আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কিংবদন্তীর নায়ক কমরেড নলিনী দাস

আজ আমার মন ভাল নেই। সময় আর অসময়ের আধো আলো

ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম বিপ্লবী কমরেড নলিনী দাস এক কিংবদন্তীর নায়ক। মাত্র ১১ বছর বয়সে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেয়ার মধ্য দিয়ে শুরু করে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সুদীর্ঘ সময়ে একটানা সংগ্রামী জীবনের গর্বিত নায়ক। তিনি ছিলেন এদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা। একনিষ্ঠ দেশ সেবক এই অকৃতদার মহান বীরের জন্ম ১৯১০ সালের ১লা জানুয়ারি উত্তর শাহবাজপুর বর্তমান ভোলার সদর উপজেলায়।

স্থানীয় জমিদার স্টেটের নায়েব দূর্গা মোহন দাসের পুত্র নলিনী দাস ভোলা শহরের কালীনাথ বাজার এলাকায় শৈশব কাটিয়েছিলেন। তার শিক্ষা জীবনের শুরুও ভোলাতেই। ভোলা সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণীর ছাত্র নলিনী দাস ১৯২১ সালে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ও খেলাফত আন্দোলন কমিটির আহ্বানে পাঞ্জাবের জালিওয়ানবাগে ব্রিটিশের নৃশংসয় গণহত্যার প্রতিবাদে হরতাল ও ধর্মঘটে অংশ গ্রহণ করেন। এই অপরাধে ব্রিটিশ পুলিশ অপর ৫ ছাত্রের সাথে নলিনী দাসও গ্রেফতার করে। মাত্র ১১ বছর বয়সে শুরু হয় নলিনী দাসের কারা জীবন।

এই মহান সৈনিক আন্দামানের কারা নির্বাসনসহ ৭২ বছর জীবনের ২৩ বছরই কাটিছেন কারাগারের অন্ধকারে। অপর দিকে ২১ বছর ছিলেন আত্মগোপনে। সেখানে থেকেও তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। নলিনী দাস ভোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯২৮ সালে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পাশ করেন । আই.এস.সি পরীক্ষার পূর্বেই কলিকাতা মেছুয়া বাজার বোমা মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়।

শুরু হয় পালাতক জীবন। পলাতক অবস্থায় ১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কলকাতার পুলিশ কমিশনার ট্রেগার্ড সাহেবকে হত্যার প্রচেষ্টা মামলায় তিনি গ্রেফতার হন। ওই মামলার বিচারে তিনি খালাস পান। তবে তাকে ডেটেনিউ করে প্রেসিডেন্সি জেলে প্রেরণ করা হয়। ১৯৩১ সালে পাঠানো হয় হিজলী বন্দী ক্যাম্পে।

ওই কাম্পেই রাজবন্দীদের উপর গুলি চালানো হয়। শহীদ হন কলকাতার সন্তোষ মিত্র ও বরিশালের তারকেশ্বর সেনগুপ্ত। আহত হন অনেক রাজবন্দী। ৩১ সালের ডিসেম্বরে নলিনী দাস ও অপর বিপ্লবী ফনিদাস গুপ্ত হিজলী জেল থেকে পলায়ন করেন। এরপর ১৯৩২ সালের কলকাতার চন্দন নগরে বিপ্লবীদের সাথে পুলিশের বন্দুক যুদ্ধে নলিনী দাস আহত অবস্থায় দিনেশ মজুমদারসহ পালাতে সক্ষম হয়।

৩৩ সালে ফের পুলিশেল সাথে বন্দুক যুদ্ধের সময় তিনি গ্রেফতার হন। পুলিশ এসোল্ট মামলায় নলিনী দাসের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দ- দিয়ে আন্দামানের সেলুলার জেলে প্রেরণ করা হয়। আন্দামানের ওই জেলে থাকা অবস্থায় নলিনী দাস কমিউনিস্ট মতবাদে দিক্ষা গ্রহণ করেন। সেখানেই তারা “বিপ্লবী বিশ্ববিদ্যালয়” স্থাপন করে শুরু করেন ব্যাপক পড়াশোনা। বন্দীদের দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে ব্রিটিশ সরকার ৩৮ সালে নলিনী দাসকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনা হয়।

ভয়ানক বিপ্লবী ব্যক্তি হিসেবে ঘোষণা দিয়ে ৪৬ সাল পর্যন্ত তাকে কলকাতার বিভিন্ন কারাগারে বন্দি রাখার পর ৩০ সেপ্টেম্বর মুক্তি দেয়া হয়। একটানা ১৪ বছর জেল খাটার পর তিনি আপর জন্মভূমিতে ফিরে এলে ভোলাবাসী তাকে বিশাল সংবর্ধনা প্রদান করে। ব্রিটিশরা চলে গেলেও নলিনী দাসের ফের পাকিস্তানের সৈরাচারী সরকারের বিভিন্ন অন্যায়ের প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন। ৪৭ সালেই পাকিস্তান মুসলিমলীগ সরকার তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। শুরু হয় তার আবারও পলাতক জীবন।

৫০ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলাকালে বরিশালের নিভৃত এক পল্লীতে গোপন সভা চলাকালীন সময়ে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে। পরে তাকে ১০ ছরের কারা দ- দেয়া হয়। ৫৯ সালের যুক্তফ্রন্ট সরকার তাকে মুক্তি দেন। ৬৯ সালে আইয়ুব খানের শাসনামলে পুনরায় তিনি আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হন। ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ফের সক্রিয় হয়ে ওঠেন।

তার রচিত “ স্বাধীনতা সংগ্রামে দ্বীপান্তরে বন্দী” গ্রন্থ থেকে বিপ্লবী জীবনের নানা রোমঞ্চকর তথ্য পাওয়া যায়। নলিনী দাস শুধু ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন ও স্বাধীনতা আন্দোলনই করেন নি। তিনি এদেশের অবহেলিত কৃষক শ্রমিকের মুক্তির আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। বিভিন্ন সময়ের দুর্ভিক্ষ, খরা, মহামারি আর দাঙ্গার সময় তিনি সাধারণ মানুষের পাশে দাড়িয়েছেন। স্বাধীনতার পরে দেশ পুনর্গঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।

ভোলা শহরে তার পৈত্রিক কোটি টাকার সম্পদ তিনি জনকল্যাণে ব্যায় করেছেন। গঠন করেছেন দূর্গামোহন দাস জনকল্যাণ ট্রাস্ট। দানবীর হিসেবে পরিচিত এই মহান ব্যক্তির দানকৃত সম্পদ নিয়ে গড়ে তোলা হয় লায়ন্স হোমিও কলেজ ও নলিনী দাস হাসপাতাল, নলিনী দাস বালিকা বিদ্যালয়, নলিনী দাস স্মৃতি পাঠাগারসহ বিভিন্ন কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান। আপোষহীণ দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের এই মহান ব্যক্তি দূরারোগ্য যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় উন্নত চিকিৎসার জন্য গেলে ১৯৮২ সালের ১৯ জানুয়ারি মৃত্যু বরণ করেন। গত ১ জানুয়ারি ছিল মানবতাবাদী, সংগ্রামী, বিফ্লবী এই মহান ব্যক্তিত্বের জন্ম শতবার্ষিকী।

আমরা তাকে গভীর শ্রোদ্ধার সাথে স্মরণ করছি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।