আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারী-পুরুষ সম্পর্ক

আমার জন্মটা অন্যদের সময়ে

পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নারী-পুরুষ সম্পর্ক সিমোন দ্য বুভ্যোয়া ভাষান্তর শরীফ আতিক-উজ-জামান সিমোন দ্য বুভ্যোয়া জন্মেছিলেন ১৯০৮ সালে প্যারিসের বৌলাভার্দ র্যাসপেইলে৷ তাঁর বাবা জর্জ বার্ট্রান্ড বুভ্যোয়ার-এর থিয়েটারে কাজ করার খুব শখ ছিল, কিন্তু বুর্জোয়া সমাজের প্রতিনিধি হওয়ার কারণে তার সে-ইচ্ছা পূরণ হয় নি; পরিবারের সবাই চাইতেন তিনি আইনজীবী হোন এবং তিনি তা হয়েছিলেনও, কিন্তু এই পেশাকে তিনি ঘৃণা করতেন৷ সিমোন-এর মা' ছিলেন গোঁড়া ক্যাথলিক পরিবারের সদস্য, আর বাবা ছিলেন পৌত্তলিক (প্যাগান)৷ কড়া ধর্মীয় অনুশাসনের মাঝে সিমোন প্রতিপালিত হয়েছেন, কিন্তু কৈশোরে পদার্পণ করার পরপরই তিনি তাঁর পরিবারের ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধকে প্রত্যাখ্যান করেন৷ সিমোন শিক্ষা লাভ করেছেন ক্যাথলিক গার্লস স্কুলে৷ পরবর্তীতে সোরবোনে দর্শন বিষয়ে পড়াশোনা করেন৷ এইসময় তিনি একদল তরুণের সাথে বেশিমাত্রায় ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন, অন্যদের কাছে যাদের খুব একটা সুনাম ছিল না৷ এঁদের মধ্যে ছিলেন পল নিজান, আন্দ্রে হারমেইড ও জাঁ পল সার্ত্র৷ তবে সার্ত্রের সাথেই তাঁর বেশি ঘনিষ্ঠতা হয়৷ তিনি ছিলেন সার্ত্রের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সমালোচক, কোনো পাণ্ডুলিপি প্রকাশকের কাছে পাঠানোর আগে সার্ত্র সিমোন দ্য বুভ্যোয়াকে দেখাতেন৷ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করার পর সিমোন দ্য বুভ্যোয়া মারসেইল, রোয়েন এবং প্যারিসের কয়েকটি বিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন৷ ১৯৪১-৪৩ পর্যন্ত তিনি সোরবোনে অধ্যাপনা করেছেন৷ এরপর জার্মানী ফ্রান্স দখল করে নেওয়ার পর তাঁকে ঐ পদ থেকে অপসারণ করা হয়৷ জার্মান দখলদারিত্বের সময়টাতে সিমোন কোনো ধরনের প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন নি৷ যুদ্ধের পর সার্ত্র, মালের্া পন্টি ও রেমন্ড অ্যারোনের সাথে মিলে সিমোন একটি মাসিক পত্রিকা, Les Temps Modernes বের করেন৷ এটা প্রায় ২৫ বছর টিকে ছিল৷ ১৯৪৩ সালে তাঁর প্রথম বই L'Invitee (She Came to Stay), ১৯৪৫ সালে Le Sang des Autres ( The Blood of Others) এবং ১৯৪৭ সালে Pour Une Morale de L'ambiguite (The Ethics of Ambiguity) প্রকাশিত হয়৷ তাঁর সাড়া-জাগানো নারীবাদী Le Deuxieme Sexe (The Second Sex) প্রকাশিত হয় ১৯৪৯ সালে৷ তাঁর আত্মজীবনীমূলক রচনা Les Mandarins (The Mandarins) Prise Goncourt পুরস্কার লাভ করে৷ ১৯৫৮ সালে তাঁর স্মৃতিকথার প্রথম খণ্ড LÊ Memoirs d'une jeune fille rangee (Memoirs of A Dutiful Daughter) প্রকাশিত হয়, যেখানে তিনি তাঁর শৈশব, বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ও সার্ত্র সম্পর্কে লিখেছেন৷ এরপর একে একে La Forcede L'age (The Prime of Life), La Force des Choses (Force of Circumstances) Ges Tout Compte Fait (All Said And Done)-১৯৭২ প্রকাশিত হয়৷ মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই তিনি তাঁর গুরুত্বপূর্ণ লেখাগুলো লিখতে থাকেন৷ এইসময় বন্ধুদের নিয়ে তিনি একটি চমত্‍কার গোষ্ঠী গড়ে তোলেন৷ সার্ত্র ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ সঙ্গী এবং তাঁরা উভয়েই পরস্পরের ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন৷ দু'জনের কাছে তাঁরা দু'টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন: এক. অন্যদেরকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে তাঁরা উভয়েই স্বাধীন থাকবেন, দুই. সববিষয়ে সত্‍ ও সুস্পষ্ট থাকবেন৷ তাঁদের মাঝে কোনকিছুই গোপনীয় থাকবে না৷ জনসমক্ষে বুভ্যোয়া সার্ত্রের সাথে নিজের সম্পর্ককে খুবই জোরালো ও দাপটের সাথে তুলে ধরতেন৷ সার্ত্র তাঁকে বিয়ের প্রস্তাবও দেন, কিন্তু তিনি তাঁর সম্পর্ককে কোন প্রাতিষ্ঠানিক সূত্রে বাঁধতে রাজী হন নি৷ এই বিষয়টি তাঁর কিছু ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও আত্মীয়স্বজনকে অসন্তুষ্ট করেছিল৷ কিন্তু সিমোন দ্য বুভ্যোয়া তাঁর সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন৷ তাঁর