জলবায়ু পরিবর্তন পরিস্হিতির মোকাবিলা নিয়ে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে বিশ্বসম্মেলন ৭-১৮ ডিসেম্বর ২০০৯ চলার পর বলা চলে গতকাল তা শুন্য হাতে নিষ্ফলা হয়ে শেষ হয়েছে। জাতিসংঘের সদস্য ১৯২টি সব দেশ এই সম্মেলনে গ্রীণহাউস গ্যাস বা মূলত কার্বন নিঃসরণ (carbon emissions) উদ্গীরণে দুষণের ভয়াবহতার মধ্যে দুনিয়াকে রক্ষা করার পদক্ষেপ নিয়ে কথা বলার সুযোগ পেয়েছিল; যদিও সম্মেলনের কার্যকর কোন সিদ্ধান্তে তা পরিণত হতে পারেনি। ওদিকে, উন্নত দেশগুলোর "শিল্পে" অগ্রসরতার বড়াই আমরা শুনে আসছি বহুদিন থেকে যার আসল মানে, কার্বন দুষণের বড়াই। কিন্তু "শিল্পে" অগ্রসরতার বড়াই ও এর সুবিধা নিতে এতদিন তাদের আমরা যতটা আগ্রহী দেখেছি আজ বিপরীতক্রমে ঠিক ততটাই কার্বন দুষণের বড়াই ও দুনিয়া ধ্বংসের দায়দায়িত্ত্ব নিতে তারা দায়িত্ত্বহীনভাবে অনাগ্রহী ও পিছু হটে পালানোর অজুহাত খুঁজছে; শুধু তাই নয় একই ষ্টাইলে "শিল্পে"র নামে দুনিয়া ধংসের কারবার চলুক এটাই চাইছে।
প্রকৃতিতে সাময়িক আবহাওয়ায় পরিবর্তন নয়, জলবায়ু পর্যায়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি জনিত দুষণ বিষয়টা এমন যে বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর গড় গ্লোবাল তাপমাত্রা যদি দুই ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড বেড়ে যায় তবে সম্ভবত দুনিয়ায় আমাদের জানা প্রজাতিকুলের ৩০-৪০ পার্সেন্ট এর বিলুপ্তি ঘটবে।
গত পনেরই ডিসেম্বরে জাতিসংঘের এক কনফিডেন্সিয়াল ডকুমেন্টের একটা মন্তব্যে জানা যাচ্ছে, সম্মেলনের এপর্যন্ত কার্বন নিঃসরণ কাট করা সম্পর্কে ১.৫-২.০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড গড় তাপমাত্রা কমানো নিয়ে যে সব প্রস্তাব খুচরা আলোচনা চলছে তা আসলে প্রায় ৩.০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড গ্লোবাল তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে রোধ করার জন্য যথেষ্ট নয়।
দুনিয়ার সব পশু পাখি গাছপালা মানুষ জীব পানি আর জড় - এসব মিলিয়ে দুনিয়ায় একটা ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে বলেই দুনিয়া টিকে আছে; দুনিয়ায় এই জড় ও প্রাণের বৈচিত্রে এক ভারসাম্যে আছে বলেই একে আমাদের মত করে বা মানুষের দিক থেকে এটাকে ঠাউরে বলি - দুনিয়া মানুষের বসবাসের যোগ্য জায়গা। অথচ এখন গ্লোবাল তাপমাত্রা বাড়ার কারণে কেবল শুধু প্রজাতিকুল নয় ভয়ঙ্কর রকমের সব তাপদহ হল্কা, খরা, বন্যা, সাইক্লোন, সমুদ্রের উচ্চতা - ঘর, পেশা চ্যুত মানুষ - ক্ষতির এসবই আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে; কোথাও কোথাও সেসব ভয়ংকর ক্ষতির আলামতও দেখা দিতে শুরু করেছে।
এতদিন মনে করা হত, এখনও অনেকেই তা ভাবেন, মানুষ-প্রকৃতির সম্পর্ক হলো যেন জবরদস্তি করে প্রকৃতির জানু চেপে নিজের আহার সংস্হান বের করাই মানুষের কাজ; আর যথেষ্ট উদার নয় এমন প্রকৃতির বিরুদ্ধে নিজের শ্রেষ্ঠত্ত্ব কায়েম করাই হচ্ছে মানুষের ধর্ম। এটাকেই আমরা অনেকের মুখে বলতে শুনি মানুষ তার পরিচয় দিচ্ছে - "প্রকৃতি জয়ী মানুষ" - বলে, আর এর ভিতরই মানুষ-প্রকৃতির সম্পর্ক নিয়ে কী ভাবা হয় তা জাহির হতে দেখেছি।
তার মানে প্রকৃতির জানু চেপে ফসল বা মানুষের আহার সংস্হান বের করাই কী মানুষের কাজ, মানুষ-প্রকৃতির সম্পর্ক ? নাকি মানুষ প্রকৃতির এক প্রজাতি মাত্র; জড় প্রাণের বৈচিত্রের এক ভারসাম্য এই প্রজাতির বসবাস বেঁচে থাকার শর্ত তৈরি আছে তাই এই মানুষ-প্রজাতি প্রকৃতিতে, দুনিয়ায় আছে?
