসন্ধান করতে হবে৷ সার্ত্র এবং আমি সৌভাগ্যবান, কিন্তু আমাদের অতীত খুব বিশিষ্ট, খুবই ব্যতিক্রমধর্মী৷ যখন আমাদের প্রথম দেখা হয় আমরা অত্যন্ত অল্পবয়সী ছিলাম৷ তার ২৩ আর আমার ২০৷ তখন আমাদের বিকাশ ঘটে নি, যদিও আমরা একই ধরনের প্রণোদনা নিয়ে বুদ্ধিজীবী হয়ে উঠেছি৷ আমাদের উভয়ের ক্ষেত্রে সাহিত্য ধর্মের জায়গা পূরণ করে৷
যদিও আপনারা প্রতিদ্বন্দ্বী, প্রতিপক্ষ হতে পারতেন...
হ্যা, এটা সত্য যে, একই রকমের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণকারী সমপর্যায়ের ব্যক্তিত্ব প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন৷ কিন্তু আমাদের মাঝে কিছু বিষয় ছিল একই রকমের : আমরা তরুণ বয়সে একইভাবে গড়ে উঠেছি৷ আমাদের উভয়ের শৈশবই ছিল খুব মজবুত, নিরুদ্বেগ৷ তার মানে আমাদের নিজেদের বা অন্যের কাছে কোন কিছুই প্রমাণ করতে হয় নি৷ আমরা আমাদের সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিন্ত ছিলাম৷ শুরু থেকেই সবকিছু যেন পূর্ব-নির্ধারিত ছিল৷ আমার মা-বাবা এমন আচরণ করতেন যেন এই পৃথিবীর কোনকিছুই আমার স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহকে পাল্টে দিতে না-পারে৷ একজন ভাবী বুজের্ায়া বুদ্ধিজীবী আমি৷ সার্ত্রের পিতামহ, যিনি তাঁকে মানুষ করেছেন_আপনাদের জানা আছে নিশ্চয় যে, তাঁর বাবা যখন মারা যান তখন তিনি শিশু_তিনিও একই রকমের আচরণ করতেন৷ তার পূর্ণ আস্থা ছিল যে, বড় হয়ে সার্ত্র অধ্যাপক হবেন৷ ব্যাপারগুলো এইরকমেরই ছিল৷ এমনকি যখন সমস্যা এলো, যেমন, সার্ত্রের ১২-১৩ বছর বয়সের সময় তার মা আবার বিয়ে করলেন, আমার বয়স যখন ১৪-১৫ তখন জানলাম, যেমনটা আমি আশা করতাম আমার বাবা আমাকে তেমন ভাবে ভালোবাসেন না৷ কিন্তু শৈশবের দৃঢ়তা আমাদেরকে এইসব সংকট মোকাবেলায় সাহায্য করেছে৷ তাঁরা পাল্টে গেছেন, আমরা যাই নি৷ আমরা এমনভাবে গড়ে উঠেছি যে, কখনো নিজেদের নিরাপত্তাহীন মনে করি নি৷ এছাড়াও ছোটখাট পার্থক্য বাদ দিলে, মা-বাবারা যেভাবে আমাদেরকে মানুষ করতে চেয়েছেন আমরাও তা মেনে চলেছি৷ তাঁরা চেয়েছেন আমরা বুদ্ধিজীবী হই, পড়ি, পড়াই এবং আমরাও তা মেনে নিয়েছি, তা-ই করেছি৷ এইভাবে যখন সার্ত্র এবং আমার দেখা হ'ল তখন যে শুধুমাত্র আমাদের অতীত যে মিললো তাই নয়, আমাদের দৃঢ়তা, আমাদের যেভাবে মানুষ হওয়ার কথা ছিল সেভাবেই হয়েছি_এমন স্বতন্ত্র ধ্যানধারণাও সেইসাথে যুক্ত হ'ল৷ এই ধরনের কাঠামোতে আমরা একে অপরের প্রতিপক্ষ হতে পারি নি৷ সার্ত্র ও আমার মাঝে যখন সম্পর্ক গড়ে উঠছিল তখন আমার এই ধারণা জন্মালো যে, তার জীবনে আমার যেমন কোন বিকল্প হতে পারে না, আমার জীবনেও তার কোন বিকল্প নেই৷ অন্য অর্থে আমরা পুরোপুরি নিশ্চিন্ত ছিলাম যে, আমাদের সম্পর্ক খুব দৃঢ় ও পূর্ব-নির্ধারিত, যদিও এই শব্দটা নিয়ে আমরা তখন খুবই হাসাহাসি করতাম৷ যখন ঐ ধরনের নিরাপত্তা থাকে তখন ঈর্ষাকাতর হওয়াটা খুব সহজ নয়৷ কিন্তু সার্ত্রের জীবনে আমি যে-ভূমিকা রেখেছি তা যদি অন্যকোন নারী রাখতো তাহলে অবশ্যই আমি ঈর্ষাকাতর হতাম৷
বাকি জীবনকে কিভাবে দেখেন?
