আমি এমন একজনকে জানি যে সরকারী মেডিকেলে ভর্তি হতে না পেরে পরবর্তিতে আত্মহত্যার পথে এগিয়ে গিয়েছিল অনেকদুর । স্বজনরা ঠিক সময়ে ব্যাপারটা বুঝতে পারায় মনোচিকিৎসকের সাহায্য নিয়ে সারিয়ে তোলা হয় তাকে । এখনো পুরোপুরি হতাশামুক্ত হতে পারেনি সে । তার গল্পটা একটু শুনুন - কোচিং করত ঢাকার শীর্ষস্থানীয় একটি কোচিংসেন্টারে । ভর্তি পরীক্ষার কয়েকদিন আগে প্রশ্নপত্র আউট হয়ে যায় ।
প্রতিষ্ষ্ঠানের মালিক তাকে ডেকে বলে- আড়াই লক্ষ টাকা হলে সে প্রশ্নপত্র পেতে পারে । দু-বার পরীক্ষা দেয়, দুবারই টাকার কাছে হার মানে তার ভর্তি হওয়ার সুযোগ । সে হতাশায় ভেঙ্গে পড়ে । গল্পটা আর এগিয়ে না নিয়ে আমি এই গল্পের অন্য দিকটি নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী ।
সে দিকটি হল আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার সবচেয়ে অনৈতিক দিক ।
রক্ষকের ভক্ষক হয়ে ওঠার প্রাথমিক পদক্ষেপ । ডাক্তার হওয়ার প্রথম পদক্ষেপেই যাকে গুনতে হয় লক্ষ লক্ষ টাকা সে যে অসুস্থ মানুষগুলোকে জিম্মী করে কোটি কোটি টাকা ইনকামের স্বপ্ন দেখবে এ আর এমন কি ! আর প্রাইভেট মেডিকেলগুলোয় যে অবস্থা কত ভয়াবহ তা আমরা অনেকেই জানি । শুধু টাকার জোরে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে ঢুকে পড়ছে কিছু মেধাহীন ডাক্তার- যাদের কারণে আমাদের পুরো চিকিৎসা ব্যবস্থাই আজ প্রশ্নের সম্মুখীন ।
এদেশে তৈরী ঔষধ বহির্বিশ্বে সুনাম কুড়িয়েছে । আবার কিছুদিন আগে উদঘাটিত হওয়া এক তথ্য বলছে এদেশেরই তৈরী ঔষধ খেয়ে মারা গেছে বেশ কিছু শিশু ।
নিম্নমানের ঔষধে ছেয়ে আছে আমাদের গ্রামীণ জনপদের ঔষধের দোকানগুলো ।
গত দশক এবং এই দশকে স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য করার নামে ব্যঙের ছাতার মত গজিয়ে ওঠা প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোর অধিকাংশই কতটা মরণফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে তাও মিডিয়ার কল্যাণে আমরা জানি । আমরা এও জানি সরকারী হাসপাতালগুলোয় আজ আর চিকিৎসা আশা করা যায়না-প্রফেসর সাহেবের প্রাইভেট ক্লিনিকের ঠিকানা সংগ্রহ ছাড়া ।
চিকিৎসা ব্যবস্থার এই হতাশাজনক চিত্রে আমরা যেন অভ্যস্থ হয়ে গেছি । আমরা যেন কোন কিছুতেই আর বিস্মিত হইনা ।
সবকিছু খুব সহজ এবং স্বাভাবিকভাবে নেয়ার কৌশল রপ্ত করে আমরা রীতিমত ভদ্র এবং শহুরে হয়ে গেছি । কিন্তু এ বিষয়টা কেন যেন আমাকে বার বার খোঁচাচ্ছে । ডাক্তার নই,সমাজসেবক নই, নই রাজনীতিক । আমার মত একজন সামান্য সংস্কৃতি কর্মী এই বিষয়টা নিয়ে কতটুকুইবা মূল্যায়ন বা বিশ্লেষণ করতে পারে !কিন্তু যখনই ভাবি একজন রোগী হিসেবে আমার সুচিকিৎসা পাবার অধিকার আমাদের সংবিধান নিশ্চিত করেছে ১৫(ক) এবং ১৮(১) অনুচ্ছেদে, তখন মনে হয় আমার অধিকারের কথা বলার অধিকারও আমার সাংবিধানিক ।
২০০৬ এর জুনে প্রকাশিত স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের 'জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি' (খসড়া) পড়লাম সম্প্রতি ।
আরো কিছু রদবদল হয়ে হয়তো অচিরেই একটা সমন্বিত জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন করবে সরকার । খসড়া স্বাস্থ্যনীতির মূল লক্ষ্য হিসেবে ১৯ টি বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে । যার ২ নম্বরে বলা হয়েছে-
"ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, নারী-পুরুষ এবং ভৌগলিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান নির্বিচারে সামাজিক ন্যায় বিচার ও সমতার ভিত্তিতে দেশের সকল জনগোষ্ঠির জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা । " এই একটি মূলনীতির সঠিক বাস্তবায়ন হলেই, আমরা মনে করি, আমাদেরকে আর স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কথা বলতে হবেনা ।
১৮ নম্বরে বলা হয়েছে-
"ভেজাল খাদ্য ও নিম্নমানের ঔষধ নিয়ন্ত্রণে একটি রেগুলেটরি অথরিটিসহ পূর্ণাঙ্গ অবকাঠামো গঠনের পদক্ষেপ গ্রহণ ।
" এই নীতিটাকে আরেকটু প্রসারিত করা দরকার বলে মনে হয় আমাদের । এখানে অসাধু ও মুনাফালোভী চিকিৎসক, নিম্নমানের চিকিৎসাসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান, নিম্নমানের মেডিকেল কলেজের বিষয়টিও অন্তর্ভূক্ত করা দরকার ।
জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি পাঠের পর আমাদের আর স্বাস্থ্যঅধিকার নিয়ে সংকিত হওয়ার কিছু থাকেনা । কারণ, মনে হয়, প্রয়োজনীয় সবই তো আছে এর মধ্যে ! কিন্তু পরক্ষণেই আমাদের সন্দেহবাতিক মন জানিয়ে দেয়-এ যে কাজীর গরু যা কাগজে আছে বাস্তবে নেই ! আর তখনই একটি দক্ষ ও কার্যকর মনিটরিং ব্যবস্থার দারুণ অভাব বোধ করি আমরা । যে সম্পর্কে স্পষ্ট কিছুই বলা হয়নি স্বাস্থ্যনীতিতে ।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের কিছু প্রস্তাব এখানে তুলে ধরছি-
০১. সরকারী কিংবা প্রাইভেট যে কোন প্রতিষ্ঠানেই টাকা নয় মেধাই হওয়া উচিত ভর্তির একমাত্র যোগ্যতা ।
০২. মেডিকেল কলেজে ভর্তি প্রক্রিয়াসহ স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত সকল দুর্নীতির সাথে জড়িতদের সার্টিফিকেট বাতিল, লাইসেন্স বাতিল সহ মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা রেখে আইন প্রণয়ন করা ।
০৩.প্রাইভেট মেডিকেলগুলোয় দরিদ্র কোঠা চালু করা ।
০৪.সবগুলো প্রাইভেট হাসপাতালেই বিনা খরচে চিকিৎসা দিতে হবে শতকরা ২০ ভাগ (দরিদ্রদের জন্য)। এটা সকল ক্যাটাগরিতেই রাখতে হবে ।
এই নিয়ম প্রাইভেট প্রাকটিসের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করতে হবে ।
জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির মধ্যেও অনেক সুন্দর সুন্দর বিষয় অন্তর্ভূক্ত রয়েছে । যা থেকে আমাদের আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ঠ কারণ আছে - খুব শিঘ্রই আমরা নব্য কসাইদের মুনাফালোভী মনোবৃত্তি থেকে মুক্তি পেতে যাচ্ছি ।
পরিশেষে বলতে চাই, যারা সেবা দিবে তাদের মধ্যে সেবা দেবার মানসিকতা গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনে মনোচিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে । সেবা প্রফেশনে টাকার ছড়াছড়ি থাকলে তা কখনো সেবক তৈরি হবার সহায়ক হয়না ।
তাই সেবক হতে হলে যেন টাকা খরচ করতে না হয় এবং সেবক হবার পরও যাতে অধিক টাকার হাতছানি না থাকে এটা নিশ্চত করা না গেলে আমরা কখনোই অসৎ সেবকদের দানবীয় হাত থেকে মুক্তি পাবনা ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।