গাছ কেটে জল ঢালো পাতায়, এ চাতুরী শিখলে কোথায়?
কে বলে গরীবের দু:খের দাম নাই! সাগরের নোনা জল গরীবের চোখের জলের যতই ঢল নামাক, তার একটা দাম ঠিকই ধরে দেয়া হবে। গরীবের ক্ষুধা, হাহাকার, উদ্বাস্তু জীবন, তার কংকালসার শরীর, হাড়-মাংস নিংড়ে নেয়া শ্রম- বর্তমান অর্থব্যাবস্থা এ সবকিছুরই 'মূল্যায়ন' করতে জানে। কম কি- ক্ষতিগ্রস্থদের জন্য তিন বছরে ৩০ বিলিয়ন ডলার, ২০২০ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে মোট ১০০ বিলিয়ন ডলার। এই অর্থের কেবল ২০ শতাংশ নগদ 'সহায়তা' আকারে আর বাকিটা বিনিয়োগ ও প্রযুক্তি 'সহায়তা' হিসেবে দেয়া হলে কিংবা জলবায়ু তহবিলের উপযুক্ত ব্যাবস্থাপনার অভাবের কথা বলে সেই নগদ অর্থ আবার বিশ্বব্যাংকের কাছে 'উপযুক্ত' ব্যাবস্থাপনার নামে তুলে দেয়া হলে এবং 'উপযুক্ত' ব্যাবস্থাপনার খরচ হিসেবে বিশ্বব্যাংক সে অর্থের ১৫ শতাংশ কেটে রাখলে আমাদের কোনই আপত্তি নেই। কেননা আমাদের জনপ্রতিনিধি কোপেনহেগেনে তো বলেছেনই আমাদের 'মনের কথা': "আমরা এখনই উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে কোন দ্বন্দ্বে যেতে চাইনা।
তাদের সহযোগিতা নিয়েই বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার কাজ করতে চায়। " আহা! আমাদের মেট্রোপলিটান মন আহ্লাদে নেচে উঠে। নাচবেই তো- আমাদের কি, আমাদের তো আর সিডর, আইলা কিংবা নার্গিসের তান্ডবের শারীরিক উপলব্ধির মধ্যদিয়ে যেতে হয় না! ফলে 'ক্ষতিপূরণ' পেলেই আমরা খুশি। আমরা প্রশ্নও তুলবনা এই 'ক্ষতিপূরণ' কোন ক্ষতির কতটা পূরণ করবে, কতটা কার্যকর হবে, কিভাবে হবে কিংবা এই ক্ষতিপূরণের প্রকৃত উদ্দেশ্যটাই বা কি। ক্ষতিপূরণের সাথে যদি ক্ষতিকর কাজ ত্যাগ করবার এবং তার উপয্ক্তু জমিন তৈরী করবার সত্যিকার অঙ্গিকার না থাকে, তাহলে সে ক্ষতিপূরণ যে বারবার ক্ষতি করবার বৈধ লাইসেন্স হয়ে উঠতে পারে সে জিজ্ঞাসাও আমাদের আসবে না।
এদিকে উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের কর্পোরেট পুঁজির আজ্ঞাবাহী শাসক বর্গ কোপেনহেগেনের পরিবেশ রক্ষার সন্মেলনকে করে তুলেছিল পরিবেশ বিক্রির সন্মেলনে যেখানে যুক্তি-তর্ক, আলোচনা-সমালোচনার মূল লক্ষ ছিল কোন ধনীক দেশ কত কম অর্থের বিনিময়ে কত বেশি কার্বন উদ্গিরণের ছাড়পত্র পেতে পারে। যার ফলাফল স্বরূপ গত ৮-১৮ ডিসেম্বর তারিখে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সন্মেলন একটি রাজনৈতিক অশ্বডিম্ব প্রসব করেছে যেখানে বিশ্বের তাপমাত্রা দুই ডিগ্রী সেলসিয়াস বৃদ্ধির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার রাজনৈতিক অঙ্গীকারের কথা বলা হলেও সেটা বাস্তবায়ন করার জন্য কোন দেশ কতটুকু কার্বন হ্রাস করবে সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোন অঙ্গিকার নেই এবং কোন আইনি বাধ্যবাধকতাও ধনী দেশগুলোর উপর আরোপ করা হয়নি! তাপমাত্রা বৃদ্ধি দেড় ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রাখা, সুস্পষ্ট আইনি বাধ্যবাধকতা সহ কার্বননি:সরণ হ্রাসের কোন চুক্তি না করে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য দশ বছরে মোট ১০০ বিলিয়ন ডলারের ফাঁপা প্রতিশ্রুতিতে ক্ষুব্ধ ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো যখন ব্যাঙ্গ করে বলছে "এতে আমাদের দাফন-কাফনের খরচ ও হবে না", বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তখন সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন: "আমাদের উদ্বেগের বেশির ভাগ বিষয় সমাধান করে একটি সমঝোতায় পৌছানো সম্ভব হয়েছে। "(প্রথম আলো, ২০ ডিসেম্বর, ২০০৯)
পরিবেশবাদীদের মধ্যে বাংলাদেশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন: কোপেনহেগেন সন্মেলন চলাকালীন সময়েই জলাবয়ু বিপর্যয়ের একেবারে সামনের সারির ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ভূমিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। শেখ হাসিনাকে বারাক ওবামা ও গর্ডন ব্রাউনের টেলিফোন, বাংলাদেশকে আলাদা ভাবে বিশেষ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি কিংবা আলাদা ভাবে যুক্তরাজ্য ও ডেনমার্কের মতো দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের বৈঠক এবং তার বিনিময়ে বিশ্বব্যাংকের ভূমিকা প্রসঙ্গে বাংলাদেশের অবস্থান ইত্যাদির প্রেক্ষিতে অভিযোগ উঠেছে যে বাংলাদেশের সমর্থন ধনী দেশগুলো কিনে ফেলেছে। কোপেনহেগেন সন্মেলন উপলক্ষে পরিবেশবাদীদের বের করা বিশেষ পত্রিকা ক্লাইমেট ক্রনিক্যালস এর চতুর্থ সংখ্যায় অভিযোগ তোলা হয়েছে:
যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিভাগ ৭৫ মিলিয়ন পাউন্ডের একটা 'সচেতনতা কিট' বাংলাদেশকে সরবরাহ করেছে যেন "কর্মপরিকল্পা নির্ধারণ ও দেন-দরবারের সময় বাংলাদেশ দৃঢ় অবস্থান নিতে পারে" যার সাথে আরও যুক্ত ছিল ঢাকা ও লন্ডনে অনুষ্ঠিত অনেকগুলো নীতিনির্ধারণী সেমিনার।
ডেনিশদূতাবাস বাংলাদেশের ১২৬ সদস্যের প্রতিনিধি দলের কোপেনহেগেন যাত্রার খরচের জন্য দিয়েছে ১.১৪ মিলিয়ন ডেনিস মুদ্রা। এই অর্থ দেয়া হয়েছে জেনেভায় অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনসারেভেশন অব নেচার বা আইইউসিএন এর মাধ্যমে।
ধনীদেশগুলোর এই বিনোয়গের ফলাফল কি? ডেনিশ কপ১৫ ওয়েবসাইটে প্রকাশিত "ঝুঁকিপূর্ণ জাতিগুলোর হয়ে বিশ্বব্যাংককে জলবায়ু তহবিল ব্যাবস্থাপনার দ্বায়িত্ব দেয়া হোক: বাংলাদেশ" - এই রিপোর্টে এর আংশিক আঁচ পাওয়া যায়। রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে, "বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত ইঙ্গিত দিয়েছেন যে তার দেশ "উন্নয়নসহযোগীদের বেঁধে দেয়া শর্ত অনুসারে স্বল্প মেয়াদে বিশ্বব্যাংককে তহবিল ব্যাবস্থাপনার দ্বায়িত্ব দিতে রাজী হয়েছে। " উল্লেখ্য যে, আইনুন নিশাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনসারেভেশন অব নেচার বা আইইউসিএন এশিয়ার একজন অন্যতম সিনিয়র অ্যাডভাইসার।
(সূত্রঃ Click This Link)
আহা, জলবায়ু যদি ব্যাংক হতো!