আদৌ দেখতে পাই না৷ ধারণা করি শীঘ্রই কিছু একটা লিখতে শুরু করবো, অর্থাত্ কাজে ফিরে যাবো, কিন্তু জানি না কী করবো৷ শুধু জানি যে, নারীদের সাথে, নারীবাদী গোষ্ঠী, নারী সংগঠনের মাঝে কাজ চালিয়ে যাব এবং যে-কোনভাবেই হোক প্রতিবাদ করে যাব, যেভাবেই পারি বৈপ্লবিক আন্দোলনের ভেতর দিয়ে_একে ওই নামেই ডাকবো৷ আর আমি জানি যে, আমি সার্ত্রের সাথেই থাকবো যতক্ষণ না পর্যন্ত আমাদের কেউ একজন মারা যাচ্ছে৷ জানেন তো যে, এখন তার বয়স ৭০ আর আমার ৬৭৷
আপনি কি আশাবাদী? আপনি কি মনে করেন যে, যে-পরিবর্তনের জন্য সংগ্রাম করছেন তা একদিন ঘটবে?
জানি না৷ হয়তো আমার জীবদ্দশায় ঘটবে না৷ কিংবা চার প্রজন্মও লেগে যেতে পারে৷ আমি বিপ্লব সম্পর্কে কিছু জানি না৷ কিন্তু যে-পরিবর্তনের জন্য মেয়েরা সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, হঁ্যা আমি নিশ্চিত, শেষমেষ তাতে মেয়েরাই বিজয়ী হবে৷
কিন্তু যখন প্রমাণিত হবে যে, নারীরা ঐরকম মার্কামারা নয়, তখন পুরুষেরা বলতে গেলে ব্যক্তিগতভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হবে৷ তাদের একটা চিন্তা হচ্ছে নারীকে 'লাভ'-করা৷
তাহলে 'প্রেম-করা একটি শিল্প এবং প্রেমিকই শ্রেষ্ঠ শিল্পী' এই মিথটার কী হবে, যা সব ফরাসী বিশ্বাস করে, যদিও ব্যাপারটা সত্য নয়?
সমাজের কিছু পরজীবী স্তর ব্যতীত এই 'মিথ'টা কিন্তু অচল৷ ফরাসীরা এখন আমেরিকান ও ইটালিয়ান পুরুষদের মত আচরণ করছে৷ তারা শুধু 'স্কোর' করতে চায় এবং স্বল্পসংখ্যক পুরুষ যারা তাদের লিঙ্গবৈষম্যকে আয়ত্তে রাখার চেষ্টা করে তারা ব্যতীত বাকিরা যে দৃষ্টিভঙ্গি বহন করে তা হ'ল: একজন মহিলা নিজেকে যতবেশি স্বাধীন বলে দাবী করে অর্থাত্ একজন নারী তার ভবিষ্যত্ প্রসঙ্গে নিজের বা পুুরুষের জগতে বস্তুতান্ত্রিকভাবে যতবেশি সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তাকে তত সহজে বিছানায় পাওয়া যায়৷
নারী স্বাধীন হচ্ছে_এ সম্পর্কিত কথাবার্তা আমাকে বেশ ধন্দায় ফেলে দেয়৷ আমাদের সমাজে স্বাধীনতা অর্জিত হয় টাকা ও ক্ষমতার মাধ্যমে৷ প্রায় একদশক ধরে নারী আন্দোলনের ফলে এখন কি নারীরা অধিক ক্ষমতা অর্জন করেছে?
