এডিট করুন
দিন দিন পৃথিবীটা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। একসময় কোন বাসায় দুপুর বেলায় ভিখিরিরা গেলে তাদের ভাত খেতে দেওয়া হত। পানি চাইলে পানি দেওয়া হত। আমার মা যে কত গ্লাস হারিয়েছেন ভিখিরিদের পানি খেতে দিয়ে তার হিসাব নাই। পরে উনি একটা কমদামী কাসার গ্লাস কিনেছিলেন যাতে হারালেও দুঃখ কম লাগে।
আমি প্রায়ই ভিখিরিদের ভাত খাওয়া দেখতাম। তাদের সাথে সবসময় একটা ঝোলা থাকত। সেই ঝোলা ভরা থাকত চালে। মোটামুটি ভিখিরিদের বৈচিত্র্যময় জীবন দেখে আমারো মাঝে মাঝে ভিখিরি হতে ইচ্ছে করত।
ঈদ বা বিজয় দিবস প্রতিটি উৎসবেই মা পোলাও রান্না করতেন।
ঈদের সময় তো ছুটি পেতাম সাধারণত জানুয়ারীর শেষে স্কুল চলাকালীন সময়ে কিন্তু বিজয় দিবসের ছুটি ছিল ডিসেম্বরে, যখন স্কুল থাকত বন্ধ, বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল ইতিমধ্যে দিয়ে দিয়েছে। বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলের ফলাফল ( মাইর-ধোর ) প্রশমিত হতে হতে বিজয় দিবস চলে আসত। আমি মেতে উঠতাম পরিকল্পনায় কি কি করব এই দিনে। ঈদের মত আনন্দ না হলেও কিছু কম ছিল না। বরং অন্যভাবে আনন্দটা একটু বৈচিত্র্যময় ছিল।
কারণ ঈদের সময় দোকানপাট বন্ধ থাকত, রাস্তাঘাট থাকত ফাকা, কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যেত না। কিন্তু বিজয় দিবস মানেই ঘুম থেকে ঊঠেই উৎসব শুরু। ঘুম ভেঙ্গে যেত দেশের গান শুনে। এলাকায় কিছু কিছু যায়গায় মাইক দিয়ে গান বাজানো হত, "একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার, সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার", "একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়", "সালাম সালাম হাজার সালাম, সকল শহীদ স্মরণে", "মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি", অতি পরিচিত আত্মার সেই গান। ঘুম থেকে উঠেই গানগুলো শুনে মনে হত আজ আমাদের উৎসব।
আজ বিজয় দিবস। আজ একটি বিশেষ দিন, আজ বীরত্বের দিন।
বাবা একবার একটা বড়সড় লাল সবুজ পতাকা কিনে এনেছিলেন। খুব ছোট থাকতে একদিন বিজয় দিবসের আগের রাতে বাবা ঢাকা থেকে আসার পর উনার ব্যাগ থেকে বেশ বড় সাইজের একটা পতাকা বের করলেন। আমার খুশী দেখে কে! পতাকা নিয়েই ঘুমাতে গেলাম! ঘুম থেকে উঠে বাপ পুতে মিলে একটা বাশ জোগাড় করলাম লম্বা দেখে।
তারপর ঐটাতে পতাকা বেধে বাশটা আমাদের কারখানার ছাদের রডের সংগে বেধে দিলাম। রাস্তায় যেয়ে বিভিন্ন স্থান থেকে দাঁড়িয়ে পরীক্ষা করতাম পতাকাটা সবাই ঠিকমত দেখতে পাবে কিনা।
