আমার সম্পর্কে বলার মতো কিছু নেই।
মার্কসবাদ ও নৈতিকতা
মার্কসবাদের মধ্যে ন্যায়পরতার কোনো অবস্থান রয়েছে কিনা সেই বিষয়টি নিয়ে সামপ্রতিককালে আলোচনা ও বিতর্ক অব্যাহত রয়েছে৷ এর প্রধান কারণ হলো মাকর্সবাদকে বিজ্ঞান বলে মনে করা হয়৷ সাধারণত বলা হয়ে থাকে, বিজ্ঞান হলো আদর্শ ও মূল্য নিরপেক্ষ এবং বিষয়গত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত৷ মার্কসবাদ যেহেতু বিজ্ঞান অতএব মাকর্সবাদের কেনো নৈতিক ভিত্তি নেই৷ মার্কসবাদীদের মধ্যেও মার্কসবাদকে প্রকৃতি বিজ্ঞানের মতো বিষয়নিষ্ঠ একটা অনড় বিজ্ঞান ও নিয়ম দিয়ে ব্যাখ্যার দৃষ্টবাদী প্রবণতা দেখা যায়৷ যার ফলে মার্কসবাদ হয়ে ওঠে নৈতিকতাশূন্য বিষয়নিষ্ঠ দৃষ্টবাদ৷ বিজ্ঞানবাদিতার নামে এতোকাল মার্কসবাদের নৈতিক দিককে অবহেলা করা হয়েছে৷ সামপ্রতিক কালে বিশ্লেষণী দর্শনের প্রভাবে, বিশ্লেষণী কৌশল প্রয়োগ করে মার্কসবাদের নতুন ভাষ্য প্রদান এবং মার্কসবাদের আদর্শগত বা নৈতিক দিক সম্পর্কে নানা ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে৷ এই ধারা সাধারণত বিশ্লেষণী মার্কসবাদ বা আদর্শিক মার্কসবাদ হিসেবে পরিচিতি লাভ করছে৷
মার্কসবাদের মধ্যে নৈতিকতার অবস্থান নিয়ে বিশ্লেষকরা প্রধানত দ্বিধাবিভক্ত৷ এক পক্ষ মনে করেন যে, মার্কসবাদের মধ্যে কোনো নৈতিক অবস্থান নেই৷ অপরপক্ষ মনে করেন যে, মার্কসবাদের অবশ্যই একটা নৈতিক ভিত্তি রয়েছে৷ বিশ্লেষণী মার্কসবাদী ধারা মার্কসবাদের ধারণাগত পরিচ্ছন্নতা, অদ্ব্যর্থকতা ও যৌক্তিক সঙ্গতি প্রদানের ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করলেও বিশ্লেষণের উপর অত্যধিক গুরুত্ব প্রদানের ফলে তাঁরা সমাজ বাস্তবতা ও সামাজিক প্রাসঙ্গিকতা থেকে অনেকটা দূরে সরে পড়েন৷ মার্কসবাদ ও নৈতিকতা প্রসঙ্গে বিতর্কটি খুবই আকর্ষণীয়, যা গভীর মনোযোগেরও দাবি রাখে৷ বর্তমান প্রবন্ধে মার্কসবাদের মধ্যে মানবিক নৈতিকতার কোনো অবস্থান রয়েছে কিনা সেটা অনুসন্ধান করা হয়েছে৷ মার্কসবাদের মধ্যে কোনো নৈতিক অবস্থান নেই_এই ধারাকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে৷ অপর দিকে, যাঁরা মার্কসবাদের মধ্যে নৈতিকতার অবস্থানকে প্রমাণ করতে চেয়েছেন, তাঁরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মার্কসবাদের বিষয়গত দৃষ্টিভঙ্গিকে অবহেলা করেন৷ নৈতিক দিকের উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব প্রদান করে তাঁরা নৈতিক চেতনাকে একটা স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে দাঁড় করবার প্রয়াস পান৷ বর্তমান প্রবন্ধে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে, মার্কসবাদের মধ্যে একটা ন্যায়পরতা ও মানবিক নৈতিক দিক রয়েছে, যা নীতিসর্বস্ববাদী নৈতিক ভাববাদ ও বুর্জোয়া মানবতাবাদ থেকে স্বতন্ত্র৷ বর্তমান সময়ে যখন মতাদর্শগত সংকট বেশ তীব্র এবং তা থেকে মুক্তির জন্য নানা কিছু হাতড়ানো হচ্ছে তখন মার্কসবাদের মানবিক সমাজের প্রকল্প, স্বাধীনতা, মুক্তি ও নৈতিকতা নিয়ে পুনর্ভাবনা আমাদের নতুন ইতিহাস বিনির্মাণে মতাদর্শগতভাবে সহায়ক হবার কথা৷ তবে তত্ত্বীয় মার্কসবাদ ও মার্কসবাদের নামে পৃথিবীব্যাপী প্রয়োগকৃত রাজনৈতিক মার্কসবাদের মধ্যেকার ফারাকটা আমাদেরকে মনে রাখতে হবে৷ বর্তমান প্রবন্ধটি তত্ত্বীয় মার্কসবাদের আলোকে রচিত৷ মার্কসবাদ ও নৈতিকতা বিষয়ক বিতর্কে গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলি দিক থাকলেও বর্তমান প্রবন্ধে কেবল মার্কসবাদের মধ্যকার মানবিক নৈতিকতার প্রসঙ্গটি তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো৷
২
কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিক এঙ্গেলস সনাতনী নীতিবিদ ছিলেন না৷ এ কারণে তাঁরা কোনো সুনির্দিষ্ট তাত্তি্বক নৈতিক মতবাদ প্রদান করেন নি৷ এতদসত্ত্বেও তাঁদের রচনার মধ্যে একটা মানবিক নৈতিকতার অবস্থান লক্ষ্য করা যায়৷ নৈতিকতা বলতে যদি একগুচ্ছ বাধ্যতামূলক অনপেক্ষ এবং ধ্রুব নিয়মের ইতিহাস অতিবতর্ী ও বাস্তবতানিরপেক্ষ প্রয়োগ বুঝায় তা হলে এই বিশেষ অর্থে বলা যেতে পারে মার্কস ও এঙ্গেলস এ ধরনের নৈতিকতাকে প্রত্যাখ্যান করেন৷ কিন্তু এই ধরনের অবস্থান হলো কান্ট-এর মতাদশর্ীয়৷১ কিন্তু নৈতিকতা বলতে যদি আমরা মানুষের কতগুলি মৌলিক মঙ্গলকে বুঝি তা হলে এ কথা বলতে কোনো অসুবিধা নেই যে, মার্কসবাদের মধ্যে অবশ্যই একটি নৈতিক অবস্থান রয়েছে, যেমনটা ব্রেনকার্ট ও টমাস কেইস মনে করেন৷২ এ প্রসঙ্গে চার্লস টেইলর-এর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য৷ তিনি মনে করেন, বৃহত্তর অর্থে মার্কসের মধ্যে একটা নৈতিকতা রয়েছে৷ টেইলর বলেন,