যে-অর্থে আপনি জানতে চেয়েছেন, সে-অর্থে নয়৷ বুদ্ধিমতি নারী, তরুণী, যারা প্রান্তিক হওয়ার ঝুঁকি নিতে ইচ্ছুক, ধনীর কন্যারা যারা তাদের পিতামাতার মূল্যবোধকে অগ্রাহ্য করতে চায়, এই নারীরা, হঁ্যা, এখন তারা মুক্ত৷ অর্থাত্ শিক্ষা, জীবনযাপনের ধরন, অর্থনৈতিক সম্পদের কারণে এই মহিলারা রূঢ় প্রতিযোগিতামূলক সমাজ থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে নিয়ে কমিউন বা সঙ্ঘ গড়ে প্রান্তিক এলাকায় বসবাস করতে পারে এবং তাদের সমস্যা সম্পর্কে সহমর্মী এমন মানসিকতার অন্য নারী-পুরুষের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে৷
অন্য অর্থে, স্বতন্ত্রভাবে যেসব মহিলাদের সামর্থ্য আছে, কারণটা যা-ই হোক না কেন, নিজেদেরকে তারা স্বাধীন ভাবতে পারে৷ কিন্তু নিম্ন শ্রেণীর নারীরা অবশ্যই মুক্ত নন্, কারণ এই যেমন আপনি বললেন, তাদের আর্থিক ক্ষমতা নেই৷ এখন নারী আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, ডাক্তার, বিজ্ঞাপননির্বাহী ইত্যাদির সংখ্যা বাড়ছে, যা প্রমাণ করবার জন্য হাতের কাছে সবধরনের পরিসংখ্যান মওজুদ রয়েছে৷ কিন্তু এই পরিসংখ্যান বিভ্রান্তিমূলক৷ কারণ প্রকৃত ক্ষমতাবান নারী আইনজীবী বা নির্বাহীর সংখ্যা একেবারেই শূন্য৷ ক'জন নারী আইনজীবী ফোন তুলে কোনো বিচারক বা সরকারী কর্মকর্তাকে হাত করতে বা বিশেষ সুবিধা দাবী করতে পারেন? এই মেয়েরা সবসময় প্রতিষ্ঠিত পুরুষ সমকক্ষের মাধ্যমে এসবের সমাধান করে থাকেন৷ আর নারী ডাক্তার? ক'জন শৈল্যবিদ, হাসপাতাল পরিচালক আছেন? সরকারে নারীরা? হঁ্যা, নামমাত্র আছেন কয়েকজন৷ ফ্রান্সে আছেন মোট দু'জন৷ একজন হলেন রাশভারী, কঠোর পরিশ্রমী সিমোন উইল৷ অন্যজন ফ্রাঙ্ক গিরাউড, যিনি মহিলা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন৷ তবে তিনি পুরোপুরি একটি 'শো-পিস', রাষ্ট্রকাঠামোয় বুর্জোয়া নারীদের অন্তর্ভুক্তির চাপ প্রশমিত করার জন্য তাঁকে রাখা হয়েছে৷ কিন্তু ক'জন নারী নিরাপত্তা বা জনকল্যাণ তহবিল সম্পর্কিত সিনেট কমিটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে? ক'জন নারী খবরের কাগজের সম্পাদকীয় নীতিমালা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন? ক'জন আছেন বিচারক? ক'জন নারী ব্যাঙ্ক প্রেসিডেন্ট, যাঁরা শিল্পোদ্যোগে আর্থিক ঝুঁকি নিতে পারেন? সাংবাদিকদের তথ্য মতে, মধ্যবর্তী স্তরে অনেক মহিলা পাওয়া যাবে, তার মানে এই নয় যে, তাঁদের হাতে ক্ষমতা আছে৷ এমনকি ঐসব নারীরা সাফল্যের জন্য পুরুষের মতই খেল