তবে, মানুষ প্রকৃতির এক প্রজাতি মাত্র - এই বয়ান একটু কম-করে-বলা বয়ান, আন্ডার-ষ্টেটমেন্ট। মানুষ এমনই এক প্রজাতি যে বোঝাবুঝির ক্ষমতা রাখে, জ্ঞান বলে যাকে চিনি - এমন এক শারীরীক ফ্যাকাল্টি ও যোগ্যতা তাঁর আছে। ফলে মানুষ নিজে কেবল প্রকৃতির এক প্রজাতি-মাত্র হলেও সারা প্রকৃতির নিয়ম কানুন, ছন্দ, বৈপরিত্য, বৈচিত্র ভারসাম্য - অর্থাৎ প্রকৃতির মধ্যে বসে থাকা নিজেকেসহ সব কিছু সে জানতে বুঝতে পারে। ওদিকে জানা বুঝা মানেই আবার সমস্যা - কারণ মানুষের জানাবুঝা মানে একইসাথে নিজের কর্তব্য করণকর্ম বোধ জাগা; জেনে বুঝে তো কেবল জ্ঞানের পাথর বা ডিব্বা হয়ে বসে থাকা যায় না কারণ, মানুষ মানেই তো একশন - সক্রিয়, তৎপর মানুষ। ফলে কথা কোথায় দাঁড়াল - মানুষ তার কর্তব্য-ধর্ম পালনে কেবল নিজেকে নয়, সারা প্রকৃতির জীব জগৎ প্রাণ সবাই একটা প্রাণবৈচিত্রের মধ্যে ভারসাম্যে যেন থাকে - একে রক্ষা করা, দেখেশুনে রাখা - সেই কর্তব্য।
আমরা মৌলবি হলে বলা যেত - মানুষ নূহ নবীর মত দুনিয়াতে আল্লার প্রতিনিধি বা খলিফা হয়ে এই কর্তব্য পালন করে; অথবা, এটা মানুষ আশরাফুল মুখলুকাত হিসাবে তাঁর কর্তব্য; অথবা, প্রজাতি-মানুষ প্রকৃতিতে তাঁর সীমা-কর্তব্য জানে আর আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীকে পছন্দ করেন না - ইত্যাদি এইসব বয়ান।
পাঠক কারও খটকা লাগতে পারে এই ভেবে যে, তাহলে মানুষ আর প্রকৃতি - এদুইয়ের মধ্যে একে অপরের উপর বিজয় ঘোষণার করার সম্পর্কের ব্যাপার নাই তা হয়ত বুঝলাম কিন্তু, দুটোকে আলাদা সত্ত্বা ভাবতে পারি কী? না, আলাদা সত্ত্বা ভাবার প্রশ্নই উঠে না। আগেই বলেছি মানুষ প্রকৃতির এক প্রজাতি মাত্র - অর্থাৎ মানুষ প্রকৃতিরই এক হিস্যা বা অংশ। সেই অর্থে মানুষও প্রকৃতি তো বটেই। আবার কেবল মানুষের দিকে তাকালে ওর চিন্তা ফ্যাকাল্টি আছে - এই বিশেষ বৈশিষ্টটুকু বাদ দিলে সে তো প্রকৃতির আর পাঁচটা প্রজাতির থেকে আলাদা কিছু নয়।
এছাড়া আরও কথা আছে, মানুষ জন্য যা কিছুই তাঁর আহার ভরণপোষণ, জীবনযাপন, সংস্হানের উপায় - এসব কিছুই তো সে সংগ্রহ করে, করা সম্ভব হচ্ছে প্রকৃতির বাকী অংশ থেকে, বাকী অংশের জন্যই তা সম্ভব হচ্ছে; প্রকৃতিকে ভোগ (appropriation) করেই মানুষের জীবনধারণ, জীবন পুণরুৎপাদন ঘটছে, ঘটতে পারছে। ফলে কাকে মানুষ আর কাকে প্রকৃতি বলে ভাগ করব, না এটা অসম্ভব।
তবে ভাব প্রকাশে কথা বলার সময় মনে হয় আমরা মানুষ ও প্রকৃতি বলে একটা ভাগ করে ফেলি। আসলে এটা ঠিক ভাগ করা নয়; বলা উচিত হবে দুই দিক থেকে দেখার, দেখে বলার কারণে একটা পার্থ্ক্য। একই জিনিষকে বিভিন্ন দিকথেকে দেখে কথা বলা যায়, ফলে একটা আপাত পার্থক্য হচ্ছে মনে হতে পারে - এটা সেরকম।
সারকথায়, মানুষ প্রকৃতি যা তাই হয়ে উঠছে অথবা প্রকৃতিই মানুষ হয়ে উঠছে; এভাবে দুটোই বলা যায়।
কথা শুরু করেছিলাম পরিবেশ, জলবায়ু, দূষণ এগুলো নিয়ে - এখন পাঠক চিন্তা করে দেখতে পারেন কার পরিবেশ, জলবায়ু, দূষণ? মানুষের না প্রকৃতির?