... it "Morality" means the Kantian morality, whose foundation is the moral quality of the will, and which issues in injunctions binding without regard to time or circumstance, then clearly Marx is bound to reject "morality". But if we use the term in a less restricted way, if we mean by "morality" a doctrine touching the fundamental human good and the way to realize it, where "fundamental" good is taken to mean a good which is inescapably and universally the good of man, then there can be no objection to speaking of a Marxist morality.নৈতিকতার এই ব্যাপকতর ও ভিন্ন অর্থে মার্কস ও এঙ্গেলসের মধ্যে একটা নৈতিকতার অবস্থান লক্ষ্য করা যায়, যা থেকে তাঁরা পুঁজিবাদের সমালোচনা করেন৷ টাকার-উড মনে করেন মার্কস ও এঙ্গেলসের মধ্যে কোনো নৈতিকতার অবস্থান নেই৷ টাকার-উডের অবস্থান সম্পর্কে এটা বলা যায় যে, তাঁরা খুবই সীমিত ও দৃঢ় অর্থে মার্কসবাদের মধ্যে নৈতিকতার অবস্থানকে নাকচ করেন৷ এ কথা সত্য যে, মার্কস সুনির্দিষ্ট ও আনুষ্ঠানিক কোনো নৈতিক তত্ত্ব প্রদান করেন নি৷ কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, মার্কসবাদ নৈতিকতাশূন্য৷ মার্কসের রচনার মধ্যে একটা সর্বব্যাপী নৈতিকতার পরিচয় পাওয়া যায়৷৪ মার্কস ও এঙ্গেলসের রচনা বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাবে যে তাঁদের রচনার নানা স্থানেই একটা নৈতিকতার অবস্থান আছে৷ তাঁদের রচনার মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবিরোধী মানবিক নৈতিকতা, ব্যক্তির আত্মরূপায়ণের আদর্শ, আত্মকেন্দ্রিকতা বিরোধী সমাজীকৃত জীবন, স্বনিয়ন্ত্রণমূলক সমাজ, স্বাধীনতা ও মুক্তির সামাজিক ও রাজনৈতিক নৈতিকতা বিদ্যমান৷ তবে এ কথা স্মরণ করা যেতে পারে যে, সনাতনী নীতিবিদদের মতো নীতিসর্বস্ববাদী কায়দায় মার্কস সমাজ বাস্তবতা বিযুক্তভাবে তাঁর নৈতিক অবস্থানকে ব্যক্ত করেন নি৷
মার্কস তাঁর ১৮৪৪ সালে অর্থনৈতিক ও দার্শনিক পাণ্ডুলিপি-তে বিচ্ছিন্নতার ধারণা প্রবর্তন করেন৷ যা ছিলো বিচ্ছিন্নতার ধারণা দিয়ে পুঁজিবাদের নৈতিক সমালোচনা৷ বিচ্ছিন্নতার ধারণা একটি নৈতিক মূল্য-বিষয়ক ধারণা৷ পেফার মনে করেন, মার্কসের বিছিন্নতার ধারণা একটি নৈতিক ধারণা৷ কমিউনিজম একটি নৈতিক ও রাজনৈতিক তত্ত্ব, যেখানে বিচ্ছিন্নতাবিরোধী মানবতাবাদী নৈতিকতা বিদ্যামান৷৫ বিচ্ছিন্নতার ধারণায় মার্কস দেখান, পুঁজিবাদে শ্রমিক তার উত্পন্নকে পায় না, তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে৷ এর মধ্য দিয়ে শ্রম তার কাছে একটা বাহ্য বিষয়ে পরিণত হয়, অর্থাত্ শ্রম তার অস্তিত্বের
অন্তঃসার নয়৷ শ্রমিক তার নিজেকে ফিরে পায় কাজের বাইরে৷ পুঁজিবাদী উত্পাদনের মধ্য দিয়ে শ্রমিক নিজেকে হারায়, তার শ্রম থেকে উত্পন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে৷ উত্পন্ন হয়ে ওঠে শ্রমের বা শ্রমিকের বিরুদ্ধ বিষয়৷ এভাবে পুঁজিবাদী উত্পাদন প্রক্রিয়ায় শ্রমিক তার নিজের জীবনকে বস্তুর মধ্যে অন্তভর্ুক্ত করার মধ্য দিয়ে সেই জীবনকেই হারায়৷ পুঁজিবাদে স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির বিরোধ চলে৷ এ থেকে মার্কস বলেন, "... the life which he has conferred on the object confronts him as something hostile and alien."পুঁজিবাদে শ্রমিক নিজকে বঞ্চিত করে বস্তুর দাসে পরিণত হয়৷ শ্রমিক এবং দৈহিক বিষয়ী সত্তা_এই দুভাবে সে নিজেকে রক্ষা করতে অসমর্থ হওয়ার মধ্য দিয়ে দাসত্বে নিপতিত হয়৷ শ্রমিক যত বেশি মূল্য তৈরি করে তত কম সে পায়, এভাবে তার জীবন হয়ে ওঠে দুর্দশাগ্রস্ত৷ মার্কস বলেন,
