আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ব্যাডভেঞ্চার গল্পঃ সিকোরস্কির সিন্দুক

এ যেন গল্পের এক রাশান রোলেট। যে সবচেয়ে সুন্দর গল্পটি লিখবে, তাকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হবে...। আমি কাঁপছি- কারণ শ্রেষ্ঠতম গল্পটি এখন আমার মাথায়...

-"হ্যাপী বার্থডে টু মজিদ ভাই !!!" দরজা খুলতেই আমাদের চারমূর্তি চিল চীৎকারে পাড়া মাথায় তুলি। "...এন্ড ম্যানী ম্যানী হ্যাপী রিটার্নস !!" মজিদ ভাই স্বাভাবিক ভাবেই খুশি না হয়ে থাকতে পারেন না। তবুও, মুখে বিনয় এবং সেইসাথে 'কী দরকার ছিলো এসবের' জাতীয় একটা মিশ্র অভিব্যক্তি আনতে চেষ্টা করেন তিনি।

এবং ব্যর্থ হন। বিনয় জিনিসটা মজিদ ভাইয়ের একদমই আসে না। -" আহ ! কী যে জ্বালাতন করিস না তোরা ! মানে হয় কোন এসবের..." মজিদ ভাই সহাস্যে দরজাটা হাট করে খুলে দেন এবং আমরাও প্রবেশ করি ভেতরে। মজিদ ভাই হাত দেখিয়ে ছোট্ট ড্রয়িংরুম পেরিয়ে পাশের বেডরুমে প্রবেশের ইশারা করেন। আমরা মানে সেই চারজন।

ক্যাফেটরিয়ার নিষ্কর্মা কর্ণার আলোকিত করে রাখা টিচার ফরহাদ, নারীলিপ্সু কবির, ঘুমকাতুরে নান্টু আর আমি- পিপুল। নিয়মিত আড্ডাখানা ক্যাফেটরিয়া থেকে আজ আমাদের মজিদ ভাইয়ের বাসায় আসার কারণ আর কিছুই নয়- মজিদ ভাইয়ের জন্মদিন। যদিও মজিদ ভাইয়ের জবানীতে বিশ্বাস রাখলে গত পঞ্চাশ বছরে পৃথিবীর ইতিহাসে সবগুলো দুনিয়া কাঁপানো ঘটনাতেই তার প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিলো, তবুও মজিদ ভাইকে দেখলে তার বয়স কিছুতেই চল্লিশের ওপর বলে বোধ হয় না। মজিদ ভাই কী না পারেন ?? এই চাঁদে রাশিয়ান মহাকাশযান পাঠানোর উদ্যোগ বানচাল করে দিলেন আমেরিকার তরফ থেকে, এই তাকলামাকান মরুভূমিতে তুলকালাম করে পাকড়াও করলেন মার্কিন গুপ্তচর আবার পরক্ষণেই ফ্লাইং ডাচম্যানের সন্ধানে পর্তুগীজ জাহাজে করে পাড়ি দিলেন বিক্ষুদ্ধ সাগর। এহেন মজিদ ভাইয়ের জন্মদিন ভুলে যাওয়ার উপায় আছে আমাদের মত আড্ডাপ্রিয় চারমূর্তির ?? ...মজিদ ভাইয়ের বাসায় এই প্রথম আসা।

তিনরুমের এই ফ্ল্যাটে তিনি একাই থাকেন- এ আমরা আগেই জানতাম। বেডরুমের একপাশে সাজানো মোড়াতে আমরা আরাম করে হাত পা ছড়িয়ে বসি- আমি আর টিচার ফরহাদ। ঘুমকাতুরে নান্টু ভদ্রতার ধার না ধেরে একটা বালিশ আড়মোড়া করে শুয়ে পড়ে বড়সড় খাটটার একপাশে। নারীলিপ্সু কবির তার লিপ্সা পূরণে সদা তৎপর, পকেটে তার একটা বাইনোকুলার সর্বদাই থাকে, সেটা বের করে জানালার পাশে গিয়ে সে আশেপাশের বাড়ির ছাদ এবং বারান্দাগুলো পর্যবেক্ষণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে-কীসের খোঁজে, বলাইবাহুল্য। শালা খাচ্চর !! আর মজিদ ভাই বসে বসে তার জন্যে আনা উপহারের প্যাকেটটা খুলতে থাকেন।

সেটা থেকে বেরোয় চমৎকার একগুচ্ছ বই। আমাদের টিচার ফরহাদের বাছাই করা- মজিদ ভাইয়ের মতো বইপড়ুয়াদের পছন্দ না হয়ে উপায় নেই। -"থ্যাঙ্কু !! থ্যাঙ্কু !!" মজিদ ভাইয়ের গলায় উচ্ছ্বাস ঝরে ঝরে পড়ে খানিক। -"কিন্তু ইয়ে, মানে, মজিদ ভাই..." চাঁদা তুলে কিনে আনা উপহার দেয়াটা হালাল করার জন্যে সকলের মুখ চেয়ে আমাকেই একটু নীচে নামতে হয়। "মানে বলছিলাম কী, একটা খানপিনা হলে আর কী, মানে মন্দ হতো না।