এই সিদ্ধান্ত সার্ত্রের সাথে তাঁর সম্পর্ককে ভেঙ্গে দিতে পারে নি, বরং সার্ত্রের মৃতু্যর পূর্ব পর্যন্ত তা অটুটই ছিল৷ সিমোন অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন এবং বেশিরভাগ সার্ত্রের সাথে৷ ফিদেল ক্যাস্ট্রো ও ক্রুশ্চেভের সাথে সার্ত্রের সাক্ষাতের সময় তিনি উপস্থিত ছিলেন৷ ফটোগ্রাফার জিসেলে ফ্রিউন্ড প্রায় চলি্লশ বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে তাঁর সাথে দেখা করেছেন৷ তিনি উল্লেখ করেছেন যে, সিমোন দ্য বুভ্যোয়া কদাচিত্‍ হাসতেন৷ আর এই না-হাসাটাকে বোধহয় তিনি অন্যদের কাছ থেকে নিজেকে রক্ষা করার বর্ম হিসাবে ব্যবহার করতেন৷ সার্ত্রের সাথে তিনি ভিয়েতনামে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত বাটর্্রান্ড রাসেল ট্রাইবুনালে অংশ নিয়েছিলেন৷ গর্ভপাত, যৌন সহিংসতা, বৃদ্ধবয়সের সমস্যা, প্রবীণদের প্রতি সমাজের উদাসীনতা নিয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ লেখা লিখেছেন৷ ১৯৮১ সালে সার্ত্রের জীবনের শেষ ক'বছর নিয়ে তিনি A Farewell to Sartre রচনা করেন৷ জীবনের শেষ দিনগুলোতে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে যেতে থাকে এবং তিনি মানসিক ভারসাম্য বজায় রাখতে অসমর্থ হয়ে পড়েন৷ ১৯৮৬ সালে ১৪ এপ্রিল সিমোন দ্য বুভ্যোয়া প্যারিসে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন৷ যে-সমাধিতে সার্ত্রকে সমাহিত করা হয়েছিল সেই একই সমাধিতে তাঁকে সমাহিত করা হয়েছে৷ বর্তমান সাক্ষাত্‍কারটি সিমোন দিয়েছিলেন জন গেরাসি'কে৷ ১৯৭৬ সালে গৃহীত এই সাক্ষাত্‍কারটি ঐ বছরের সোসাইটি, জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী সংখ্যায় প্রকাশিত হয়৷] আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে The Second Sex প্রকাশিত হয়েছিল৷ অনেকে, বিশেষ করে আমেরিকাতে, এটাকেই সমসাময়িক নারীবাদী আন্দোলনের সূচনা বলে মনে করেন৷ আপনি কি... আমি তা মনে করি না৷ পাঁচ-ছয় বছর আগে যখন বর্তমান নারীবাদী আন্দোলন শুরু হয়, তখন এই বই সম্পর্কে আদৌ কেউ কিছু জানতেন না৷ এরপর আন্দোলনে গতিসঞ্চার হতে থাকলে নেতৃস্থানীয় কয়েকজন এই বইয়ের কিছু কিছু বিষয়কে তাঁদের তাত্তি্বক ভিত্তি হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন৷ এই আন্দোলনে সক্রিয় বেশিরভাগ নারী ১৯৪৯-৫০ সালে, যখন বইটি প্রকাশিত হয়, তখন স্বল্পবয়সী ছিলেন, সুতরাং এই রচনা দ্বারা তাঁদের প্রভাবিত হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না৷ তবে আমার কাছে বিষয়টা অবশ্যই আনন্দের যে, পরবর্তী সময়ে তাঁরা বইটা খুঁজে বের করেছেন৷ অপেক্ষাকৃত প্রবীণ যারা, তাঁরা কয়েকজন বইটা পড়েছেন এবং কিছুটা হলেও এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন৷ তাঁদের মধ্যে বেটি ফ্রাইডান একজন, যিনি তাঁর The Feminine Mystique আমাকে উত্‍সর্গ করেছিলেন৷ তবে অন্যরা একদমই পড়েন নি৷ যেমন, কেট মিলে তার রচনার কোথাও আমার উল্লেখ করেন নি৷ হয়তো তাঁরা নারীবাদী হয়েছেন সেইসব কারণেই, যা আমি আমার The Second Sex -এ ব্যাখ্যা করেছি, কিন্তু সেই অভিজ্ঞতা হয়তো তাঁরা নিজেদের জীবন থেকে লাভ করেছেন, আমার বই পড়ে নয়৷ আপনি বলেছেন যে, The Second Sex লেখার অভিজ্ঞতা থেকেই আপনার নিজস্ব নারীবাদী সচেতনতা জন্মেছে৷ দুস্তর পথ-পরিক্রমার আলোকে, এই বই প্রকাশিত হওয়ার পর এই আন্দোলনের ক্রমবিকাশকে আপনি কিভাবে দেখেন ? The Second Sex লিখতে গিয়ে প্রথমবারের মত আমি উপলব্ধি করলাম যে, আমি হয় একটি ভ্রান্ত জীবন যাপন করছি, নয়তো না-জেনেই পুরুষশাসিত সমাজ থেকে সুবিধা গ্রহণ করছি৷ যা ঘটেছে তা হ'ল, জীবনের একেবারে সূচনালগ্ন থেকে আমি পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলো স্বীকার করে নিয়েছি এবং সেইমত চলেছি৷ অবশ্যই আমি সাফল্য পেয়েছি এবং তা আমার মাঝে যে-বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে তা হ'ল, নারী ও পুরুষ সমান হতে পারতো যদি নারী সেই সাম্য অর্জন করতে চাইতো৷ অন্য অর্থে, আমি বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা করতাম৷ সমাজের বুর্জোয়া অংশ থেকে আসার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার, যার ফলে আমার জন্য শুধু যে শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়গুলোতে পড়বার খরচ যোগানো সম্ভব হয়েছিল তাই নয়, নিজের ভাবনাগুলো নিয়ে খেলবারও বিস্তর অবসর জুটেছিল৷ এই কারণে অতিরিক্ত কোন জটিলতা ছাড়াই আমি পুরুষ মানুষের জগতে প্রবেশ করতে পেরেছিলাম৷ আমি দেখাতে পেরেছিলাম যে, আমি দর্শন, শিল্পকলা, সাহিত্য ইত্যাদি নিয়ে 'পুরুষের সমপর্যায়ে' আলোচনার সামর্থ্য রাখি৷ নারী-সমপ্রদায়ের কাছে, নিজের কাছে যা স্বতন্ত্র তা বজায় রেখে চলতে পেরেছি৷ আর এই সাফল্য আমাকে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি যুগিয়েছে৷ আর তা করতে গিয়ে আমি দেখলাম যে, একজন পুরুষ বুদ্ধিজীবীর মতই আমি জীবনব্যয় নির্বাহের অর্থ উপার্জন করতে সক্ষম, এবং আমার সমকক্ষ যে কোন পুরুষের মতই আমাকে গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করা হচ্ছে৷ এইরকম হয়ে-ওঠার জন্য আমি দেখলাম যে, আমি চাইলে একা একাই চলাফেরা করতে পারি, যে-কোন ক্যাফেতে বসে পুরুষদের মত লিখতে পারি এবং ওদের মত সম্মানও পাই৷ আমার স্বাতন্ত্র্য ও সমকক্ষতার অনুভূতিই প্রত্যেক ক্ষেত্রে আমার জন্য রক্ষাকবচ হিসাবে কাজ করেছে৷ ফলে আমার জন্য এ-সত্য ভুলে যাওয়া খুবই সহজ হয়েছে যে, একজন মহিলা দপ্তর কর্মচারী কোনভাবেই এই একইরকম সুবিধা উপভোগ করতে পারতো না; নিগৃহীত না-হয়ে তার পক্ষে ক্যাফেতে বসা বা বই পড়া অসম্ভব ছিল; শুধুমাত্র 'মেধার' কারণেই তার পক্ষে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হওয়া সম্ভব হতো না; সে নিজের সম্মান বা প্রতিপত্তি গড়ে তুলতে পারতো না৷ হঁ্যা, আমি পেরেছিলাম৷ আরো তাত্‍পর্যপূর্ণ হ'ল এটা যে, যেসব মহিলা নিজেদেরকে আর্থিক ও আত্মিকভাবে অসমর্থ মনে করতো, আমার প্রবণতা ছিল তাদেরকে অবজ্ঞা করার৷ পুরুষদেরকে দেখিয়ে আমি স্বাবলম্বী হতে বলতাম৷ কার্যত না-বললেও মনে মনে ভাবতাম, 'আমি পারলে ওরা পারবে না কেন ?' The Second Sex এর গবেষণা ও রচনার সময় আমি উপলব্ধি করলাম যে, অন্ততঃ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে আমার প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধাগুলো, আমার নারীত্বকে পরিত্যাগ করার ফল বটে৷ যদি একে শ্রেণী-অর্থনীতির সংজ্ঞায় ফেলি তাহলে সহজে বুঝতে পারবেন যে, আমি শ্রেণীশত্রুর সহযোগী হয়েছি৷ লৈঙ্গ-সংগ্রাম প্রসঙ্গে আমি নিজেকে খানিকটা সমকক্ষ মনে করতাম৷ The Second Sex -এর মাধ্যমে আমি এই প্রয়োজনীয় সংগ্রাম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়েছিলাম৷ আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, বিপুলসংখ্যক নারীদের কোনো পছন্দ অপছন্দ নাই, যেমনটা আমার আছে৷ কারণ নারীদের গুরুত্ব অস্বীকার করা হয়েছে এবং পুরুষ-শাসিত সমাজে তাদেরকে 'দ্বিতীয় লিঙ্গ' হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে, যে-অবস্থাটা সত্যিকার অর্থে ধ্বংস হয়ে গেলে সমাজের ঐ কাঠামোটিই পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়বে৷ কিন্তু অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে নিষ্পেষিত এলাকার মানুষের মতই বিদ্রোহীদের পক্ষে সামনে এগুনো কষ্টকর ও ধীরগতির ব্যাপার৷ প্রথমে শোষণ সম্পর্কে ঐসব মানুষদের আগে সচেতন হতে হবে৷ তারপর নিজেদের উপর এমন আস্থা থাকতে হবে যে, এটাকে পাল্টে দেওয়ার ক্ষমতা তাদের রয়েছে৷ যারা দালালী করে সুবিধা লাভ করবে তাদের বিশ্বাসঘাতকতার সম্পর্কেও ধারণা থাকতে হবে৷ শেষমেষ যারা একটা অবস্থান নেওয়ার ফলে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, অর্থাত্‍ আমার মত নারীরা যারা একটি সফল ভবিষ্যত্‍ গড়তে সক্ষম হয়েছে, তারা আত্মসম্মান অর্জনের জন্য অনিশ্চয়তার ঝুঁকি নিতে রাজি হবে৷ তাদেরকে বুঝতে হবে যে, তাদের যেসব বোনেরা সবচেয়ে বেশি প্রবঞ্চিত হচ্ছে তারা শেষমেষ তাদের সাথে যোগ দেবে৷ যেমন, একজন শ্রমিকের স্ত্রীর পক্ষে এই আন্দোলনে যোগ দেবার মত স্বাধীনতা খুবই অল্প৷ সে ভালো করেই জানে যে, বেশিরভাগ নারীবাদী নেত্রীর তুলনায় তার স্বামী বেশিমাত্রায় শোষিত, এবং তার স্বামী নিজে টিকে-থাকার জন্য সংসারে স্ত্রী ও মা হিসাবে তার ভূমিকার উপর খুবই নির্ভরশীল৷ এই সমস্ত কারণে নারীরা আন্দোলনে যোগ দেয় না৷ তবে হঁ্যা, রাজনৈতিক প্রচার, রাজনীতি ও সরকারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে ছোটখাট, তবে চমত্‍কার বুদ্ধিদীপ্ত কিছু আন্দোলন হয়েছে৷ আমি এইসব গোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত হতে পারি নি৷ এরপর ১৯৬৮ সাল এলো এবং সবকিছু পাল্টে গেল৷ আমি জানি এর আগেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে৷ বেটি ফ্রাইডেনের বই এসবের একটি, যা ১৯৬৮এর আগেই প্রকাশিত হয়েছিল৷ আর তখন আমেরিকার নারীরা জোরেশোরে আন্দোলন করছিল৷ অন্য যেকোন দেশের নারীদের তুলনায়, সুস্পষ্ট কারণে নতুন প্রযুক্তি এবং হেঁশেলে আটকে-রাখার রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির মাঝে যে-পার্থক্য, সে-বিষয়ে তারা অনেক বেশি সচেতন ছিল৷ যেহেতু প্রযুক্তি হচ্ছে মস্তিষ্কের জোর, পেশির নয়, সেহেতু প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে নারী হচ্ছে দুর্বললিঙ্গ আর সেই কারণে সবসময় অধস্তন ভূমিকা রাখবে_এমন যুক্তি আর ধোপে টিকতে পারে না৷ প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন আমেরিকাতে খুব ব্যাপক হওয়ার কারণে ওখানকার নারীরা এই বিরোধিতাটা না-দেখে পারে না৷ সেইজন্য এটা খুবই স্বাভাবিক যে, সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিতন্ত্রের একেবারে বুকের মধ্যে নারীবাদী আন্দোলন সবচেয়ে বেশি গতি লাভ করেছিল৷ এমনকি ওই প্রণোদনা ছিল সুস্পষ্টভাবে অর্থনেতিক, অর্থাত্‍ আন্দোলনের মূল দাবী ছিল পুরুষের সমান কাজের জন্য পুরুষের সমান মজুরি৷ তবে নারীবাদী সচেতনতার বিকাশ ঘটেছিল সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়েই৷ আমেরিকায় ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন, ফ্রান্স ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে ১৯৬৮'র বিদ্রোহ-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার মাঝে নারীরা তাদের ক্ষমতার আঁচ পেতে শুরু করেছিল৷ পুঁজিবাদ সারাবিশ্বের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে, এটা বুঝতে পেরে বিপুলসংখ্যক নারী শ্রেণীসংগ্রামের আন্দোলনে যোগ দিতে শুরু করে, যদিও তারা 'শ্রেণী-সংগ্রাম' শব্দবন্ধ গ্রহণে সম্মত ছিল না৷ তারা সক্রীয় কর্মী হয়ে ওঠে৷ মিছিল, বিক্ষোভ, প্রচারণা, গোপন-গোষ্ঠী ও জঙ্গী বামদলে যোগ দেয়৷ একজন পুরুষের মতই তারা সংগ্রাম করেছে শোষণহীন ভবিষ্যতের জন্য৷ কিন্তু ফলটা কী হ'ল ? দল বা সংগঠন যেখানেই তারা যোগ দিয়েছে সেখানেই আবিষ্কার করেছে যে, যে-সমাজ তারা ভাঙ্গতে চায় তার প্রত্যেকটি জায়গাতে তারা 'দ্বিতীয় লিঙ্গ'৷ ফ্রান্সে, এমনকি বলতেই হচ্ছে যে আমেরিকাতেও, তারা যেখানেই চোখ রেখেছে সেখানেই দেখেছে পুরুষরাই হচ্ছে নেতা৷ আর এই ছদ্মবিপ্লবী দলে নারীরা টাইপিস্ট আর কফি-পরিবেশনকারীর দায়িত্ব পালন করছে মাত্র৷ 'ছদ্ম' কথাটি বলা উচিত্‍ নয় হয়তো৷ কারণ অনেকগুলো আন্দোলনের 'জাঁদরেল' পুরুষ নেতারা সত্যিকার বিপ্লবী ছিলেন৷ কিন্তু পুরুষ-শাসিত সমাজে বেড়ে উঠে, গড়ে উঠে এবং প্রশিক্ষণ লাভ করে এই বিপ্লবীরাও আন্দোলনে একই ধরনের মেজাজ নিয়ে আসেন৷ বোঝাই যায়, বুর্জোয়া শ্রেণী যে-ভাবে স্বেচ্ছায় তাদের ক্ষমতা ত্যাগ করবে না, ঠিক সেই একইভাবে এইসব পুরুষরাও স্বেচ্ছায় তাদের মেজাজ-মর্জি বর্জন করবে না৷ ধনীদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে-নেওয়াটা যেমন নির্ভর করে দরিদ্রদের উপর, তেমনি পুরুষের ক্ষমতা কেড়ে-নেওয়া নির্ভর করে নারীদের উপর৷ এর অর্থ কিন্তু পুরুষের উপর কতর্ত্ব করা নয়, এর অর্থ সাম্য প্রতিষ্ঠা করা৷ যেমন_সমাজতন্ত্র, সত্যিকার সমাজতন্ত্র_সমস্ত মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করেছে, সেইভাবে নারীবাদী আন্দোলন নারী-পুরুষের মাঝে সাম্য স্থাপন করতে শিখেছে আন্দোলনের মধ্যকার শাসক শ্রেণীর অর্থাত্‍ পুরুষের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে-নেওয়ার মাধ্যমে৷ অন্যভাবে বললে : শ্রেণী-সংগ্রামের মাঝে থেকেই নারীরা উপলব্ধি করলো যে, শ্রেণী-সংগ্রাম নারী-পুরুষের মাঝে বৈষম্য দূর করতে পারবে না৷ এই পর্যায়ে, একটু আগে যা বললাম সেই বিষয়ে আমার সচেতনতা সৃষ্টি হ'ল৷ তার আগ পর্যন্ত আমার বিশ্বাস ছিল যে, নারী-পুরুষের মাঝে সাম্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব পুঁজিতন্ত্রকে ধ্বংস করার ভেতর দিয়েই, সুতরাং অবশ্যই প্রথমে শ্রেণী-সংগ্রাম করা উচিত্‍; সেই 'সুতরাং'টা কিন্তু ছিল একটি ভ্রান্তি৷ এটা সত্য যে, পুঁজিতন্ত্রের মাঝে নারী-পুরুষের সাম্য অসম্ভব৷ যদি সকল নারী পুরুষের সমান কাজ করে, তাহলে ঐসব প্রতিষ্ঠানের কী হবে যাদের উপর পুঁজিতন্ত্র নির্ভর করে, যেমন_গীর্জা, বিয়ে, সেনাবাহিনী, লাখ লাখ কলকারখানা, দোকানপাট ইত্যাদি, যেগুলো ভর করে থাকে কাজ তত মজুরি, খণ্ডকালীন কাজ এবং সস্তা শ্রমের উপর? কিন্তু এটা আদৌ সত্য নয় যে, একটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব কার্যত নারী-পুরুষের মাঝে সাম্য প্রতিষ্ঠা করে দিতে পারে৷ সোভিয়েত রাশিয়া ও চেকোশ্লোভাকিয়ার দিকে তাকান, সেখানে সর্বহারার মুক্তি আর নারীমুক্তির মাঝে একটা বড় রকমের বিভ্রান্তি রয়েছে৷ যে কোনোভাবেই হোক সর্বহারা শেষমেষ পুরুষ নিয়েই গঠিত৷ পুরুষতান্ত্রিক মূল্যবোধ এখানেও যেমন ওখানেও তেমন অক্ষত আছে৷ শ্রেণী-সংগ্রাম যে লৈঙ্গ-সংগ্রামকে কোনভাবেই অন্তর্ভুক্ত করে না_এই ধারণাটি নতুন, যদিও এই সংগ্রামের সাথে জড়িত সমস্ত নারীই আজ একথা জানেন৷ আর নারীবাদী আন্দোলনের এটাই একটি বড় অর্জন৷ যে-সব অভিজ্ঞতা আগামী দিনে ইতিহাসকে পাল্টে দেবে, এই অভিজ্ঞতা তাদের একটি৷ কিন্তু এই সচেতনতা সেই নারীদের মাঝেই তো সীমিত যারা বামপন্থী অর্থাত্‍ সেইসব নারী যারা সমস্ত সমাজটাকে নতুন কাঠামো দান করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ৷ অবশ্যই৷ তার কারণ বাকিরা রক্ষণশীল, তার মানে তারা যা ছিল বা যা আছে তা অপরিবর্তিত রাখতে চায়৷ দক্ষিণপন্থী নারীরা বিদ্রোহ চায় না৷ তারা মা ও স্ত্রী হয়ে তাদের পুরুষদের প্রতি নিবেদিত থাকতে চায়, কিংবা যদি তারা কখনো বিদ্রোহী হয়ে ওঠে তাহলে পিঠার বড় অংশটা চায়৷ তারা বেশি উপার্জন করতে চায়, সংসদে অধিক সংখ্যক নারীদের নির্বাচিত করতে চায়, একজন নারীকে প্রেসিডেন্ট হিসাবে দেখতে চায়৷ নীচে নয়, বরং শীর্ষে থাকার আকাঙ্ক্ষা ব্যতিরেকে তারা মূলতঃ অসাম্যে বিশ্বাসী৷ কিন্তু তারা বর্তমান পদ্ধতির সাথে নিজেদেরকে চমত্‍কারভাবে মানিয়ে নেয় অথবা ঐসব দাবীনামাকে সঙ্গতিপূর্ণ করতে বিদ্যমান ব্যবস্থাটাকে খানিকটা পাল্টে নিতে চায়৷ এটা অসম্ভব নয় যে, পুঁজিতন্ত্র হঠাত্‍ করেই নারীকে সেনাবাহিনী বা পুলিশ বিভাগে যোগদানের সুযোগ করে দেবে৷ চালাকি করে অধিকসংখ্যক নারীকে সরকারে যোগ দিতে দেবে৷ কপট সমাজতন্ত্রও হয়তো একজন নারীকে পার্টির সাধারণ সম্পাদক হওয়ার অনুমতি প্রদান করবে৷ এগুলো সামাজিক নিরাপত্তা ও অবকাশকালীন মজুরির সংশোধনী মাত্র৷ আর অবকাশকালীন মজুরির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ কি পুঁজিতন্ত্রের অসাম্যকে পাল্টে দিতে পেরেছে? পুরুষের সমান মজুরিতে কলকারখানায় কাজের অধিকার কি চেক প্রজাতন্ত্রের সমাজে পুরুষের আধিপত্য খর্ব করতে পেরেছে? সমাজের সামগ্রিক মূল্যবোধ বা মাতৃত্বের ধারণা পাল্টে দিতে পারলে সেটা হতো নিঃসন্দেহে একটি বৈপ্লবিক ঘটনা৷ একজন নারীবাদী, যিনি নিজেকে বামপন্থী বলুন আর নাই বলুন, সংজ্ঞানুযায়ী তিনি বামপন্থীই৷ সামগ্রিক সাম্যের জন্য তিনি সংগ্রাম করছেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার জন্য, যে কোনো পুরুষের মত প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠার জন্য৷ সুতরাং লৈঙ্গ-সাম্যের আন্দোলনের সাথে তাঁর সম্পৃক্ত হওয়ার অর্থই হ'ল শ্রেণী-সাম্যের দাবী তোলা৷ যে-সমাজে পুরুষরা মায়ের ভূমিকা নিতে পারে, যেখানে মূল্যবোধের প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক উসকে দেওয়া যায়, সেখানে এটা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, তথাকথিত 'নারী স্বজ্ঞা' 'পুরুষের জ্ঞান'এর মতই গুরুত্বপূর্ণ; আজকের দিনের উদ্ভট ভাষায় বললে, যেখানে অমায়িক ও নরম হতে হবে সেখানে তেমন হওয়াটা শক্ত ও রূঢ় হওয়া থেকে ভালো; অন্যকথায়, যে-সমাজে প্রত্যেকটি মানুষের অভিজ্ঞতা অন্যের অভিজ্ঞতার সমার্থক, সেখানে আপনাআপনিই সমতা প্রতিষ্ঠিত হবে, যার মানে আর্থিক ও রাজনৈতিক সমতা, এবং আরো কিছু৷ এইভাবে লৈঙ্গিক সাম্যের আন্দোলন শ্রেণী-সংগ্রামের সাথে এবং শ্রেণী-সংগ্রাম লৈঙ্গিক আন্দোলনের সাথে একীভূত হয়৷ সুতরাং নারীবাদীরাই খাঁটি বামপন্থী৷ তবে বামপন্থী বলতে আমরা সাধারণতঃ রাজনৈতিক বামপন্থীদেরকেই বুঝে থাকি৷ কিন্তু যেহেতু আপনি বলেছেন, লৈঙ্গ-সাম্যের আন্দোলন সাময়িকভাবে অন্যান্য রাজনৈতিক খাতে অপ্রাসঙ্গিক, সেহেতু এই সময়ের মধ্যে, শুধুমাত্র বামপন্থীদের মাঝে এই আন্দোলনের সূত্রপাত করে, যারা সর্বত্র নারী ও দরিদ্রদের প্রবঞ্চিত করছে তাদের