... the more the worker produces, the less he has to consume; the more values he creates, the more valueless, the more unworthy he becomes; the better formed his [worker] product, the more deformed becomes the worker; the more civilised his object, the more barbarous becomes the worker, the more powerful labour becomes, the more powerless becomes the worker; the more ingenious labour becomes, the less ingenious becomes the worker and the more he becomes natutre's servant...উত্পাদনের সাথে শ্রমিকের এই বঞ্চনার সম্পর্ককে মার্কস সমালোচনা ও প্রত্যাখ্যান করেন৷ তিনি বলেন, শ্রমিক ধনীদের জন্য আশ্চর্য সব জিনিষ উত্পাদন করে, কিন্তু সে নিজের জন্য তৈরি করে শুধুমাত্র বঞ্চনা৷ শ্রমিক ধনিক শ্রণীর জন্য তৈরি করে প্রাসাদ, কিন্তু নিজের জন্য পায় জীর্ণ কুটির৷ শ্রমিক সৌন্দর্য সৃষ্টি করে কিন্তু নিজের জীবনের জন্য সে পায় বিষণ্ন ক্লিশতা৷৮ স্পষ্টতই, মার্কস পুঁজিবাদী বিচ্ছিন্নতা উত্পাদকের জীবনে যে বঞ্চনা ও দুর্দশা নিয়ে আসে তাকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে নৈতিকভাবে সমালোচনা করেন৷ শ্রমের সাথে উত্পন্নের এই সম্পর্ককে তিনি কেবল উত্পন্নের সাথে শ্রমের বিচ্ছিন্নতা হিসেবেই দেখেন নি, উত্পন্নের সাথে শ্রমের বিচ্ছিন্নতাকে উত্পাদকের 'নিজের সাথে নিজের বিচ্ছিন্নতা' হিসেবেও দেখেন৷ একে তিনি ক্রিয়ার বিচ্ছিন্নতা এবং বিচ্ছিন্নতার ক্রিয়া উভয়ভাবেই দেখেন৷৯ তাঁর বক্তব্য, পুঁজিবাদী উত্পাদনে উত্পাদক তার নিজকে নাকচ করে৷ সে নিজকে অনুভব করে উত্পাদনের বাইরে, পুঁজিবাদী উত্পাদন প্রক্রিয়ায় শ্রমিক নিজকে হারায়৷ বিচ্ছিন্নতায় শ্রমিক তার স্বাধীনতাকে হারায়, উত্পাদন কর্মের বাইরেই কেবল তার জৈবিক ক্রিয়ার মধ্যে সে নিজেকে স্বাধীন বলে অনুভব করে৷ মানবিক ক্রিয়ার ক্ষেত্রে সে নিজকে পাশবিকতার বাইরে অনুভব করতে পারে না৷ পানাহার ও সন্তান উত্পাদন মানবিক ক্রিয়া হলেও অন্য সবকিছু থেকে বিছিন্ন করে সেগুলোকে জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য ও সর্বস্বে পরিণত করাকে মার্কস মানবিক ক্রিয়ার পাশবিক রূপ হিসেবে চিহ্নিত করেন৷১০ পুঁজিবাদী উত্পাদনে শ্রমিক বিচ্ছিন্নতা বোধ থেকে তার মানবিক রূপ হারায় এবং নিজকে খুঁজে পায় পাশবিকতার মধ্যে৷ এ থেকে তিনি বলেন, "What is animal becomes human and what is human becomes animal."11 মার্কস মনে করেন মানুষ হলো প্রজাতি সত্তা৷ পুঁজিবাদে প্রকৃতি ও মানুষে এবং মানুষে মানুুষে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়৷ প্রজাতি সত্তার বৈশিষ্ট্য হলো স্বাধীন ও সচেতন ক্রিয়া৷ মানুষ তার কর্মকে চেতনার অনুষঙ্গ করে৷ মানুষের এই সচেতন জীবন-ক্রিয়া পশু থেকে মানুষের পার্থক্য রচনা করেছে৷ এ কারণেই মানুষ সচেতন সত্তা; কিন্তু পুঁজিবাদে বিচ্ছিন্নতার ফলে এই অবস্থাটা উল্টে যায়৷১২ মানুষের শ্রমের উদ্দেশ্য হলো তার প্রজাতি সত্তার মূর্তায়ন, কেননা সৃষ্টির মধ্যেই সে নিজকে দেখতে পায়৷ কিন্তু পুঁজিবাদে সৃষ্ট বিচ্ছিন্নতার কারণে উত্পাদক তার সৃষ্টির মধ্যে নিজকে দেখতে পায় না৷ বিচ্ছিন্নতার ফলে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাধীন সচেতন ক্রিয়া লোপ পায়, বিচ্ছিন্নতা মানুষের শ্রমকে কেবলমাত্র জৈবিক অস্তিত্বের উপায়ে পরিণত করে৷ বিচ্ছিন্নতার ফলে মানুষ প্রজাতি সত্তা, প্রকৃতি, উত্পন্ন ও আধ্যাত্মিক সম্পদ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়৷ এভাবে পুঁজিবাদে বিচ্ছিন্নতার ফলে মানুষ তার মানবিক মর্যাদাকে হারায়৷
বিচ্ছিন্নতার ফলে মানুষ স্বাধীনতাকে হারায়৷ যখন শ্রমিকের নিজের কাজের ফল তার নিজের না হয়ে অপরের হয়, তখন সেটা হয়ে ওঠে একটি জবরদস্তিমূলক ক্রিয়া৷ পুঁজিবাদের বিচ্ছিন্নতা শ্রমিকের কাজকে একটা জবরদস্তিমূলক কর্মে রূপ দেয় এবং এভাবে উত্পাদককে বিচ্ছিন্ন সত্তায় পরিণত করে৷ পুঁজিবাদী ব্যক্তিগত সম্পত্তি থেকে যেমন বিচ্ছিন্নতার উদ্ভব হয় তেমনি আবার বিচ্ছিন্ন শ্রম ব্যক্তিগত সম্পত্তির কারণ, সম্পর্কটা পারস্পরিক৷ মজুরি-শ্রম, বিচ্ছিন্ন শ্রম ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি এর যে কোনো একটির অবসান অন্যগুলির বিলুপ্তি ঘটাবে৷ মার্কস ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসানের কথা বলেন৷ তিনি পুঁজি গ্রন্থে বলেন, "নিজ উত্পাদ থেকে শ্রমের, শ্রমের বিষয়গত অবস্থাসমূহ থেকে বিষয়ীগত শ্রমশক্তির বিচ্ছিন্নতা... পুঁজিবাদী উত্পাদনের প্রকৃত ভিত্তি এবং যাত্রা বিন্দু৷"১৩ মার্কস Grundrisse -এ পুঁজিবাদের বিচ্ছিন্ন শ্রমের কথা উল্লেখ করেছেন৷১৪ জার্মান ভাবাদর্শ গ্রন্থে পুঁজিবাদী ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসানের মধ্য দিয়ে পরক সম্পর্কের লুপ্তির কথা বলেছেন৷১৫ তিনি বিচ্ছিন্নতার মাধ্যমে নিজের শ্রমের সৃষ্টির ওপর অন্যের দখলদারিত্বের নিন্দা করেন৷ বিচ্ছিন্নতার ফলে যে অমানবিক ও পাশবিক বাস্তবতার মধ্যে মানুষকে জীবন যাপন করতে হয়, মার্কস মানবিক আদর্শ থেকে তার একটা নৈতিক সমালোচনা করেন৷ বিচ্ছিন্নতার বিরোধিতা করতে গিয়ে তিনি একটা মানবিক মূল্যবোধকে সামনে নিয়ে আসেন৷
