আমি অবাক চোখে বিশ্ব দেখি, দৃশ্য সাজাই চোখের তারায়......
জীবনে যতটা নিষ্ঠার সঙ্গে নানামুখি ফাজলামো করে সময় কাটিয়েছি, তার অর্ধেকেরও কম নিষ্ঠার সঙ্গে কোন কাজ করলে নাকি অনেক কিছুই করতে পারতাম। সেই অনেক কিছুটা আসলে কত কিছু সেটা সম্পর্কে অবশ্য আমার বা কারো কোন ধারণা নেই। তাতে খুব একটা সমস্যা নেই। কারণ বাংলাদেশের মানুষ ধারণা ছাড়াই অনেক কিছু করে থাকে।
তো ঘটনা হচ্ছে এবার সেই ‘অনেক কিছু’ করার আশায়, কাজে নিয়োজিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম।
এবং এই সিদ্ধান্তের কারণে মোটামুটি ভদ্রস্থও হয়ে গেলাম। কেউ কেউ এই ধারণার সঙ্গে দ্বিমতও পোষণ করতে পারেন। তবে সেটা করতে হবে নিজ দায়িত্বে। আমার আত্মপর্যবেক্ষণে সাম্প্রতিক শাকিল এবং পূর্ববর্তী শাকিলের মধ্যে অনেক পার্থক্য। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক- মাত্র মাস ছয়েক আগেও দুপুর দেড়টা না বাজলে আমার ঘুম ভাঙতো না।
এখন প্রতিদিন সকাল এগারোটায় নিয়মিতভাবে অফিসের ডেষ্কে আমাকে দেখা যায়।
এই সকাল এগারোটায় অফিসে আসার জন্য আমাকে অবধারিতভাবে রাত বারোটার মধ্যে বিছানায় যেতে হয়। কারণ আমার মায়ের মতে আমার মাঝে একটা ‘ভাদাইম্যা’ মানসিকতা বিদ্যমান। ভাদাইম্যাদের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তারা বেশি ঘুমায়। যারা ভাদাইম্যা তারা জীবনে কিছু করতে পারে না।
সরাসরি ভাদাইম্যা না বললেও, আমার বাবা এই বিষয়ে একমত যে এক জীবনে আমি কিছুই করতে পারবো না।
বাবা-মায়ের এইসব ধারণা ভুল প্রমাণ করে তাদের একহাত দেখিয়ে দেওয়ার খায়েশটা বহুদিন ধরেই মনে আকুপাকু করছিল। তো কাজে মন দিয়ে চিন্তা করেছিলাম সেই খায়েশটা এবার পূরণ করা যাবে। তো এসব কারণে আমার কাজে মন দেওয়া এবং ঠিক সময়মত অফিসে আসতে গিয়ে রাত বারোটায় ঘুমাতে যাওয়ার কারণে আমার দিনগুলো এখন খুবই ছোট হয়ে গেছে। ডিজিটাল সময় বাদ দিয়ে নতুন সময় চালু করে ঘড়ির কাঁটা এক ঘন্টা পিছিয়ে আনার পরও সেই দিন একটুও বড় হয়নি।
আমার দিনগুলো ছোট হয়ে যাওয়ায়, আমার পূর্ববর্তী জীবনের নিয়মিত কর্মকান্ডে বেশ বিঘœ ঘটছে। এখন আমি রাতভর রাস্তায় হাঁটতে পারি না। কিংবা সারারাত বুড়িগঙ্গায় নৌকা ভ্রমণে যেতে পারি না। অথবা কোন উদ্দেশ্য ছাড়া শেষ বাসে মুন্সীগঞ্জ উপস্থিত হয়ে শেয়ালের ধাওয়া খেয়ে পদ্মা নদীর পাড় দিয়ে ছুটতে পারি না। পারি না ইট কাঠের এই নগরী থেকে হঠাৎ উধাও হয়ে যেতে।
কাউকে কিছু না জানিয়ে জাফলং গিয়ে দিন দশেকের ট্যুর দিয়ে আসতে পারি না। মোবাইল বন্ধ করে ঘুমিয়ে কাটাতে পারিনা টানা দুইদিন। কিংবা হাবিজাবি (!) পাণীয় পান করে ঝিমুনিতে কাটিয়ে দিতে পারি না সপ্তাহখানেক। পারি না সেই লাজুক কিশোরীর বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে মধ্যরাতে বেসুরো গলায় গান গেয়ে উঠতে, যে কিশোরী-মধ্যরাতে নিজের বারান্দার নিচে আমাকে দেখে ভয়ে শিহরিত হত, না জানি বাসার কারো কাছে সে ধরা পড়ে যায়! রাত করে বাড়ি ফিরে গেটের তালা খোলানোর জন্য বাড়িওয়ালাকে ঘুম ভাঙিয়ে তুলতে পারি না, কারণ আমি তো এখন সে ঘুমানোর আগেই ঘরে ফিরি। পারি না........................, আরো অনেক কিছুই করতে পারি না আজ আর।
সব মিলিয়ে শেষ পর্যন্ত এই নিষ্ঠুর নাগরিকতা গ্রাস করে নিল আমাকেও!
তবে আমি যে এতটা নাগরিক হতে চাই নি কখনও, এমন উড়নচন্ডী হয়েই তো থাকতে চেয়েছিলাম আজীবন। কিন্তু মানুষ যা চায় তা বোধহয় কোনদিনও পায় না। এই নাগরিকতার দহনে যখন আমি বদলে যাচ্ছি, যখন আমার রাতজাগা সাথীরা বেশ আপে নিয়ে বলছে, ‘সব শালা একই রকম। লুথা, দুনিয়ার সবাই লুথা’, আমার এই হঠাৎ ভদ্রস্থ হওয়া দেখে চোখ কপালে তুলে যখন পরিচিতরা বিস্ময় প্রকাশ করছে, ‘আরে এইটা কেডা? শাকিল নাকি?’জ্জতখনও আমি নির্বিকার। চুপ করে শুধু দেখে যাই আমার বদলে যাওয়া।
হঠাৎ করে সভ্য সমাজের বাসিন্দা হওয়ার আকূল চেষ্টায় নুব্জ আমি, নিজের উচাটন মনকে স্বান্তনা দিতে মাছের মত নির্বিকার চোখে দেখে যাইজ্জ আমার মায়ের প্রশান্তি, বাবার দুঃশ্চিন্তামুক্তি, পরিবারের অন্য সবার নিশ্চিন্ত ভাব, সেই ভীত কিশোরীর চোখের ভয়হীন নির্মল আনন্দ, আমার রাত করে বাড়ি ফেরায় বিরক্ত বাড়িওয়ালার মুখের হাসি, কিংবা কর্মস্থলের উর্ধ্বতনদের প্রশস্তি। ওসব দেখেই মনকে বোঝাই, ‘কিছু পেতে হলে তো কিছু হারাতেই হবে। ’
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।