"আকাশে নক্ষত্র দেখে নক্ষত্রের মতন না হয়ে পারিনি আমি / নদী তীরে বসে তার ঢেউয়ের কাঁপন, / বেজেছে আমার বুকে বেদনার মত / ঘাসের হরিৎ রসে ছেয়েছে হৃদয়"। _আহমদ ছফা
নেপালের ইউনিফায়েড কমিউনিস্ট পার্টি - মাওবাদী নেতা, দলের পলিটব্যুরোর সদস্য কমরেড ইন্দ্রমোহন সিজেল বাংলাদেশে এসেছিলেন গত ২৮ ডিসেম্বর, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল - বাসদের কেন্দ্রীয় কনভেনশনে অংশগ্রহণ করতে।
৩০ ডিসেম্বর ঢাকার মহানগর নাট্যমঞ্চে অনুষ্ঠিত কনভেনশনের উদ্বোধনী সমাবেশ ও ৩১ ডিসেম্বর প্রতিনিধি অধিবেশনে তিনি তার দলের বর্তমান অবস্থান, নেপালের পরিস্থিতি বিশদ তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন।
১ জানুয়ারি দেশের বামপন্থি দল, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের সাথে আয়োজিত মতবিনিময় সভাতেও তিনি বক্তব্য রাখেন।
৩০ ডিসেম্বর বিকেলে কনভেনশনের প্রকাশ্য সমাবেশে কমরেড ইন্দ্রমোহন সিজেলের প্রদত্ত বক্তব্য ভ্যানগার্ড - জানুয়ারি ২০১০ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল।
সামহোয়ারের পাঠকদের জন্য এখানে তা সামান্য সম্পাদনা করে তুলে ধরা হল।
http://www.spb.org.bd/
বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের ১ম কনভেনশনের কমরেড সভাপতি, ওয়ার্কার্স ওয়াল্র্ড পার্টি থেকে আসা প্রতিনিধি কমরেড, ইন্টারন্যাশনাল একশন সেন্টার থেকে আসা প্রতিনিধি কমরেড, সোশ্যালিস্ট ইউনিটি সেন্টার অব ইন্ডিয়া থেকে আসা কমরেডগণ, নিউ ডেমোক্র্যাটিক পার্টি শ্রীলংকা থেকে আসা কমরেড, বাসদ এর কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এবং এখানে উপস্থিত সকল কমরেড ও বন্ধুগণ, লাল সালাম। আমি আমার জীবনে প্রথম বাংলা ভাষণ করতে যাচ্ছি। হয়তো আপনাদের একটু আশ্চর্য লাগছে নেপাল থেকে এসে বাংলায় ভাষণ দিচ্ছে। আমি এতটুটুকু বাংলা শিখেছি সেজন্য সুযোগ পেয়েছি বলে প্রয়োগ করছি।
বাঙালি জনগণের সংগ্রামী ঐতিহ্যের সাথে সংহতি জানানোর জন্য আমি বাংলায় বলতে চাইছি।
কমরেড ও বন্ধুগণ, প্রথমত, আমাদের পার্টিকে কনভেনশনে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য পার্টির পক্ষ থেকে আমি বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলকে ধন্যবাদ জানাই ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি।
কমরেডস, আপনাদের এ কনভেনশন চলার সময় বিশ্বপরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল হতে যাচ্ছে। আমরা সবাই দেখছি, বিশ্বের অন্তর্দ্বন্দ্বগুলো ঘনীভূত হতে যাচ্ছে বা শার্প হতে যাচ্ছে, পুঁজি এবং শ্রমের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব হোক বা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর মধ্যেকার দ্বন্দ্ব হোক বা সাম্রাজ্যবাদী ও উৎপীড়িত রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব হোক - এসবই এখনকার বিশ্বে তীব্রতর বা শার্প হতে যাচ্ছে। সাথে সাথে এখনকার বিশ্ব বাজারে যে অর্থনৈতিক সংকট আসছে তাতে দেখা যাচ্ছে যে চলমান পুঁজিবাদী বা সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা এ অন্তর্দ্বন্দ্বগুলো সমাধান করতে পারবে না বরং আরও বাড়িয়ে দেবে।