মানে বেশ একটা উৎসব উৎসব ..." মজিদ ভাইয়ের মুখটা বেশ কাঁচুমাচু হয়ে পড়ে। খানিকটা অপরাধী বলেও দেখায় তাকে। "আহা ! এসব কী আর বলতে হয় রে ? আর তোদের আমার জন্মদিনে তোরাই যদি না খাবি- তবে আর কাদের জন্যে ওসব করবো বল্‌ ? তবে কী না, কথা হচ্ছে কী..." -"না না, মজিদ ভাই। তোমার কোনো কথাই এবার শুনছি না। " ঘুম ঘুম গলায় নান্টু বলে।

" এবার তোমার কাছ থেকে উইম্পিতে একটা জোরালো ট্রিট আমরা আদায় করবোই করবো। " আমার আর ফরহাদের গলায় জোরালো সমর্থন ধ্বনিত হয়। মজিদ ভাইয়ের মুখ আরো পাংসুটে দেখায়। "কিন্তু আমার যে, মানে... একটা সমস্যা... "। নাক গলায় কবীর।

হারামীটা কখন বাইনোকুলার গুটিয়ে রেখে ঘরের দিকে নজর দিয়েছে, তা আমরা খেয়ালই করিনি। ন্যাকা ন্যাকা গলায় সে আচমকা মন্তব্য ছোঁড়ে, "বাহ ! সুন্দর তো সিন্দুকটা। কোথা হতে পেলে মজিদ ভাই ?" কবীরের কথায় আমাদের মনোযোগও আকৃষ্ট হয় ঘরের এককোণায় পড়ে থাকা সিন্দুকটার দিকে। প্রস্থে আর উচ্চতায় প্রায় সমান সিন্দুকটা দৈর্ঘ্যে প্রায় চার ফুট। সামনে দুটো বড়সড় হাতল।

আমাদের সাথে সাথে মজিদ ভাইও সিন্দুকটার দিকে তাকান এবং, আমাদের চোখের ভুলও হতে পারে, তার চোখে মূহুর্তেই একটা স্বস্তির ছায়া ফিরে আসে। -"ওটা ? ওটাই যত নষ্টের গোড়া কোবরে, ওটার জন্যেই তো তোদের বাইরে খাওয়াতে যেতে পারছি না। আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। প্রাণ দিয়ে হলেও রক্ষা করবো এ সিন্দুক। " মজিদ ভাই বলেন।

আমাদের মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। পয়সা বাঁচানোর জন্যে মজিদ ভাই নানারকম ফন্দী-ফিকির করেছেন আগে। তাই বলে একটা সিন্দুকের দোহাই দেয়া? এমনটাতো আগে ঘটেনি কখনো! -"কেন মজিদ ভাই? ঐ সিন্দুকের ভেতরে খুব মূল্যবান কোন রত্ন আছে বুঝি ? তাই বুঝি ওটা পাহারা দিতে হচ্ছে তোমায় ?" প্রশ্ন করি আমি। -" মূল্যবান ? গুস্তাভ সিকোরস্কি যে সিন্দুকের পিছে লেগে আছে একযুগ ধরে, সেটার আসল মূল্য কী তোরা বুঝবি ? আচ্ছা, বলতো- আমায় গত এক সপ্তাহ ক্যাফেতে আসতে দেখেছিস?" -"না। " উত্তর দেয় ফরহাদ।

" আপনিই না গত হপ্তায় বললেন- আপনার কী এক নাটকের শুটিং এর কাজে ঢাকার বাইরে যাবেন ?"। মজিদ ভাই সম্প্রতি কী একটা প্রোডাকশান হাউসে পার্ট টাইম চাকরি নিয়েছেন, জানি আমরা। -"আরে সে কাজতো আমি কবেই শেষ করে ফেরত এসেছি। তবুও যে বাড়ির বাইরে পা দিচ্ছি না- তার কারণ হলো... কোবরে, একটু জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখ তো, বাদশা মিয়ার টি-স্টলের বাইরে এখনো লোকটা আছে কি না ?" মজিদ ভাই হঠাৎ কবীরকে আদেশ দেন। -"কোন লোকটা ?" জানালায় দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে কবীর।

-"প্রায় ছ'ফিট লম্বা। রোগা টিংটিঙ্গে। ফর্সা বেশ- খাড়া নাক। ব্যাকব্রাশ করা চুল। কটা চোখ।

" -"কটা চোখ কি না সেটা এতো দূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না মজিদ ভাই। তবে ওরকম একটা লোককে দেখতে পাচ্ছি। রাস্তার ওপারে হাঁটাহাঁটি করছে। পরনে জিন্স আর খাকি শার্ট। " -"সে-ই, ওটাই সে।

বুঝলি না, "মজিদ ভাইয়ের স্বগতোক্তি করেন। "গুস্তাভ সিকোরস্কি। কথা রেখেছে সে। বারো বছর পর ঠিকই আমায় খুঁজে বের করেছে দুনিয়া ঘুরে। " গল্পের গন্ধ পেয়ে নড়ে বসি আমরা।

