অলসদের দিয়ে কী আর হয়। আলসেমি ছাড়া!
[১১ ও ১২ তারিখ ধরে ঢাকায় একটি উদ্ভাবনী মেলা হচ্ছে। আজ সমাপনীতে একটি প্রবন্ধ পড়েছি। ভাবলাম সবার সঙ্গে শেয়ার করা যাক। মেলায় হরিপদ কাপালী, কেনু মিস্ত্রী দুইজনই এসেছেন।
আজকের শেষণে হরিপদ কাপালী ছিলেন প্রধান অতিথি]
কৃষকটি তার ফসলের মাঠকে নিজের সন্তানের মতোই ভালবাসেন। সেজন্য সময় পেলেই তিনি চলে আসেন মাঠে। প্রত্যেকটি ধানের গোছাকে তিনি আলাদা করে চেনেন! সবই তাঁর আত্মার আত্মীয়। সেদিনও হাটতে হাটতে তার মনে হলো একটি গোছা কেমন জানি আলাদা। গোছা একটু বেশি পুরুষ্ঠু।
কী ভেবে সেটিকে আলাদা করে রাখলেন তিনি। নিয়মিত খোঁজ রাখলেন। ধান কাটার সময় সেই গোছার ধানটিকে আলাদা করলেন। ভাবলেন পরখ করে দেখা যাক। পরের বার বীজতলা করার সময় সেই ধান আলাদা করে ব্যবহার করলেন, পৃথক বীজতলা বানালেন, আর সেই বীজ ব্যবহার করেলন একটি ছোট্ট প্লটে।
ফলনও ভাল পেলেন। ঠিক করলেন পরের বার ঐ ধানেরই চাষ করবেন। করলেনও। মাঠ জুড়ানো ধান দেখে আশে পাশের সবাই চমকিত। জানতে আসে তার কাছে- ভাই, তোমার এটা কোন ধান।
জবা দেন কৃষক - নাম জানি না। আমার মাঠ থেকে আলাদা করেছি। তুমি চাইলে পরের বার তোমাকে দেব, বীজ। সবাই দেখলো এই ধানের ফলন বেশি। আর বীজ নিয়েও তেমন টাল বাহানা নেই।
ব্যস, ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়লো এই ধান। দক্ষিণবঙ্গের হরিধানের কথা এখন বাংলাদেশের সবাই জানে। এমন কী জানে অন্য দেশের বিজ্ঞানীরাও। আমাদের এই কৃষক বিজ্ঞানীর নাম হরিপদ কাপালী।
রংপুর শহরের খেটে খাওয়া মজুর।
মঙ্গা মৌসুমে কাজ থাকে না। ঠিক করলো বগুড়া যাবে কাজের সন্ধানে। ‘তুমি যদি চলে যাও। তাহলে আমরা খাবো কী? আর টাকাই বা পাঠাবে কেমনে?’ স্ত্রীর প্রশ্নের জবা খোঁজে মজুর। ভেবে ভেবে চলে গেল একটু অবস্থাপন্ন এক বন্ধুসম লোকের কাছে।
জানতে চাইলো মোবাইলে সে টাকা ভরে কেমনে? জানলো ফ্লেক্সি করে টাকা ভরা যায় মোবাইলে, যে কোন জায়গা থেকে। মোবাইল বন্ধুর কাছে জানতে চাইলো কী রকম টাকা সে ভরে নিয়মিত। জেনে টেন বন্ধুকে বললো “আমি বগুড়া যাচ্ছি কাজের জন্য। আমি সেখানে তোমার ফোনে ১০০ টাকা ভরে দেবো। তুমি কষ্ট করে এর মধ্যে ৯৫ টাকা আমার বউরে দেবা।
তাহলে আর তোমাকে টাকা ভরতে হবে না। ” রংপুরের মজুর কথা মতো বগুড়া এসে কাজ পেলো বন্ধুর মোবাইলে টাকা ভরলো আর বন্ধু সে টাকা পৌঁছে দিল মজুরের পত্নীর কাছে। আমরা পেয়ে গেলাম টাকা স্থানান্তরের এক নতুন প্রক্রিয়া মোবাইল গ্রাম - মানিগ্রামের বাংলাদেশী সংস্করণ। দু:খের বিষয় রংপুরের উদ্ভাবক মজুরের নাম জানা হলো না কারোর!
রংপুরের মজুরের নাম জানা না থাকলেও গাইবান্ধার বিজ্ঞানী নামে পরিচিত ওমর আজাদ চৌধুরীকে অন্তত গাইবান্ধা এবং তার আশে পাশের এলাকার মানুষেরা চেনে।
আজাদের কাজ হলো শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে ‘বিজ্ঞানভীতি’ দূর করা।
তাতো আর সহজে দূর করা যায় না। তাই আজাদ তৈরি করলেন বিভিন্ন ধরণের শিক্ষা উপকরণ। এগুলো দিয়ে সহজে নানা জাতের বিজ্ঞান পরীক্ষা করা যায়, নানা সূত্রের প্রয়োগ দেখা যায়। সবচেয়ে বড় কথা আজাদের বিজ্ঞান পরীক্ষাগারের উপকরণগুলো খুবই সস্তা। মাত্র ৩০০ টাকার কিড দিয়ে ২০টি পরীক্ষা হয়তো করে ফেলা সম্ভব!