এ থেকে প্রমাণিত হচ্ছে যে, পুঁজিবাদ এ সমাজকে এগিয়ে নিতে পারবে না। এটা ব্যর্থ হয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ ব্যর্থ হয়েছে। এরা জনগণকে মুক্তি দিতে পারবে না। এবং বিশ্বে যতগুলো দ্বন্দ্ব আছে তার সমাধান করতে পারবে না।
সাথে সাথে এটাও প্রমাণিত হচ্ছে যে, একমাত্র বিকল্প হচ্ছে মার্কসবাদ বা সমাজবাদ। সমাজবাদ বা মার্কসবাদ ছাড়া এ বিশ্বের উন্নয়ন সম্ভব নয় - এখনকার তীব্র সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এ ধারণা করছি।
কমরেডগণ, এ পরিস্থিতিতে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে কোনো না কোনোভাবে সংগ্রাম এগিয়ে চলছে। এ সংগ্রামের পেছনে মূল কারণ হচ্ছে তিনটি দ্বন্দ্ব, যা আমরা আন্তর্জাতিক হিসেবে দেখছি। পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, আমেরিকা, জাপান বা বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে হোক না কেন, যেখানেই সংগ্রাম চলছে তার কারণ হলো এ তিনটি দ্বন্দ্ব - সাম্রাজ্যবাদ, উৎপীড়িত রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব।
এতে বোঝা যাচ্ছে যে, বিশ্বপরিস্থিতি বিপ্লবের জন্য ম্যাচিউর হতে চলেছে, মানে বিপ্লব ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই এবং বিশ্বে বিপ্লবী পরিস্থিতি তৈরি হতে যাচ্ছে - এটাই আমরা বুঝি। আর যখন বিশ্বব্যাপী এ বিপ্লবী পরিস্থিতি ক্রমাগত পরিপক্ক হতে চলেছে তখনই বাসদের কনভেনশন চলছে। আমরা বিশ্বাস করি, এ কনভেশন বিশ্বের চলমান দ্বন্দ্বগুলোর সমাধান করে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য প্রয়োজনীয় মতাদর্শিক, রাজনৈতি লাইন ও বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় বিপ্লবী লাইন গ্রহণ করতে পারবে। এটা আমাদের পার্টির পক্ষ থেকে শুভকামনা।
কমরেডস, আমি নেপালের একটি বিপ্লবী পার্টির পক্ষ থেকে এসেছি।
আপনারা সবাই জানেন, নেপালে কি হচ্ছে বা কি চলছে। শুধু আপনারা না আমি যেখানেই যাই না কেন নেপালে বিপ্লব কি চলছে কোথায় পৌঁছেছে, বিপ্লব সফল হবে কি না - এ প্রশ্নগুলোই সবখানে শুনতে পাই। আমি জানি, আপনাদেরও সবারই নেপালের বিপ্লব সম্পর্কে জানতে ইচ্ছা করছে। সে কারণে সুযোগ পেয়েছি বলে আমি আপনাদের কাছে নেপালের এখনকার পরিস্থিতি এবং নেপালের নয়া গণতান্ত্রিক বিপস্নব সম্পকেê কিছু বত্ত্নব্য রাখবো।
কমরেডস, আপনারা জানেন, আমরা ১০ বছর ধরে নেপালে গণযুদ্ধ এগিয়ে নিয়েছি।
একটা নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে আমরা নেপালের সংগ্রামের স্বরূপটা একটু বদলে দিয়েছি। নেপালের বিপ্লবের স্বরূপ একটু বদলে দেওয়ার কারণে সারাবিশ্বে নেপালের বিপ্লব নিয়ে কিছু সংশয় তৈরি হয়েছে। হয়তো বাংলাদেশে আপনাদের মাঝেও কোনো না কোনো সংশয় থাকতে পারে। হয়তো সাম্রাজ্যবাদীরা বা সম্প্রসারণবাদীরা প্রচার করছে যে, নেপালের মাওবাদীরা মূলধারায় চলে এসেছে, পার্লামেন্টারি মূলধারায় এসে মাওবাদীরা বিপ্লব ছেড়ে দিয়েছে। হতে পারে, আপনাদের মনেও কোনো সংশয় আছে।
