কৃষ্ণশুভ্রারা বেঁচে থাকুক দূরে সুদূর স্বপ্নসীমান্তে
[ঈদ চলে আসল উৎসবের আমেজ নিয়ে। ছোট বেলায় যখন ঈদ উৎসব নিয়ে রচনা লিখতাম ঈদের আনন্দে মোহবিষ্ট হয়ে গিয়ে যা করি আর যা করতে চাই সব কিছুকে চালিয়ে খাতার মাঝে এক জগত তৈরি করে ফেলতাম। নিজের রচনা নিজেই পড়তে পড়তে অদ্ভুত ভার্চুয়াল সুখে মেতে উঠতাম। সময়ের আবর্তনে এখন যখন একটু দেখি চারপাশে বাস্তবতার আঘাতে সেই আনন্দ হারিয়ে যেতে চায়। কুরবানীর ঈদকে অনেকে বলে বড় ঈদ।
কেন এটা বড় হলো সেটা আমার মাথায় কখনো ঢুকে না। যা হোক সেটা ঢুকানো খুব গুরুত্ব পূর্ণ মনে হয় না। অন্য সব বিশ্বাসীদের মত আমিও পশুবধের বুনো আনন্দে মেতে উঠি ছোট বেলা থেকেই। সেই বুনো আনন্দ কখনও কখনও যে আত্মদংশন করেনি তা নয় কিন্তু যে ভাবনাগুলো আমাকে সে আত্ম দংশন থেকে মুক্তি দিল তা নিয়েই একটা ছোটখাটো পোস্টের অবতারণা করা। ]
ঈদ এলে অন্য বাড়ির বাচ্চাদের হৈ চৈ যতটা বাড়ে মিহির আলীর বুকের ভেতরকার স্পন্দন তার বর্গের সমানুপাতে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
গিন্নীর মার্কেটিং বাচ্চাদের কাপড়ের ঠেলা সামলে নিতেই যার হিমশিম খাওয়ার জোগাড় বৌয়ের ঠেলায় শালা শালীদের জন্য কিছু রাখতে গেলে তার অবস্থা যে ত্রাহি মধুসূদন হবে এ আর বিচিত্র কী। নিজের কাজ নিয়ে সদা ব্যস্ত মিহির আলীকে তাই ঈদের এক মাস আগে থেকেই তার সকল বন্ধের দিনগুলিকে উৎসর্গ করে দিতে হয়। তারপরেও যে খুব নাম হবার সম্ভাবনা আছে এমন নয়। বরং কাপড় কারো পছন্দ না হলে সেটার জন্য নিজের আনাড়িপনার বয়ান মাথা পেতে নিয়ে আবার ছুটতে হয় মার্কেটে।
শপিং এর তোপটা কুরবানীর ঈদে এলে অবশ্য কমে যায়।
তার চেয়ে গরু কেনা নিয়ে সবার মাঝে উৎসাহ উত্তেজনা বেশি বিরাজ করে। গরু কেনার ছুতা করে হয়তো এবার দোকানের পর দোকান ঘুরে গিন্নীর পাশে নির্বাক পুতুলের মত অর্ধাঙ্গীর সবুজ সংকেতের বিরক্তিরকর প্রতীক্ষার হাত থেকে বাঁচা যাবে বলে। গরু অবশ্য কিনেছেন গতকালকেই। গরু কেনার পর নিরীহ জন্তুটার দিকে অনেকক্ষণ নিষ্পলক চেয়ে ছিলেন। সেই বোবা প্রাণীটার কষ্ট বুঝার চেষ্টা করছিলেন।
আজকে দিনের শুরু থেকে অবশ্য গরুর কষ্ট ভুলে গেছেন। তবে গরুমশায় ঠিকই বয়ে চলেছেন তার ভাবনা চিন্তার স্রোতে। হঠাৎ করেই মিহির আলী নিজের সাথে গরুর বেশ মিল খুঁজে পেতে শরু করেছেন। ঘটনার সূত্রপাত অবশ্য আজ সকালে। সকালে বেশ ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে বের হয়েছিলেন ।