৩
মার্কস ও এঙ্গেলসের রচনা থেকে দেখা যায় যে, তাঁদের মধ্যে একটি অনড় মানবিক নৈতিকতার অবস্থান রয়েছে৷ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যে অমানবিকতা ও বি-মানবিকীকরণ ঘটে তার বিরোধিতা করেন তাঁরা৷ এই বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে তাঁদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ বা নৈতিক বোধ ক্রিয়াশীল ছিল৷ মার্কস বলেন, "র্যাডিকাল হবার অর্থ হল বিষয়টার মূলটাকে উপলব্ধি করা৷ কিন্তু মানুষের বেলায় মূলটা হল মানুষ নিজেই... মানুষ হল মানুষের পক্ষে সর্বোচ্চ সত্তা, তাই আবশ্যক সেই সমস্ত সম্পর্কের শর্তহীন উচ্ছেদ দিয়ে যেগুলোতে মানুষ হল একটা হীনাবস্থ, দাসত্ববন্ধনে আবদ্ধ, পরিত্যক্ত, জঘন্য সত্তা...৷"১৬ মার্কসের এ বক্তব্য থেকে বলা যায় মানুষ ছিল মার্কসের কাছে মৌল বিষয় ও সর্বোচ্চ সত্তা৷ তিনি যে কোনো অমানবিক বাস্তব পরিস্থিতির বিরোধী ছিলেন৷ মার্কস পুঁজিবাদের মানবিকতা বিরোধী ভূমিকার সমালোচনা করতে গিয়ে 'যথার্থ মানবিক' বিবেচনা থেকে বিচ্ছিন্নতার সমালোচনা করেন, এবং মানবিতার বিকাশ ও মানবিক মর্যাদা খর্ব ও ক্ষুণ্ন করার দায়ে পুঁজিবাদের সমালোচনা করেন ওই মূল্যবোধগুলো এসব প্রতিষ্ঠার কথা বলেন৷১৭ তিনি মনে করেন, পুঁজিবাদে শ্রমের মধ্য দিয়ে মানুষ নিজ সত্তাকে হারায়৷ তাই পুঁজিবাদে মানুষ শ্রমিক বা পণ্য হিসেবে হাজির হয়৷ ফলে মানুষ শ্রমিক ছাড়া অন্য কোনো ভাবে বিবেচিত হয় না৷ এভাবে তার মানবিক গুণাবলি পুঁজির সেবায় নিবেদিত হয়৷ যার দরুন পুঁজির সম্পর্কের বাইরে মানুষের আর কোনো অস্তিত্ব থাকে না৷ পুঁজিবাদে উত্পাদক তার মানবিক সত্তাকে এভাবে হারিয়ে ফেলে৷
পুঁজিবাদী উত্পাদন মানুষকে পণ্যে পরিণত করে, অর্থাত্ এক্ষেত্রে মানুষ পণ্যের ভূমিকা গ্রহণ করে৷ পুঁজিবাদ মানুষকে শারিরীক ও মানসিক উভয় ভাবেই বি-মানবিক সত্তায় পরিণত করে৷১৮ মার্কস The Holy Family গ্রন্থে বলেন, পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিক তার জীবনের পরিবেশটাকে অমানবিক রূপের মধ্যে দেখতে পায়, এ কারণে মানুষ তার নিজেকে প্রলেতারিয়েতের মধ্যে হারিয়ে ফেলে৷ এ থেকে তিনি আরো বলেন, পুঁজিবাদী অমানবিকতার বিরুদ্ধে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বিদ্যমান সামাজিক অমানবিক পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে হবে৷১৯ মানুষ যদি তার পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়ে থাকে তবে মানবিকতা অর্জনের জন্য পরিবেশকেই করে তুলতে হবে মানবিক৷ মার্কস বলেন, "If man is shaped by enviornment, his environment must be made human"২০ এ থেকে বলা যায় যে, মার্কস পুঁজিবাদী পরিবেশটাকে অমানবিক হিসেবে বিবেচনা করেন এবং ভাববাদী নীতিসর্বস্বতার বিপরীতে মানবিক সামাজিক বাস্তবতা নির্মাণের মধ্য দিয়ে মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার কথা বলেন৷ পুঁজিবাদী অমানবিক অবস্থাকে একটা মানবিক মূল্যবোধ থেকে প্রত্যাখ্যান করেন৷ এভাবেই পুঁজিবাদের সমালোচনায় মার্কসের মধ্যে সর্বদাই একটা মানবিক মূল্যবোধ ক্রিয়াশীল ছিল৷ এঙ্গেলসও 'যথাযথভাবে মানবিক নৈতিকতা'-র কথা বলেন৷২১ শ্রেণী সমাজে বিদ্যমান শ্রেণী-নৈতিকতার স্তর বা বাস্তব ইতিহাসে শ্রেণী সমাজের স্তর অতিক্রম করার মধ্য দিয়েই এই যথার্থ মানবিক নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব বলে মনে করেন৷ পুঁজিবাদের সমালোচনায় তাঁদের মধ্যে এই মানবিক নৈতিকতা সক্রিয় ছিল৷