কারণ, আগে এক ধরনের সংগ্রাম চলছিল কিন্তু এখন এগুলো কি চলছে? এখন তো সংগ্রাম চলছে পার্লামেন্টে বা সংবিধান সভার ভবনে। কি ধরনের সংগ্রাম চলছে তা আপনারা ভাল করে ধরতে পারছেন না। নেপালের বিপ্লব একটা আশাবাদের কেন্দ্র হিসেবে ছিল, কিন্তু এখন সেখানে কি হয়েছে তা নিয়ে আপনাদের একটা শংকা হতে পারে। সেজন্য এসময়ে সেখানকার অবস্থা কি বা বিপ্লবের অবস্থান কি সে সম্পর্কে আমি আপনাদের সামনে কিছু বলব।
আমরা মনে করি, নেপালে ১০ বছরের গণযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯ দিনের যে গণঅভ্যুত্থানটা হলো সেটা দিয়ে নেপালের রাজতন্ত্র খতম হয়েছে।
রাজতন্ত্র খতম হয়েছে এটা সবাই জানে, কিন্তু আমরা মনে করি নেপালের বিপ্লব পূর্ণ হয়নি। কেননা, সামন্ততন্ত্রের প্রতিনিধি সংস্থা হিসেবে রাজতন্ত্র খতম হলেও নেপালের জনগণের হাতে ক্ষমতা পুরোপুরি আসেনি। সে কারণে আমি আপনাদের সামনে এটা স্পষ্ট করতে চাই যে, একটা বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটলেও নেপালের জনগণের হাতে এখনো ক্ষমতা আসেনি বা নেপালের জনগণ বিজয়ী হয়নি। সেই বিজয়ের জন্যই এখনও সংগ্রাম চলছে, এটাই আমি প্রথমে আপনাদেরকে জানাতে চাই।
কমরেডস, আপনারা জানেন, আমরা সংবিধান সভায় আছি।
নেপালের রাজতন্ত্র খতম হওয়ার পর আমরা বলেছিলাম, নেপালের কাঙ্ড়্গিত পরিবর্তন, গণতান্ত্রিক পরিবর্তন বা আমরা যাকে নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব বলি তার জন্য সংবিধান সভায় সংগ্রাম করতে যাচ্ছি। আপনারা জানেন, সংবিধান সভাতে আমাদের পার্টি সবচেয়ে বড় পার্টি হয়ে দাঁড়িয়েছে, প্রায় ৪০ শতাংশের মতো আসন আমাদের হাতে আছে। এটা বা এ সংখ্যাই নেপালের প্রতিক্রিয়াশীল সামন্ততান্ত্রিক শক্তি, ওখানকার কম্প্রাডর বুর্জোয়া, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এমকি ভারতীয় আধিপত্যবাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ালো। ওরা মনে করতো সংবিধান সভায় মাওবাদীকে নিয়ে গেলে সবচেয়ে ছোট পার্টি বনে যাবে, তারপরে নেপালের মাওবাদী আন্দোলনটা উবে যাবে। সেজন্য সংবিধান সভাতে তারা আমাদেরকে স্বীকার করে নিয়েছিল।
যেহেতু, যুদ্ধে তারা আমাদেরকে বা নেপালী জনগণকে পরাজিত করতে পারলো না তাই, সংবিধান সভা থেকে এটাকে একটা সংসদীয় পার্টি বানিয়ে বা একটা কম্প্রাডর বুর্জোয়ার পার্টি বানিয়ে নেপালের বিপ্লবকে ধ্বংস করার চেষ্টা হিসেবে সংবিধান সভায় আমাদের স্বীকার করে নিয়েছিল। কিন্তু সংবিধান সভার নির্বাচনে আমাদের পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে উঠলে নেপালের সামন্ততান্ত্রিক দালাল পুঁজিপতি, বুর্জোয়া, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের সামনে আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ালো। আপনারা দেখেছেন যে, সংবিধান সভার নির্বাচনে আমাদের পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরও আমাদের পার্টিকে ৪ মাস সরকারে যেতে দেয়া হয়নি। সেখানে অনেকগুলো ষড়যন্ত্র হয়েছে। সংবিধান সভাতে সবচেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আসার পরও তারা একটা দলকে সরকারে যেতে দিল না, এখান থেকেই বোঝা যায় তাদের গণতন্ত্রটা কি? আসলে এটা গণতন্ত্রের নামে উপহাস।