ঈদের সময় যানজট নামক বস্তুর হাত থেকে মুক্তি মিলেছে গত কয়েক দিনে। সাথে বোনাসের টাকা। সেটার অনেকখানি গরুর জন্য চলে গেছে। গত কয়েকদিনের আনন্দটুকুকে গরু কেনার পরে সাথে সাথে খড় দিয়ে আপ্যায়ন করার সাথে গভীর মিল খুঁজে পেলেন একটু পরেই। রাস্তা থেকে পাবলিক বাস গুলো প্রায় উধাও।
হঠাৎ করেই তিনি আবিষ্কার করেন তার কুরবানী হবার প্রক্রিয়া। অফিসে যেতে হবে এদিক ওদিক ঘুরে কিছু পান না। রিকশা সিএনজি ওয়ালারা অনেক আগেই সলিমুল্লাহর নবাবী বংশ গ্রহণ করেছে। অতএব তাদের তাদের মর্জির উপর তাকে নির্ভর করতে হবে। হঠাৎ করেই কোন এক দেবদূতের মর্জি হলো।
মিহির সাহেব আগের ভাবনার জন্য নিজেকে ধিক্কার দিয়ে মানুসের উপর বিশ্বাস রাখার আকীদা করলেন। তার আকীদা স্থায়ী হলো কয়েক সেকেন্ড। সিএনজি ওয়ালা যখন আশি টাকার রিকশা ভাড়া মাত্র দুইশত চাইল তিনি পায়ে বাঁধা গরুর মত ছটফট করতে লাগলেন অতঃপর পরাজয় মেনে নিয়ে চেপে বসলেন সি এনজিতে। তারপাশে দিয়ে ছুটে যাওয়া গাড়িতে বসে থাকা কালো সানগ্লাস ঢাকাচোখ দিয়ে জ্যামহীন নগর পরিবহনে বেরুনো মেমসাহেব দেরকে দেখতে থাকেন তিনি। কেন যেন তাদের সাং্লাস ঢাকা অদৃশ্য চোখে কসাইয়ের নিষ্ঠুরতা দেখতে পান।
সন্ধ্যাবেলা যখন অফিস থেকে বেরুচ্ছেন সকালের ঘটনাতে নিজের অক্ষমতা গ্লানিগুলো তার মনে হানা দিচ্ছিলো। কিছু লোকের জন্যই তো ঈদ। অথবা সবার জন্যই ঈদ। কারো জন্য দুইদিন কারো জন্য সবদিন। কুরবানী কারো জন্য ছোট আর কারো জন্য ছোট বড় দুটোই।
যে গরু কাটা হয় এটা আসলে ছোট কুরবানী। গরুকে মেরে যে আনন্দে তিনি মেতে উঠেন তেমনি ভেবে তাকে তিলে তিলে হত্যা করে উৎসব করছে অন্যরা। ভাবনাতে ঘেন্নায় গা ঘিনঘিন করে উঠে তার। নিজেকে খুব ছোট মনে হতে থাকে। তিনি উপলব্ধি করতে থাকেন তার মত মানুষদের ত্রাহি রব একই আনন্দ দেয় তাদের যে আনন্দ তিনি পান গলা কাটা গরুর নিস্ফল শ্বাসের শব্দে।
ভাবতে ভাবতে রিকশায় উঠেন তিনি। অফিসে বিরাট ধকল গেছে। ঈদের আগে কাজ গুছাতে গিয়ে শরীরের বারোটা বেজে গেছে। আগামীকাল ঈদ। সকল আয়োজন সম্পূর্ন করতে হবে।
রিকশা ভ্রমনটুকু তিনি বেশ উপভোগ করছিলেন। তার পাশ দিয়ে গরুরা হাটছে। নগর বেশ ফাঁকা। গরু নিয়ে যাবার সময় সবাই দাম জানতে চায় । সেটা বলার সময় বেশি দামের গরুর খরিদ্দারদের মুখে চোখে দ্যুতি খেলে যায়।
