দৃশ্যপট ১
আমার এক বন্ধুর আত্মীয় রাতের বেলায় প্রচণ্ড মাথাব্যাথায় মোটামুটি অতিষ্ঠ হয়ে একটা মাথা ধরার ট্যাবলেট আর একটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমিয়ে থাকল। পরের দিন সকালে তার আর সকাল হয়নি, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে ঘুমের মাঝেই মারা যায় সে।
দৃশ্যপট ২
আমার ভাতিজাকে আমরা তার জন্মের পর থেকেই নিয়মিতভাবে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতাম, মাসিক ভিত্তিতে, চেক আপের জন্য। ডাক্তার সব সময় বলতেন ‘হেলদি বেবি, হ্যাপি বেবি’।
সাত মাস বয়সে আমার ভাতিজা মারা যায় জন্মগত কিডনি সংক্রান্ত জটিলতায় যেটা ডাক্তার ধরতে পারেননি সাত মাসেও।
এখানে বলা দুইটি ঘটনাই সত্যি।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে রোগী – ডাক্তারের মাঝে পারস্পরিক অবিশ্বাস। ডাক্তারের অনুযোগ, ‘রোগী নিজে নিজে ওষুধ খেয়ে অবস্থা খারাপ করে আমার কাছে আসে, আমি সাইড ইফেক্ট সামলাবো না চিকিৎসা করব?’ রোগীর অভিযোগ, ‘ডাক্তার তো ভালো করে দেখলই না, শুধু শুধু এক গাদা টেস্ট দিলো। শালা কসাই খালি চিনে টাকা। ’
অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানানো যাচ্ছে, দুইটিই বহুলাংশে সঠিক।
রোগী এবং ডাক্তারের পরস্পরের দোষারোপের মাঝে কত জীবন রোজ হারিয়ে যাচ্ছে, তার হিসেব কি রাখা হয়?
না, রাখা হয় না। আমাদের দেশের ডাক্তাররা একেকজন জেমস বন্ড, লাইসেন্সড টু কিল। মারতে আসার আগে একটু থামুন চিকিৎসক বন্ধুরা, একটু চিন্তা করে বলুন তো, আমাদের দেশে আপনাদের পেশায় জবাবদিহিতা কতখানি আছে? বুকে হাত দিয়ে বলুনতো, আপনাদের মাঝে কতজন চিকিৎসা ব্যাবসায় (চিকিৎসা সেবা নয়) নিয়োজিত ?
যাই হোক, কাদা ছোড়াছুড়ি করে শুধু শুধু কর্দমাক্ত না হই, কি বলেন। জানি আপনারা ৫-৭ বছর মেলা কষ্ট করছেন, এখন টেকাটুকা দরকার। কিন্তু তারপরও, মানুষের জীবন নিয়ে কথা, কি দরকার রিস্ক নেবার?