খেলে থাকেন৷ তার মানে অবশ্য এই নয় যে, সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নারীরা এগুতে সক্ষম হয়েছে বলে আমি তা বিশ্বাস করি না৷ এই অগ্রগতি জনগণের কর্মোদ্যোগের ফসল৷ সিমোন ভেইল-প্রস্তাবিত নতুন গর্ভপাত আইন-এর কথাই ধরুন৷ জাতীয় স্বাস্থ্য কার্যক্রমে গর্ভপাত অন্তর্ভুক্ত হবে না এটা সত্য, তা সত্ত্বেও গরীবদের থেকে ধনীদের কাছে তা অধিক লভ্য হবে; এই আইন অবশ্যই বড় এক ধাপ অগ্রগতি৷ কিন্তু যে-গুরুত্ব দিয়ে সিমোন ভেইল এই আইনের পক্ষে লড়াই করেছেন তার কারণ হিসাবে তিনি উল্লেখ করতে পারেন যে, হাজার হাজার নারী এমন একটা আইনের জন্য সারা ফ্রান্স জুড়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন, হাজার হাজার নারী প্রকাশ্যে দাবী করেছেন যে, তাঁরা গর্ভপাত ঘটিয়েছেন, এভাবে সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করেছেন যে, হয় তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করা হোক, নয়তো বিদ্যমান আইন বদলানো হোক, বলতে পারেন শত শত ডাক্তার ও ধাত্রী এই কাজ করিয়েছেন বলে স্বীকার করে মামলার ঝুঁকির মধ্যে পড়েছেন, আর এই কারণে ইতিপূর্বে কয়েকজনের বিচার হয়েছে এবং তাঁদেরকে আদালতে লড়তে হয়েছে৷
আমি বলতে চাচ্ছি যে, জনতার কর্মকাণ্ডে নারীদের ক্ষমতা বাড়তে পারে৷ যত বেশিসংখ্যক নারী ঐ ধরনের গণ-আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠবে তত বেশি অগ্রগতি সম্ভব হবে এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যে-বেশি অর্থ যোগাতে পারে সে-ই নারীর কাছে যেতে হবে, মেয়েরা যতবেশি তাদের বোন বা বান্ধবীদের প্রভাবিত করতে সক্ষম হবে ততবেশি সচেতনতা ছড়িয়ে পড়বে, যে-সচেতনতা পর্যায়ক্রমে প্রচলিত পদ্ধতিতে হতাশ হওয়ার দরুন গণ-আন্দোলনের পথে এগোবে৷ অবশ্যই যত বেশি সচেতনতা ছড়িয়ে পড়বে তত বেশিসংখ্যক পুরুষ আগ্রাসী ও হিংস্র হয়ে উঠবে৷ তখন যত বেশি পুরুষ আগ্রাসী হয়ে উঠবে তত বেশি নারীর প্রয়োজন পড়বে অর্থাত্ আরো জোরালো গণআন্দোলনের দরকার হবে৷ পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বের বেশিরভাগ কর্মী আজ শ্রেণী-সংগ্রামের বিষয়ে অবগত, তা তাঁরা নিজেদেরকে মার্কসবাদী মনে করুন চাই না করুন৷ এমনকি তাঁরা মার্কসের নাম শুনেছেন কিনা সে-বিষয়েও সন্দেহ থাকবে৷ তবে এই সংগ্রামকে শ্রেণী-সংগ্রামের ভেতরেই হতে হবে এবং তাই হবে৷
গতবছর আপনি আমাকে বলেছিলেন যে, ঞযব The Second Sex এর ধারাবাহিকতায় আপনি আর একটা বই লেখার কথা ভাবছেন৷ লিখছেন কি?
