ন্যুজু শরীরটার ভার বহনের দায় হাতের লাঠিটির। কানে প্রায় শুনেনই না, চোখেও ছানি পড়েছে। নদী তার কাছের মানুষদের দুরে ঠেলে দিয়েছে। কেড়ে নিয়েছে সহায় সম্বল। নদীর ভাঙ্গা গড়া, সংসারের ভাঙ্গা গড়া, জীবনের ভাঙ্গা গড়া, করতে করতে তিনি আজ প্রায় ক্লান্ত।
তবুও থেমে নাই তার জীবন। তিনি কালাই বেওয়া (১০০)। গ্রামের সবাই কালাই বুড়ি বলেই ডাকে তাকে।
কুড়িগ্রামের ধরলা পাড়ের গ্রাম হলোখানা হেমেররকুটি বাঁধের পাড়ে ছোট একটি ঝুপড়ি ঘরে থাকেন কালাই বুড়ি। প্রতি বছর বর্ষায় তার ঘরটিতে পানি উঠে তলিয়ে যায়।
বন্যা হলে পানির তোড়ে মিলিয়ে চলে যায় ধরলা থেকে ব্রহ্মপুত্র হয়ে সাগরে। তখনও দু’চারটা থালাবাটি নিয়ে কোন মতে হাতড়াতে হাতড়াতে উঠে পড়ে বাধেঁর উপরে। বাঁধটাকে আঁকড়ে ধরে থাকেন কয়েকদিন। তারপর পানি কমে গেলে আবারো খরখুটো দিয়ে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নেন নিজেই। সর্বশক্তি দিয়ে শক্ত পোক্ত করে বাঁধার চেষ্টা করেন ঝুপড়ির বেড়া চাল।
এই বাঁধটাই তো তার আশ্রয়দাতা! প্রায় সারা জীবন কোলেপিঠে করে রেখেছে তাকে। নিজের হাত-পা ঘাড়-গর্দান ছিড়ে গেলেও কালাই বুড়িদের ফেলে দেয়নি নদীতে। ববং নিজের বুক পাজড় কেটেও থাকতে দিয়েছে পরম মমতায়।
কালাই বুড়ির জন্ম হয়েছিল ধরলা পাড়ের গ্রামে। খুব ছোট বয়সে দাদির কোলে চড়ে গিয়েছিলেন পাশের পাড়ায় স্বামীর বাড়ি।
স্বামীর নাম কেরামত আলি। মারা গেছেন প্রায় চল্লিশ বছর আগে। কেরামত আলি ছিলেন দুধ ব্যবসায়ী। চরের গৃহস্থদের গরুর দুধ সংগ্রহ করে তিনি হাটে বাজারে বিক্রি করতেন। জমি জিরাত তেমন ছিল না।
যা ছিল বসত ভিটার মতো তাও গিলে খায় ধরলা। তাই তাদের বার বার করতে হয়েছে ঠিকানা বদল। সারা জীবন নদীর এপার -ওপার করতে করতে কালন- কেরামত আলী এক সময় চলে গেলেন চিরস্থায়ী ঠিকানায়। কালাই বুড়ি মরিয়ার হাসে হেসে বলেন, ওমরা (তিনি) মরিয়াও ঠিক থাইকবার (থাকতে) পায় নাই, যেটে (যেখানে) মাটি (কবর)দিছে পরের বার (বছর) সেখানও ভাইঙ্গছে (ভেঙ্গে) । তিন ছেলে মন্তাজ, এন্তাজ ও নওসাদ যে যার মতো আশ্রয়ের খোঁজে চলে গেছে।
তারা কোথায় থাকে তাও জানেন না কালাইবুড়ি। মেয়ে সোনাভানও বিধবা। তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে তিনিও বাধেঁ আশ্রিত। তার নিজেরই চলে না , তবুও মা তো , মাঝে মাঝে দেখেন। তাই কালাইবুড়িকে পুরোপুরি নির্ভর করতে হয় বয়স্ক ভাতার উপর।
কত টাকা ভাতা পান জানতে চাইলে বলেন, মুই(আমি) কিছুই জানোং(জানি) না। কতদিন পর কয় টাকা দেয় তাও জানং না। সে টাকা নিবার যাওয়া নাগে শহরের ব্যাংকে। অন্য কোন ভাতা পাওয়া ব্যক্তি এসে খবর দিলে তিনি রিক্সায় করে চলে যান শহরের ব্যাংকে। তিনি বলেন, ব্যাংকে যার শইল্লে(শরীরে) শক্তি নাই তার দিকে কাইয়ো(কেউ) দেখে না, ভীড় ঠেলার শক্তি কি মোর আছে? এই ভাতার টাকায় চলে খাওয়া-পরা-চিকিৎসা,থাকার ঘরটি মেরামতসহ সব কাজ।
সময়ের সাথে সাথে তিনি স্বামী, সন্তান, সংসারের সাথে সাথে হারিয়ে ফেলেছেন তার নিজের নামটাও। অনেক চেষ্ঠা করেও তিনি নিজের নামটি মনে করতে পারেননি। তিনি জানান, ছোট বেলায় মোর(আমার) একটা নাম আছিল(ছিল)। মোর নাম ধরি তো কাইয়ো (কেউ)কোনদিন ডাকায় (ডাকে) নাই। মানসে (মানুষে) তো কালাই বুড়ি কয়।
তিনি আরো বলেন, দ্যাশে (দেশে) কত আজা (রাজা) আসে আজা যায়, ভোটের সময় হইলে(হলে) সবায় (সবাই) ভোট চাবার(চাইতে) আইসে কিন মোর তো কপাল বদল (আমার তো ভাগ্য পরিবর্তন) হয় না। ঝড়,বন্যা ও নদী ভাঙ্গনের সাথে যুদ্ধ করে যার জীবন কেটেছে, নদীর গর্জন শুনতে শুনতে তার কেটে গেছে রাত। বাতাসের শব্দ ও নদীর গর্জন শুনে তিনি এক সময় বলে দিতে পারতেন ধরলার পানি সেবার কতোটা বাড়তে পারে বা নদীটা কোন দিকে ভাঙ্গবে। প্রতি বছর ভাঙ্গা গৃহস্থালী গুছিয়ে জোড়া লাগিয়েছেন। আবারো ভাঙ্গনের অপেক্ষা করে করে গেছে দিন মাস বছর।
যেন নিয়তি ভেবে সেটা মেনে নিয়েছিলেন। তাই অভ্যাসে পরিনত হয়েছে তার গোছাগোছি। তাছাড়া বেশীক্ষণ বসেও থাকতে পারেন না এক জায়গায়। লাঠিটিতে ভর দিয়ে খড়ি কুড়াতে হেঁটে বেড়ান চর থেকে চরে। চরে খড়ি পাওয়া দায়।
শুকনা গোবর,কাশের মুড়া কুড়িয়ে কোছায় নিয়ে ঘরে ফিরেন। সকাল-সন্ধ্যার রান্না পরে কিছুটা খড়কুটো জাবলিয়ে চলে শীত নিবারণ। জীবনেরই শেষ সময়টায় একটু নির্ভরতা বা নিশ্চয়তা চান কালাই বুড়ি। বলেন, মুই আর কোনোটে (কোথাও) যাবার (যেতে) না চাঙ (চাই)। এই বাধেঁর জাগাতেই(জায়গা) যেন মোর মরন হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।