আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্প: জোকার

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ

সকালের মিষ্টি রোদে কাবুল শহরটি ঝলমল করছিল । যদিও বাতাসে ভাসছিল বারুদের গন্ধ । রাস্তায় অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের বুক কাঁপানো কর্কস আর্তনাদ।

দূরে ভয়ানক বিস্ফোরনের পর কালো ধোঁওয়ার কুন্ডলি উড়ছিল। শীতের নীল আকাশটা ক্রমশ ঢেকে যাচ্ছিল কালচে ধোঁওয়ায়। কারণ, ১৭৪৭ সালে আহমেদ শাহ দুররানী যে আধুনিক আফগান রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, সেই রাষ্ট্রটি এখন ইঙ্গ-মার্কিন দংশনে জর্জরিত। আজ সকাল থেকে বিস্ফোরনের শব্দে বেশ ক’বার কেঁপে উঠেছে কাবুল শহর। রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড বসিয়েছে; চেক পোস্ট বসিয়ে ন্যাটোর সৈন্যরা তল্লাশী চালাচ্ছে ।

তল্লাশীর শিকার নিরীহ আফগান জনগন শীতে থরথর করে কাঁপে। শীতকালের দিকে সাধারনত আফগানিস্তানের তাপমাত্রা আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পায় । দেশটির অধিকাংশ অঞ্চলই পর্বতময়। শীতের সংক্রমনে নিঃস্তব্ধ অরণ্যপাহাড় জমে সাদা হয়ে থাকে। সেই নিঃস্তব্ধ অরণ্যপাহাড়ে জমে কাঠ হয়ে থাকে লুকিয়ে থাকা একরোখা তালিবান গেরিলারা ।

তবু তালিবানদের সর্তক থাকতেই হয়-মাথার ওপর ন্যাটো হেলিকপ্টার চক্কর দেয়। পশ্চিমা সভ্যতার ত্রাস কট্টরপন্থী তালিবান মুজাহেদিন দমনের ছুতায় ২০০১ সালের মাঝামাঝি থেকে ন্যাটোবাহিনী আফগানিস্তানে অনুপ্রবেশ করতে থাকে; মূল উদ্দেশ্য আফগানিস্তানের প্রকৃতিক সম্পদের ওপর সাম্রাজ্যবাদী শ্বেতাঙ্গদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, সেই সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ায় ইঙ্গ-মার্কিন প্রভাববলয় সংহত করা এবং আফগান জনগনের ওপর কৃত্রিম যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ব্যবসা চাঙা রাখা। এদিকে যত দিন যাচ্ছে তালিবান প্রতিরোধ তত তীব্র হয়ে উঠছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর জেনারেল ম্যাকক্রিষ্টাল। তিনি গত অক্টোবরে (২০০৯) আফগানিস্তানে সৈন্য বাড়ানোর অনুরোধ জানান।

ওবামা প্রশাসন ডিসেম্বরে সিদ্ধান্ত জানায় । জেনারেল ম্যাকক্রিষ্টাল ৩ বছর মেয়াদে ৪০,০০০ মার্কিন সৈন্য পাঠানোর কথা বলেন; ওবামা প্রশাসন ১৮ মাস মেয়াদে ৩০,০০০ সৈন্য পাঠানো হবে বলে তাদের সিদ্ধান্ত জানায় । আফগানিস্তানে তালিবানদের শক্তি বৃদ্ধি উদ্বেগজনক। তবে পশতুনরা এখনও প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের বিরোধীতা করেনি। পশতুনরা তীব্র গ্লানিতে ভুগছে ।

কারণ তালিবানদের ক্ষমতায় যেতে সাহায্য করেছিল তারা। তালিবানদের চরম দুঃশাসন তারা ভোলেনি। (তথ্যসূত্র: রাজকূট। কালের কন্ঠ। ১০ ফেব্রুয়ারি।

২০১০) হাকিম ফারিদুন। পাতলা বাদামি চুল,চৌকো মুখ আর ঈষৎ নীলাভ চোখের ২২ বছর বয়েসি এক লম্বা ফরসা পশতুন যুবক; সকালের মিষ্টি রোদে বারুদের গন্ধের ভিতর কাবুলের রাস্তায় ফুটপাত ঘেঁষে দ্রুত পায়ে হাঁটছিল । হঠাৎই দূর থেকে ন্যাটোর সশস্ত্র সৈন্যদের দেখতে পেয়ে থমকে যায় সে। ওর বুকটা ধক করে ওঠে। ব্যারিকেডের ওপাশে ইউরোপীয় সৈন্যরা সতর্ক পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে ।