এই অধম একটা মডেল দাড় করেছি, অবশ্যই এটা মৌলিক না, অনেক জায়গায় অনেক দেখা জিনিসের একটা জগাখিচুড়ী, যেইটা বাংলাদেশে করা সম্ভব এবং এইটা এক রকম উইন উইন সল্যুশন, রোগী, ডাক্তার এবং সরকার, সবার জন্য।
ভুমিকাঃ
একটি দেশের স্বাস্থ্য ব্যাবস্থার অবস্থা দিয়ে দেশটির আর্থসামাজিক অবস্থার একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র পাওয়া যায়। অর্থনৈতিক অবস্থা যতই ভালো হোকনা কেন, সুষ্ঠু, সময়োপযোগী এবং কার্যকরী স্বাস্থ্যসেবা ব্যাবস্থা না থাকলে তাকে ঠিক ‘উন্নত দেশ’ বলা যায়না। গুরুজনেরা যেমনটি বলেছিলেন, ‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। ’
বর্তমান অবস্থাঃ
একটা ‘আকবর-বীরবল’ কৌতুক দিয়ে শুরু করি। একবার সম্রাট আকবর তার সভাসদদের ডেকে বললেন যে রাজ্যের স্বাস্থ্যসেবার ব্যাবস্থার অবস্থা শোচনীয় এবং তিনি এই ব্যাপারে কিছু একটা করতে চান।
একথা শুনে বীরবল বাবাজি উঠে বললেন, ‘গোস্তাখি মাফ জাঁহাপনা, কিন্তু আমাদের দেশে আসলে রোগীর চেয়ে ডাক্তারের সংখ্যা বেশি, এসব নিয়ে মাথা না ঘামানোই উত্তম। ’ সভাসদরা ব্যাপক আমোদিত হলেন, কেউ কেউ তেড়ে মারতে এলেন, কেউ গালমন্দ করলেন, আর সম্রাট হাসলেন। বীরবল তখনকার মত কিছু বললেন না। সপ্তাহখানেক পরে একদিন বীরবল একটা কম্বল গায়ে জড়িয়ে রাজসভায় হাজির হলেন। সবাই আহা উহু করে পড়লো, বীরবল কাতর কণ্ঠে বললেন তার জ্বর।
সভায় আরেক পশলা হাসি ঠাট্টা হল। ‘আরে বেকুব, এইটুক জ্বরে এই অবস্থা? যাও অমুক পাতার রস খাও, দেখো জ্বর কই পালায়!’ ‘আরে ধুর, অই পাতার রসে আর এমন কি, যাও তমুক গাছে বাকল নিয়ে চিবোও, জ্বর যদি না পালিয়েছে, আমি পাগড়ী পরা ছেরে দেব!’ এইরকম আরও অনেক। বীরবল কম্বলটি খুলে রেখে মৃদু হেসে সম্রাটের দিকে তাকালেন। আকলমন্দ সম্রাট এই ব্যাপারে আর কখনও কিছু বলেননি।
আমাদের দেশের সাধারণ নাগরিকদের মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব চোখে পড়ার মত।
কয়েকটি অত্যন্ত ব্যায়বহুল হাসপাতাল ছাড়া অধিকাংশ হাসপাতালের অবস্থা শোচনীয়, আর ব্যায়বহুল হাসপাতালগুলোতে যে খুব ভালো অবস্থা, তাও বলা যাচ্ছেনা।
অধিকাংশ মানুষের সঠিকভাবে ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহণে অপরিসীম অনীহা দেখা যায়। তারা গলির মাথার ওষুধের দোকান থেকে প্যারাসিটামল খেয়ে নিতেই বেশি উৎসাহী।
অন্যদিকে দেখা যায় বেশিরভাগ ডাক্তার যত বেশি সম্ভব রোগী দেখেন বেশি ভিজিটের আশায়, স্বাভাবিকভাবেই সব রোগীর প্রতি সর্বোচ্চ মনোযোগ দেয়া সম্ভব হয় না। আর এই অমনোযোগিতায় ঘটে যেতে পারে চরম অঘটন।
প্রস্তাবিত মডেলঃ
আমাদের দেশে এখন সবার একটা জাতীয় পরিচয়পত্র আছে এবং এর মাঝের নম্বরটি ইউনিক। একই নম্বরের দুইটি জাতীয় পরিচয় পত্র নাই। আর যাদের বয়স ১৮ এর নিচে, তাদের আছে জন্ম নিবন্ধন সনদ। এর মাঝেও একটি নম্বর থাকে যেটি ইউনিক। এই নম্বর দুইটিকে একীভূত করা সম্ভব।