কবীর দ্রুত এগিয়ে এসে খটে বসে পড়ে। পকেট হাতড়ে একটা সিগারেট বের করে এগিয়ে দেয় মজিদ ভাইয়ের দিকে। নান্টু ভালোমত একটু চোখ ডলে নিয়ে বালিশে এবার খাড়া হয়ে শোয়। মজিদ ভাই সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে সিন্দুকটার দিকে দৃষ্টি রেখে অন্যমনষ্ক স্বরে বলতে থাকেন। -"বুঝলি, সেবার গিয়েছিলাম জাম্বিয়ায়- মপুলুঙ্গু নামের একটা জায়গায়।

জাম্বিয়ার উত্তর পূর্বের তাঞ্জানিয়া সীমান্তের কাছাকাছি। অভিযানের মূল লক্ষ্য ছিলো রোডেশিয়ান মনস্টার। কি হলো ? চমকে উঠলি যে, নাম শুনিসনি বুঝি রোডেশিয়ান মনস্টারের ? হুম। ইয়েতির নাম তো শুনেছিস ? এ অনেকটা সে জাতের প্রাণী। আফ্রিকান উপকথায় প্রায়ই শুনতে পাবি।

রোডেশিয়ার উত্তরের জলাভূমি অঞ্চলের অসভ্য জুলুরা নাকি অনেকেই ঐ জলাভূমির মাঝে দেখেছে এক আজব জানোয়ার। মাথা আর লেজ নাকি কুমিরের মতো, গলাটা অজগর সাপের আর দেহটা জলহস্তির। আকারে নাকি সেটা প্রায় ডাইনোসরের সমান। অনেকে আবার বলে প্রানীটা স্রেফ একটা বিশালাকার ডাইনোসর, কেবল সেটার সাতটা সাপের মত মাথা রয়েছে। বিশ্বাস করছিস না তো ? গুড।

সভ্যজগৎ ঠিক তোর মতই ঐ অসভ্য উপজাতীয়দের কথায় কান দেয়নি বহুদিন। দিলো প্রায় ১৯০০ সালের দিকে। জেমস মার্টিন নামের এক ভূতত্ত্ববিদ ভদ্রলোক সোনার সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে একদিন দেখে ফেললেন এই জানোয়ার। নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেন নি মার্টিন সাহেবও, কিন্তু বিশাল কিছু একটা কুয়াশার মাঝে ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন তিনি ঐ অঞ্চলে। ভদ্রলোক জীবটার দিকে এগোতে চাইলেও তার চাকরেরা জানোয়ারটার ঘোড়ার মত ডাক শুনেই 'ডিঙ্গোনেক, ডিঙ্গোনেক- পালাও সাহেব' বলে ছুট লাগায়।

জুলু লোকেরা ঐ জানোয়ারকে 'ডিঙ্গোনেক' বলে ডাকে। মার্টিন সাহেব সন্ধ্যার ঘনিয়ে আসা আঁধারে রহস্যময় সে জানোয়ারের পিছু ধাওয়া করার মত সাহস দেখান নি। কিন্তু নিজের জার্নালে সম্পূর্ণ সজ্ঞানে লিখে গেছেন এই জানোয়ারকে দেখার কথা। ... গত একশো বছর ধরে টুকটাক আরো বহুবার এই জানোয়ারকে দেখা গেছে বলে রব উঠেছে। আর তাই এই রহস্য পাকাপাকি ভাবে ভেদ করতেই রওয়ানা দিলাম আমরা তিনজন।

... তিনজন মানে আমি, ফরাসী প্রানীতত্ত্ববিদ জেরাল্ড বার্থলোমিউ এবং রাশান এক শিকারী-বহুবছর ধরে যে ঐ অঞ্চলে ঘুরেছে বলে দাবি করে বিধায় তাকে করা হয়েছে এই অভিযানের পথপ্রদর্শক - গুস্তাভ সিকোরস্কি, হ্যাঁ- এইমাত্র কবীর যাকে দেখলি- ও ব্যাটাই। সিকোরস্কি বহুদিন ও অঞ্চলে আছে, স্থানীয় ভাষা 'সেঙ্গা'- যেটাতে আমাদের মালামাল বহনকারী কুলিরা কথা বলে- সেটা তার বেশ সড়গড়। বার্থলোমিউ আমার পুরোনো বন্ধু। মার্টিন সাহেবের জার্নাল পড়ে সে-ই এই অভিয়ানে আমাকে ডাক দিয়েছে, নিজে ছোটাছুটি করে যোগাড় করেছে অভিযানের জন্যে সরকারী অনুদান। পথেও তার সাথে কথাবার্তা বিশেষ হয়নি আমার।

মার্টিনের জার্নালের কিছুটা অংশ পানিতে ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে এবং আফসোসের বিষয়, ঐ জায়গাগুলোতেই ছিলো ঠিক কোন অঞ্চলে সাহেব সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন মনস্টারের। বার্থলোমিউ পুরোটা রাস্তায় গত তিনদিন ধরে জার্নালের পাঠোদ্ধারে ব্যস্ত। ... তৃতীয়দিন রাতের কথা। আমরা আপাততঃ লেক কোভিরান্ডোর দিকে এগুচ্ছি। মার্টিন সাহেব এ পথেই এগিয়েছিলেন- এ তার জার্নালেই রয়েছে।