ফারিদুন জানে ওদিকে না যাওয়াই ভালো। সে উপায় নেই । ও পথ ধরেই এখন যেতে হবে। অজানা আশঙ্কায় এই শীতের সকালে ফারিদুন ঘেমে ওঠে। পশতুন যুবক ফারিদুন হকিম বয়েসে তরুণ।

এ বয়েসি ছেলেরা তালিবানদের সঙ্গে যোগ দেয়। তবে যতটা না তালিবানি আদর্শের জন্য তার চেয়েও বেশি জন্মভূমির স্বাধীনতা পুনুরুদ্ধারে। আফগান তরুণ-যুবকদের ইঙ্গ-মার্কিন কর্তৃপক্ষ সন্দেহ করে। প্রায়ই ইঙ্গ-মার্কিন সৈন্যরা আফগান তরুণ-যুবকদের মিলিটারি ট্রাকে তুলে নিয়ে যায় । এরা কেউই ফিরে আসে না।

তাদের কারও কারও লাশ হয়তো কাবুল নদীতে ভাসে ...কাক-শকুনে ঠুকরে খায় সে লাশ ... ফারিদুন চলার গতি শ্লথ হয়ে আসে। সে উদ্বেগ বোধ করে। আনোশের মুখটা ভেসে ওঠে। ফারিদুনের বড় বোন আনোশে ক’দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে রয়েছে। ফারিদুন-এর হাতে নীল রঙের একটি ফ্লাক্স।

তাতে শোরওয়া (স্যূপ) । ফারিদুন-এর মা তৈরি করে দিয়েছে। ফারিদুন-এর মা বিকেলে হাসপাতালে যাবে। ততক্ষণে যদি ফারিদুন-এর বাবা সেরে ওঠেন। আজ সকালে বিস্ফোরনের বিকট শব্দে ফারিদুনের বাবা বারবার মূর্চ্ছা যাচ্ছেন।

হার্টের সমস্যা আছে বৃদ্ধ রাজাব নাজজির। সকালে আফিজা আর আফিজার বিধবা মা এসেছে। আফিজারা ফারিদুনদের বাড়ির উলটো দিকের বাড়িতে থাকে। তারাই এখন রাজাব নাজজির মাথায় পানি ঢালছে। ২০০১ সালের পর থেকে কাবুল শহরে পানির সঙ্কট।

কাবুল বিমান বন্দর এবং কাবুলের ন্যাটোবাহিনীর প্রধান কার্যালয়ে ও বিদেশি সৈন্যদের ব্যারাকে পানির লাইন বসানোর পর থেকে শহরে পানির সঙ্কট তীব্র হয়ে উঠেছে। তাছাড়া তালিবান মুজাহেদিনরা প্রায়ই পানির পাইপ উপড়ে ফেলছে। হাসপাতালের দিক থেকে আসা বিস্ফোরনের ভোঁতা শব্দে ভেসে আসে। ফারিদুন চমকে ওঠে। তার মনে আনোশের মুখটা ভেসে ওঠে ।

পিঠেপিঠি ভাইবোন তারা। আনোশে অবশ্য এক বছরের বড়। তিন বছর হল বিয়ে হয়েছে আনোশের । ওর শ্বশুরের কাবুল বাজারে ফলের ব্যবসা আছে। আনোশের স্বামী বদরউদ্দীন গত বছর কাবুল শহরের খাজা বুঘরার কাছে তালিবানদের আত্মঘাতী হামলার সময়ে বিস্ফোরনে মারা যায়।

এই মর্মান্তিক ঘটনার পরপরই বিধবা গর্ভবতী শোকগ্রস্থ বোনকে নিয়ে এসেছিল ফারিদুন । তিনদিন আগে আনোশের প্রসব বেদনা ওঠার পর ওয়াজির আকবর খান হাসপাতালে ভর্তি করেছে। রোজই একবার হাসপালে যায় ফারিদুন । কখনও কখনও ফারিদুনের মা-বাবা; কখনও-বা আফিজা আর আফিজার বিধবা মা আফসুন আরা ফল নিয়ে যায় । শোরওয়া নিয়ে ফারিদুন একাই যাচ্ছে হাসপাতালে।