মানুষ ও প্রকৃতির জন্য যা দুর্যোগ, পুঁজির জন্য তা-ই সুযোগ। মুনাফাকেন্দ্রিক শিল্প ও কৃষি জল দূষণের মত দুর্যোগ ঘটায় বলেই দূষিত জলকে বিশুদ্ধ করবার জন্য বিনোয়োগের সুযোগ তৈরী হয়। বায়ুমন্ডলে কার্বন বেড়ে যাওয়ার মত দুর্যোগ তাই তার কাছে শাপে বর- আনকোরা এক পণ্য পাওয়া, মানবজাতিকে উদ্ধারের নামে, যে পণ্যের সার্কুলেশানের মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া যাবে বিপুল মুনাফা। যে মার্কেট লজিক বা বাজারের যুক্তি এই পরিবেশ বিপর্যয় ঘটালো, বলা হচ্ছে, সেই বাজারের যুক্তিই এবার নতুন রূপে তার অদৃশ্য হাতের মাধ্যমে পরিবেশকে উদ্ধার করবে। কিয়োটো প্রটোকলের পর থেকেই কার্বন ট্রেডিং চালু হয় এবং ২০০৫ সালে স্থাপিত ইউরোপিয় ইউনিয়নের ইমিশান ট্রেডিং স্কিম বা ইটিএস এর বাজার এখন ৭৫ বিলিয়ন পাউন্ডে এসে দাড়িয়েছে।
এবারের কোপেনহাগেন জলবায়ু সন্মেলনেরও মূল প্রণোদনা ছিল বাজারের এই যুক্তির 'যৌক্তিকতা' প্রতিষ্ঠা করা, তার জরুরত সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে নসিহত করা এবং উন্নত-অনুন্নত সমস্ত দেশকে ইতোমধ্যেই চালু হয়ে যাওয়া কার্বন-বাণিজ্যের শৃঙ্খলে শক্ত ভাবে গেঁথে ফেলা। ফলে প্রতিবাদ হয়েছে, পরিবেশ আন্দোলনকারীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, পরিবেশ বা জলবায়ু যদি ব্যাংক হতো, তাহলে তো কবেই তাকে বেইল আউট করা হতো! ইউরোপ-আমেরিকার বড় বড় ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো যখন ধ্বসে যেতে লাগল, তখন কি বাজারের অদৃশ্য হাতের অপেক্ষায় ছিল সেগুলোর পোষক বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো? সারা বিশ্বের জনগণের প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মুখে তারা জনগণের রক্ত-ঘাম পানি করা কয়েক হাজার বিলিয়ন ডলার অকাতরে বিলিয়ে দিল সেগুলোকে উদ্ধার করার নামে। কই, তখন তো কার্বন ক্রেডিটের মতো কোন বায়বীয় পণ্য উদ্ভাবনের প্রয়োজন পড়লো না!
কার্বন-ট্রোডিং: দুর্যোগের পুঁজিবাদ
কার্বন ট্রেডিং ব্যবস্থায় কার্বন ক্রেডিট নামের যে বায়বীয় পণ্যটি তৈরী করা হয়েছে তা ১ টন কার্বন ডাইঅক্সাইড এর সমতুল্য অর্থাৎ কারো হাতে এক কার্বন ক্রেডিট থাকা মানে সে এক টন কার্বন ডাইঅক্সাইড সমপরিমাণ পরিবেশ দূষণের অধিকার নিজে ভোগ করতে পারে কিংবা আর কারও কাছে নির্দিষ্ট মূল্যের বিনিময়ে সেই অধিকার বিক্রি করতে পারে। কার্বন ক্রেডিট কিভাবে পাওয়া যাবে? "ক্যাপ এন্ড ট্রেড" সিস্টেমে প্রত্যেকেটি দেশকে তাদের কার্বন উদ্গীরণের ইতিহাস বিবেচনা করে কার্বন উদ্গীরণ করার সীমা বেধে দেয়া হবে অর্থাৎ তাকে কিছু কার্বন ক্রেডিট দেয়া হবে যে ক্রেডিটগুলোকে দেশটি আবার অর্থের বিনিময়ে তার বিভিন্ন কার্বন উৎপাদনকারী কোম্পানির কাছে বিক্রি করবে কিংবা বিনামুল্যে প্রদান করবে। ফলে কোম্পানিগুলো এখন কার্বন ক্রেডিটের মালিক অর্থাৎ নির্দিষ্ট পরিমাণ কার্বন উৎপাদনের লাইসেন্স প্রাপ্ত।