মার্কস কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে একটা মানবিক সমন্বয় ঘটানোর কথা ভাবেন৷ কমিউনিজমে মানুষ একই সাথে তার নিজেকে এবং 'অন্য মানুষকে' ধারণ করবে৷ এর মধ্যে দিয়েই ব্যক্তির নিজের অস্তিত্ব একই সাথে তার নিজের জন্য ও অন্যের জন্য হয়ে উঠবে৷২২ ফলে মানুষ হয়ে উঠবে সামাজিক মানুষ৷ নাগরিক সমাজে ব্যক্তি কতর্ৃক ব্যক্তিকে উপায় হিসেবে ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে ব্যক্তিকে পরক শক্তির খেলনায় পরিণত করা হয়৷ মার্কস মানুষকে উপায় হিসেবে ব্যবহার করার বিরোধিতা করেন এবং এটাও একটা দৃঢ় নৈতিক অবস্থান৷ তিনি নাগরিক সমাজের সমালোচনায় বলেন, পুঁজিবাদী আত্মকেন্দ্রিকতাবাদ হলো 'সবার বিরুদ্ধে সবার যুদ্ধ'_যার লক্ষ্য মানবিক সমাজ নয় বরং আত্মস্বার্থপরতার সিদ্ধি৷ নাগরিক সমাজের বা পুঁজিতান্ত্রিক সমাজের লক্ষ্য হলো মানুষে মানুষে ভেদ রচনা করা৷ মার্কস পুঁজিবাদী ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিনাশের মধ্য দিয়ে মানুষে মানুষে সত্যিকার সমন্বয়ী প্রতিষ্ঠা করতে চান৷২৩ নাগরিক সমাজের আত্মকেন্দ্রিক ব্যক্তিকে তিনি বিচ্ছিন্ন 'মোনাড' বা গবাক্ষ বিবর্জিত সত্তা হিসেবে চিহ্নিত করেন, যা মানুষের সাথে মানুষের ঐক্যের ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়, বরং 'মানুষকে মানুষ থেকে আলাদা' করার ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত৷২৪
পুঁজিবাদী আত্মকেন্দ্রিক স্বাধীনতার ধারণা অন্য মানুষের ভোগ ও মালিকানাকে উচ্ছেদ করে স্বাধীনভাবে অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করে৷ পুঁজিবাদে নাগরিকেরা এই আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপরতার দাসে পরিণত হয়, মানুষ হয়ে ওঠে নিষ্ক্রিয়৷ মানুষের চাহিদা হয়ে ওঠে আত্মস্বার্থপর আকাঙ্ক্ষা মাত্র৷ পুঁজিবাদী আত্মস্বার্থপরতার সমালোচনা করে মার্কস আত্মস্বার্থপরতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত মানবিক ব্যক্তি বিশেষের বিপরীতে মানুষকে তার প্রজাতি বন্ধনে সমন্বিত করার কথা বলেন৷ তিনি মনে করেন যে, কমিউনিজমে মানুষ হয়ে উঠবে সামাজিক৷ কমিউনিজমের এই সামাজিকীকরণের বৈশিষ্ট্যকে তিনি গুরুত্ব দেন৷ কারণ এই মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষ বিচ্ছিন্নতার কষ্ট থেকে মুক্তি পাবে৷ কমিউনিজমে মানুষের অস্তিত্বের ধরন সামাজিক হয়ে উঠার মধ্য দিয়ে ব্যক্তি হয়ে উঠবে সামাজিক৷ এ ভাবে বাস্তবতা হয়ে উঠবে মানবিক বাস্তবতা৷ যেখানে ব্যক্তির ক্রিয়া সামাজিকতা অর্জন করবে৷২৫ ফলে মানুষের ব্যক্তিক জীবন ও প্রজাতি জীবনের মধ্যে গড়ে উঠবে সমন্বয়৷ এঙ্গেলস বলেন, কমিউনিস্ট সমাজে ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির সংঘাতের অবসান হওয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হবে সামাজিক ঐক্য, সমাজে অমঙ্গলজনক অবস্থার অবসান ঘটবে৷ উত্পাদন ও বন্টন হয়ে উঠবে জীবনের প্রয়োজন অনুযায়ী৷ ফলে সকলের বিরুদ্ধে সকলের যুদ্ধের নিরসন ঘটার মধ্য দিয়ে মানবিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে, এবং মানুষ তার মানবিক প্রকৃতি ও সক্ষমতার বাস্তবায়ন করতে পারবে৷২৬ এঙ্গেলস কমিউনিস্ট সমাজকে যৌক্তিকভাবে সংগঠিত হিসেবে দেখেন, যেখানে সামাজিক যৌথ ক্ষমতা দিয়ে উত্পাদন ও বন্টন নিয়ন্ত্রিত হবে৷২৭ এর ফলে সমাজ জীবনের মধ্যেই ব্যক্তির স্বাভাবিক গুণাবলির সর্বতোমুখী চর্চা সম্ভব হবে৷২৮ কমিউনিজমে বস্তুগত উত্পাদন ও ব্যক্তির সম্মিলনের শর্ত তৈরি হবে এবং ব্যক্তি মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বতন্ত্রভাবে কোনো কিছুর পৃথক অস্তিত্ব থাকবে না৷২৯ মার্কস তাঁর নিজের বস্তুবাদের সাথে অন্যান্য বস্তুবাদের পার্থক্য প্রসঙ্গে বলেন, "পুরনো বস্তুবাদের দৃষ্টিকোণ হল 'নাগরিক' সমাজ; নূতন বস্তুবাদের [মার্কসের] দৃষ্টিকোণ হল মানবিক সমাজ বা সমাজীকৃত মানবজাতি [social humanity]৩০ অর্থাত্ নাগরিক সমাজটা হলো পুঁজিবাদী আত্মস্বার্থের দ্বন্দ্বে লিপ্ত সমাজ যা পুরনো বস্তুবাদের লক্ষ্য৷ মার্কসের নিজের নতুন বস্তুবাদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সমাজ হলো 'মানবিক সমাজ' বা 'সমাজীকৃত মানবজাতির'৷ এই 'মানবিক সমাজ'-এর অবস্থান থেকে তিনি পুঁজির সমাজ বা নাগরিক সমাজের সমালোচনা করেন৷ পুঁজিবাদের এই সমালোচনায় মানবিক সমাজের নৈতিক মূল্যবোধ যে ক্রিয়াশীল তা সহজেই দেখা যায়৷ যা হয়ে উঠেছে পুঁজিবাদের একটা নৈতিক সমালোচনাও৷
৪