হরিপদ কাপালী, রংপুরের সেই নাম না জানা মজুর কিংবা গাইবান্ধার আজাদকে বিজ্ঞানী বা উদ্ভাবকের মর্যাদা দিতে কুন্ঠিত হোন অনেকে।
কিন্তু তারা সবাই সত্যিকারের বিজ্ঞানী, উদ্ভাবক।
বিজ্ঞান হলো প্রকৃতির রহস্যকে উন্মোচন করার জ্ঞান, সেটিকে নিজের, সমাজের আর মানব সভ্যতার দিন বদলে ব্যবহার করার জ্ঞান। বিজ্ঞানকে পুঁজি করে গড়ে উঠে প্রযুক্তি। আর দুই এর মিলনে একটি জাতির উন্নতি!
গ্যালিলিওর আমল থেকে আমরা আধুনিক বিজ্ঞানের একটি প্রথাসিদ্ধ পদ্ধতি দেখি - একটি প্রকল্প, সেটিকে যাচাই বাছাই করার জন্য নানা আয়োজন, কখনো সেটি বিজ্ঞানাগারে, কখনো আকাশে চোখ রেখে। পর্যবেক্ষণের খাতা মিলে যায় প্রকল্পের সঙ্গে , গড়ে উঠে তত্ত্ব।
বিকশিত হয় বিজ্ঞান, সভ্যতা। কেমন করে যেন আমরা এই পদ্ধতিকেই চূড়ান্ত বলে মেনে নিয়েছি। যদিও সেটি শেষ বিচারে চূড়ান্ত ছিল না। কারণ ক্রমাগত সত্যের কাছে যাওয়াটাই বিজ্ঞানের চূড়ান্ত গন্তব্য।
প্রথাগত বিজ্ঞানীদের বাইরে, হাজার বছরের ঐতিহ্যের অনুসারী বিজ্ঞানী, উদ্ভাবকদের বিজ্ঞানী বলতে অনেকে কুন্ঠিত থাকেন।
কিন্তু, ধরুন আদিম সেই মানুষটির কথা, যিনি প্রথম লক্ষ্ করেছেন এক ধরণের বুনো ঘাসকে পোষ মানানো যায়। সেই ঘাসে যে ফসল হয়, সেটিকে সিদ্ধ করে খাওয়া যায়। তাকে কী আমরা বিজ্ঞানী বলবো না? নিশ্চয় বলবো, কারণ মানুষের হাত ধরেই বিজ্ঞানের প্রকাশ, পরিবর্তন কিংবা বলা ভাল বদলে যাওয়া।
ঠিক সেই রকমেরই আমাদের দেশের হাজারো উদ্ভাবক, আবিস্কারক। এরকম অনেকেই এই মেলায় এসেছেন।
বাগেরহাটের তন্ময়ের কথা ভাবুন। তন্ময় দেখেছে টেলিভিশনের পিকচার টিউব নষ্ট হয় বেশি আর কম্পিউটার মনিটরের সার্কিট! ও ভেবেছে তাহলে নষ্ট মনিটর আর নষ্ট টেলিভিশন দিয়েতো অন্তত একটি মেরামত করা যায়!
বিজ্ঞানী হতে হলে কোতুহলী হতে হয়। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এমন যে, এখানে কৌতুহলের কোন স্থান নেই। ছোট বেলা থেকে আমাদের শিক্ষা দেওয়া হয় কিছু গৎ মুখস্ত করে সেগুলো পরীক্ষায় উগরে দিতে। শ্রেণীকক্ষে শিক্ষকেরা প্রশ্ন করতে উৎসাহ দেন না।
প্রশ্ন করতে উৎসাহ দেওয়া হয়না আমাদের পারিবারিক গন্ডিতে। ফলে, কৌতুহলের নিরন্তন মৃত্যু ঘটতে থাকে। প্রশ্ন না করতে করতে আমাদের শিক্ষার্থীদের মনোজগতে কোন কৌতুহল আর স্থায়ী হয় না। আমরা দেখছি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম দিন যখন শিক্ষার্থীদের জিঙ্গেস করা হয় তাদের কোন প্রশ্ন আছে কী না তখন তারা সমস্বরে জানতে চায় “পরীক্ষায় কোন প্রশ্ন আসবে?”এই রকম একটি বৈরি পরিবেশে বেড়ে উঠছে আমাদের আগামীদিনের জগদীশ চন্দ্র বসু, আমাদের এফ আর খান কিংবা আমাদের কুদরাত-ই-খুদা।
তারপরও দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক তরুন উদ্ভাবক, আবিস্কারক তাদের মেধা -মনন দিয়ে নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করছেন।
এদের জন্য আমাদের কী করা দরকার:
১. কাজের স্বীকৃতি : বিশ্বের অনেক দেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক প্রতিভা খুঁজে বের করার জন্য আলাদা সংস্থা থাকে। তারা আবিস্কারক উদ্ভাবকদের স্বীকৃতি দেন।
২. বিশেষ প্রশিক্ষণ : অনেকে নানাভাবে কাজের কৌশল শিখেন, সেটার প্রয়োগ বের করেন। কিন্তু সামান্য তত্ত্বীয় প্রশিক্ষণ তাদের কাজকে অনেক উন্নত করতে পারে।
৩. সহযোগিতা : এই সবের কোন কোনটি যদি প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা পায় তাহলে বদলে দিতে পারে সমাজের চালচিত্র।
আমার ধারণা দিন বদলের সরকার অপ্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞান চর্চ্চাকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।
[গতকাল মেলায় এসেছিলেন স্থপতি ইয়াফেস ওসমান। বলেছেন ওদেরকে কীভাবে সহায়তা করা যাবে সেটা ভেবে দেখবেন। তাঁর বিশ্বাস একটি পথ বের হবে। কারণ প্রযুক্তিই যে প্রগতির পথ সেটা তো আমরা মেনে নিয়েছি।
আমার স্থির বিশ্বাস এমনতরো বিজ্ঞানীদের আমরা অচিরে সহায়তা করতে পারবো। ]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।