যদি এর চেয়ে বেশি কার্বন উদ্গীরণ সে করতে চায় তাহলে বাজার থেকে অন্য কোন কোম্পানি, যে কার্বন সাশ্রয়ী প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে নিজস্ব কোটার চেয়ে কম কার্বন খরচ করে কিছু কার্বন ক্রেডিট অব্যবহৃত রেখেছে কিংবা অন্যকোন দেশে বা স্থানে বনায়ন বা অন্যকোন কার্যক্রমের মাধ্যমে কার্বন অফসেট করে বা কমিয়ে কিছু কার্বন ক্রেডিট অর্জন করেছে- তার কাছ থেকে সেই কার্বন ক্রেডিট কিনে তার সমপরিমাণ কার্বন উদ্গীরণ করতে পারবে। এই ব্যাবসার উদ্দেশ্য হলো- যতই দিন যাবে কোম্পানির বৃদ্ধির সাথে সাথে কার্বন উদ্গীরণের প্রয়োজনীয়তাও বাড়বে কিন্তু কার্বন ক্রেডিট নির্দিষ্ট থাকার ফলে ঐ নির্দিষ্ট পরিমাণ কার্বন ক্রেডিটের জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে যাবে, কার্বন ক্রেডিটের দাম বেড়ে যাবে ফলে কোম্পানিগুলো বাধ্য হবে কার্বন ক্রেডিট না কিনে বরং কার্বন সাশ্রয়ি প্রযুক্তি কিনতে। এভাবেই নাকি বাজারের অদৃশ্য হাতের মাধ্যমে কোম্পানিগুলোকে বাধ্য করা হবে কার্বন সাশ্রয় করার কাজে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে-
এক. এ পদ্ধতিতে অধিক দূষণকারী দেশগুলো অধিক কার্বন ক্রেডিটের মালিক হচ্ছে অর্থাৎ অর্থের বিনিময়ে অধিক দূষণের লাইসেন্স পাচ্ছে। তারা একদেশে দূষণ কমানোর নামে কিংবা ক্ষতিপূরণের অর্থের বিনিময়ে নিজেদের দেশে দূষণ চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
ফলে একদিকে মোট কার্বন দূষণ তো কমছেই না বরং পৃথিবীকে রক্ষার জন্য তাদের অর্থনীতি ও জীবনযাত্রার যে মৌলিক পরিবর্তন এখনই জরুরী ছিল তা এই সুযোগে আরও পিছিয়ে যাচ্ছে এবং পৃথিবী আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে।
দুই. কার্বন অফসেট ব্যাবস্থা না থাকলেও কোন দেশের নিজস্ব প্রয়োজনে যে বনায়ন হতো সেটাকে এখন কার্বন ট্রেডিং এর আওতায় দেখিয়ে বলা হচ্ছে যে এই কার্বন সিংকিং বা কার্বন হজম প্রকল্পটি পাশ্চাত্য কোম্পানির কার্বন নি:সরণের ক্ষতিপূরণ (কার্বন অফসেট) হিসেবে করা হয়েছে- ফলে সেই কোম্পানির চলমান পরিবেশ দূষণ জায়েজ। ইতোমধ্যেই ফিউচার ফরেস্ট বা অধুনা কার্বন নিউট্রাল নামে পরিচিত একটি কোম্পানির জালিয়াতি ধরা পড়েছে। এরা ২০০২ সালে যুক্তরাজ্যের হাইল্যান্ড এন্ড আইসল্যান্ড এন্টারপ্রাইজের গড়ে তোলা বন অরবুস্ট এর 'কার্বন রাইটস্' কিনে নামকরা ব্যান্ড রোলিং স্টোনের কাছে বিক্রি করেছে রোলিং স্টোনের ট্যুর ও মিউসিক এলবামকে কার্বন-নিরপেক্ষ করতে।
তিন. কার্বন অফসেট প্রজেক্টের নামে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, ইকোপার্ক, মনোকালচার উডলট, জৈব জ্বালানী ইত্যাদি প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের ভূমি অধিকার কেড়ে নেয়া হবে যার নিদর্শন ইতোমধ্যেই ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশে দেখা গিয়েছে।
