পিছনের পায়ের ছাপের রেখাটা র্দীঘ আর অস্পষ্ট হয়ে আসছে... ক্রমশঃ...
অর্থাভাবে আজও বাবার কবর দেখার সুযোগ হয়নি। এই কষ্ট কি ক্ষুধার চেয়েও কোন অংশে কম? হয়তো ক্ষুধাকে অবদমন করা যায়না বলেই তা মেটানোর জন্য আমাদের নিয়ত প্রচেষ্টা। আর অন্যটি দীর্ঘ ৩৮টি বছর বুকের মাঝে বয়ে বেড়ানো।
১০ ই ডিসেম্বর ১৯৭১, দুপুর ১২টা, স্থানঃ মংলা বন্দর। ভারত সরকারের থেকে উপহার পাওয়া দুটি গানবোট পদ্মা ও পলাশ।
সাথে রয়েছে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর গানবোট পানভেল। লক্ষ্য তৎকালীন পাকিস্তানী নৌঘাটি পি.এন.এস তিতুমীর দখল করা। হঠাৎ আকাশে তিনটি জঙ্গী বিমানের আগমন। অভিযানের সর্বাধিনায়ক ক্যাপ্টেন মনেন্দ্রনাথ ভারতীয় বিমান মনে করে গুলিবর্ষণ করার নির্দেশ দিচ্ছেন না। কিন্তু ততক্ষণে ভুল যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে।
বিমান আক্রমনে বিধ্বস্থ গানবোট পদ্মা। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি অবস্থায় পলাশের অধিনায়ক লে. কমান্ডার রায় চৌধুরী নাবিকদের জাহাজ ত্যাগের নির্দেশ দেন। তার এই আদেশে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন ইঞ্জিন আর্টিফিসার মোহাম্মদ রুহুল আমিন। মৃত্যুর মুখোমুখি এই অবস্থানে জাহাজ পরিত্যাগ করে নিজের জীবন বাঁচানোর বদলে দেশের জন্য লড়াই করার জন্য আহবান জানান সহযোদ্ধাদের। দৃঢ় প্রত্যয়ে বিমানগুলোর দিকে কামান চার্জের জন্য ছিলো তার এ আহবান।
ফিরে আসেন নিজের যুদ্ধক্ষেত্র ইঞ্জিনরুমে। কিন্তু অধিনায়কের আদেশ অমান্য করে বিমানগুলোকে আর চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। বিমানগুলো উপূর্যপুরি বোমাবর্ষণ করে পলাশের ইঞ্জিনরুম ধ্বংস হয়ে যায়। আহত হন তিনি। কিন্তু অসীম সাহসী রুহুল আমিন তারপর-ও চেষ্টা চালিয়ে যান পলাশ কে বাঁচানোর।
অবশেষে পলাশের ধ্বংশাবশেষ পিছে ফেলেই আহত রুহুল আমিন ঝাঁপিয়ে পড়েন রূপসা নদীতে। প্রাণশক্তিতে ভরপুর এ যোদ্ধা একসময় পাড়ে এসে পৌছান। কিন্তু ততক্ষণে সেখানে ঘৃণ্য রাজাকারের দল অপেক্ষা করছে তার জন্য। আহত এই বীর সন্তান কে তারা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে রূপসার পাড়ে। তাঁর বিকৃত মৃতদেহ বেশকিছুদিন সেখানে পড়ে ছিলো অযত্নে, অবহেলায়।
এইসব রুহুল আমিনদের জীবনের বিনিময়েই আসে স্বাধীনতা।
হয়তো ভাগ্যজোরেই পরবর্তীতে জুটে যায় বীরশ্রেষ্ঠ উপাধী। কিন্তু আজো ভাগ্য সহায়ক হয়নি তার সন্তান শওকত আলী পাটোয়ারীর। আজো তিনি পারেননি রূপসা নদীর পারের তার বাবার সমাধী দেখার। দেশের জন্য জীবন দেয়া এই বীরশ্রেষ্ঠ সহ সকল শহীদেরা কিন্তু সংসারের টান, পৃথিবীর মায়া সবকিছু বিসর্জন দিয়েছেন আমাদের স্বাধীনতার জন্য।
স্বাধীন আমি আজ মাথা উচুঁ করে হাটি, চিৎকার করে শ্লোগান দেই জয় বাংলা বা বাংলাদেশ জিন্দাবাদ বলে। আমার একাধিক বাড়ী... ঠিক এই মুহুর্ত্বে ব্যাংকে আমার কত টাকা জমা আমি জানি না। অথচ আমার এই অবস্থানে আসতে যে মানুষটি জীবন দিলো, তার পরিবারের কথা একটিবার ভাবার মতো কিছুটা সময় আমার হয়নি। তার সন্তান আজ বাবার কবর একটিবার দেখতে না পারার কষ্টে কাদেঁ।
যুদ্ধে নিজের জীবন দানের বীরত্বের চেয়ে অন্যকোন মহৎ কাজ হয়তো এ জগতে দ্বিতীয়টি নেই।
যাঁদের জীবনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজ আমি স্বাধীন ভাবে বাঁচতে শিখেছি, পেয়েছি নাগরিক অধিকার, তাঁদের কথা ভাবার মতো সময় কি আমাদের হবে না? শওকতদের কান্না কি আজো আমাদের র্ষ্পশ করবে না? আমাদের দায়ভার আর কতদিন আমরা এড়িয়ে যাবো? রাষ্ট্রযন্ত্র শওকতদের কান্না থামাতে পারবেনা, এ আমি বিশ্বাস করিনা। কবে সেই দিন আসবে যেদিন আমরা শওকতদের মুখে হাসি ফোটাতে পারবো? যতদিন সেই মুহুর্ত্ব না আসছে ততদিন মাথা উচুঁ করে চলার কোন অধিকার আমার নেই। আমি লজ্জিত... দায়ভার শোধরাতে না পারার লজ্জায়। আমি লজ্জিত... অকৃজ্ঞতার লজ্জায়। আমি লজ্জিত... রাজাকারদের পেছনে মিছিলে অংশ নেয়ার লজ্জায়।
আমি লজ্জিত... ইতিহাস ভুলে যাবার প্রচেষ্টার লজ্জায়।
এ আমার লজ্জা...। এ আমাদের লজ্জা...। এ আমার জাতীসত্বার লজ্জা...
======================
ছবিঃ বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের সমাধি
তথ্যসূত্রঃ বাংলা উইকিপিডিয়া ও প্রথম আলো
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।