না৷ প্রথমতঃ ঐ-ধরনের একটি কাজে সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার৷ তারপর এটাকে তত্ত্বের চেয়ে অনুশীলনের ভেতরেই বেশি করে প্রোথিত করতে হবে৷ The Second Sex এর ক্ষেত্রে উল্টোটা ঘটেছে৷ এখন তা করা আর আদৌ যৌক্তিক নয়৷ প্রায়োগিক ক্ষেত্রে এসে একজন দেখতে পাচ্ছে যে, কিভাবে লৈঙ্গিক আন্দোলন ও শ্রেণী-সংগ্রাম একে অপরের সাথে জড়িত বা নিদেনপক্ষে কিভাবে একটার সাথে অপরটাকে গ্রন্থিত করা যায়৷ কিন্তু এখন সব আন্দোলন সম্পর্কেই কথা এটা সত্য যে, অনুশীলনের মধ্য দিয়েই আমরা তত্ত্বের উদ্ভব ঘটাতে সক্ষম হব, অন্যভাবে নয়৷ আসলে যা প্রয়োজন তা হ'ল, সবদেশের নারী-সংগঠনগুলো থেকে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা এক জায়গায় জড়ো করা এবং তা থেকেই জানতে হবে বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় নারীরা কোন্ কোন্ ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে৷ আরো যা দরকার তা হ'ল সমস্ত শ্রেণী থেকে এইসব তথ্য সংগ্রহ করতে হবে, যেটা খুবই কঠিন কাজ৷ সবের্াপরি আজকের দিনে যেসব মেয়েরা মুক্তি-আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে তারা সবাই বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী৷ মোট কথা, শ্রমিকদের স্ত্রীরা এবং নারী শ্রমিকরা দৃঢ়ভাবে মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের প্রতি অনুরক্ত৷ যেমন, নারী শ্রমিকদের কাছে গণিকাদের অধিকার ও তাদের প্রাপ্য সম্মান নিয়ে কথা বলে দেখুন, ধারণাটি তাদের জন্য মর্মপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়াবে৷ নারী শ্রমিকদের সচেতনতা বাড়ানো একটি ধীর প্রক্রিয়া, যার জন্য প্রচুর কৌশল প্রয়োজন৷ আমি জানি অনেক গখঋ চরমপন্থী পুরুষ নির্যাতনকারী চিহ্নিত করে শ্রমিকদের স্ত্রীদেরকে তাদের স্বামীদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে৷ আমি মনে করি কাজটা ভুল; কারণ জিজ্ঞাসা করলেই একজন শ্রমিকের স্ত্রী, নিদেনপক্ষে এই ফ্রান্সে, ঝটপট উত্তর দেবে, 'আমার স্বামী আমার শত্রু নয়, সে আমার নিয়ন্ত্রক৷' এমনকি সারাদিন তাকে কোনো কারখানায় শ্রম-দেওয়ার পরও তাকে তার স্বামীর মোজা ধুয়ে পরিষ্কার করতে হয়, তার জন্য সু্যপ তৈরী করতে হয়৷ ব্যাপারটা আমেরিকাতেও একইরকমের, যেখানে নিগ্রো মহিলারা নারী স্বাধীনতার দীক্ষাদানকারীদের কথা শুনতে অসম্মতি জানিয়েছিল, কারণ দীক্ষাদানকারীরা সবাই ছিল শ্বেতাঙ্গ৷ এইসব নিগ্রো মহিলারা শোষণ-নির্যাতন সত্ত্বেও তাদের স্বামীর প্রতি পরিপূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছে, শুধুমাত্র এই কারণে যে, যারা তাদের এই শোষণ সম্পর্কে সচেতন করার চেষ্টা করছে তারা সবাই শ্বেতাঙ্গ৷