দেখা যাচ্ছে প্রকৃতি, পরিবেশ ব্যাপারগুলো বুঝার ক্ষেত্রে একটা ঘোরতর মৌলিক ও গভীর ফিলসফিক্যাল বা ভাবদর্শনের ব্যাপার আছে আমরা যার কিছুটা ভিতরে ঢুকে পরেছিলাম। এখন আপাতত ফিরব।
তাপমাত্রা দুষণের কথা বলছিলাম। দুষণ নিয়ে কাজ করতে যেয়ে একে কোয়ানটিফাই করে অর্থাৎ একটা পরিমাণগত ধারণা তৈরি করতে হয়েছে।
এক্ষেত্রে একধরণের গ্রাউন্ড জিরো বা বেঞ্চমার্ক ধরা হয়েছে ১৯৯০ সালকে। ১৯৯০ সালের সময়ে গ্রীণহাউস গ্যাসের দূষণ যা ছিল দুষণের মাত্রা সে জায়গায় ফিরিয়ে আনতে কত কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে বা পাল্টা পদক্ষেপ নিতে হবে - এই নিয়েই ২৫% বা ৪০% দূষণ কাট করার কথার মানে দাঁড়িয়ে আছে। সেই সাথে আগামি কত বছরের মধ্যে এই ২৫% বা ৪০% দূষণ কাট করা হবে এটাও গুরুত্ত্বপূর্ণ; কারণ কত বছরের মধ্যে এটা সহ পার্সেন্টের কথা না বললে বছরে কত হারে কাট করা হবে সে কথা বুঝা যাবে না বা কোন মানে দাঁড়ায় না। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা ২০২০ সালের মধ্যে ২০% নিঃসরণ দূষণ কাট করা হবে - এটা ধরে নিয়ে এমন একটা ধারণা নিয়ে কার কী দায়, করণীয় তা নিয়ে আলোচনা আগাতে বলছেন। কিন্তু কোপেনহেগেন সম্মেলনে আমরা দেখলাম কিছুই আগাচ্ছে না।
কেন?
দুনিয়া, প্রকৃতি ধ্বংসের ঘটনাকে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সমস্যা বলে যদি দেখি, তার মানে এটা গ্রীণহাউস গ্যাস বা কার্বন নিঃসরণ উদ্গীরণের সমস্যা। ফলে কার্বন নিঃসরণ হার কমানো, ক্ষতিপূরণ - এসবের দায়দায়িত্ত্বের ভাগ নিয়ে ঠেলাঠেলি, কোন আইনী বাধ্যবাধকতার দলিল তৈরির বা না-তৈরির দরকষাকষি - এই হলো কোপেনহেগেন সম্মেলনের বিষয়।
আমরা অনেকে মনে করছি, জলবায়ুর ক্ষতির একটা ন্যায্য ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারলে এই বিশ্বকে ধ্বংস এর হাত থেকে রক্ষা কর যাবে। কিন্তু ক্ষতিপূরণ আদায় করেই কী এই বিশ্ব প্রকৃতিকে ধ্বংস হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব - এই প্রশ্নকে যাচাই করে দেখবার দরকার আছে।
লেখার বাকি অংশ পরের দ্বিতীয় ও শেষ পর্বে দেখুন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।