যখন কেউ প্রাপ্ত বয়স্ক হবেন, তখন তার জাতীয় পরিচয়পত্রটি জন্ম নিবন্ধন সনদের নম্বরে ইস্যু হবে। ওই একটি নম্বরই একজন নাগরিক তার সারা জীবন রাখবেন, ওইটি হবে তার পরিচিতি (কাগজে কলমে)।
একটি জাতীয় ডাটাবেজ হবে যেখানে সব নম্বর থাকবে এবং সব নম্বরধারীর যাবতীয় স্বাস্থ্যসেবার ইতিহাস (মেডিক্যাল হিস্টরি) ওই ডাটাবেজে সংরক্ষিত থাকবে। যদি টেকনাফে বসবাসকারী কোন নাগরিক তেতুলিয়াতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পরেন এবং সংজ্ঞাহীন অবস্থায় হাসপাতালে আসেন, তাহলে তার পকেটে থাকা জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর ডাটাবেজে মিলিয়ে নিয়ে তেতুলিয়ার ডাক্তার তার ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থাগ্রহণ করতে পারবেন। ওই ডাটাবেজে শুধুমাত্র একজন চিকিৎসক (যিনি তার রেজিস্ট্রেশন নাম্বার দিয়ে লগ ইন করতে পারবেন) কোন পরিবরতন বা পরিবরধন সাধন করতে পারবেন।
হাতে লেখা কোন প্রেসক্রিপশন আর থাকবে না। প্রেসক্রিপশন হবে প্রিন্টেড, ফার্মেসী প্রিন্টেড প্রেসক্রিপশন ছাড়া ঔষধ বিক্রি করতে পারবে না। যখনই একজন ডাক্তার কোন প্রেসক্রিপশন ‘প্রিন্ট’ করবেন, তখনই তা ওই রোগীর ফাইলে সেভ হয়ে যাবে। যাবতীয় রোগ নিরীক্ষার ফলাফল ডায়গনসটীক সেন্টার সরাসরি ডাক্তারের কাছে পাঠাবে, ওই রোগীর ফাইলের রেফারেন্স নাম্বারে, সেটিও সেভ হয়ে থাকবে রোগীর ফাইলে। স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারি যেকোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যাক্তি এই নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকতে বাধ্য থাকবেন।
কিভাবে সম্ভবঃ
অনেকেই হাসছেন। ভাবছেন, নতুন পাগলের আমদানি হয়েছে। অবাস্তব কথাবার্তা শুরু হয়েছে।
কিন্তু না গো না! এ অবাস্তব না!
বাংলাদেশে ৪৬৪ টি উপজেলা আছে এবং সব উপজেলাতেই একটি করে স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে। এছারাও সব জেলা সদরে আছে সরকারি হাসপাতাল, কিছু কিছু জেলায় একাধিক।
রাষ্ট্রায়ত্ত ‘টেলিটক’ এর মাধ্যমে প্রত্যেকটি হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে এই নেটওয়ার্কের মধ্যে নিয়ে আসা সম্ভব। প্রত্যেকটিতে একটি করে কম্পিউটার বসিয়ে শুরু করা যেতে পারে। বেসরকারি হাসপাতাল এবং প্রাইভেট প্রাকটিশনার যারা আছেন, তাদেরকে বাধ্যতামূলক ভাবে এই নেটওয়ার্কে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
এখন প্রশ্ন আসবে এই বিশাল কর্মযজ্ঞের অর্থের যোগান কোত্থেকে আসবে। দুই একটি বলি, জাপানি JICA অথবা বিল অ্যান্ড মেলিণ্ডা গেটস ফাউনডেশন স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে প্রচুর কাজ করে থাকে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে।
এদেরকে অংশিদার করা যেতে পারে। আর ট্যাক্সের পয়সা যায় কই? ফ্রিগেট কিনার পয়সা থাকলে আমাদের চিকিৎসা হবে না কেন?