তখন আমরা আবার রাজপথের সংগ্রামকে তীব্র করে তুললে তারা বাধ্য হয়ে আমাদেরকে সরকারে আসতে দেয়, আমরা সরকারে গিয়েছি। কিন্তু তাদের ধারণা ছিল সরকারে গেলে টাকা-পয়সা, সুযোগ-সুবিধা, গাড়ি-বাড়ি ইত্যাদি সুবিধার ভিতরেই মাওবাদীরা ফুরিয়ে যাবে বা খতম হয়ে যাবে। কিন্তু তাদের সে ধারণা ছিল ভুল, আমাদের পার্টি বিপ্লবের জন্য সংগ্রামের বিভিন্ন পথ ধরে এগিয়ে চলছে। সরকারে থাকার সময় আমরা যে ধরনের কর্মসূচি দিয়েছি তা বিপ্লবী কর্মসূচি নয়। কারণ, বিপ্লবতো পূরণ হয়নি।
আমরা কিছু সংস্কারের কর্মসূচি দিই এবং কতগুলো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত আমরা নিতে শুরু করি। সেদিকে আলোকপাত করলে সংবিধান সভার নির্বাচনে মাওবাদীদের এগিয়ে থাকা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের, ধারণার বিপরীত।
সরকারে যাওয়ার পর আমাদের প্রতি জনগণের সমর্থন আরও বেড়ে যায়। এটাও তাদেরকে ভাবিয়ে তুলল। তারপরে ষড়যন্ত্র করে আমাদেরকে সরকার থেকে বের করে দেওয়া হলো।
আমরা তখন ছোট একটা কথা বলেছিলাম - আপনারা সবাই জানেন নেপালের কোতোয়াল বা সেনাপতির টেনিউর বা কার্যকাল শেষ হয়ে গিয়েছিল, সরকার যদি টেনিউরকে এক্সটেনড না করতো সে অফিস কন্টিনিউ করতে পারতো না। তখন আমরা ইউএমএলকে (নেপালের অপর প্রভাবশালী বামপন্থি দল, বর্তমানে ক্ষমতাসীন) বললাম সেনাপতিকে বের করে দিয়ে সেকেন্ড ইন কমান্ডকে দায়িত্বে নিয়ে আসতে, তারা রাজী হল। তারপর আমরা নেপালি কংগ্রেসের কাছেও একই প্রস্তাব দিলাম, তাদের একটা সেকশন বললো, ঠিক আছে, সে লোকটা দুর্নীতিবাজ এবং গণআন্দোনের সময়ে গণবিরোধী কাজও করেছে, সেকারণে তাকে বের করে দেওয়াই ভাল - এভাবে তারা সমর্থন দিল। অন্য কতগুলো পার্টি ছিল তারাও মূলত কমবেশি সমর্থন দিল। সেই সমর্থনের ভিত্তিতে আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম যে, আমরা কোতোয়ালকে বের করে দেব এবং তার জায়গায় সেকেন্ড ইন কমান্ডকে নিয়ে আসব।
যখন আমরা এই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হলাম তখন জানা গেল যে সেসময় চীন সফররত ইউএমএল এর এক নেতাকে ভারত থেকে জানিয়েছে, খবরদার এমন কাজ করবে না এবং নেপালী কংগ্রেসকেও ভারত থেকে ফোন করে জানানো হল, খবরদার এ কাজটা করবে না। সে অবস্থায় তারা তাড়াতাড়ি পুরোপুরি সমর্থন প্রত্যাহার করে নিল। কিন্তু আমাদের পার্টি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তার টেনিউর বৃদ্ধি করা হবে না। যখন আমরা এ সিদ্ধান্তে অটল থাকলাম তখন তাৎক্ষণিকভাবে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ অন্যান্য পার্লামেন্টারি পার্টিগুলোকে এই মেসেজটা দিল যে, রাষ্ট্রপতিকে উঠিয়ে বা ব্যবহার করে তোমরা কিছু কর না হলে মাওবাদীরা ক্ষমতা দখল করবে। সন্ত্রাস সৃষ্টি করে তারা বলল রাষ্ট্রপতিকে ব্যবহার করা না হলে নেপাল মাওবাদীদের হাতে চলে যাবে।