চার. প্রতি টন কার্বন এর মূল্য নির্ধারণ থেকে শুরু করে কার্বন নি:সরণের, কার্বন অফসেটিং, কার্বন ক্রেডিটের গুণগত মান অর্থাৎ এটি সত্যিকার অর্থে কতটুকু কার্বন অফসেট করবে, কতদিন অফসেট করবে ইত্যাদি বিষয়ে ব্যাপক অনিশ্চয়তা ও ফাটকাবাজীর নতুন সুযোগ উন্মুক্ত হচ্ছে।
পাঁচ. কার্বনঅফসেট প্রজেক্ট আকৃষ্ট করার জন্য উন্নয়নশীল দেশে গ্রীনহাউস গ্যাস বেশি উৎপাদিত হয় এমন ইন্ডাস্ট্রি তৈরীর প্রবণতা বেড়ে যাবে কেননা গ্রীনহাউস গ্যাস উদ্গীরণ হলেই সুযোগ আসে সেটাকে অফসেট করার বিনিময়ে অর্থ উপার্জনের।
ছয়. জেপি মর্গান চেজ, গোল্ডম্যান স্যাকস বা ক্রেডিট স্যূসির মতো বিনিয়োগ কোম্পানিগুলো নেমে গেছে কার্বন-ক্রেডিট নিয়ে ফাটকাবাজির খেলায়। ২০০৮ সাল পর্যন্ত র্কাবন ক্রেডিট এ বিনিয়োগের লক্ষে মোট ৮০ টি ইনভেষ্টমেন্ট ফান্ড গঠিত হয়েছে।
ফলে পরিস্কার, কোপেনহাগেন এর তোড়জোড়ের মাধ্যমে যেমনটি দেখানোর চেষ্টা চলছিল, স্বাভাবতই তেমন কোন বোধদয় হয়নি ধনী দেশের ধনীক শ্রেণীর- এখনও মুনাফা তাদের ভাবনার কেন্দ্রে; পরিবেশ বিপর্যয়ের ভাবনা সহ আর যা কিছু, সবই ছলাকলা।
জলবায়ুর বিপর্যয়ের সামরিকীকরণ:
জলবায়ু বিপর্যয়ে জলবায়ু উদ্বাস্তু হবে আমাদের মত দেশের কোটি কোটি মানুষ আর নিরাপত্তা বিপন্ন হবে নাকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের! আর এই নিরাপত্তা ইস্যূটাই নাকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টনক নড়ার মূল কারণ। গত কয়েক বছর ধরেই জলবায়ু বিপর্যয়ের সাথে সামরিক নিরাপত্তা বিষয়টিকে যুক্ত করে আলোপ আলোচনা চলছে। সর্বশেষ কোপেনহেগেনেও এবিষয়ে একটি পৃথক সন্মেলন হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবাজ সাবেক জেনারেলরাও জলবায়ু নিরাপত্তা বিষয়ক নানান পলিসি মেকিং এর সাথে যুক্ত আছেন। জাতি সংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ২০০৭ সালেই তারা এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন।
১১ জন সাবেক মার্কিন জেনারেল সেখানে একটি রিপোর্ট পেশ করেন যে রিপোর্টে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে চরম জলবায়ু পরিবর্তন, খরা, বন্যা, জলোচ্ছাস, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি, গলতে থাকা হিমবাহ ও গ্লেসিয়ার, জীবন যাত্রার পরিবর্তন এবং জীবন ধ্বংসকারী রোগজীবাণুর দ্রুত বৃদ্ধি ইত্যাদি মার্কিন স্বার্থের হুমকী হয়ে দাড়াবে যেখানে দ্রুত মার্কিন হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়ে পড়বে। রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে: "এই পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়ার আগেই এবং সন্ত্রাসবাদীরা এর সুযোগ নেয়ার আগেই যুক্তরাষ্ট্রকে ঘন ঘন এর মাঝে হস্তক্ষেপ করতে হতে পারে- একা অথবা সহযোগী দেশগুলোকে সাথে নিয়ে"। শুধু তাই নয় এর আগাম প্রস্তুতি হিসেবে মার্কিন সামরিক বাহিনী পরিচালিত ন্যাশনাল ডিফেন্স ইউনিভার্সিটিতে তারা খোদ বাংলাদেশকে নিয়ে একটা পরীক্ষাও চালিয়েছে যেখানে তারা দেখিয়েছে জলবায়ু বিপর্যয়ের ফলে বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার উদ্বাস্তু ভারতে স্থানান্তিরত হচ্ছে ফলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, মারণ ব্যাধির মহামারি ও অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে! এ সমস্ত দেখিয়ে তারা প্রস্তুুতি গ্রহণ করছে যেন সময় মতো 'প্রয়োজনীয়' সামরিক হস্তক্ষেপ তারা করতে পারে। (সূত্র: নিউ ইয়র্ক টাইমস, আগষ্ট ০৯, ২০০৯)
সাবধান! প্রথম সুনামির পর আসে দ্বিতীয় সুনামি:
২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে স্মরণ কালের ভয়াবহতম প্রাকৃতিক দুর্যোগ সুনামি আঘাত হানে শ্রীলংকার পূর্ব উপকূলে, সরাসরি নিহত হয় ৩৫ হাজার মানুষ এবং উদ্বাস্তু হয় মোট ১০ লক্ষ অধিবাসী যাদের অধিকাংশই হলো সমুদ্র উপকুলে বসবাসকারী জেলে সম্প্রদায়ের লোক। দুর্যোগের পরপর বেঁচে যাওয়া জেলেদেরকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল দূরবর্তী কিছু অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে।
প্রাথমিক বিপদ কেটে যাওয়ার পর যখন তারা আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ফিরে নিজ নিজ এলাকার সমুদ্রউপকুলে আবার ঘর বাধতে চাইল তখন নিরাপত্তার অযুহাত তুলে তাদেরকে সেখানে ঘরবাঁধতে বাঁধা দেয়া হলো। অথচ কিছুদিনের মধ্যেই সেই একই উপকুলে গড়ে তোলা হল হাজার হাজার ট্যুরিস্ট রিসোর্ট, হোটেল, ক্যাসিনো ইত্যাদি। আসলে ২০০২ সালে যখন তামিল টাইগার দের সাথে শ্রীলংকা সরকারের যুদ্ধ বিরতি শুরু হয় তখন থেকেই এ যুদ্ধ বিধ্বস্ত অঞ্চলের ভার্জিন বিচগুলোকে কাজে লাগিয়ে আনকোরা ট্যুরিস্ট স্পট গড়ে তোলার এক পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়। এ লক্ষে ২০০৩ সালে ইউএস এইড, বিশ্বব্যাংক ও এডিবি সম্মিলিত ভাবে 'রিগেইনিং শ্রীলংকা' নামের একটি পুনর্গঠন পরিকল্পনা চুড়ান্ত করে কিন্তু এ সবকিছুর পথে একমাত্র বাধা হয়ে দাড়ায় উপকূলীয় অঞ্চলের হাজার হাজার জেলে যারা যুগ যুগ ধরে সেসব স্থানে বসত করে আসছিল। অবশেষে প্রাকৃতিক সুনামি এসে প্রাকৃতিক ভাবে জেলেদেরকে উচ্ছেদ করে বিচগুলোকে বিরান করে দিয়ে শ্রীলংকা ও তার উন্নয়ন সহযোগীদের সুযোগ করে দেয় তাদের বাসনা চরিতার্থ করার।
