ছোটবেলায় যে বাসায় ছিলাম সেখানে পাশের বাসায় ছিল একটা পিচ্চি, যার নাম সোহান। আমার ছোট ভাইয়ের চেয়ে বোধহয় পাঁচ-ছয় মাসের ছোট হবে বয়সে। জন্মের পর থেকে ও আমাদের বাসাতেই বড় হয়েছে। আমার ছোট ভাইয়ের সাথে।
আর সব বাবুর মত সোহানও দেখতে অনেক কিউট ছিল।
ফরসা, বোঁচা, থ্যাবড়ানো নাক আর কপালের ওপর পড়ে থাকা শনের মত সোজা সোজা চুল। ওর একটা ভীষণ বদঅভ্যাস ছিল, বুড়ো আঙুল চুষতো। কিছুতেই এই অভ্যাস ছাড়াতে পারিনি। একটা সময় দেখা গেল মুখে আঙুল দিয়ে রাখতে রাখতে ওর সামনের দাঁতগুলো কেমন উঁচু হয়ে গেছে।
ও সারাদিন থাকতো আমাদের বাসায়, আমার আম্মাকে আম্মা, আব্বুকে আব্বু ডাকতো আর আমরা দুইবোন ছিলাম ওর দুইটা আপা, বড় আপা আর ছোট আপা।
সক্কাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই চলে আসতো বাসায়, আমার ছোটভাইয়ের সাথে খেলতো, একসাথে খাওয়া-দাওয়া, বাথরুম করা, গোসল, দুপুরের ঘুম, আবার বিকালে খেলা, সন্ধ্যায় আব্বু অফিস থেকে আসলে আব্বুর সাথে সারাদিনের কাহিনী শেয়ার করা, সমস্ত শেষে রাত দশটা-এগারোটায় বহুকষ্টে ওর আম্মা ওকে নিয়ে যেতে পারতো ওদের বাসায়, শুধু রাতে ঘুমানোর জন্য। আবার পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই দৌড় দিতো আমাদের বাসায়।
কখনো কোথাও বেড়াতে গেলে ও অস্থির হয়ে থাকতো আমাদের বাসায় আসতে। যত রাতই হোক ফিরতে একবার দেখা দিয়ে যেতো। একবার ঈদের দিন ও ওর নানুবাসায় গেছে।
আসতে আসতে রাত সাড়ে দশটা। এসেই দুমদাম দরজায় ধাক্কা। আর চিৎকার, 'আম্মা দরজা খুলেন। '
আমার আম্মা বলছে, 'তুমি কে?'
-'আমি সোহান। '
-'সোহান কে?'
-'আপনার ছেলে।
'
এই কথা বলার পর কি আর বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা যায়! আমার আম্মা তাড়াতাড়ি দরজা খুলে ওকে কোলে তুলে নিয়েছে তখন।
আবার কখনো যদি বাসায় মাংস বা ভাল কিছু রান্না হতো , সে গন্ধ পেয়েই আম্মার আশপাশে ঘুরঘুর করতো আর বলতো, 'আম্মা আপনাদের বাসায় আমার আজকে দাওয়াত। '
আমার আম্মা একটা স্কুলে ছিল তখন। দুপুর একটার দিকে ছোট ভাইটাকে নিয়ে স্কুল থেকে এসে রাতের পান্তা ভাত ডাল আর ডিমভাজি দিয়ে খেতে দিতো। সোহানও সাথে এসে বসতো।
যে ছেলেকে ওর আম্মা মেরে ধরে কিছু খাওয়াতে পারতো না, দেখা যেতো আমাদের বাসায় এসে মাটিতে বসে ওই পান্তা ভাতই চেটেপুঠে খাচ্ছে।
একদিন বাসায় পিঠা বানানো হচ্ছে। আমার ছোটভাইটা ঘুমিয়ে পড়েছে সন্ধ্যায়ই। সব সুনসান। তাই সোহানকে ডেকে আনা হল।
সে সারাটা সময় চালের গুড়ির লেই আলনায় ডলে ডলে মেখে পুরো আলনাটাকে সাদা করে তুলল আর একটু পর পর বলতে লাগল, 'আম্মা আমি পিঠা বানাই। '
সারাদিন একসাথে খেললেও মাঝে মাঝে দুই বন্ধুর ঝগড়াও লেগে যেতো। তখন তারা কার কি আছে তাই নিয়ে প্রতিযোগিতা লাগতো। খেলনা, জামাকাপড় সব দিকথেকেই দেখা যেতো সোহান এগিয়ে আছে। শেষ মূহুর্তে আমার ছোটভাই মোক্ষম অস্ত্রটা ছাড়তো, 'আমার দুইটা আপা আছে, তোমার আছে?'
সোহান থেমে যেতো, মন খারাপ করে সরে যেতো।
কারণ ও ছিল এক ছেলে। পরে চুপচুপ করে আমাকে এসে বলতো, 'ছোটআপা আপনি আমার আপা, তাই না?'
ছোটআপার জন্য ওর টানটা একটু বেশি ছিল। কারণ ছোটআপা ওদের সাথে খেলাধূলা করতো, শয়তানিগুলা প্রশ্রয় দিতো, আর ছোটআপা নিজেওতো তখন ছোটই ছিল, তাই বনতো ভাল।
সালমান শাহ যখন মারা গেল, তখন আমি এইটে নাকি নাইনে পড়ি যেন। সবার মধ্যে একটা ক্রেজ ছিল।
সালমান শাহর পোস্টার, ভিউকার্ড সংগ্রহের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। আমিও কিছু কিছু যোগাড় করেছিলাম। একদিন ঘরে বসে আছি, সোহান খেলার মাঝখান থেকে ছুটে আসছে, হাতে ছোট্ট একটা স্টিকার। হার্ট আকৃতির, মাঝখানে সালমান শাহ আর শাবনাজের ছবি। 'ছোটআপা নেন', হাতে দিয়েই আবার খেলার মধ্যে দৌড়।
ও কিভাবে যেন বুঝছিল ছোটআপা এটা পেলে খুশি হবে। ওই স্টিকারটা আমি এখনও যত্ন করে রেখে দিয়েছি।
এগারো বছর আগে ওই বাসা ছেড়ে এসেছি। তখন সোহানের বয়স ছয় কি সাত। যেদিন আসি ও সামনে আসে নাই।
এত মন খারাপ করেছিল। তারপর বছর দুয়েক আগে ওর সাথে দেখা হয়েছিল একটা বিয়েতে। অনেক বড় হয়ে গিয়েছিল। আমার ওই ছোট্ট ভাইটার সাথে কোন মিলই নাই। আর এতগুলো বছরের কারণে তৈরি হয়েছিল বিশাল দূরত্ব।
কিন্তু সোহান নামটা শুনলেই আমার চোখের সামনে ওই থ্যাবড়া নাকের পিচ্চিটার চেহারাই ভাসে।
.........................................................
এই লেখাটা ব্লগার রাজসোহানের জন্য। ওকে দেখে আমার সেই ছোটভাইটাকে অনেক মনে পড়ছিল। রাজসোহানের চেহারা আর ওর কপালের ওপর পড়ে থাকা চুল, ঠিক আমাদের সোহানের মত। রাজসোহান, ছোটভাইটা.............অনেক ভাল থেকো, অনেক বড় হও কিন্তু দূরে সরে যেও না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।