এরপর থেকে প্রতি বিজয় দিবসে ঘুম থেকে উঠে আমার প্রধান কাজ হল একটা লম্বা দেখে বাশ জোগাড় করা। তারপর সেই বাশের সাহায্যে পতাকা উত্তোলন। যদি একটু বাতাস বয়ে যেত তাহলে পতাকাটা উড়তে শুরু কতত।
খুব আনন্দময় দৃশ্য হত যখন পতাকাটা উড়ত। মনে মনে কামনা করতাম আজ সারাদিনই যেন বাতাস থাকে।
বিজয় দিবস উপলক্ষে বিটিভিতে সকাল সকাল অনুষ্ঠান শুরু হত। আমাদের বাসায় টেলিভিশন ছিল না। তাই সকাল বেলায় উঠেই আমার ধান্দা থাকত বন্ধু খসরুদের বাসায় যাওয়া।
কারন ওদের বাসায় টেলিভিশন আছে। কিন্তু মা নাস্তা না করে বের হতে দিবেন না। তাই ফাকি দিয়ে একফাকে বের হয়ে যেতাম ঘর থেকে। তারপর খসরুদের বাসায় বসে কতক্ষণ টেলিভিশন দেখতাম। আমি জানতাম মা আজকে সকালবেলা ঘরদোর সাফ করবেন, তাই নাস্তা হতে দেরি হবে।
সেহেতু কিছুক্ষণ খসরুদের বাসায় কাটিয়ে আসা যাক।
খসরুদের বাসায় কতক্ষণ অনুষ্ঠান দেখে আবার দৌড় দিতাম আমাদের বাসায়। বাসায় যেয়ে যথারীতি দেখতাম মা এখনো নাস্তা বানায় নি অথবা বাজারে চলে গেছেন মুরগী কিনতে। কারণ আজ পোলাও রান্না হবে। আমি তখন বাবার কাছ থকে দশটা টাকা চাইতাম।
উদ্দেশ্য পাচ টাকার কাগজের বাংলাদেশের পতাকা কিনব আর পাচ টাকার রঙ্গীন কাগজ কিনব। বাবা দশটা টাকা দিতেন আর আমি সেটা নিয়েই সোজা আরেক দৌড় দিতাম স্থানীয় এক দোকানে যেখানে কাগুজে পতাকা কিনতে পাওয়া যায়। মাঝে মাঝে দোকানের পতাকা শেষ হয়ে যেত। তখন ঘোরাঘুরি করতে হত দোকান থেকে দোকানে। তবে শেষমেষ পতাকা আর রঙ্গীন কাগজ নিয়ে ঘরে ফিরতাম।
ঘরে ফিরেই লেগে যেতাম দড়ির প্যাচ খুলতে। কারখানায় থাকতাম তাই দড়ি কিনতে হত না। কারখানার কাজে দড়ি সবসমই লাগে। শুধু সমস্যাটা হত দড়িগুলো ছিল প্যাচ লাগানো। দড়ির প্যাচ খোলা ছিল কঠিন একটা কাজ।
দড়ির প্যাচ খুলে লেগে যেতাম আঠা বানাতে। বাবা এই কাজে সাহায্য করতেন। এড়ারুট দিতে ঘন আঠা তৈরী করা হত। তারপরে কাগজগুলোকে তিনকোনাকৃতি করে কাটতাম কাচি দিয়ে। তারপর কারখানার আশেপাশে দড়ি দিয়ে বেড়ার মত বানাতাম।
যেখানে মনে চাইত একটা দড়িসজ্জা তৈরী করতাম। তারপর কাজ হল আঠা দিয়ে পতাকা আর কাগজ লাগানো। পতাকা একসময় শেষ হয়ে যেত। বাবার কাছে আবার হাত পাততাম, বাবা না দিলে মায়ের কাছে চাইতাম। কোন না কোন ভাবে জোগাড় হয়ে যেত।
তখন পাচ টাকারও অনেক দাম ছিল। আবার পাচ টাকা নিয়ে পতাকা কিনতে বের হতাম। আবার কাগুজে পতাকা দিয়ে চারপাশ ভরে ফেলা, এইসব করতে করতে প্রায় দুপুর হয়ে যেত। বিজয় দিবস উপলক্ষে টেলিভিশনে ছবি দেখান হত। আমি চিন্তা করতাম দুপুরে পোলাও খাব নাকি ছবি দেখব।