মার্কস ও এঙ্গেলস তাঁদের রচনায় পুঁজিবাদী অমানবিক সামাজিক বাস্তবতার বিরুদ্ধে মানবিক বাস্তবতা বা পরিস্থিতির কথা বলেন৷ তাঁরা দারিদ্র্য, ক্ষুধা, যন্ত্রণা, ভিক্ষাবৃত্তি, স্বল্পায়ু, শারীরিক ও মানসিক নিগ্রহ, পুঁজির দাসত্ব, শ্রমিকের দুর্বিষহ জীবন, বঞ্চনা, অমানবিক পরিবেশ, নিষ্ঠুরতা ও নিষ্ঠুর পরিবেশ ও পাশবিক বর্বরতা ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করে পুঁজিবাদের সমালোচনা করেন৷৩১ এই সব শব্দ দিয়ে পুঁজিবাদের সমালোচনা করার মধ্য দিয়ে তাঁদের ভাষা হয়ে উঠেছে এক ধরনের মানবাহক নৈতিক ভাষা৷ তাঁরা মানবিক জীবন বিরোধী পরিস্থিতি ও অস্তিত্বকে মানবিক মূল্যবোধ থেকে সমালোচনা করেন, যার একটা বাস্তব বিষয়গত ও নৈতিক প্রত্যাখ্যান ঘটেছে তাঁদের ভাষার মধ্যে৷ মার্কস ও এঙ্গেলসের রচনা তুলে ধরলে বিষয়টি আরো সুস্পষ্ট হবে৷
এঙ্গেলস The Condition of the Working-Class in England গ্রন্থে ইংল্যান্ডের সে সময়কার শ্রমিক শ্রেণীর দুর্দশা এবং নৈতিক ও বৌদ্ধিক অধঃপতনের বিশদ অনুসন্ধান করেন৷ তিনি এখানে ইংরেজ বুর্জোয়া শ্রেণীর সৃষ্ট অমানবিক পরিস্থিতিতে শ্রমিক শ্রেণীর মানবেতর জীবন যাপনের বিষয়টি তুলে ধরেন৷ অর্থনৈতিক দুর্দশা ও নিষ্ঠুরতার কারণে শ্রমিক শ্রেণীর ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের নৈতিক অধঃপতনের চিত্র তুলে ধরেন এবং এর জন্য ইংরেজ বুর্জোয়া শ্রেণীর উদ্বেগের সমালোচনায় বলেন, অমানবিক ও বর্বরোচিত বিদ্যমান পুঁজিবাদী সমাজ-বাস্তবতার অবসানের মধ্য দিয়েই মানবিক অবস্থা তৈরি করে তার নিরসন সম্ভব৷ এঙ্গেলস বলছেন,
... English workers cannot feel happy in this condition; that theirs is not a state in which a man or a whole class of men can think, feel, and live as human beings. The workers must therefore strive to escape from this brutalising condition, to secure for themselves a better, more human position; and this they cannot do without attacking the interest of the bourgeoisie which consists in exploiting them.এটা স্পষ্ট যে, শোষণমূলক বিদ্যমান সমাজ-বাস্তবতার অবসানের মধ্য দিয়ে শ্রমিক শ্রেণীর মানবিক উত্তরণের বিষয়টি বিবেচনা করেন মার্কস ও এঙ্গেলস৷ মার্কস ১৮৪৪ সালের পাণ্ডুলিপি'তে মানবিক পরিস্থিতির এক বিশদ চিত্র তুলে ধরেছেন৷ তিনি মনে করেন, কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই কেবল মানবিক সমন্বয় ঘটবে বা মানুষ তার নিজের মধ্যে ফিরে আসবে৷৩৩ এছাড়াও তিনি তাঁর কমিউনিজমের ভাবনায় মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে ঐক্য স্থাপনের কথা চিন্তা করেন৷ মার্কস মনে করেন যে, বিকশিত মানবতাবাদ প্রকৃতিবাদেরই সমার্থক৷ তিনি বলেন, "...communism, as fully developed naturalism, equals humanism, and as fully developed humanism equals naturalism; it is the genuine resolution of the conflict between man and nature and between man and manÑthe true resolution of the strife between existence and essence..."৩৪ কমিউনিজমে সাধিত হবে প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যেকার ঐক্য৷ তা হয়ে উঠবে মানুষের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ প্রকৃতিবাদ, আবার একইসাথে তা হবে প্রকৃতির সাথে সমাঞ্জস্যপূর্ণ মানবতাবাদ৷
মার্কসের মতে পুঁজিবাদী ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসানের মধ্য দিয়ে মানবিক সকল অনুভূতি ও গুণাবলির পরিপূর্ণ মুক্তি ঘটবে৷ এই পর্যায়ে মানবিক অনুভূতি ও গুণাবলি বিষয়গত ও আত্মগত উভয়ভাবেই মানবিক হয়ে উঠবে৷ এভাবে কমিউনিজমে মানুষের অনুভূতি ও অনুভূতির মানবিক প্রকৃতি হয়ে উঠবে মানবীয়৷ স্থূল ব্যবহারিক আকাঙ্ক্ষা তার স্থূল রূপ বর্জন করে মানবীয় আদল অর্জন করবে৷৩৫ কমিউনিজমের পর্যায়ে মানুষের আকাঙ্ক্ষা আত্মপর হবে না, প্রকৃতি কেবল উপযোগের জন্য না হয়ে তা হয়ে উঠবে মানবিক উপযোগের জন্য৷ কমিউনিজমে মানুষ বিষয়ের মধ্যে নিজকে হারাবে না ফলে তাঁর মধ্যে বিচ্ছিন্নতা বোধের অবসান হবে৷ এটা সম্ভব হবে কেবল তখনই যখন বিষয় মানুষের নিজের জন্য হবে এবং ব্যক্তি যখন সামাজিক সত্তা হিসেবে আবিভর্ূত হবে৷ এই অবস্থা অর্জনের জন্য প্রয়োজন বিষয়গত জগত্টাকে সমাজের অন্তর্গত মানুষের জন্য সর্বত্র অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠা৷ এর ফলে মানুষের অন্তর্গত শক্তি প্রকাশের অনুকূল বাস্তবতা তৈরি হবে৷ মার্কস বলেন, যখন বিষয়গত জগত্টা মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তির মূর্তায়নের যোগ্য হবে তখন বিষয়গত অবস্থাটা হয়ে উঠবে মানবিক বাস্তবতা৷ এই অবস্থায় ব্যক্তি নিজেকে বাস্তবভাবে ব্যক্ত করার ধরন অর্জন করবে এবং ব্যক্তি হয়ে উঠবে জীবন্ত সত্তা৷৩৬ এভাবে পুঁজিবাদে ব্যক্তি বাস্তব ও সদর্থকভাবে নিজকে মূর্ত করতে পারে না বলেই মার্কসের পুঁজিবাদের সমালোচনা হয়ে উঠেছে মানবিক দিক থেকে একটা নৈতিক সমালোচনা৷