সে একটা স্থানীয় একটা খবরে কাগজের অফিসে চাকরি করে। সাংবাদিক নয়। অত পড়ালেখা তার ভাগ্যে জোটেনি। ফারিদুন ‘পায়াম এ মোজাহেদ’ পত্রিকা অফিসের পিয়ন । আজও অফিস ছিল।

হাসপাতালে যাবে বলে অফিস যায়নি। ‘পায়াম এ মোজাহেদ’ পত্রিকার সম্পাদক মীর আমীর আব্বাস। তাকে যথেস্ট স্নেহ করেন বৃদ্ধ। জরুরি ছুটিছাঁটা মঞ্জুর করেন। একটা শ্বাস টেনে ফারিদুন চেক পোস্ট এর দিকে এগিয়ে যায়।

ন্যাটোর একজন সশস্ত্র সদস্য হাত তুলে থামতে বলে। এরা আটঘাট বেঁধেই নেমেছে। ৯ বছর ধরে আছে এদেশে। পশতু ভাষা শিখেছে। সৈন্যটি পশতু ভাষায় জিজ্ঞেস করে, অ্যাই, থাম! এদিকে কোথায় যাও? হাসপাতালে স্যার।

দুর্বল কন্ঠে ফারিদুন বলে। হাসপাতালে? হাসপাতালে কেন? তোমার পরিচিত কেউ কি উনডেড? অটোমেটিক কারবাইন হাতে আরেক সৈন্য এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে। না। ফারিদুন মাথা নাড়ে। ভীষন টেনশন হচ্ছে তার।

জিভ শুকিয়ে এসেছে। সৈন্যদের পিছনে মৃত্যুদূতের মতন থেমে থাকা কালো সবুজ রঙের একটা ট্যাঙ্কের ওপর চোখ আটকে যায়। সৈন্যটি চেঁচিয়ে উঠল। তাহলে? আমার বোন হাসপাতালে । ওহ্ ; ফ্লাক্স-এর ভিতর কি? শোরওয়া।

ফারিদুন বলল। আমার বোনের জন্য। দেখি। বলে একজন লালচে শুয়োমুখো ন্যাটো সৈন্য হাত বাড়ায়। কাঁপা কাঁপা হাতে ফারিদুন ফ্লাক্সটা এগিয়ে দেয়।

একজন ন্যাটো সৈন্য জিনিশটা নেয়। তারপর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। প্যাঁচ ঘুরিয়ে মুখ খোলে। উঁকি দিয়ে দেখে। তারপর তরলটুকু ফারিদুনের মাথায় ঢেলে দিতে থাকে।

ফারিদুন অনঢ় দাঁড়িয়ে থাকে। গরম শোরওয়া ওর মাথায় চুলে কপালে চোখে ছড়িয়ে পড়ে। তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করে সে। থরথর করে কেঁপে ওঠে। উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থার লোকজন হা হা হি সি করে হাসে।

একজন ন্যাটো সৈন্য বলে, অ্যাই, তুমি তালিবান-এর চর নও তো? না। সত্যি করে বল! ফারিদুন হকিম মাথা নাড়ে। উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থার একজন সৈন্য আদেশ দেয়: অ্যাই, জ্যাকেট খোল্ তুই । দেখি ভিতরে কি আছে। সময়টা শীতকাল।

নীল কাবুলি পোশাকের ওপর নীল জিনের জ্যাকেট পরেছিল ফারিদুন। ন্যাটো সৈন্যদের আদেশে সে ধীরে ধীরে জ্যাকেট খুলতে থাকে। জ্যাকেট খোলার পর আবার আদেশ হয়, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? পাজামা খোল্। ফারিদুন কেঁপে ওঠে। এমনি তল্লাশী করলেই পারে।

পাজামা খুলতে হবে কেন। খোল্! কখন গুলি করে- এই ভয়ে ফারিদুন পাজামার ফিতেয় হাত দেয়। লালচে শুয়োরমুখো উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থার সশস্ত্র লোকজন হা হা হি হি করে হাসে। এদেরই পূর্বপুরুষ যুদ্ধবাজ আলেকজান্দার। যিনি এই অঞ্চলে সেকান্দার নামে পরিচিত।