কোন কুল কিনারা করতে পারতাম না। কিন্তু আমার বাবা মা কখনই পরিবারের সবাই একত্রিত না হওয়া পর্যন্ত কোন উৎসবের খাবার খান না। ঈদের দিন আমি নামাজ পড়তে যেতাম এক ময়দানে বাবা আরেক ময়দানে। আমি ফিরতে দেরী করে ফিরে দেখতাম বাবা আমার জন্য না খেয়ে বসে আসে। তাই ছবি দেখার আশা বাদ দিতাম।
খেয়েদেয়ে দৌড় দিতাম আবার খসরুদের বাসায়। আসলে ঐদিন সারাদিনই দৌড়ের উপরে থাকতাম। নিজেকে কেমন যেন যোদ্ধা যোদ্ধা লাগত যুদ্ধ বিজয়ের দিনে। যোদ্ধারা তো দৌড়ের উপরেই থাকে সবসময় নাকি! খসরুদের বাসায় যেয়ে সিনেমার কিছু অংশ পেতাম। সেটাই গভীর আগ্রহের সাথে দেখতাম।
দেখা শেষ করে খসরু আর আমি কতক্ষন মুক্তিযুদ্ধ খেলতাম। লাঠি হত আমাদের বন্ধুক আর মাটির ঢেলা হত গ্রেনেড। ছবিতে কিছুক্ষণ আগে দেখা দৃশ্যগুলিই আমরা আবার মঞ্চস্থ করতাম। পাকিস্থানী বাহিনী হিসেবে ঠিক করতাম কোন পিলার অথবা গাছ অথবা ইটের দেওয়ালকে। তারপর সেই পিলার বা গাছের উপর চলত কাল্পনিক গোলাবর্ষণ আর মাটির ঢেলার গ্রেনেড ছোড়া।
মাঝে মাঝে গায়ের শার্ট খুলে মাথায় গামছার মত করে বাধতাম। বাসা থেকে আমাদের এই অপরিষ্কার খেলার জন্য কোনভাবেই গামছা দেওয়া হত না। খেলা শেষ করে সন্ধ্যার দিকে বাসায় আসতাম। তখন আবার ধান্ধা থাকত তিনটা টাকার জন্য। কারণ দশ পাচ এর পর তিনই উপযুক্ত।
তিনটা টাকা দিয়ে বারোটা বাজি/বোম/পটকা কেনা যাবে। ঐগুলা ফুটাবো। মাঝে মাঝে পতাকা কেনার সময়ই বাজি কিনে আনতাম। তবে বাজি ফুটানোর ব্যাপারে বাবার কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু কে মানে কার নিষেধাজ্ঞা! আজকেই ত বোমা ফাটানোর দিন! আজ বিজয় দিবস!
সারাদিন বাতাসে দেশাত্মবোধক গান বাজত।
একেবারে রাতে গিয়ে থামত মাইকগুলো। বাবা তাগাদা দিতেন পতাকা নামানোর। যখন গান বন্ধ হয়ে যেত তখন খারাপ লাগত। শীতের রাতে বোমা ফুটিয়ে বিশাল কর্মকান্ডে বিজয় দিবস উদযাপন শেষে কিছুটা মন খারাপ নিয়ে ঘুমাতে যেতাম। বিজয়ের আনন্দ বড় তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়।
এখন আর মাইকে গান বাজে না।
আমার সেই বয়সী বাচ্চাদের সেই দৌড়ও দেখিনা।
পতাকা এখন অঢেল পাওয়া যায়। আমার দোস্ত ফয়সালের একটা লাইব্রেরী আছে। ওর এক বছরের পতাকা আরেক বছর বিক্রি করতে হয়।
বাজি/পটকা ফোটানো এখন মনে হয় নিষিদ্ধ।
মনখারাপ কারো হয় কিনা জানিনা।
বিজয় দিবসে এখন সবাই কাজে ব্যাস্ত থাকে। নয়তো ঘুমায়।
অনেকেই আজ বিজয় দিবসে সকাল শুরু করে হিন্দি গান দিয়ে।
আমার উৎসব ফিরিয়ে দাও।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।