সুরক্ষা প্রদানের মাধ্যমে নারীবাদীরা কি বামশক্তিকে দুর্বল করছে না? না, শেষমেষ এটা বামপন্থীদেরকেই সুরক্ষা দেবে৷ একটা বিষয় হ'ল, বামপন্থী হিসাবে বিরোধিতার মুখে পড়া অর্থাত্‍ শোষিতদের প্রতিপক্ষ হওয়ার দরুন বামপন্থী পুরুষরা নতুন করে ভাবতে বাধ্য হবে৷ বেশিসংখ্যক গোষ্ঠী বা দল বাধ্য হবে তাদের 'পৌরুষসম্পন্ন' নেতাদের বাগে রাখতে৷ আর এটাই হল অগ্রগতি৷ এই পুরুষশাসিত সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজে একজন নারীকে খবরের কাগজের পরিচালক হতে দিতে বাধ্য হয়, যা অগ্রগতির লক্ষণ৷ বামপন্থী পুরুষরা তাদের ভাষা-ব্যবহারের দিকটা সম্পর্কে সতর্ক হতে শুরু করেছে৷ আর... কিন্তু আসলেই কি তাই? আমি বোঝাতে চাচ্ছি, যেমন ধরুন, এই শিক্ষা আমার আছে যে, কোন দলগত আলাপ-আলোচনা, থালাবাসন পরিষ্কার করা, ঘরদোর ঝাড়পোছ করা, কেনাকাটার ক্ষেত্রে কোথাও নারীর প্রতি অধিক মনযোগ দিতে পযরপশ শব্দটা ব্যবহার করতে নেই৷ কিন্তু আমি কি আমার ভাবনায় কম যৌন-বৈষম্যবাদী? আমি কি আমার পুরুষ-মূল্যবোধগুলোকে খারিজ করে দিয়েছি? আপনি কি আপনার অন্তরস্থ সত্তাকে বোঝাচ্ছেন ? তা পাত্তা দিচ্ছে কে ? একটু ভাবুন৷ দক্ষিণী একজন উগ্র সামপ্রদায়িককে আপনি চেনেন৷ আপনি জানেন সে উগ্র সামপ্রদায়িক কারণ আপনি তাকে সারাজীবন ধরে চেনেন৷ কিন্তু এখন তিনি আর 'নিগ্রো' শব্দটি উচ্চারণ করেন না৷ মনযোগ সহকারে কালো মানুষের অভিযোগ শোনেন এবং সাধ্যমত চেষ্টা করেন সেগুলোর সমাধান করতে৷ নিজের পূর্বেকার উগ্রবাদী অবস্থান থেকে সরে এসে অন্য উগ্রবাদীদের নিরস্ত করার চেষ্টা করেন৷ অতীতের অজ্ঞানতার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নিগ্রো শিশুদেরকে গড়পড়তার চেয়ে উন্নততর শিক্ষা দেওয়ার উপর জোর দেন৷ ঋণের জন্য কালো মানুষদের আবেদনে তিনি সুপারিশ করেন৷ নির্বাচনে কালো প্রার্থীদের তিনি অর্থ ও ভোট_দুটো দিয়েই সমর্থন যোগান৷ এখন আপনি কি মনে করেন যে, আগে তাঁর মনে উগ্রবাদী ধ্যানধারণা ছিল বলে এখনো মানুষ তাঁকে অভিসম্পাত দেবে? অজস্র বিষয়মুখ স্বার্থসাধনই (Objective Exploitation) হ'ল মানুষের স্বভাব৷ যদি সেই স্বভাবকে আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তাই করুন, কারণ বিপরীতমুখী স্বভাব (Counter-habit) থাকাটা খুবই 'স্বাভাবিক'৷ আর এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ৷ যদি আপনি থালাবাসন পরিষ্কার করেন, ঘরদোর ঝাড়পোছ করেন এবং একজন পুরুষ থেকে 'নূ্যন' হয়েছেন বলে মনে না-করেন, তাহলে আপনি নতুন অভ্যাস গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন৷ দু'টি প্রজন্ম যদি অনুভব করে যে, সবসময় তাদের অসামপ্রদায়িক থাকতে হবে, তৃতীয় প্রজন্ম তাহলে সত্যি সত্যিই অসামপ্রদায়িক হিসাবে বেড়ে উঠবে৷ সুতরাং যৌন-অবৈষম্যবাদী হিসাবে খেলুন এবং খেলাটা চালিয়ে যান৷ এটাকে একটা খেলা হিসাবেই গ্রহণ করুন৷ আপনার একান্ত ভাবনায় আপনি নিজেকে নারী থেকে শ্রেষ্ঠ ভেবে থাকেন৷ কিন্তু যখন আপনি প্রত্যয়ের সাথে খেলাটা খেলবেন_থালাবাসন পরিষ্কার, কেনাকাটা, ঘরদোর ঝাড়পোছ করা, বাচ্চাদের যত্ন নেওয়া_এখন আপনি দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন, বিশেষ করে আপনার মত পুরুষরা যাদের পুরুষালি 'ভাব' আছে৷ সমস্যাটা হ'ল আমার বিশ্বাস হয় না, আমি কোনমতেই মানতে পারি না যে, আপনারা যা বলেন তা করতে পারবেন৷ থালাবাসন ধোওয়া এক ব্যাপার, আর সকালসন্ধ্যা বাচ্চার কাঁথা পাল্টানো আর-এক৷ আমার কোন বাচ্চাকাচ্চা নেই... কেন নেই? আপনি চান নি নিশ্চয়৷ আপনার কী ধারণা, যেসব মায়েদের আপনি চেনেন তারা সবাই ইচ্ছা করেই বাচ্চা নিয়েছে? নাকি তাদের বাধ্য করা হয়েছে? আরো স্পষ্ট করে বললে, নাকি তাদের এই শিক্ষা দিয়ে বড় করা হয়েছে যে, বাচ্চাকাচ্চার জন্ম দেওয়াটা অতিস্বাভাবিক, প্রাকৃতিক ও নারীসুলভ একটি ব্যাপার, আর তাই বাচ্চাকাচ্চা নিতেই হবে৷ কিন্তু এই পছন্দটাকে বাধ্যতামূলক করলো কে? এইগুলোই হচ্ছে মূল্যবোধ, আর তাদেরকেই পাল্টাতে হবে৷ বেশ, আর আমার ধারণা, সেইজন্যই অনেক নারীবাদী বিচ্ছিন্নতাবাদী হওয়ার জন্য প্ররোচনা দেন৷ কিন্তু বিপ্লবের শর্তানুযায়ী, তাদের সাথে আমিও যদি পুরোপুরি আলাদা দলে বিভক্ত হয়ে যাই তাহলে কি জিততে পারবো? পুরুষদের পরোপুরি বাদ দিয়ে নারীবাদী আন্দোলন কি তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হবে? যদিও নিদেনপক্ষে