আজ থেকে ২,২০০ বছর আগে পশতুনদের প্রাচীন জনপদটি তছনছ করেছিল সেকান্দার ...তখনও আফগানিস্তানের নাম আফগানিস্তান হয়ে ওঠেনি। আফগানিস্তান শব্দটির মানে: ‘আফগানদের ভূমি’। দেশটির অধিকাংশ অধিবাসীই পশতুন; পশতুন শব্দটি আফগান শব্দেরই সমার্থক। বাঙালিরা যেমন বাংলাদেশি। তালিবান শব্দটি পশতু; অর্থ ছাত্ররা।

বহুবচন তালিব ... ঐতিহাসিকগনের অনুমান: আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল-এর প্রাচীন নাম ‘কম্বোজ’। ঐতিহাসিকগন আরও অনুমান করেন যে বর্তমান আফগানিস্তানেই অবস্থিত ছিল প্রাচীন ভারতের অস্মক রাজ্য। প্রাচীন ভারতের ষোড়শ জনপদের একটি অন্যতম সমৃদ্ধশালী রাজ্য ছিল অস্মক। অস্মক শব্দটি সংস্কৃত ‘অশ্ব’ থেকে উদ্ভূত বলে অনুমিত। বলাবাহুল্য, পর্বতময় অস্মক রাজ্যের অধিবাসীরা ছিল দুর্ধর্ষ ঘোরসওয়ার।

ঘোড়া বা অশ্ব এদের প্রাত্যহিক জীবনে জড়িয়ে আছে। ভারতবর্ষে মুগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট বাবর। তাঁর লেখা স্মৃতিকথায় ‘আফগান’ শব্দটি পাওয়া যায়। এরও আগে ষষ্ট শতকের প্রসিদ্ধ ভারতীয় জ্যোতির্বিদ বরাহমিহির প্রণীত বৃহৎসংহিতা গ্রন্থে ‘আভাগানা’ শব্দটির উল্লেখ রয়েছে। বিখ্যাত আরব পন্ডিত আলবিরুনীও ‘আফগান’ গোত্রের কথা উল্লেখ করেছেন।

দূরের পাহাড় থেকে শীতার্ত বাতাস ধেয়ে আসে। খালি গায়ে ফারিদুন এসব ভাবে কিনা বোঝা যায় না। তবে তার শীত করে। পায়জামার ফিতে খুলতে খুলতে তার হাত-পা কাঁপে। কানের কাছে উষ্ণতা টের পায়।

কপালের দুপাশের শিরা দপদপ করে লাফাচ্ছে। কন্ঠনালী শুকনো ঠেকে। শীতেও ঘেমে যাচ্ছে। হায় রে মোলআতন্ত্র। তোদের জন্য আজ আমার এই অপমান।

তোরা জঙ্গি হয়ে উঠলি বলেই এ দেশে বিদেশি সৈন্যরা ঢোকার অজুহাত পেল। আজ আমি নগ্ন হচ্ছি তোদের জন্য। ফারিদুন এভাবে ভাবল বটে - তবে সে জানে তালিবানরা আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সৈন্য হটাতে যুদ্ধ করছে। ওদের অবশ্যই সমর্থন দেওয়া উচিত। তবে তালিবানরা অতিরিক্ত কট্টরপন্থী।

তারা আফগানিস্তানের ক্ষমতায় এলে সাধারন মানুষের সর্বনাশ হয়ে যাবে। তালিবানরা মানবীয় প্রেম-ভালোবাসায় বোঝে না। পাশের বাড়ির ষোড়শী আফিজাকে ভালোবাসে ফারিদুন । অবশ্য মনে মনে। কেননা, কথাটা তালিবানদের কানে পৌঁছলেই সর্বনাশ।

সর্বত্র ওদের চর ঘুরঘুর করছে। তালিবানরা কখনও বিদেশি সৈন্যদের পরাস্ত করে কাবুল দখল করে নিতে সমর্থ হলে ওদের ভালোবাসার কথা জানাজানি হয়ে গেলে ওকে আর আফিজাকে পাথর মেরে ফেলবে নির্ঘাৎ। তবে সে সব পরের কথা। আফিজাকে যে ফারিদুন বিয়ে করবে সে উপায় কী। গত বছর ঠিক এই সময়ে খাজা বুঘরার কাছে এক বিস্ফোরনে আনোশের স্বামী বদরউদ্দীন মারা গেলে তার ঠিক একমাস পর গর্ভবতী শোকগ্রস্থ বিধবা বোনকে নিয়ে এসেছিল ফারিদুন ।

