আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জ্বি ভাই, আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হতভাগা সন্তান

.......অতঃপর মৃত্যুর প্রতীক্ষা

মফস্বলের মাঝে গেও গেরামের স্কুলের ছেলে একটু ভাল ফলাফল করলে তাকে নটরডেম কলেজে রপ্তানি করে দেবার প্রক্রিয়া চলে। জমি জমা বেচে হলেও ছেলেকে ভাল কলেজে পড়িয়ে ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠিয়ে দিতে পারলেই বাবাদের স্বস্তি। অন্তত বাবাদের আয় রোজগার বা সঞ্চয়ের মূল উদ্দেশ্যই থাকে ছেলে মেয়েদের লেখা পড়া করিয়ে প্রতিষ্ঠিত করিয়ে দেয়া। আর নটরডেম মানেই তো নিশ্চিত বুয়েট মেডিক্যাল বা ঢাবির আঙ্গিনায় এক পা পড়া। আমাদের গেও গেরামে ঢাকা থেকে কোন ছেলে আসলে মনে হত সাক্ষাৎ অবতার, দেখা মাত্রই নমঃ নমঃ করতাম।

একবার বিখ্যাত আইডিয়াল স্কুলের ছেলে আসল, আমরা মুগ্ধ হয়ে স্বর্গ দূত দেখি। ঢাকায় বাবার হোটেলে থেকে যারা আইডিয়াল->নটরডেম->বুয়েট বা গভঃ ল্যাব->ঢাকা কলেজ->বুয়েট হয়েছেন তাদের আমার ভীষণ হিংসা হয়। সেখানে এলাকায় নটরডেমিয়ান এলে দুয়া দুরুদ পড়া শুরু করতাম। সামান্য ক'টা নম্বরের জন্য বোর্ড স্ট্যান্ড হাত ছাড়া হয়ে যাওয়াতে, সবাই পরামর্শ দিল নটরডেমে ভর্তি হবার জন্য। নাম করা হলে কী হবে, প্রাইভেট কলেজ।

স্কুলের ব্যাক বেঞ্চার গুলো দেখি বাবার টাকায় দিব্বি গিয়ে নটরডেমে ভর্তি হয়ে, পাশ করে এক এক জন জাদরেল ছাত্র হয়ে উঠল চোখের সামনে। আসলেই ছাত্র পিটিয়ে মানুষ করতে নটরডেমের জুড়ি মেলা ভার। খ্রিস্টান ছাড়া হোস্টেলে জায়গা হবেনা, রামকৃষ্ণ মিশন শুধু হিন্দুদের জন্য এমন তথ্য পাবার পর দেখি ঢাকা শহরে থাকা, খাওয়া পড়া বাবদ বাবার ৪/৫ হাজার টাকা চলে যাবে। বাবা নেহাৎ ছা পোষা সরকারি চাকুরে, যে মাইনে পেতেন তাতে করে মাসে ২ জন স্যারের কাছে ব্যাচে ৩০০+৩০০=৬০০ টাকা দিয়ে পড়ানোর বেশি সাধ্যে কুলাতোনা। কাজেই নটরডেম বা ঢাকার চিন্তা বাদ।

টাকা ওয়ালাদের একটা বিকল্প চিন্তা থাকে। বুয়েট, ঢাবি, কুয়েট, রুয়েটে কম্পিউটারে চান্স না পেলে, ঢাকার একটা ভাল মানের প্রাইভেটে পছন্দের কম্পিউটার বিভাগে ভর্তি হয়ে যাওয়া। এমনকি দম্ভোক্তি শোনা যায়, "রুয়েটের ইলেক্ট্রিক্যালে পেয়েও আমি নর্থ সাউথের কম্পিউটারে পড়ছি। " আমাদের সময় আবার কম্পিউটারের নেশাটা এমন পর্যায়ে ছিল বুয়েটে কম্পিউটার না পেলে অন্য যেকোন ভার্সিটি গিযে হলেও কম্পিউটারে ভর্তি হবে। কিন্তু ঢাকার বাইরে কোথাও ভর্তি হওয়া মানে ৫ বছর পিছিয়ে পড়া, খ্যাত হয়ে যাওয়া।

ঢাকা কেন্দ্রীক শিক্ষাবাজারের জোশে টাকাওয়ালারা ঢাকার প্রাইভেটে কম্পিউটারে পড়তে লাগল। টাকাওয়ালারা এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারলেও আমাদের মত ছা পোষা কর্মচারীর সন্তানেরা সম মেধা নিয়ে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়, কেউ যায় খুলনার কম্পিউটারে। একে তো পদার্থ বিদ্যায় চাকুরির বাজার নেই, তার উপর সেশন জট, হতাশা , গরীবের জন্য দারিদ্র্যের দুষ্ট চক্রটা বনবন করে ঘুরতে থাকে। টাকাওয়ালা শুধু টাকায় সম্পদশালী নয়। মামা চাচাদেরও অবস্থা গতিক ভালই থাকে।