কিভাবে এটি ‘উইন-উইন’
• সরকারের জন্যঃ
প্রথমতঃ দেশব্যাপি এই নেটওয়ার্ক রাতারাতি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান টেলিটককে দেশের এক নম্বর টেলিফোন অপারেটর বানিয়ে দেবে, যেখান থেকে সরকারের বিপুল উপার্জনের সুযোগ রয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ বেসরকারি যত ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্যসেবা খাতে জড়িত আছেন, তাঁরা একটি নির্দিষ্ট মাসিক ফি এর মাধ্যমে এই নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকবেন (বাধ্যতামূলকভাবে), এখান থেকেও বিপুল রাজস্ব আসবে সরকারের।
তৃতীয়তঃ একজন চিকিৎসকের উপার্জনের সঠিক পরিমাপ সরকারের কাছে কখনোই থাকে না। এই ব্যবস্থা চালু হলে সকল চিকিৎসকের কাছ থেকে সঠিক অঙ্কের আয়কর আদায় করতে পারবে সরকার।
চতুর্থতঃ অবস্থাসম্পন্ন রোগীরা, যারা কিনা ঢেকুর উঠলে সিঙ্গাপুর যান, তাঁরা দেশীও স্বাস্থ্যসেবার উপর আস্থা ফিরে পাবেন এবং বিপুল পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।
পঞ্চমতঃ দেশের নাগরিকদের আর ভুল বা অপচিকিতসায় মরতে হবে না, সরকার আর কি চায় ?
• রোগীদের জন্যঃ
প্রথমতঃ ভুল চিকিৎসা পেতে হবে না আর, যেহেতু সব কিছু রেকর্ডেড থাকছে, ডাক্তার বাবু ওষুধটা সাবধানেই দেবেন!
দ্বিতীয়তঃ যদি কখনও চিকিৎসক পরিবর্তন করতে হয় এবং আগের প্রেসক্রিপশন না থাকে, চিন্তা নেই, রেকর্ড আছে। এক ক্লিকেই সব পাওয়া যাবে।
তৃতীয়তঃ যদি কখনও কোন রোগী চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরন করেন এবং যদি তাঁর কাছের লোকরা মনে করেন এখানে চিকিৎসকের বিন্দুমাত্র অবহেলা রয়েছে, তাঁরা সরকারি সংস্থার কাছে অভিযোগ করতে পারবেন এবং পুর্নাংগ তদন্ত সম্ভব হবে।
• চিকিৎসকের জন্যঃ
প্রথমতঃ কেউ বলতে পারবেনা ‘রোগী মারা ডাক্তার’, বললে ফাইল খুলে দেখিয়ে দেবেন, যে ওটা আমার না, আজরাইলের কাজ।
দ্বিতীয়তঃ যেসব রোগী বিদেশে দৌড়োত, তাঁরা আস্থা ফিরে পেয়ে এখন আপনাদের কাছে আসবেন, কি কি ওষুধ লিখলেন, হিসাব থাকবে। ওষুধ কোম্পানির কমিশন মিস হবে না আর। ডায়গনসটীক সেন্টারের টাও না। ইনকাম বাড়বে, কমবে না!
তৃতীয়তঃ নতুন রোগী এলে হাতড়ে মরার দরকার নাই। সব লিখা আছে।
এক ক্লিক দূরে!
আমি জানি এটা একদিনে সম্ভব না। এক বছরেও না। এটা সম্পূর্ণভাবে করতে কমপক্ষে ১০ বছর সময় দরকার। আমরা যদি আজকে থেকে শুরু করি, ১০ বছর পরে আমাদের থাকবে একটি বিশ্বমানের স্বাস্থ্যব্যবস্থা। আমরা গর্বভরে বলতে পারব, আমার দেশে কেউ বিনা চিকিতসায় মরে না।
আমার দেশের ডাক্তার রোগী মারে না।
যারা এতক্ষণ কষ্ট করে পড়েছেন, এবং লেখককে গালমন্দ করেছেন এবং করছেন, তাদেরকে ধন্যবাদ। কিন্তু একটু চিন্তা করুনতো, এটা কি আসলেই অসম্ভব? না বোধহয়, তাহলে আমার দুইটা প্রশ্নের উত্তর দিন, IF NOT NOW, THEN WHEN? IF NOT US, THEN WHO?
(অনাহুত পরিব্রাজক)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।