সিকোরস্কির সাথে এতোদিনে আমার মোটামুটি একটা স্বাভাবিক কথাবার্তার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। সে আমায় শুধোলো, "সত্যি করে বলুনতো বাওয়ানা মাজিড, ঠিক কী খুঁজছেন আপনারা এ সাফারিতে ?" সঙ্গত কারণেই কুলিরা রাজি হতো না-যদি আমরা বলতাম আমরা ডিঙ্গোনেকের খোঁজে এসেছি। ওদের তাই বলা হয়েছে আমরা সোনার খোঁজে প্রসপেক্টিং-এ এসেছি। আমি সেটা আর ফাঁস করলাম না। -"কেন সিকোরস্কি?" হেসে পালটা প্রশ্ন করলাম আমি।

"এ অঞ্চলে সোনা ছাড়াও আর মূল্যবান কিছু আছে নাকি ?" সিকোরস্কির মুখটা কেমন যেনো গম্ভীর হয়ে গেলো। বললো, "সত্যি বলছেন বাওয়ানা - শুধু সোনা ? কোনো বাক্সের লোভে আসেননি তো ??" -"বাক্স ? কীসের বাক্স বলতো শুনি ?" আমার কেমন সন্দেহ হলো। কি বলতে চায় লোকটা, জানা দরকার। -"ঠিক বাক্স নয় বাওয়ানা, একটা সিন্দুক। " সিকোরস্কি বললো।

"কিন্তু... না থাক। সে জেনে আপনি আর কী করবেন..." এটুকু বলে সিকোরস্কি একদম চুপ মেরে গেলো। কোন কথাই আর তার মুখ থেকে বের করা গেলো না। আমারও মনে পড়লো- পুরো যাত্রায় স্থানীয় বাসিন্দাদের যতগুলো বসতি আমাদের চোখে পড়েছে- তার প্রতিটাতেই সিকোরস্কি খোঁজ করেছে একটা সিন্দুকের, কিন্তু প্রতিবার আমরা জানতে চাইলেই চুপসে গেছে। আমি একটু ভেবে দেখলাম।

লোকটা খারাপ নয়- আফ্রিকার এসব অঞ্চলে শিকারীরা নানা ধরণের গুজবে বিশ্বাস করে গুপ্তধনের জন্যে মরিয়া হয়ে ওঠে- এরও দেখি সে দশা। কাকতালীয় ভাবে ঠিক পরদিনই পথে স্থানীয় আদিবাসীদের যে বসতিটা দেখা গেলো- সেটাতেই আমরা খোঁজ পেয়ে গেলাম একটা সিন্দুকের। হ্যাঁ, এই সিন্দুকটাই। স্থানীয় অধিবাসীরা এই সিন্দুক পূজো করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে- কতদিন -তার সঠিক হিসাব কেউ দিতে পারলো না। সিন্দুকের গড়ন এবং তার গায়ের বিভিন্ন সূক্ষ্ণ কাজ দেখে আমি আর বার্থলোমিউ নিশ্চিত হলাম এটা আফ্রিকান কোন আদিবাসীদের তৈরী না।

অন্য কোথাও এটা তৈরী করা হয়েছে- কালক্রমে এটা এসে গেছে এই জাম্বিয়ায়। ঠিক করলাম এটা আমরা আদিবাসীদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে যাবো। কে জানে, হয়তো মূল্যবান কোন প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের জন্যে প্রয়োজনীয় সূত্র এ সিন্দুক থেকেই বেরিয়া আসতে পারে। সাথে পর্যাপ্ত পরিমানে অস্ত্রশস্ত্র ছিলোই। দুটো পুরনো রাইফেল আর শ'তিনেক রাউন্ড গুলির বিনিময়ে আমরা রাজার কাছ থেকে কিনে নিলাম সিন্দুকটা।

আদিবাসীরা প্রথমে আপত্তি করেছিলো তাদের দেবতাকে এভাবে নিয়ে যেতে দেখে- কিন্তু এই জাতীয় পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে রংচঙ্গে নানা খেলনা আর কাপড়চোপড় নিয়ে আসা হয়েছিলো। সেটার কিছু অংশ আমরা বিলিয়ে দিলাম গ্রামবাসীর মাঝে। সিন্দুকটা দেখতে বিশাল হলেও আদতে সেটা একেবারেই হালকা। দুজন কুলি সেটা বেশ আরামেই বয়ে নিয়ে আসতে লাগলো আমাদের সাফারির সাথে। সে রাতে, আমরা তাঁবু খাটিয়ে রাতের খাবার খেয়ে নেয়ার পর আগুনের পাশে বসে তামাক টানছি- আমি আর কুলিরা।

বার্থলোমিউ তাঁবুতে বসে জার্নাল উদ্ধারের চেষ্টায় ব্যস্ত। এমন সময় এলো সিকোরস্কি। -"বাওয়ানা মাজিড, আপনার কাছে একটা জিনিস চাইবার আছে। " মুখ নামিয়ে বললো সিকোরস্কি। -"সে কী কথা সিকোরস্কি, বলে ফেলো।