কাজেই পাশ করলেই চাকুরি এমন একটা প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে প্রাইভেটে পড়া লেখা করে। ঢাকার প্রাইভেটের ছেলে, ভাল ইংরেজি জানে, গণ যোগাযোগের বিষয় গুলো রপ্ত আছে সেখানে মফস্বলে পড়া খ্যাত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে কে পাত্তা দিবে? ঢাকার বাইরে মানে পিছিয়ে পড়া , পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় মনে হানাহানি-- এ বোধ বিশ্বাস থেকে দেখা যায় ঢাকার অনেকেই রুয়েটে কম্পিউটারে পেয়েও ঢাকায় থেকে প্রাইভেটে পড়ছে। অন্তত মেয়েদের বলা হচ্ছে এত দূরে গিয়ে কাজ নেই, প্রাইভেটই এখন ভাল, বাসার কাছে থেকে টাকা দিয়ে সময় মত ডিগ্রী শেষ করা যায়। পাবলিকের উচু ডিগ্রিধারী শিক্ষকেরা পেটের দায়ে পাবলিকের ফরয ক্লাশ নেয়া বাদ দিয়ে প্রাইভেটে শিক্ষাদান করছেন। প্রাইভেটের মান তাই বাড়ছে বৈকি।

এখনকার পরিস্থিতি শুনি আরো ভয়াবহ। জিপিএ ৫ না থাকলে নাকি বুয়েটের ফরমই তোলার যোগ্যতা বাতিল করে দেয়া হয়েছে। ছাত্র ভর্তির ব্যাপারে পাবলিকের এত উন্নাসিক ভাব টিকবে তো? ঢাকার মানুষের যত বড় বড় টাকার গাছ আর খরচের ইয়া বড় হাত ----তাতে করে সামনের দিন গুলোতে গরীবের বিনে পয়সার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় কিনা, ভাবনার বিষয়। প্রাইভেটের বেলায় ৪/৫ এর মাঝে একটা কিছু থাকলেই হল, ভর্তির এই উদারীকরণে তাই ছাত্রদের বেশ হিড়িক। জিপিএ ৫ এর হিড়িকের যুগে যারা দুর্ভাগ্য বশত (!!!) জিপিএ ৫ পাননি, তাদের জন্য না হয় প্রাইভেটের দরজা খোলা আছে।

কিন্তু গরীবের সন্তানের বাবার পকেটে তো পয়সা নেই, অন্তত সরকারি চাকুরেদের দুর্নীতির হাত যশ না থাকলে প্রাইভেটের উচ্চ বেতন পরিশোধ করা অসম্ভব। আবার গরীবের ছেলের ঘোড়ার রোগ, কম্পিউটারে পড়তে চায়। জ্বি উপায় তো আছেই। দিনাজপুরের হাজী দানেশ, টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিশ্ববিদ্যালয়। বা সম্প্রতি কুমিল্লা, নোয়াখালী বিশ্ববিদ্যালয়।

ছা পোষা লোকের সন্তানের মাঝে মাঝে ডাক্তারি পড়ার রোগ ধরে। পাবলিক মেডিক্যাল /ডেন্টালে না পেলেও পাওনিয়ার ,সাপ্পোরো, সিকদার, বাংলাদেশ মেডিক্যাল কমিউনিটি বেইজড আরো কত কী আছে! গরীবের সন্তানকে ১০-২০ লাখ টাকা দিয়ে ডাক্তার বানিয়ে টাকাটা ঠিক মত উঠে আসবে তো বাংলাদেশে? না হলে সিলেটে চট্রগ্রাম ভেটেরিনারি কলেজে ভর্তি করিয়ে দাও কী আর করা! গরু ছাগলের ডাক্তার হয়ে থাকুক। বাপের পকেটে টাকা থাকলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের খুনাখুনি, ছাত্র রাজনীতি, সেশন জটের বিরুদ্ধে কথা বলে জাত নামানো খুব সোজা ----সেই সাথে প্রাইভেটকেও দশ হাত উপরে উঠিয়ে দেয়া যায়, যাতে মাটিতে পা না পড়ে। মাঝে মাঝে ভাবি ছেলেকে নটরডেমে পড়িয়ে সুস্থ মানুষ বানাতে বাবা না হয় ক'টা টাকা বাম হাত দিয়েই উপার্জন করতেন। অথবা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে খুব বুঝদার, জানে ওয়ালা কর্পোরেট গ্রাজুয়েট বানাতেন মুড়ি মুড়কির মত বৈধ পথেই টাকা আসতো।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতি, খুনাখুনি , সেশন জটের অভিযোগ-অভিশাপ থেকে পরিত্রাণ পেতাম। অন্তত ভাইভা বোর্ডে গিয়ে দেখতে হতনা স্কুলের পুরনো সহপাঠী প্রাইভেট থেকে খুব দ্রুত পাশ করে এখন আমার বস, আমার ইন্টারভিউ নিচ্ছেন, খ্যাত মফস্বলের পিছিয়ে পড়া ছেলেটিকে চটকে দিচ্ছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে দুটো কথা শুনিয়ে দিয়ে। কী যে পাপ করেছিলাম গরীবে ঘরে জন্মে আর পাবলিকের অভিশপ্ত শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষা নিয়ে। প্রাইভেট ওলারা আজ সুযোগ বুঝে আমায় মূর্খ, মানসিক রোগী ডাকে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।