প্রাকৃতিক সুনামির সুযোগে মানবসৃষ্ট দ্বিতীয় সুনামি নেমে আসে উপকুলবাসী অধিবাসিদের উপর। শ্রীলংকায় এসময় এভাবে তিরিশটিরও বেশি ট্যুরিস্ট স্পট তৈরী করা হয়। থাইল্যান্ড এবং ইন্দোনেশিয়াতেও একই ধরণের ঘটনা ঘটে। বিষয়গুলো লক্ষ করে নাওমি ক্লেইন তার সাম্প্রতিক বই ডিসাস্টার ক্যাপিটালিজম এ বলেছেন: "সামরিক ক্যু, সন্ত্রাসী আক্রমণ, বাজারের ধ্বস, যুদ্ধ, সুনামি, হারিকেন ইত্যাদি বিপর্যয় সমস্ত মানুষকে একটা কালেক্টিভ শক বা আঘাতের সম্মুখীন করে ফেলে। নিক্ষিপ্ত বোমা, সন্ত্রাসের আতংক কিংবা শো শো ঝড়ো হাওয়া সমগ্র সমাজকে কাদার মত নরম করে ফেলে- যেমন আঘাতের পর আঘাত নরম করে ফেলে কারবন্দী আসামীকে।
আতংকিত বন্দী যেমন বিপর্যস্ত হয়ে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সহযাত্রী বন্ধুর নাম ফাঁস করে দেয়, বড় ধরণের বিপর্যয়ের মুখে আতংকিত সমাজও অনেক সময় এমন সব কাজের অনুমোদন দিয়ে ফেলে যেগুলো অন্যসময় হলো তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়তো। "
জলবায়ু বিপর্যয়কে কাজে লাগিয়ে এ ধরণের কাজ কারবার ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে এবং তা হয়েছে কিয়োটো প্রটোকলের আওতায় জাতি সংঘের ইউএনএফসিসিসি পরিচালিত ক্লিন ডেভেলপমেন্ট ম্যাকানিজমের আওতায় । ওলন্দাজ সরকারের কয়লা ভিত্তিক বিদ্যূৎ প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় কার্বন অফসেট তৈরীর কাজে উগান্ডায় মাউন্ট এলগন এলাকার ৬০০০ অধিবাসীকে উচ্ছেদ করে ২৫,০০০ হেক্টর জমিতে বৃক্ষরোপন করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওরিগন রাজ্যের ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের কার্বন অফসেটের প্রয়োজনে শ্রীলংকার চা বাগানের দরিদ্র শ্রমিকদের জ্বালানো কুপিবাতির কার্বন নির্গমন হ্রাস করার জন্য তাদেরকে সৌর ঋণের মাধ্যমে সোলার প্যানেল বিক্রয় করে ঋণে জর্জরিত করা হয়েছে। স্কটল্যান্ডের গ্র্যাঞ্জমাউথ এলাকায় ব্রিটিশ পেট্রলিয়ামের তেল শোধনাগারের কার্বন উদগীরণ জায়েজ করার প্রয়োজনীয় কার্বন অফসেট করার জন্য ব্রাজিলের সাউ ডু বুরিতিতে ইউক্যালিপটাস বনায়ন করা হয়, যে ইউক্যালিপটাসের ব্যাপক পানি শোষণের কারণে বিশাল এলাকার মুরুকরণ ঘটে।
ভারত, চিন, মধ্য আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকায় এরকম আরো অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে।
কাজেই জলবায়ু বিপর্যয়ের মত একটি দীর্ঘস্থায়ী সংকটের সময় বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মানুষ ও প্রকৃতির অভিযোজন অর্থাৎ পানি ও কৃষি জমির লবণাক্ততা, প্লাবন ও জলাবদ্ধতা, মৎস সম্পদ, ধান ও সবজি চাষ, উদ্বাস্তু উপকুলবাসী ও জেলেস¤প্রদায়ের জীবন জীবিকা সংক্রান্ত সমস্যা মোকাবেলার ক্ষেত্রে লোকয়তা জ্ঞান ও স্থানীয় মানুষের অভিজ্ঞতা, মতামতের তোয়াক্কা না করে বিদেশী উন্নয়ণ সহযোগী ও কর্পোরেট পুঁজির মুনাফাবাজীর চেষ্টা চলবে নিশ্চিত। আর আভিজ্ঞতা বলে, এর ফলাফল হবে খোদ জলবায়ু বিপর্যয়ের চেয়েও ভয়ংকর ও দীর্ঘস্থায়ী।
অতএব জলবায়ু অভিযোজনে গণনজরদারি ও গণঅংশগ্রহণ এখন থেকেই জরুরী।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।