ভালো আছি
রাম রাজা বিদার বেজনগর আক্রমণ করেছেন। নগর সুরতি-সহজে শত্র“র হস্তগত হওয়া অসম্ভব। কিন্তু অবরুদ্ধ নগরে নগরবাসীদের দুর্দশার সীমা নেই। নগরে খাদ্য দ্রব্য ফুরিয়ে গেছে, কূপে পানি নেই । ধনীরা অতিকষ্টে কিছু খাদ্য সংগ্রহ করছেন।
গরীবরা অখাদ্য কুখাদ্য খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছে । দিনের পর দিন নানা রকম ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ছে। সবাই চিন্তিত, সকলেই বিজাপুরের সম্রাট ইসমাইল আব্দুল শাহার প্রতিশ্র“ত সাহায্যের আশায় পথ চেয়ে আছেন। কিন্তু বিলম্ব হেতু আশার আলো নিরাশার অন্ধকারে ঢাকা পড়ছে। তথাপি পুরবাসীরা শত্র“ হস্তে আত্মসমর্পণে সম্মত নয়।
সকলেই সানন্দে কষ্ট স্বীকার করছেন। মহিলারাও পুরুষদের উৎসাহ জোগাচ্ছেন। নিজেরা অর্ধাহারে অনাহারে থেকে বীর যোদ্ধাদের আহার যোগাচ্ছেন। কিন্তু এমন করে আর কয়দিন কাটবে। পানি শেষ হয়ে গেলে আত্মসমর্পণ ছাড়া উপায় থাকবে না।
অবরুদ্ধ নগরীর অধিকারী আমীরের চোখে ঘুম নেই, মনে শান্তি নেই। প্রজার কষ্টে, ভবিষ্যতের চিন্তায় তিনি অবসন্ন হয়ে পড়ছেন। মাঝে মাঝে প্রাসাদ চূড়ায় আরোহণ করে পথের দিকে তাকিয়ে দেখছেন শাহার সৈন্যদল আসছে কিনা। শত্র“রা পুরী মধ্যে গোলাবর্ষণ করছে, বাড়ি ঘর দোর সব ভেঙে পড়ছে । কত বীরের জীবনের উপর নামছে মৃত্যুর যবনিকা।
নগরের উপর আসন্ন বিপদের সম্ভাবনায় সবাই বিভ্রান্ত, দেশেহারা।
আলসা বিদারের সর্বশ্রেষ্ঠ নর্তকী। তার অসামান্য রুপ লাবণ্য, অনন্য কণ্ঠস্বর আর নৃত্য সবার কাছে সুপরিচিত। সুশিার ফলে তার সঙ্গীত এক বহু আলোচিত সম্পদ। আলসার গান ছাড়া নবাবের প্রাসাদে ও আমীর ওমরাহদের গৃহে উৎসব সর্বাঙ্গ সুন্দর হয় না ।
বিভিন্ন রাজদরবার থেকে তার নৃত্য গীত পরিবেশনের আহবান আসে । সে অতুল ঐশ্বর্যের অধীশ্বরী ছিল। এই বিপদের সময় সে আপনার সর্বস্ব দিয়ে নগর রার সংকল্প করল। সে গরীবদের গৃহে গৃহে খাদ্য ও ওষুধ বিতরণ করতে লাগল । আলসা যেন মূর্তিমতী করুনা।
শ্রান্তি নেই, কান্তি নেই সে ুধিতের ও ব্যথিতের সেবায় আত্মনিয়োগ করল। নিজের আরামকে সে হারাম করে দিল । আলসার ত্যাগের দিকে চেয়ে পুরবাসীরা ও সৈনিকদল উৎসাহ বোধ করল। কিন্তু বিধিবাম! তার গৃহ প্রাঙ্গণস্থ কূপের পানি ও সমস্ত জীবনের সঞ্চয় সব ফুরিয়ে এল । তথাপি অবরোধ শেষ হলো না, শাহার সাহায্য এলো না ।
অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত। রাজপথ আঁধারে হারিয়ে গেছে। দুইজন সহচর সঙ্গে নিয়ে আলসা নগরের প্রান্তে অবস্থিত দরিদ্র পল্লী থেকে ফিরছে। দারুণ পরিশ্রমে তার শরীর ভেঙে পড়েছে। স্বর্ণাভ গণ্ডে অস্থি দৃশ্যমান।