মার্কস মনে করেন, কমিউনিজমে এভাবে বিষয় ও বিষয়ীর, আধ্যাত্মিকতা ও বস্তুগততা, কর্ম ও দুর্দশা_এ সবের মধ্যকার বিরোধাত্মক অবস্থার অবসান ঘটবে৷৩৭ তিনি একটা ব্যবহারিক সমাধান দেন৷ তিনি মনে করেন যে, প্রকৃতি বিজ্ঞানের অগ্রগতির তাত্ক্ষণিক ফলাফল হিসেবে বি-মানবিকীকরণ ঘটেছে, বিজ্ঞান মানুষ ও মানুষের শ্রমের মধ্যে একটা বিচ্ছিন্ন ও বৈরী সম্পর্ক তৈরি করেছে৷ কিন্তু কমিউনিজমে এই বৈরিতার অবসান হবে৷ তাঁর মতে মানুষের ইতিহাস প্রাকৃতিক ইতিহাসেরই অংশ৷ কমিউনিজমের পর্যায়ে বিজ্ঞানের সাথে মানুষের বৈরিতার নিরসনের মধ্য দিয়ে প্রকৃতি বিজ্ঞান মানুষের বিজ্ঞানে পর্যবসিত হবে৷ মানব বিজ্ঞান হয়ে উঠবে প্রকৃতি বিজ্ঞান, ফলে তখন একটাই বিজ্ঞান থাকবে৷৩৮ এক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে মার্কস বিষয় ও বিষয়ীর মানবিক ঐক্যের প্রকল্প রচনা করেন তাঁর কমিউনিজমের তত্ত্বে৷ তবে সনাতনী নীতিবিদদের মতো করে নয়৷ মার্কস বিষয়গত বাস্তবতার এই মানবিক আদল অর্জনকে একটা বাস্তব-ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখেন৷ পুঁজিবাদের সমালোচনায় তাঁর মধ্যে পুঁজিবাদের বাস্তব সমালোচনা ও নৈতিক সমালোচনা উভয়ই অবিচ্ছিন্নভাবে বিদ্যমান৷ স্বার্থপর আকাঙ্ক্ষা, মানুষকে পরক শক্তির অধঃস্তনকরণ, প্রতারণা, লুণ্ঠন, পাশবিক বর্বরতা, স্থূল আকাঙ্ক্ষা, কৃচ্ছ্রকার উত্পাদক দাস, বঞ্চনা ও দারিদ্র্য_এসবের জন্য পুঁজিবাদকে দায়ী করেন৷৩৯ পুঁজিবাদী সমাজে মানবিক গুণাবলির ওপর অর্থের আধিপত্যের তীব্র সমালোচনা করে একে 'উল্টানো জগত্' বলে নিন্দা করেন এবং মানুষের সাথে মানুষের মানবিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য পুঁজিবাদের অবসানের কথা বলেন৷৪০
মার্কসের এসব অভিযোগ ও সমালোচনা হলো মানবিক আদর্শ থেকে এবং মানবিক সমাজের লক্ষ্যে পুঁজিবাদের নৈতিক সমালোচনা৷ পুঁজিবাদী অর্থনীতিরও একটা নৈতিকতা রয়েছে, সেও মোটে নৈতিকতামুক্ত নয়৷ মার্কস বলেন, "...political economyÑdespite its worldly and voluptuous appearanceÑis a truly moral science, the most moral of all sciences."৪১ সামাজিক বিজ্ঞান ও নৈতিকতার মধ্যে যে দ্বিখণ্ডিকরণকে খুব মান্য করে চলা হয় মার্কস তাকে অস্বীকার করেন৷ বিরোধটা আপাত; প্রকৃত অর্থে কোন বিরোধ নেই৷ দৃষ্টবাদের প্রভাবে নিওক্ল্যাসিকালরা বিজ্ঞান ও নৈতিকতার মধ্যে চরম বিভাজন করেন, তার ফলে সমাজবিজ্ঞানকে চূড়ান্তভাবে মানমুক্ত মনে করা হয়৷ কেইটা মনে করেন, নিওক্ল্যাসিকাল অর্থনীতি নিজেকে যতই মূল্য বা আদর্শিকতা মুক্ত বলে দাবি করুক না কেন তা প্রকৃত অর্থে প্রায়োগিক নীতিবিদ্যারই একটা রূপ৷ তাঁর ভাষায়, "the whole theoretical corpus of Neoclassical economic theory is to be understood as a kind of system of applied ethics."৪২ অমর্ত্য সেন একইভাবে অর্থনীতি ও নীতিবিদ্যার বিচ্ছেদের বিরোধিতা করেন৷৪৩ আসলে বিজ্ঞানের ভান করে অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞান নিজের নৈতিক অবস্থানকে আড়াল করে যতই নিরপেক্ষতার ভান করুক না কেন তা আসলে আদর্শ ও নৈতিকতা মুক্ত নয়৷ বিজ্ঞানের নিচে চাপা পড়া নিগূঢ় মানবিক সম্পর্ক, মূল্যবোধ ও নৈতিকতাকে উদ্ধার করা মার্কসবাদের একটা বড় কৃতিত্ব৷
পুঁজিবাদী নৈতিকতার লক্ষ্য হলো আত্মস্বার্থপরতা, শোষণ, লুণ্ঠন, প্রতারণা, বিচ্ছিন্নতা, অমানবিকতা ও মুনাফা অর্জন৷ পুঁজিবাদের সমালোচনার ক্ষেত্রে মার্কস মানবিক নৈতিক মূল্যবোধকে সামনে আনেন এবং পুঁজিবাদের বিপরীতে মানবিক ব্যবস্থা হিসেবে কমিউনিজমের কথা বলেন৷ কমিউনিজমের নৈতিকতা হলো একটা মানবিক নৈতিকতা৷ কমিউনিজমের যে মানবিক বাস্তবতার চিত্র ও প্রকল্প মার্কস প্রণয়ন করেন তা থেকে এটা বলা যায় যে, পুঁজিবাদ সমালোচনায় ও কমিউনিজমের ধারণার ক্ষেত্রে তাঁর মধ্যে মানবিক নৈতিকতা অন্তত জোরালোভাবে রয়েছে৷ পুঁজিবাদের অবসান ও কমিউনিজম প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক প্রকল্পের মধ্য দিয়ে মার্কস মানবিকতার বাস্তবায়নযোগ্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন৷