তারপর থেকে বিধবা বোনের দায়িত্ব কাঁধে। আফিজাকে যে ফারিদুন বিয়ে করবে সে উপায় কী। ফুটফুটে শিশুর মা হয়েছে গতকাল। শিশুটির ভবিষ্যৎও যে তার ওপরই নির্ভর করছে। আনোশে আর তার মেয়ের জন্য জীবন উৎসর্গ করবে ফারিদুন।

এ জন্য আফিজাকে বিয়ে কথা সম্ভব নাও হতে পারে। অসহায় নিকট আত্মীয়ের দেখভাল করা পশতুন ঐতিহ্য। ফারিদুন সহজে দেশিও ঐতিহ্য সহজে লঙ্ঘন করে না। তবে ফারিদুন জানে, দেশিয় ঐতিহ্য সবই যে ভালো তা কিন্ত নয়। ‘পায়াম এ মোজাহেদ’ পত্রিকার বয়স্ক সাংবাদিক ফারাজ কাশেম-তিনি উদার মনের মুক্তচিন্তার এক মানুষ।

চা নিয়ে তাঁর ডেস্কে গেলে নিজে থেকেই কত কথা বলেন প্রবীণ ওই সাংবাদিকটি। ফারাজ কাশেম প্রায়ই বলেন, দেশিয় ঐতিহ্য সবই যে গ্রহনীয় তা কিন্তু নয়, তাকে বুদ্ধিবিবেচনা দিয়ে পরখ করতে হয় রে ফারিদুন । যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়, নইলে জগতে অন্যদের তুলনায় পিছিয়ে পড়তে হয়। এই দেখ না, দিনেদিনে উত্তর কোরিয়া কত এগিয়ে গেল; ইঙ্গমার্কিন যুদ্ধবাজদের তাদের দেশ আক্রমনের সাহস নেই, যদিও উত্তর কোরিয়ার মাটির তলায় আফগানিস্তানের মতোই প্রচুর সম্পদ রয়েছে । উত্তর কোরিয়রা পারমানবিক শক্তিবলে বলীয়ান বলেই ইঙ্গমার্কিন যুদ্ধবাজদের সে দেশ আক্রমনের সাহস নেই ।

আর আমরা? আজও আমরা মধ্যযুগীয় ঐতিহ্য আঁকড়ে ধরে আছি; কই আমরা বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে পারমানবিক শক্তি অর্জন করে এগিয়ে যাব, না আমরা মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক জীবনধারায় আবদ্ধ হয়ে আছি । আর মুসলিম বিশ্বের দিকে চেয়ে দেখ না,-ইরাক-ইরান নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে শক্তি ক্ষয় করল। ওই মুসলিম দেশ দুটি একতাবদ্ধ হয়ে থাকতে পারলে ইসরাইল অত থ্রেট দেওয়ার সাহস পেত কি? আমার মনে হয় কি জানিস, মুসলমানের ভরাডুবির কারণ সময়ের দাবী অনুধাবনে ব্যর্থ হওয়া। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে না যাওয়া। অস্টম-নবম শতকে বাগদাদ অন্যদের তুলনায় অনেক উন্নত ছিল ।

কিন্তু বারবার সে কথা বলে আজ আর কী লাভ! অবশ্য সে সংস্কৃতি ছিল ধারকবাহক ছিল পারশিক ভূস্বামীরা, জনগন নয়। আর সেই বাগদাদী সংস্কৃতির ওপর ভর করেছিল মোল্লাতন্ত্রের আছড়। আব্বাসীয়দের সময় ইসলামিক ইনকুইজিশন অবধি ইমপোজ করা হয়েছিল। মোল্লাতন্ত্র আমাদের দেশে ইসলামিক ইনকুইজিশন ইমপোজ করার পাশাপাশি ভূস্বামীদের স্বার্থও রক্ষা করল। ভূস্বামীরা পশতুন জনগনকে শিক্ষিত করে তুলল না।