" -"বাওয়ানা, আপনাদের কাছে আমার যত পারিশ্রমিক হয়েছে- আমার সেগুলো দরকার নেই। তার বদলে আমায় এই সিন্দুকটা দেবেন ??" -"কী বলছো সিকোরস্কি। কোথাকার কোন এক সিন্দুক, তার ভেতরে মূল্যবান কিছু আছে কি না কে জানে, আদৌ আছে কি না তারই ঠিক নেই - তুমি হঠাৎ ওটার জন্যে ক্ষেপে উঠলে কেন ?" -"না না, বাওয়ানা। এমন কিছু নয়। কিন্তু... দিন না আমায় সিন্দুকটা।

" -"শোনো সিকোরস্কি," বললাম আমি। " এই সিন্দুক নিয়ে তোমার আগ্রহ আমার কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না। লুসাকায় ফিরে আমি সরাসরি এটা ওখানকার প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে জমা দেবো ব্যস্‌। এ বিষয়ে আর কথা না বললে আমি খুশি হবো। " -"কাজটা কিন্ত আপনি ঠিক করলেন না বাওয়ানা মাজিড," উদ্ধত স্বরে বলে উঠলো সিকোরস্কি।

"পস্তাবেন এর জন্যে। " -"তুমি কি আমায় হুমকি দিচ্ছো নাকি হে ??" আমিও গলা উঁচালাম। সিকোরস্কি এবার সামলে নিলো। "না বাওয়ানা, হুমকি নয়। এটা মানে... মাফ করবেন বাওয়ানা।

মাথার ঠিক নেই-কী বলেছি না বলেছি মনে রাখবেন না। শুভ রাত্রি। বিশ্রাম নিন। " কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সিকোরস্কি বেরিয়ে গেলো। ... সে রাতে।

তাঁবুতে শুয়ে শুয়ে ভাবছি সিকোরস্কির এই অদ্ভূত আচরণের কারণ। ভালোমত খুঁটিয়ে দেখলাম সিন্দুকটাকে আরেকবার। টর্চলাইটের উজ্জ্বল আলোয় মেপেও দেখলাম। লম্বায় ১.১৫ মিটার, প্রস্থ আর উচ্চতায় ০.৭ মিটার। নাহ, কোন গুপ্তকুঠুরী নেই।

সিন্দুকের ভেতরটাও ধুধু করছে। কী জন্যে এই সিন্দুক আকর্ষণ করছে সিকোরস্কিকে ?? সিন্দুকের ভেতরে আলো ফেলে খুঁটিয়ে দেখবার সময় নজরে এলো- গুটিগুটি করে কী যেন লেখা আছে ভেতরের গায়। লেখাটা প্রাচীন হিব্রুলিপি বলে মনে হলো আমার কাছে। এবং সেই মূহুর্তেই চট করে বুঝে ফেললাম এই সিন্দুকের রহস্য। এ যে প্রায় অলৌকিক ব্যাপার।

হাজার বছর ধরে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা খুঁজে ফিরছে এই সিন্দুক...। এটা যে আর্ক অভ কোভেন্যান্ট !!! " -"আর্ক অভ কোভেন্যান্ট ?" আমরা চারমূর্তি প্রায় একত্রে চ্যাঁচিয়ে উঠলাম মজিদ ভাইয়ের দীর্ঘ গল্পের এই পর্যায়ে। -"আর্ক অভ কোভেন্যান্ট মানে ঐ যে ইন্ডিয়ানা জোন্স 'রেইডার অফ দ্যা লস্ট আর্ক' ছবিতে যেই বাক্স উদ্ধারের জন্যে নাজি বাহিনীর সাথে টক্কর দিলো ??" টিচার ফরহাদ প্রশ্ন ছোঁড়ে। -"হুম, সেটাই। জানিস কেউ এই আর্ক অভ কোভেন্যান্টের আসল রহস্য ? ... জানিস না ? বেশ- বলছি।

জিনিসটা একটা সিন্দুক, যা ঈশ্বরের নির্দেশে ধর্মযাজক জ্যাকবের বারো বংশধর নির্মাণ করেছিল। আর সেই সিন্দুকে তারা সযত্নে রেখে দিয়েছিল ঈশ্বরপ্রদত্ত ১০টি অনুশাসনের বাণী। বলা হয়, যাঁর কাছে এ মহামূল্যবান ও পরম পবিত্র সিন্দুকটি থাকবে, তিনি মালিক হবেন পৃথিবীর সব শক্তির। সেই সিন্দুক নিয়েই তাই কালে কালে কত লোকে মারামারি করলো অসীম ক্ষমতার লোভে। বাইবেলে বলা হয়েছে, সিন্দুকটি আসলেই বানানো হয়েছে ঈশ্বরের নির্দেশে।