তখন ২২ দলের সবাই একাট্টা হল, মার্কিন সহায়তায় এবং ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের নকশা অনুযায়ী ২২ দলের গঠিত ঐকমত্য মাওবাদীদের সিদ্ধান্ত উল্টিয়ে দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করল, রাষ্ট্রপতি সেই সিদ্ধান্ত উল্টিয়ে দিল। সে পরিস্থিতি এমন ছিল যে, আমরা সংসদে মাইনরিটিও ছিলাম না বা আমাদের উপর থেকে অন্য কোন দলও সমর্থন প্রত্যাহার করেনি। তবুও আমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে এলাম যে, বিপ্লবের জন্য জনগণের সাথে যাব কিন্তু বিদেশী প্রভূদের সামনে মাথা নত করব না। এটা সাম্রাজ্যবাদী বা সম্প্রসারণবাদীদের জন্য বড় একট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ালো। এর পর যখন আমরা সরকার থেকে বের হয়ে এসেছি তখন তারা আমাদের বিরুদ্ধে অনেক ধরনের ষড়যন্ত্র করা শুরু করেছে।
আপনারা হয়তো শুনেছেন যে, নেপালি কংগ্রেস ইউএমএল-এর কাছে এ প্রস্তাব করেছিল যে এবারের সংবিধান সভাটা ডিসলভড করে বা ভেঙে দেওয়া হোক। কেননা এখানে মাওবাদীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, ৪০ ভাগ। ফলে প্রতিক্রিয়াশীলদের ইচ্ছানুযায়ী এখানে সংবিধান তৈরি হতে পারে না, এখানে সংবিধান তৈরি হবে জনগণের ইচ্ছানুযায়ী। কেননা মাওবাদীরা জনগণের বিরুদ্ধে সংবিধান তৈরি করবে না। এক্ষেত্রে মাওবাদীরা সংবিধান সভায় সমস্যা সৃষ্টি করছে, তাই এ সংবিধান সভা ডিসলভড করে দেওয়া হোক।
ইউএমএল-এর একজন উপ-সভাপতি এ ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দিয়েছে। এ প্রস্তাব শুধু নেপালি কংগ্রেস করেছে তা নয়, এটা সরাসরি ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ থেকে এসেছে। শুধু এটা নয়, যখন নেপালে রাষ্ট্রপতির শাসন জারির কথা উঠেছে তখন ভারত থেকে নেপালি আর্মির জন্য অস্ত্র ও গোলাবারম্নদ সরবরাহ করা হয়।
আপনারা জানেন নেপালে এখন শান্তিপ্রক্রিয়া চলছে, আমাদের সেনারা ক্যান্টনমেন্টে আছে আর তাদের সেনারা তাদের ব্যারাকে আছে, এখন কোনো যুদ্ধ নাই। তাহলে অস্ত্র ও গোলাবারুদ দরকার কেন, ভারত কেন সেগুলো পাঠাচ্ছে? আপনারা হয়তো বোঝেন, চলমান শান্তিপ্রক্রিয়া বা সংবিধান সভা নেপালি জনগণের পক্ষে কাজ করবে এটা ভারত ভাবতে পারে না।
কারণ ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীরা তাদের প্রতিবেশী যে কোনো দেশ - নেপাল হোক, বাংলাদেশ হোক, মালদ্বীপ হোক, শ্রীলংকা হোক বা সিকিম হোক - যেটা প্রতিবেশী ছিল এখনতো ওদেরই হয়ে গেছে - এর উন্নয়ন বা সেখানকার জনগণের সার্বভৌমত্বকে দেখতে চায় না। সব সময় তারা প্রতিবেশী দেশের জনগণকে দমন করতে চায় ও তাদের হেগেমনি (আধিপত্যকে) বিস্তার করতে চায়। আমি এখানে এসে একটা ইংরেজি রিপোর্ট দেখেছি - সেটা সত্যি কিনা জানি না - ঢাকাতে খোদ ভারতীয় সেনা কমান্ডো রাখার কথা বলছে, তারিখটা ঠিক মনে নেই। এরকমটা নেপালেও চলে। এর আগেও তাদের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য নেপালের ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে তাদের আর্মি কমান্ডো রাখার কথা বলেছিল।