শ্রেণী-সংগ্রাম কিছু সুনির্দিষ্ট পথে লৈঙ্গিক-সংগ্রামকে উত্সাহিত করতে পারে এবং করেও থাকে; আর সাথে সাথে লৈঙ্গিক সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যায়৷ যেমন, গত কয়েক বছর ধরে ফ্রান্সের বিভিন্ন উত্পাদন প্রতিষ্ঠানে প্রচুর ধর্মঘট হয়েছে, যেখানে কর্মীরা প্রায় সবাই নারী৷ যদি আমরা উত্তরের টয়েজ, কিংবা থিয়োনভিলের নুভেলা গ্যালারীর বস্ত্র-কারখানার ধর্মঘট কিংবা লিপের সেই বহুল-আলোচিত ধর্মঘটের কথা চিন্তা করি তাহলে দেখবো যে, প্রত্যেক ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকরা শুধুমাত্র যে নতুন এক সচেতনতা লাভ করেছে তাই নয়, নিজেদের ক্ষমতা সম্পর্কে এক নতুনতর ও জোরালো বিশ্বাস জন্মাতে পেরেছে এবং বাড়িতে যে পুরুষতন্ত্রের মুখোমুখি তারা হয়েছে এই সত্য তাদেরকে চিন্তিত করেছে৷ যেমন, লিপে নারীরা কারখানা দখল করে নিয়েছিল এবং বল-প্রয়োগের মাধ্যমে তাদেরকে বের করে দেওয়ার পুলিশি হুমকির মুখেও তারা স্থান ত্যাগ করতে অসম্মতি জানিয়েছে৷ প্রথম প্রথম পুরুষ শ্রমিকরা তাদের জঙ্গি স্ত্রীদের কারণে গর্ববোধ করছিল৷ তারা স্ত্রীদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছিল, খুঁটি পুতে সীমানা ঠিক করতে সাহায্য করেছিল, কিন্তু গোল বাধলো তখন যখন মহিলারা লিপে-কর্মরত কতিপয় পুরুষ সহকর্মীর সমকক্ষতা দাবী করলো; ঐ কর্মকর্তারাও ধর্মঘটে ছিল৷ ধর্মঘটীরা পুলিশি আক্রমণের ভয়ে পালাক্রমে কারখানা পাহারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো, যার মানে রাতে দায়িত্ব-পালন৷ ওহ্! হঠাত্ করেই ধর্মঘটী মহিলাদের স্বামীরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো, বললো, 'তুমি ধর্মঘট, পিকেটিং যা খুশী করো, তবে তা শুধুমাত্র দিনের বেলায়, রাতে নয়৷ নৈশ-প্রহরীর দায়িত্ব? কখনোই না৷ বড় ঘরে সবার সাথে ঢালাও বিছানায় একত্রে শোওয়া ? কখনোই না৷' স্বভাবতই নারী শ্রমিকরা বাধা দিল৷ তারা সাম্যের জন্য লড়াই করছিল, তারা তাই ছাড় দিতে রাজি হ'ল না৷ এখন সংগ্রামটা হয়ে দাঁড়াল দ্বিমুখী : একদিকে লিপ কতর্ৃপক্ষ, পুলিশ, সরকার প্রমুখের বিরুদ্ধে শ্রেণী-সংগ্রাম; অন্যদিকে স্বামীদের বিরুদ্ধে লৈঙ্গিক আন্দোলন৷ লিপের ইউনিয়ন সংগঠকরা অভিযোগ করেছিল যে, ধর্মঘটের পরে মহিলা শ্রমিকরা একেবারে পাল্টে গেছে, তারা বলতে শুরু করেছে, 'অনেক শিক্ষা হ'ল, বাড়িতে আর কখনো মিনসেকে খবরদারি করতে দিচ্ছি না, আমি এখন সব ধরনের খবরদারির বিরুদ্ধে৷'
বৃদ্ধবয়স সম্পর্কে আপনার সচেতনতা পাল্টে গিয়েছিল কি? এ ব্যাপারে আপনি লিখেছেন যে, The Second Sex লেখার সময় নারী-হওয়া সম্পর্কিত আপনার সচেতনতা পাল্টে গিয়েছিল৷