এই ফ্রান্সে, এমনকি আমেরিকাতেও নারী-আন্দোলনের প্রধান বিষয় হ'ল এর বিচ্ছিন্নতাবাদী বৈশিষ্ট্য৷ এক মিনিট৷ আমাদের আগে খুঁজে বের করতে হবে কেন তারা বিচ্ছিন্নতাবাদী৷ আমেরিকার কথা বলতে পারবো না, তবে এখানে, এই ফ্রান্সে, অনেক গোষ্ঠী আছে, সচেতন গোষ্ঠী যারা পুরুষদেরকে অন্তর্ভুক্ত করে না, কারণ নারী হিসাবে নিজেদের পরিচয় পুনঃআবিষ্কার এবং নারী হিসাবে নিজেদের অনুধাবন করার বিষয়টিকে তারা গুরুত্ব সহকারে দেখে৷ এটা তারা করতে পারে শুধু নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই; স্বামী, প্রেমিক, ভাই, পিতা বা অন্যপুরুষদের সামনে যা বলতে সাহসে কুলায় না তা একে অন্যের কাছে বলার মাধ্যমে৷ কাঙ্ক্ষিত ঐকান্তিকতা ও সততার সাথে তাদের কথা বলার প্রয়োজনীয়তা শুধুমাত্র এইভাবেই পূরণ হতে পারে৷ আর এভাবে তারা প্রগাঢ় যোগাযোগ স্থাপনে সমর্থ হয়েছে, পঁচিশ বছর বয়স পর্যন্ত যা আমার কল্পনায় আসে নি বা সম্ভব বলে মনে হয় নি৷ এমনকি যখন আমি আমার একান্ত ঘনিষ্ঠ বান্ধবীদের মাঝে থেকেছি তখনও নারীর সত্যিকার কোন সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয় নি৷ তবে এখন প্রথমবারের মত, এই সচেতন গোষ্ঠী ও তাদের মাঝে নারীর সমস্যা নিয়ে আন্তরিকভাবে লড়বার দৃঢ় আকাঙ্ক্ষার কারণে নারীর ভেতর প্রকৃত বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে৷ আমি বোঝাতে চাচ্ছি যে, অতীতে তরুণ বয়সে খেয়াল করেছি, এমনকি এখনো করি যে, মহিলারা একে অন্যের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হতে চায় না৷ পরস্পরকে তারা একে অন্যের প্রতিপক্ষ, এমনকি শত্রু এবং নিদেনপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে দেখে থাকে৷ এখন এইসব সচেতন গোষ্ঠীর কারণে, মহিলারা যে শুধুমাত্র পরস্পরের প্রকৃত বন্ধুই হতে পারছে তা-ই নয়, তারা একে অন্যের সাথে উষ্ণ, খোলামেলা ও কোমল আচরণ করছে; তারা এই সম্পর্ককে সমকামিতার উপর নির্ভরশীল না-করেও নারীসঙ্ঘ ও সৌভ্রাত্রকে বাস্তবেরূপ দিতে সক্ষম হয়েছে৷ অবশ্যই এখনো অনেক সংগ্রাম বাকি আছে, এমনকি পুরোপুরি নারীবাদী সংগ্রামও বাকি আছে, যার সামাজিক অভিঘাত রয়েছে, যেখানে নারীরা চায় পুরুষরা যোগ দিক এবং অনেকে দিয়েছেও৷ যেমন, এ-প্রসঙ্গে গর্ভপাত আইন সিদ্ধ করার দাবী নিয়ে সংঘটিত আন্দোলনের কথা মনে আসছে আমার৷ তিন-চার বছর আগে আমরা যখন এ-দাবীতে বড় ধরনের বিক্ষোভ করি তখন সেখানে প্রচুরসংখ্যক পুরুষ উপস্থিত ছিলেন৷ এর মানে এই নয় যে, তাঁরা যৌন-বৈষম্যবাদী নন্৷ শৈশব থেকেই একজনের আচরণ ও মূল্যবোধের ভেতরে যে বিষয়গুলো গেঁথে যায় তাকে উপড়ে ফেলতে বছরের পর বছর এমনকি দশক লেগে যায়৷ কিন্তু নিদেনপক্ষে এই লোকগুলোই সমাজে লিঙ্গ-বৈষম্য সম্পর্কে সচেতন এবং এর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করেছেন৷ এইরকম পরিস্থিতিতে পুরুষদের স্বাগত জানানো যায়, ঐ সংগ্রামে যোগ দেওয়ার জন্য উত্‍সাহিত করা যায়৷ কিন্তু অনেক গোষ্ঠী আছে, নিদেনপক্ষে এই ফ্রান্সে, যারা গর্বভরে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বা বিচ্ছিন্নতা ঘোষণা করে এবং নিজেদের আন্দোলনকে পুরোপুরি সমকামী বলে থাকে৷ বিষয়টাকে একটু সুস্পষ্ট করি৷ নারীমুক্তি আন্দোলন (MLF)-এর মাঝে অনেক দল আছে যারা নিজেদের সমকামী বলে থাকে৷ গখঋ এবং সচেতন গোষ্ঠীগুলোকে ধন্যবাদ যে, অনেক নারী এখন খোলাখুলিভাবে বলতে পারছে যে তারা সমকামী৷ সেটা দারুণ ব্যাপার৷ কিন্তু এটাকে শুধু ওভাবে দেখা ঠিক হবে না৷ আরো অনেক মহিলা আছেন যাঁরা সমকামী হয়েছেন রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির কারণে, অর্থাত্‍ যাঁরা অনুভব করেন যে, সমকামী হওয়া একটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড যা লৈঙ্গিক আন্দোলন বা উগ্রবাদী আন্দোলনের সমার্থক৷ কিন্তু তার মানে এই নয় যে, নিপীড়নের বিরুদ্ধে সর্বত্র যে অসংখ্য আন্দোলন হচ্ছে সেগুলোর প্রতি তাঁরা উদাসীন৷ যেমন, পুলিশ যখন রেমন্টের একটি কারখানায় বিক্ষোভরত শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করতে ব্যর্থ হয়ে ঠাণ্ডা মাথায় তরুণ মাওবাদী সংগঠক, পিয়েরে ওভারনি'কে হত্যা করে, যার প্রতিবাদে সমস্ত বামপন্থীরা প্যারিস জুড়ে বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করে, তখন এইসব তথাকথিত প্রাগ্রসর সমকামী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সেই বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন এবং তাঁর সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেছিলেন৷ এর মানে এই নয় যে, তাঁরা পুরুষ ওভারনির প্রতি তাদের সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন৷ তাঁরা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার প্রতি রাষ্ট্রের শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে আয়োজিত প্রতিবাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন৷ আমেরিকার ক্যাম্পাসগুলোতে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে যে, নারী-স্বাধীনতার অনেক কুফলের একটি হ'ল, ব্যাপকহারে পুরুষের ক্লীবত্ব বৃদ্ধি, বিশেষ করে সেইসব তরুণদের মধ্যে যারা তাদের লিঙ্গ-বৈষম্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে৷ এটা তাদের নিজস্ব ত্রুটি৷ তারা যে ভূমিকা রাখার চেষ্টা করে..... কিন্তু সুস্পষ্ট করে বললে, এখন তারা উপলব্ধি করে যে, তারা আগে যে-ভূমিকা পালন করতো তাতে পুরুষালি হওয়া সহজ ছিল এবং এখন বিশ্বাস করে যে, যখন তারা প্রেম করতো তখন তারা স্বার্থপর ও আগ্রাসী ছিল, এবং মহিলাদের শ্লীলতাহানীর চেষ্টা করতো, কারণ সেটাই কাঙ্ক্ষিত ছিল, কিন্তু এখন... যে-কাজ তারা করেছে, একদা যা সহজ ছিল এবং যা তাদের যৌনতৃপ্তি দান করতো, সে-বিষয়ে সচেতন হওয়ার পর এখন তারা নারীকে পরিতৃপ্তি দিতে পারবে কিনা সে-ব্যাপারে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে, কারণ তারা এখন নিজেদেরই পরিতৃপ্ত করতে পারে না৷ খুব খারাপ কথা! আমার মনে হয়, যদি তারা তাদের সঙ্গী মহিলাদের প্রতি প্রকৃত প্রেম অনুভব করতো, যদি তারা তাদের নিজেদের ও সঙ্গিনীদের প্রতি সত্‍ থাকতো তাহলে তারা উভয়ের পরিতৃপ্তির বিষয়ে ভাবতো৷ এখন যদি তারা তাদের সঙ্গিনীদেরকে পরিতৃপ্ত করতে না-পারে তাহলে লিঙ্গ-বৈষম্যবাদী হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার ভয়টা থাকে৷ ফলে একাজে তারা আর নৈপুণ্য দেখাতে পারছে না, কিন্তু এ-কাজে নৈপুণ্য প্রত্যাশিত, তাই নয় কি? ওই পুরুষেরা নপুংসক, কারণ তারা একটা বিরোধিতার মাঝে বসবাস করে৷ এটা খুবই দুঃখের বিষয় যে, পুরুষদের এই দলগুলো, যারা নিদেনপক্ষে লিঙ্গ-বৈষম্য সম্পর্কে সচেতন, তারা নারীর জন্য জীবনকে বেশিমাত্রায় অসহিষ্ণু করে তোলার ফলে নারীদের আন্দোলনের জন্য বেশি করে ভুগবে৷ কিন্তু ব্যাপকসংখ্যক পুরুষ এর থেকে উপকৃত হবে... উপকৃত হবে? কিছুক্ষণ আগে MLF কিভাবে নারীসঙ্ঘ গড়ে তুলতে, একে অপরের প্রতি সহমর্মী হতে সাহায্য করে তা নিয়ে কথা বলছিলাম৷ এটা আমার মনে যে-ধারণা তৈরী করেছে তা হ'ল, নারীরা এখন অপেক্ষাকৃত সচ্ছল৷ আসলে কিন্তু তা নয়৷ সংগ্রামটা শুরু হয়েছে মাত্র, আর সূচনাপর্বে এটা জীবনকে আরো কঠিন করে তোলে৷ নারীর যৌন-নিপীড়ন বিষয়ে সচেতন হোন বা নাই হোন, প্রচারণার কারণে 'স্বাধীনতা' শব্দটি সব পুরুষের জিবের ডগায় থাকে৷ এখন পুরুষের অতিসাধারণ যে-দৃষ্টিভঙ্গিটা দাঁড়িয়েছে তা এইরকম, 'বেশ, তোমরা তো এখন মুক্ত, তাহলে চলো বিছানায় যাই৷' অন্য অর্থে, পুরুষরা এখন আরো বেশি মাত্রায় আগ্রাসী, ইতর ও হিংস্র৷ যৌবনে আমরা শ্লীলতাহানির শিকার না-হয়ে মোঁতপারনাসিতে পায়চারী বা ক্যাফেতে বসতে পারতাম৷ হঁ্যা, আমাদের দেখে ছেলেরা হাসতো, বড় বড় চোখ করে চেয়ে থাকতো কিংবা চোখ টিপতো; এখন কিন্তু একজন নারীর পক্ষে একা একা ক্যাফেতে বসে বই-পড়াটা অসম্ভব ব্যাপার৷ আর গায়ে-পড়ে আলাপ জমাতে-আসা ওইসব ছেলেগুলোকে পাত্তা না-দিয়ে যদি কোন মেয়ে একাকী থাকার ব্যাপারে দৃঢ়তা দেখায় তবে ওরা চলে যাওয়ার সময় প্রায়ই শুয়োরের বাচ্চা বা খানকি বলে গালি দিয়ে যায়৷ এখন অনেক বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রে, পুরুষের আগ্রাসন ও বৈরিতা এতটাই স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, এই শহরে কোন মহিলাই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না এবং আমেরিকার সব শহরেই এমন ঘটনা ঘটে বলে শুনেছি৷ তবে হঁ্যা, নারীরা ঘরে থাকলে আর এমনটি ঘটে না৷ পুরুষেরা মনে করে, নারী-স্বাধীনতা যে হুমকিটাকে সামনে এনেছে পুরুষকে তা আরো নিরাপত্তাহীন করবে৷ এখান থেকে পুরুষদের মাঝে আরো ক্রোধ জন্ম নেবে, তারা এমন আচরণ দেখাতে শু

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।