একইভাবে দেখছি বাংলাদেশেও একই প্রস্তাব তারা করছে। এটা হতে পারে। আমি এটা বলতে চাই যে, প্রতিবেশী দেশের কাছে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের প্রত্যাশা হলো সে সবাইকে নিজের হাতে রাখতে চায়, জনগণের মুক্তিযুদ্ধ বা সংগ্রামী আন্দোলনকে দেখতে চায় না, জনগণের পক্ষে আন্দোলনটা এগিয়ে চলুক তা তারা চায় না। সব সময় তাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকুক তাই তারা দেখতে চায়। এ পরিস্থিতিতে সরকারের মধ্যে থেকে বা বের হয়েও যখন আমরা জনগণের পক্ষে আমাদের অবস্থান নিয়েছি তখন তাদের জন্য আমাদের পার্টি একটা বাধা হয়ে দাঁড়াল।
সে কারণে তারা সংবিধান সভাকে ডিসলভ করার প্রস্তাব করেছে এবং এ প্রস্তাব যে ভারতের কাছ থেকেই এসেছে এটাও স্পষ্ট। তারপর ভারত থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আপনারা শুনেছেন নেপালের প্রধান সেনাপতি ভারতে গেলে ভারতের পক্ষ থেকে তাকে বলা হয়েছে যে, নেপালের মাওবাদীদের খতম করার ক্ষমতা একমাত্র নেপালী সেনাবাহিনীর হাতেই আছে, রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ তা সম্ভব নয়। সে কারণে মাওবাদীদের আপনাদেরকেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, ঐক্যবদ্ধভাবে আপনারা তা করবেন। এভাবে নেপালের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারত সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছে।
আপনারা জানেন, নেপালে একটা কম্প্রিহেনসিভ এগ্রিমেন্ট হয়েছিল যে, নেপালি সেনা এবং রেভুলিউশনারি পিপল’স আর্মি - এ দুটোকে মিলিয়ে ন্যাশনাল আর্মি গঠন করা হবে। কিন্তু এই চুক্তির বিপেক্ষ ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও ভারতীয় সেনাপ্রধান বলেছে, মাওবাদী সেনাদেরকে পুরোপুরি ইন্টিগ্রেশন করবেন না, একটা একটা করে আলাদা করে করতে গেলে ঠিক আছে, নেপালী নাগরিকদের যেভাবে করে থাকেন। কিন্তু মাওবাদীদের নেপালী সেনার মধ্যে পুরোপুরি অন্তভুক্ত করবেন না। এভাবে তারা প্রত্যক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করেছে। কিন্তু এসব ঘটলেও নেপালের পার্টিগুলো কিছুই বলতে পারছে না, বাইরে থেকে প্রভুরা যা বলছে সেটাই ঠিক ধরে নিয়ে সমর্থন করে বসছে।
এ পরিস্থিতিতে দেখা যাচ্ছে যে, আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের সহায়তায় ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ, নেপালের সামন্ততান্ত্রিক দালাল পুঁজিপতি, দালাল বুর্জোয়া ও সেখানকার আমলাতান্ত্রিক শক্তি সবাই আমাদের বিপক্ষে একজোট হয়ে গেছে। এভাবে আমাদের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে তারা নেপালি জনগণের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা ও বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষার ওপর আঘাত হানছে। আমরা এখন এই সিদ্ধান্তের ওপর চলছি যে, অবস্থা যাই হোক না কেন আমরা শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে সংবিধানসভা থেকে এক নতুন সংবিধান তৈরি করে নেপালি জনগণের হাতে দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাব। সংবিধান সভা থেকে শান্তিপূর্ণভাবে একটা পথ বের করতে মাওবাদীরা রাজি থাকার পরও প্রতিক্রিয়াশীলরা যদি সেখানে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করে বা আর্মি লাগিয়ে বিপ্লবকে ধ্বংস করতে চায় তাহলে যে নেপালীরা ১০ বছর পর্যন্ত গণযুদ্ধ করেছে তারা চুপ করে বসে থাকবে না। আমাদের পার্টি জানে টিট ফর ট্যাট, বাংলা প্রবাদে এটাকে কি বলে তা আমি জানি না।
দুশমন যে-ভাবে আঘাত করবে সে-ভাবেই আমরা তার জবাবটা দেব। এ দিক থেকে আমি আপনাদের কাছে আমাদের বিশ্বাসটা জানাতে চাই যে, নেপালের বিপ্লব এগিয়ে গেছে, পিছিয়ে যায় নি। এগিয়ে গেছে মানে রাস্তাটা আঁকা বাঁকা পথে গেছে, এভাবেই যেতে হবে। কারণ, বিপ্লবের রাস্তা সোজা হয় না। মার্কস, লেনিন, মাও সবাই বিপ্লবের লাইনটা বলেছেন কিন্তু, নেপালের বিপ্লব কি ধরনের হবে সেটা বলেননি।
সে লাইনটা আমাদেরই বানাতে হবে, আমরা বানাচ্ছি। বাংলাদেশের বিপ্লব কি ধরনের হবে সেটা আপনাদেরকেই বানাতে হবে, আপনারা বানাবেন। সে কারণে আমরা কখনও এদিকে যাচ্ছি, কখনও ওদিকে যাচ্ছি। এটা যাওয়ার দরকারও আছে, অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির বাধ্যতা আছে, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতাও আছে। এসব হলেও আমরা বিপ্লবটাকে ছাড়ব না, বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, এগিয়ে নিয়ে যাব - এটা আমাদের পক্ষ থেকে আপনাদের সামনে একটা কমিটমেন্ট।
আমি আপনাদেরকে আরেকটি কথা স্পষ্ট করে বলতে চাই, বিশ্বায়নের বর্তমান পরিস্থিতিতে নেপালের মতো একটা ছোট দেশে বিপ্লবের কথাটা আগে ভাবতে হচ্ছে। সে কারণে আমাদের বিপ্লব শুধু নেপালি জনগণের বিপ্লব নয় এটা বাঙালি জনগণের বিপ্লব, আমি এটা আপনাদের কাছে বলতে চাই। এবং এখানে আপনারা যে চেষ্টা চালাচ্ছেন তা শুধু বাঙালি জনগণের বিপ্লব নয়, এটা নেপালি উৎপীড়িত জনগণেরও বিপ্লবও বটে। সে কারণে শুধু নেপালি জনগণ ও বাঙালি জনগণ নয়, বিশ্বের বিপ্লবী জনতার ঐক্যবদ্ধ ও সংহত হওয়া দরকার। কারণ, নেপালের এখনকার বিপ্লবের বিরুদ্ধে বিশ্বের সকল প্রতিক্রিয়াশীলরা একজোট হতে যাচ্ছে।
তখন বিশ্বের সকল শ্রমজীবী, নিপীড়িতসহ বিশ্বের সকল শ্রমিকশ্রেণীর মধ্যেকার ঐক্য ও সংহতি মজবুত হওয়া দরকার। অভ্যন্তরীণভাবে আমরা দৃঢ় এটা আপনারা সবাই জানেন, কিন্তু এখানকার পরিস্থিতিতে নেপালী বিপ্লবের প্রতি আপনারা যত বেশি আওয়াজ দেবেন তত আমাদের পক্ষে সুবিধা বেশি হবে - এটা আপনারা মনে রাখবেন। একথা বলেই আমি আমার বত্ত্নব্য এখানেই শেষ করলাম, লাল সালাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।