চন্দন চর্চিত অঙ্গ ম্লান । শ্রান্ত দেহে গৃহে ফিরছে। পথের পাশে ভগ্ন দেবালয় হতে আগত শিশুর কাতর ক্রন্দন শুনে আলসা সেই দিকে চলল। আলোকবাহী সঙ্গী সে দিকে যেতে দ্বিধা করছিল। যে ভগ্ন দেবালয়ে দিনের বেলা বিষাক্ত পোকামাকড় দেখা যায় রাতে সেখানে প্রবেশ করা এক প্রকার দুঃসাহসিক ব্যাপার ।
কিন্তু আলসার আদেশে তাকে যেতে হলো। মন্দিরে প্রবেশ করে আলো দিয়ে আলসা যা দেখল তা একমাত্র দোযখেই শোভা পায় । মন্দিরের মেঝেতে এক শীর্ণকায় পুরুষের শব পড়ে আছে। তার পাশে একজন কঙ্কালসার মহিলা একটি শাণিত ছুরি নিয়ে একটি শিশুকে হত্যা করতে উদ্যত। তার চোখে পৈশাচিক দৃষ্টি।
আলসা বলল, তুমি কে? এ ভীষণ স্থানে কেন এসেছ? নারী উত্তর দিল, আমি ুধা তৃষ্ণায় মারা যাচ্ছি। কোন উপায় না দেখে আমি ও আমার স্বামী এই মন্দিরে সন্তানকে কেটে তার রক্ত পান করব ভেবেছিলাম। কিন্তু এখানে এসেই আমার স্বামীর জীবন শেষ হয়ে গেল। আমি...আমি...। আলসা ছেলেটিকে কোলে তুলে নিল।
সঙ্গীদের মহিলাকে আনবার নির্দেশ দিয়ে শিশুকে নিয়ে দ্রুত গতিতে নিজের বাড়ির দিকে রওনা হলো।
আলসা গৃহে প্রবেশ করল। তার পদভারে তোরণের হর্ম্মতলস্থ একখানি পাথর নীচে পড়ে গেল । আলসার মনে হলো যেন পাথরখানি গড়ায়ে কোন তরল পদার্থে ডুবে গেল। সে শিশুটিকে দুধপান করিয়ে শয্যায় রেখে পরিচারকদের দ্বারা সেখানে কখানা পাথর উঠাল ।
নীচে অন্ধকার গর্ত । বাতির আলোতে সোপান দেখা গেল । পরিচারকরা সাহস করে সেই অজ্ঞাত অতলে যেতে স্বীকৃত হলো না । তখন আলসা বলল, আমি পানির শব্দ শুনেছি, আমি যাব। সঙ্গীরা বলল, এমন কাজ করবেন না ।
এ শয়তানের ছলনা। আলসা বলল, যদি সহস্র লোকের জীবন রা করতে আমার এ তুচ্ছ জীবন যায়, তাতে দুঃখ কী। পরিচারকের হাত থেকে বাতি নিয়ে আলসা দ্রুত পদে সোপান বেয়ে অবতরণ করতে লাগল। কিছু দূর যাওয়ার পর তার হাত থেকে ঝপ করে বাতি পড়ে গেল । বাতি নিভে যাওয়ায় চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল ।
উপরে সঙ্গীরা আল্লাহকে ডাকতে লাগল।
আলসা গর্ত থেকে হীরকখচিত বলয় খুঁজে বের করল। অন্ধকারে হীরক জ্বলে উঠল। এই আলোতে আলসার পদ তলে পানি দেখা গেল । সে অমূল্য বলয় আলসা পানিতে নিপে করল।
বলয় পড়ে যাওয়ার শব্দে নীচে জলের অস্তিত্ব সম্বন্ধে আর সন্দেহ রইল না। আলসা জানু পেতে বসে আল্লাহর কাছে মোনাজত করল।
এ কথা নগরে প্রচারিত হলো । এই অলৌকিক কৃপা নগরবাসীদের হতাশ বুকে নতুন আশা জাগাল । আল্লাহ তাদের সহায় ।
কয়দিন পর শাহার সেনাদল এল । বিদার শত্র“মুক্ত হলো । বহুদিন হলো আলসার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু আজও নর্তকীর কূপের কিংবদন্তী তার পুণ্য স্মৃতি সযতেœ রা করছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।