তারা এমনভাবে বলে যাতে আশেপাশের অনেকের কানে কথাটা পৌছায়।
এমন সময় ফোন আসে তার কাছে। " মিহির তুই কই?" । বড় ভাই তাহের আলীর কথায় চমকে উঠেন। তার ভাই তাকে ফোন করার হেতু খোঁজ করতে থাকেন।
কারণ খুঁজে পেতে বেশি দেরি হয় না। তাহের আলীর গরু চুরি গেছে। " আলহামদুলিল্লাহ। কুরবানীটা নিশ্চিতভাবে কবুল হয়ে গেলো। " মিহির আলী প্রশস্তি নিয়ে বললেন, পরমূহুর্তে চুপসে গেলেন ধমক খেয়ে, " চোপ ব্যাটা কুরবানী কবুল।
থাম। তাড়াতাড়ি আয় । এর চেয়ে বেশি দাম দিয়ে আরেকটি গরু কিনতে হবে। " ফোন রেখে কুৎসিত কিছু গালি বেরোয় তার মুখ থেকে। লোকদেখানো সামজিকতার সাথে ধর্মকে গুলিয়ে এই জরাজীর্ণ ব্যবস্থাতে তিনি হাঁপিয়ে উঠছেন।
বাস স্ট্যান্ডে নামলেন। কিন্তু এ কী অবস্থা। কাউন্টার বন্ধ করে চলে গেছে দেখি সবাই। কাউন্টার বাস গুলো যারা অন্য দিন সিটিং ভাড়া নিয়ে চিটিং করে দাঁড় করিয়ে লোক নেয় তাদের এমন অনুপস্থিতি তার কাছে রহস্যময় মনে হয়। লোকাল বাসের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
অগত্যা লোকাল বাসের অপেক্ষা করে। কিন্তু না। সময় গরম বুঝে চরম লোকাল সার্ভিস আজ প্রকৃত সিটিং হয়ে গেছে। তার মতো অনেকেই রাস্তায় দাড়িয়ে আছে অনেক লোক। তাদের দিকে তাকিয়ে সিটিং বাসে লোক গুলো কি কুরবানীর আনন্দ পাচ্ছে? তার ভাবনা আগানোর আগে তিনি বাসটির দিকে আগান।
বাসটি তাকে ফেলে চলে যায়। পরের বাসের কন্ট্রাকটরের সাথে কথা বলে বুঝেন বাসের যাত্রীরা কুরবানী কারী নয় বরং কুরবানীকৃত জীব। দশ টাকার ভাড়া একশ টাকা দিয়ে তারা কুরবানী হচ্ছে। তিনি এগুতে থাকেন পায়ে হেঁটে। এই একটু আড় একটু।
এমন সময় হঠাৎ করেই গরুর দৌড়ানি টের পান তার পাশ দিয়ে দৌড়ে গরু চলে গেল। তার পরেও আগান রাস্তা ধরে। গন্তব্যহীন হাঁটা আনন্দ এতে নেই বরং গন্তব্যে পৌছানোর তাড়না পথকে দীর্ঘ করে তুলে। পথের পাশে পরে থাকা গোবরে পা দিয়ে তিনি তার পথের দূরত্ব আরো বাড়িয়ে দেন।
মিহির আলী এগিয়ে যেতে থাকেন।
আসতে পেছেন তিনি তার বাসায়। দরজা পেরিয়ে দ্রুত বাথরুমে ছুটে যান। কিন্তু দীর্ঘ লোড শেডিং আর পানি বিভাগের অব্যবস্থাপনায় কলের পানি কয়েক ফোটা পরে থেমে যায়। অন্ধকার বাথরুমে মিহির আলীর নিজেকে কেমন গরু গরু বোধ হতে থাকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।