৫
মার্কস ও এঙ্গেলস পুঁজিবাদী ব্যবস্থাধীনে ব্যক্তি নিজকে বাস্তবে রূপায়িত করতে সক্ষম নয় বলে পুঁজিবাদের সমালোচনা করেন৷ মার্কস মনে করেন, কমিউনিজমে এমন এক অবস্থা তৈরি হবে যেখানে ব্যক্তি তার নিজকে বাস্তবায়িত করতে পারবে৷ কমিউনিজমে মানুষের সত্তা ও বাস্তব পরিস্থিতির মধ্যে একটা মিলন ঘটবে, যার ফলে ব্যক্তি তার নিজকে রূপায়িত করতে পারবে৷ ফলে মানুষ নিজকে একটা সামগ্রিকতার ভেতর সর্বাঙ্গীণরূপে বাস্তবায়িত করতে পারবে৷ তাঁর মতে, এতে করে মানুষের অভ্যন্তরীণ প্রজাতির ক্ষমতার বাস্তবায়ন সম্ভব হবে৷ এর মধ্য দিয়ে কমিউনিজমে সমৃদ্ধ মানব সত্তা ও সমৃদ্ধ মানবিক আকাঙ্ক্ষার উন্মেষ ঘটবে৷ পরিণতিতে, মানুষ হয়ে উঠবে স্বাধীন, জীবনের জন্য তাকে অন্যের মুখাপেক্ষী হতে হবে না, কমিউনিজমের মধ্য দিয়ে ইতিহাসে মানুষের মুক্তি ও উত্থান ঘটবে৷৪৪ এই পর্যায়েই মানব প্রকৃতির মধ্যে নবতর সমৃদ্ধি আসবে৷৪৫ এই স্তরের মানুষ স্বার্থপর আকাঙ্ক্ষা ও পাশবিক বর্বরতাকে অতিক্রম করে তার নিজেকে মানবিকভাবে বাস্তবায়নের সুযোগ লাভ করবে৷ কমিউনিজমের পর্যায়ে সর্বাঙ্গীণ পূর্ণ বিকশিত স্বাধীন ব্যক্তি সত্তার আবির্ভাব ঘটবে৷৪৬ সমাজীকৃত মানুষ সংঘবদ্ধ যৌথ উত্পাদক হবার মধ্য দিয়ে প্রকৃতির উপর মানুষের যুক্তিসিদ্ধ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে৷ ফলে কমিউনিজমে মানব প্রকৃতি বিকাশের সর্বাধিক অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হবে৷ প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষ তখনো প্রয়োজনের জগতে অবস্থান করবে৷ কিন্তু পরবতর্ীতে মানুষ এই পর্যায়কে অতিক্রম করে মানবিক ক্ষমতার একটা চূড়ান্ত বিকাশ সাধনের মধ্য দিয়ে এমন স্তরে উন্নীত হবে যে, তখন মানুষ নিজেই নিজের উদ্দেশ্যে পরিণত হবে৷৪৭
মানুষের এই পরিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ বিকাশের জন্য মার্কস পুঁজিবাদী ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসানের কথা বলেছেন৷ ব্যক্তিগত সম্পত্তির অবসানের মধ্য দিয়ে ইতিহাসে ব্যক্তির বৈশ্বিক উত্থান ঘটবে৷ কমিউনিজমে স্থানীয় ব্যক্তির পরিবর্তে বিশ্ব-ঐতিহাসিক বাস্তব ব্যক্তির আবির্ভাব হবে৷৪৮ এ কারণে তিনি কমিউনিজমকে মনে করেন 'ব্যক্তি মনুষ্যগণের বিশ্ব-ঐতিহাসিক সহযোগ৷'৪৯ বিশ্বায়নের একটা ধারণা এখানে মার্কসের মধ্যে আমরা পাই, তবে সেটা দুনিয়া জুড়ে লুণ্ঠনের সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন থেকে পৃথক মানবিক বিশ্বায়নের ধারণা৷ মার্কস ও এঙ্গেলস ব্যক্তির শ্রেণী অস্তিত্ব থেকে মানবিক অস্তিত্বে উত্তরণের কথা ভাবেন, কমিউনিজমের ধারণায়৷ শ্রেণী বিভক্ত সমাজে ব্যক্তি-মানুষ কোনো-না-কোনো পূর্বনির্দিষ্ট শ্রেণী পরিবেশে শ্রেণীর অধঃস্তন বা অন্তভর্ুক্ত হয়ে পড়ে৷ ফলে মানুষ হয়ে পড়ে 'শ্রেণী-ব্যক্তি'৷৫০ এই শ্রেণী-ব্যক্তি সমাজে ব্যক্তি পরস্পরের সাথে যে সম্পর্কে আসে তা শ্রেণী জীবনের পরিস্থিতি দিয়ে তৈরি, তারা ব্যক্তি হিসেবে নয় বরং শ্রেণীর সদস্য হিসেবে সম্পর্কভুক্ত হয়৷ তাঁরা শ্রেণী সমাজের এই সমালোচনা থেকে বলেন, কমিউনিজমে "ব্যক্তি-মানুষেরা শামিল হয় ব্যক্তি মানুষ হিসেবেই৷ ব্যক্তি-মানুষদের ঠিক এই সাম্মিলনী থেকেই ...ব্যক্তি-মানুষের অবাধ বিকাশ এবং গতিবিধির পরিবেশ তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়...৷"৫১ এই শ্রেণীহীন মানবিক সমাজের আকাঙ্ক্ষা থেকে মার্কস ও এঙ্গেলস পুঁজিবাদী শ্রেণী সমাজকে প্রত্যাখ্যান করেন৷
পুঁজিবাদে উত্পাদন শক্তি ব্যক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ব্যক্তি সঞ্জীবন আধেয় ছিনিয়ে নেয়৷ ফলে ব্যক্তির আত্ম-সক্রিয়তা ও বৈষয়িক জীবনের মধ্যে একটা বিচ্ছেদ ঘটে, এবং ব্যক্তির বৈষয়িক জীবনই লক্ষ্য হিসেবে উপস্থিত হয়৷ এতে করে পুঁজিবাদে আত্ম-সক্রিয়তা নেতিবাচক রূপ গ্রহণ করে৷৫২ কিন্তু কমিউনিজমে ব্যক্তি মানুষ থেকে স্বতন্ত্র হয়ে কোনো কিছুর পরক অস্তিত্ব অসম্ভব হবে৷৫৩ কমিউনিজমের পর্যায়ে ব্যক্তির সার্বিক ক্ষমতার ব
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।