কেন? জনগনকে শিক্ষিত বিজ্ঞানমনস্ক করে তুললে তারা যে সামন্তবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে। ভূস্বামীদের নিরাপদ গদিটি খানখান হয়ে ধ্বসে পড়বে। অথচ কেবলমাত্র অভিজাত ভূস্বামীদের স্বার্থ রক্ষা ইসলাম অনুমোদন করে না। সপ্তম শতকের আরব উপদ্বীপের আরব বেদুইনরা ছিল বঞ্চিত হতদরিদ্র; অপরদিকে সম্পদশালী বণিক কুরাইশরা ছিল অতিরিক্তমাত্রায় ভোগী; ইসলামের নবী অত্যন্ত ব্যথিত চিত্তে এ অনাকাঙ্খিত বৈষম্য লক্ষ করেছিলেন। আরব সমাজে আল্লাহর অনুশাসন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি পার্থিব বৈষম্য দূর করাও ছিল ইসলামের নবীর অন্যতম লক্ষ।

তিনি মানুষকে বারবার ‘মধ্যপন্থা’ অবলম্বনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সুরা ফাতিহার ‘সিরাতুল মোস্তাকীম’ শব্দটা মানে জানিস তো? ‘সিরাতুল মোস্তাকীম’ অর্থ হল সরল পথ। ইসলামের নবীর দিব্যদৃষ্টি ছিল। হায়, নবীর কথা কেউ মানল না রে ফারিদুন। আফগানিস্তানে মোল্লাতন্ত্র নবীর আদেশ বিস্মৃত হয়ে ভূস্বামীদের স্বার্থই রক্ষা করল।

পশতুন জনগনকে সূদীর্ঘকাল কুসংস্কারে আচ্ছন্ন করে রাখল। আফসোস। তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যেও তাইই হয়েছিল রে ফারিদুন। অটোমানদের চালচলন ছিল মধ্যযুগীয়; তাদের অধীন ছিল ফিলিস্তিন। শাসন শোষনের কারণে অটোমান সুলতানরা ফিলিস্তিনকে অনাধুনিক পশ্চাৎপদ ও শিক্ষাবঞ্চিত করে রেখেছিল।

যে কারণে ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর দুর্বল ও ক্ষয়িষ্ণু ফিলিস্তিনে ইহুদিদের অনুপ্রবেশ করাতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের বেগ পেতে হয়নি। ভারতবর্ষের অধিকাংশ মুসলমান আজও মুগল ঐতিহ্যকেই শ্রেয়তর আর্দশ মনে করে। মুগল ও অটোমানরা আসলে একই মুদ্রার এপিঠওপিঠ। তখন বললাম না যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। নইলে জগতে পিছিয়ে পড়তে হয়।

ইউরোপের মত অটোমান সাম্রাজ্যেও পুর্নজাগরন প্রয়োজন ছিল। গোঁড়া মোল্লাতন্ত্রের কারণে সে রকম কিছু হল না। এখন চিন্তাচেতনায় পিছিয়ে পরা মুসলিম বিশ্ব পশ্চিমের চোখে হাস্যকর ভাঁড় হয়ে আছে। ভাঁড় মানে জোকার, বুঝলি, জোকার। ... ততক্ষণে ফারিদুন পাজামা খুলে ফেলেছে।

তার শরীরের রং ফরসা। তার পূর্ব পুরুষ এককালে কাস্পিয়ান সাগরের ছিল। তারা ফরসাই ছিল। ফারিদুন-এর পরনে কালো লাল রঙের আন্ডারওয়ার। ফরসা শরীরে তাকে জোকার এর মতোই দেখায়।

লালচে শুয়োরমুখো উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থার সশস্ত্র লোকজন হা হা হি হি করে হাসে। বাইশ বছর বয়েসি পশতুন যুবক ফারিদুন হাকিম এই মুহূর্তে মাটির সঙ্গে মিশে যেতে চায়। সে পারে না। একটি পরাধীন দেশের পরাধীন নাগরিক সে। মাটির সঙ্গে মিশে যেতেও বিদেশি কর্তৃপক্ষের অনুমতি লাগবে।

তাছাড়া সে তো জোকার। অন্যদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যেই জোকারদের বেঁচে থাকতে হয়।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.