অ্যাকাসিয়া নামের মিসরের একটি পবিত্র গাছের কাঠ দিয়ে নির্মিত সিন্দুকটি পরে সোনা দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয়েছে। নির্মাণের পর থেকে বহু বছর ইহুদিরা এটি তাদের কাছে সযত্নে রেখেছিল। যখন ইহুদিরা ‘ল্যান্ড অব ক্যাননে’ এসে পৌঁছায়, তখন তাদের পথ দেখিয়েছে এ সিন্দুক। এই সিন্দুকের জন্যই জর্দান নদী দুই ভাগ হয়ে রাস্তা করে দিয়েছিল তাদের। রাজা ডেভিড ও তাঁর ছেলে সলোমন জেরুজালেমে স্থানান্তর করে সিন্দুকটিকে একটি মন্দিরে রেখে দেন।

বহু বছর পর ব্যাবিলনের সম্রাট নেবুচাঁদনেজার ধ্বংস করে ফেলেন মন্দিরটি। তারপর যে কী হলো তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। অনেকে বলেন, ব্যাবিলন সভ্যতাই সিন্দুকটি তার কাছে রেখে দিয়েছে। অনেকে আবার বলেন, সলোমন নিজেই সিন্দুকটির এমন ভবিষ্যত্ আন্দাজ করতে পেরে ‘ডেড সি’র কাছে একটি গুহায় সযত্নে রেখে দিয়েছিলেন। ইথিওপিয়ান খ্রিষ্টানরা দাবি করে, সিন্দুকটি আসলে ইথিওপিয়ার অ্যাজিউমে সংরক্ষিত আছে।

ফালতু কথা ওসব। আমি বুঝতে পারলাম দীর্ঘদিন ধরে দক্ষিণ আফ্রিকা আর জিম্বাবুয়ের লেম্বা সম্প্রদায়ের লোকেরা যে দাবি করে আসছে- সেটাই আসলে ঠিক। তাদের দাবি যে তাদের পূর্বপুরুষেরাই সিন্দুকটি বহন করে নিয়ে এসেছে। বুঝলাম- ঐ লেম্বাদের কাছ থেকেই কোনভাবে সীমান্ত পেরিয়ে এই সিন্দুক চলে এসেছে জাম্বিয়ায়। ... বার্থলোমিউও এই আবিষ্কার দেখে উত্তেজিত।

কিন্তু দুজনের কেউই বুঝে উঠতে পারলাম না এই সিন্দুকের কথা সিকোরস্কি জানলো কীভাবে। ভেবে কোন কূল পেলাম না। ঘুম থেকে উঠলাম বেশ বেলা করে। আর উঠেই বুঝলাম কিছু একটা গোলমাল আছে। বুঝতে দেরী হলো না একদমই।

ক্যাম্পের প্রাত্যহিক সকালের যে কর্মচাঞ্চল্য- সেটা একদম অনুপস্থিত। পুরো এলাকা কবরের মত নিশ্চুপ। বার্থলোমিউকে ঘুম থেকে তুলে আমিও বেরিয়ে এলাম তাঁবুর বাইরে। একখানা হ্রদের ধারে আমরা আস্তানা গেড়েছিলাম। অবাক হয়ে দেখি হ্রদের ধারে কাল রাত্রে খাটানো কুলিদের তাঁবুগুলোর একটাও নেই।

কেবল... কেবল সিকোরস্কি দাঁড়িয়ে আছে জনা তিনেক কুলি নিয়ে, শিকারীর হাতে একটা ভারী রাইফেল। -"কি হে বাওয়ানা মাজিড ? ঘাবড়ে গেলেন ?" সহাস্যে বললো সিকোরস্কি। "পাবেন না- কাউকেই পাবেন না। সব কুলির ব্যাটাকে কাল রাতে আমি নিজে পারিশ্রমিক দিয়ে ভাগিয়ে দিয়েছি। কেবল এই তিনটেকে পোষ মানিয়ে রেখে দিয়েছি সিন্দুকটা বহন করার জন্যে।

দেখলেন তো ?? বলেছিলাম না পস্তাবেন ? আমায় সিন্দুকটা দিয়ে দিলে কি এমন ক্ষতি হতো আপনাদের ?" -"বদমাশ !!" চ্যাঁচিয়ে উঠলো বার্থলোমিউ। "আর্ক অভ কোভেন্যান্ট তোর হাতে আমরা এমনি এমনিই তুলে দেবো, মশকরা পেয়েছিস ??" সিকোরস্কির বেশ অবাক হলো এ কথায়। "ওহ ! বুঝে ফেলেছেন এরই মাঝে ?? ভালো - আপনাদের আর বোঝাতে হলো না। আবার একই সাথে এটা খারাপ - ভেবেছিলাম আপনাদের জীবন্ত ফেরত যেতে দেবো তাঞ্জানিয়া সীমান্তে। কিন্তু এখন যেহেতু আপনারা সবই জেনে গেছেন, আপনাদের আর বাঁচিয়ে তো রাখা যায় না।