না, তা নয়৷ আমি অনেক কিছু আবিষ্কার করেছিলাম৷ আমি বৃদ্ধ মানুষদের সম্পর্কে অনেক কিছু জেনেছি, কিন্তু আমি কোন নতুন সচেতনতা লাভ করি নি, কারণ প্রথমতঃ আমি বৃদ্ধ_এই উপলব্ধি থেকেই আমি বইটা লিখতে উদ্যোগী হয়েছিলাম৷ এখন আমি আগের থেকে আরো ভালোভাবে বৃদ্ধদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারি৷ আগে আমি অধিক মাত্রায় কঠোর ছিলাম৷ এখন বুঝতে পারি কখন একজন প্রবীণ মানুষ অধিক সংবেদনশীল বা অধিক স্বার্থপর হয়, কেন তিনি নিজের চারপাশে প্রতিরক্ষাবূ্যহ রচনা করে শুধু গা বাঁচিয়ে চলেন৷ কিন্তু আপনি দেখুন, একজন মহিলা মূল্যবোধ, অভিজ্ঞতা ও জীবনবোধে তিনি মৌলিকভাবে পুরুষদের থেকে আলাদা এই সত্যের মুখোমুখি হতে অস্বীকৃতি জানিয়ে জীবন কাটাতে পারেন, কিন্তু এই সচেতনতাটা এড়ানো কঠিন যে, তিনি বুড়ো হচ্ছেন৷ একটা সময় আসে যখন আপনি জানতে পারেন যে, আপনি সীমারেখা স্পর্শ বা অতিক্রম করছেন৷ এখন যেমন আমি জানি যে, পায়ে হেঁটে আর কখনো পাহাড়ে যেতে পারবো না, বাইসাইকেল চালাতে পারবো না, কোন পুরুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবো না৷ বৃদ্ধ হওয়ার আগেই আমি বৃদ্ধ বয়স সম্পর্কে আতঙ্কিত ও উত্কণ্ঠিত ছিলাম৷ এরপর যখন সময় এলো, যখন জানলাম আমি সেই সীমারেখা অতিক্রম করেছি, তখন যা আশা করেছিলাম তার থেকে সহজেই ব্যাপারটা ঘটলো৷ অবশ্যই আপনাকে পিছনে তাকানো বন্ধ করতে হবে৷ আমি দেখলাম বেশিবয়স হলে বেঁচে থাকাটা যা ভেবেছিলাম তার থেকে সহজ৷ কিন্তু আমি জেনেছিলাম যে, বৃদ্ধবয়স সম্পর্কিত আমার বইয়ের গবেষণার ঐ সীমারেখা আমি স্বাধীনভাবে অতিক্রম করেছি৷ বইয়ের কাজ করতে গিয়ে আমি শিখেছি কিভাবে বৃদ্ধদের বুঝতে হয়, বেশি সহিষ্ণু হতে হয়৷
এখন কী নিয়ে কাজ করছেন?
বলতে গেলে কিছুই না৷ বৃদ্ধবয়স সম্পর্কিত একজন সুইডিশ চিত্রপরিচালককে একটি চলচ্চিত্রের ব্যাপারে সাহায্য করছি৷ সার্ত্র'কে তার টেলিভিশন প্রকল্পের ব্যাপারে সহযোগিতা করছি৷ জানেন নিশ্চয় যে, এই শতাব্দীর ৭৫ বছর ও এর প্রধান ঘটনাপ্রবাহের সাথে নিজের সম্পর্ক নিয়ে সার্ত্র জাতীয় টেলিভিশনের সাথে এক ঘণ্টা করে দশটি অনুষ্ঠানের এক চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন, যা এই অক্টোবর থেকে শুরু হতে যাচ্ছে৷ বিশেষ কোন প্রকল্প হাতে নেওয়ার ইচ্ছা আমার আপাতত নেই৷ এটা আমার জন্য বেশ নতুন ব্যাপার, কারণ নির্দিষ্ট কোন বই নিয়ে কাজ করার সময়ও আমার মাথায় অনেক প্রকল্পের ঝামেলা থাকতো৷
আপনি লিখেছেন যে, আপনার একটি সন্তোষজনক জীবন ছিল এবং কোন ব্যাপারে আপনার কোন আফসোস নেই৷ আপনি কি জানেন অনেক দম্পতি সার্ত্রের সাথে আপনার জীবনকে মডেল হিসাবে বিশেষ দৃষ্টিতে দেখে, বিশেষ করে এই অর্থে যে, একে অপরের প্রতি আপনারা আদৌ ঈর্ষাকাতর নন্, আপনাদের মাঝে একধরনের, যাকে বলে খোলামেলা সম্পর্ক বিদ্যমান এবং এটা ৪৫ বছর ধরে চলছে৷
কিন্তু আমাদের মডেল হিসাবে গণ
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।