তাতে আমারই ক্ষতি। " -"দাঁড়াও !! দাঁড়াও !!" বলে উঠলাম আমি। "একটা কথা কিছুতেই বুঝতে পারছি না সিকোরস্কি। তুমি এই সিন্দুকের খোঁজ পেলে কীভাবে ??" -"খোঁজ় ?? তুমি জানো বাওয়ানা- কতদিন ধরে আমি এই সিন্দুক খুঁজে বেড়াচ্ছি ?? এগার বছর- ঠাট্টা নয়- এগারো বছর। রাশান সিক্রেট সার্ভিসে আমার বাদবাকি বন্ধুরা ঘুরে বেড়াচ্ছে লন্ডন, নিউইয়র্ক, প্যারিস।

আর আমি ? গুস্তাভ সিকোরস্কি- এগার বছর ধরে পড়ে আছি নোংরা আফ্রিকায় শুধুমাত্র এই সিন্দুকের জন্যে। শোনো বাওয়ানা, আমরা রাশানেরা বহুদিন ধরেই এই সিন্দুক খুঁজে আসছি- ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই। জানতাম এটাকে এ অঞ্চলের কোথাও পাওয়া যাবেই। ... আমার কাজ আপাততঃ শেষ। তোমাদের দুটোকে মেরে রেখে বাইরে কেবল প্রচার করতে হবে তোমাদের অকাল মৃত্যুর কথা।

কোনমতে এই আফ্রিকা থকে বেরুতে পারলেই হয়। তারপর এখান থেকে বেরিয়ে সিন্দুক নিয়ে আমি অনায়াসে চলে যাবো মস্কোয়। হয়েছে, আর কথা নয়। ঈশ্বরকে ডেকে নাও শেষবারের মতো। " সিকোরস্কি বন্দুক তাগ করলো।

আর ঠিক সেই মূহুর্তেই... নাম না জানা সেই হ্রদের পানিতে প্রচন্ড আলোড়ন উঠলো। ভুস করে মাথা তুললো দানবাকার কিছু একটা। আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে রাখা সিকোরস্কি এবং তিন জুলু কুলির পিঠের দিক থেকে শব্দ শুনে ফিরে তাকালো পেছনে। 'ডিঙ্গোনেক !! ডিঙ্গোনেক !! ' চ্যাঁচিয়ে উঠলো জুলু কুলিরা...। ওফ !! ভয়ঙ্কর এক জানোয়ার।

বিরাট আকারের দেহটার অর্ধেক জলের নিচে অদৃশ্য। অজগরের মত লম্বা গলার উপরে বসানো ড্রাগনের মতো কাঁটা দাঁতযুক্ত একটা ভয়ানক মাথা। প্রচন্ড দ্রুততার সাথে সে দাঁতের ফাঁকে সেটা চেপে ধরলো দুই জুলু কুলিকে। তাদের আর্তচীৎকার শেষ হবার আগেই হতভম্ব বার্থলোমিউর হাত ধরে আমি দৌড় দিয়েছি তাঁবুর ভেতরে। হতবাক সিকোরস্কি হাতের রাইফেল তাগ করেছে তখন সেই রোডেশিয়ান মনস্টারের দিকে।

তাঁবুর ভেতরে দ্রুত কম্পাস আর শুকনো খাবারের টিনে আমি বোঝাই করলাম সিন্দুকটা। বাইরে গুলির শব্দ শুনতে পেলাম দু'বার। বেরিয়ে দেখি শেষ জুলু কুলিটাও ঢুকে গেছে দানবটার মুখে। সিকোরস্কির হাতে রাইফেল নেই। বাঁচার উপায় না দেখে সে ছুটতে শুরু করলো তাঞ্জানিয়া সীমান্তের দিকে।

সিন্দুক পিঠে তুলে আমি আর বার্থলোমিউও আর দেরী করলাম না। দুজন মিলে ছুটলাম ফেলে আসা ট্র্যাক ধরে। লুসাকার পথে। হাজার গজ দূর থেকে শেষবারের মত একবার দেখে নিলাম রোডেশিয়ান মনস্টারকে। নাম না জানা সেই হ্রদে ডিঙ্গোনেক ডুব দিচ্ছে তখন।

মনে মনে তাকে ধন্যবাদ দিলাম আমাদের প্রাণ বাঁচানোর জন্যে। ... লুসাকায় ফিরে আসতে আমাদের সময় লেগেছিলো সাতদিন। সে যাত্রার বিস্তারিত বর্ণনা আর দিলাম না। বার্থলোমিউ হয়ে পড়েছিলো প্রচন্ড অসুস্থ। ও অবস্থায় সিন্দুকটা আর লুসাকার মত দুর্নীতিপরায়ণ জায়গায় রাখার সাহস পাইনি।

আমার সাথেই নিয়ে এসেছিলাম। মাস দুয়েক পরে অবশ্য বার্থলোমিউ চিঠি পাঠিয়েছিলো। সে চিঠিতে লেখা ছিলো- বেনামে সিকোরস্কি চিঠি দিয়েছে বার্থলোমিউকে। বলেছে, প্রয়োজনে পৃথিবীর সমস্তটা চষে ফেলে সে আমায় খুঁজে বের করবেই। আর্ক অভ কোভেন্যান্ট তার চাই-ই চাই।

... তারপর আমিও নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সিন্দুকটা সত্যিকারের কোন প্রাচীন লিপি বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়েও যাওয়া হলো না আর। তারপর এইতো, গত সপ্তাহ দুয়েক ধরে টের পাচ্ছি আমার পিছু নিয়েছে কেউ। দুদিন বাসার জানালা থেকে উঁকি মেরে বুঝলাম -এ আর কেউ নয়। সিকোরস্কি।

" আমরা চারমূর্তি নিশ্চুপ হয়ে বসে আছি। মজিদ ভাই আবারো কথা বলে উঠলেন- "বুঝলি তো, কেন তোদের বাইরে নিয়ে খাওয়াতে পারছি না। সিকোরস্কিকে জানাতে চাইনা এ শহরে আমার পরিচিত কারা আছে। তোদের বিপদ হলে সেটা কী তোরা সামলাতে পারবি ?? দুধের বাচ্চা তোরা- নেহাতই ভালো মানুষ... কাজেই আজ আর জন্মদিনের খাওয়া কপালে নেই তোদের। পারলে কাল একবার আসিস।

এখন চুপচাপ বেরিয়ে যা এ বাড়ি থেকে। খবরদার, সিকোরস্কি যেন ঘুর্ণাক্ষরেও না বোঝে তোরা আমার কাছে এসেছিলি। ..." আমরাও আসন্ন বিপদের মাত্রা বুঝতে পেরে চুপ হয়ে গেছি। কবীর চুপসানো, নান্টুর চোখ থেকে ঘুম উধাও, ফরহাদ মাথা চুলকাচ্ছে, আমি দমবন্ধ করে আছি। কোনমতে বেরিয়ে এলাম আমরা মজিদ ভাইয়ের বাসা থেকে।

রাস্তায় নামতেই ওপাশের টি-স্টল থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের পাশ কাটিয়ে গেলো একটা লোক। প্রায় ছ'ফিট লম্বা। রোগা টিংটিঙ্গে। ফর্সা বেশ- খাড়া নাক। ব্যাকব্রাশ করা চুল।

কটা চোখ। আড়চোখে লোকটার দিকে চেয়ে অজানা এক ভয়ে কেন যেন শিউরে উঠলাম আমরা। ... ***************************************************** পরদিন সাবধানে আমরা আবার এলাম মজিদ ভাইয়ের বাড়িতে। বাইরে খাওয়ার লোভটাকে অগ্রাহ্য করা যাচ্ছে না। গুস্তাভ সিকোরস্কির চেহারাটা রাস্তায় না দেখে স্বস্তি পেলাম বেশ।

কিন্তু মজিদ ভাইয়ের দরজায় বিরাট এক তালা দেখে মেজাজটা খিঁচড়ে গেলো। দরজার সাথে টেপ মেরে আটকানো একটা খামও দেখা গেলো- খামের ওপর আমাদের চারজনের নাম লেখা। খুলতেই ভেতর থেকে বেরুলো একটা চিরকুট। " স্নেহের চারমূর্তি, আর দেরী করা যাচ্ছে না। সিকোরস্কির হাত থেকে এই সিন্দুক বাঁচাতেই হবে।

নেলসন ম্যান্ডেলার সাথে আমার গতকাল কথা হয়েছে। তোরা যখন এই চিঠি পড়ছিস, আমি তখন দঃআফ্রিকার পথে। খাওয়াটা বকেয়া থাকলো। - মজিদ আহমেদ " ... হতাশ আমরা সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছি, হঠাৎ পথ রোধ করে দাঁড়ালো সেই ছ'ফিট লম্বা, রোগা গড়নের,কটা চোখের সিকোরস্কি। আমাদের উদ্দেশ্য করে বললো- "এই যে ভাইয়েরা, একটু শোনেন।

আপনারা কি তিনতলার মজিদ সাহেবের বাসায় গেছিলেন নাকি ??" এমন খাস বাংলা শুনে চট করে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলো, "সে কি ! আপনি বাংলা জানেন ??" হতবাক সিকোরস্কি আমার কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো, "বাংলা জানবো না মানে ? এ কেমন কথা..." আমরা চারজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করি। তাইতো, আফ্রিকান আদিবাসীদের 'সেঙ্গা' ভাষা যে লোক বলতে পারে- বাংলা তো তার জন্যে কিছুই না। ফটকা কবীর চট করে কথা ঘুরিয়ে বলে, "না - মানে আপনার কটা চোখ দেখে আপনাকে বাঙ্গালি বলে মনে হয় না কি না..." লোকটা বলে চলে, " কী যে বলেন ভাই। আমার চৌদ্দপুরুষ বাঙ্গালি। আমার নাম প্রাণগোপাল পাঁচু দত্ত।

পান্থপথে 'ডিজিটাল ফার্নিচার' দোকানের সেলস ম্যানেজার। ... বিশ্বাস করবেন আপনারা, এই বাড়ির তিনতালার মজিদ সাহেব নামের একজন নাটকের কথা বলে দোকান থেকে একটা বাহারি সিন্দুক ভাড়া নিয়ে এসেছে মাসখানেক আগে। কী বলবো ভাই, প্রতিদিন নানা টালবাহানা করে ঘোরাচ্ছে আমায়। জোচ্চোর যে কত রকমের হয়... "

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।