সৃজনশীল সাহিত্যের শৈল্পিক প্রয়াসে নিমগ্ন একজন প্রকাশক
পুরোন ঢাকার প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী মাহবুব সওদাগর ছোট খাটো বাড়ি বানিয়ে মোটামুটি ভালোই আছেন। ব্যবসা কে ফুলিয়ে ফাপিয়ে আরো ভালো থাকতে পারতেন, কিন্তু দূর্নীতি করতে হয়। কিন্তু দূর্নীতির আয়ও হারাম, ব্যয়ও হারাম। দুই ছেলেও একই রকম সৎ। তারা তার ব্যবসার পার্টনার কিন্তু তিনিই সব।
হজ্ব করেছেন এখন সখ ছেলে দুটো হজ্ব করে আসুক। নতুন বিয়ে হয়েছে ওদের এখনি সময় হজ্ব করার। পড়ে বাচ্চা কাচ্চা হয়ে গেলে কঠিন হয়ে পড়বে।
বড়ো ছোট দুই ছেলে বৌ নিয়ে হজ্বে যাবে- বড়ো ছোটাছুটি করে যোগাড়যন্ত্র করছে কিন্তু ছোটটাকে নিয়ে মহাসমস্যা। ছোটবেলা থেকেই তার রহস্যের শেষ নেই।
বাবা হজ্বের প্রস্তুতির কথা জানতে চাইলেই সে বলে-
হচ্ছে বাবা হচ্ছে, চিন্তা করোনা। এ বছর যদি একজনের হজ্বও কবুল হয় তো আমারই হবে ইনশাআল্লাহ।
বাবা আস্বস্ত হন। কিন্তু ছোট বউ হয়না। তার বাবাও হজ্ব করেছেন।
সে জানে হজ্বে যেতে হলে কি আয়োজন করতে হয়। কিন্তু দিব্যি দেখতে পাচ্ছে তার স্বামী কিছুই করছেনা। জানতে চাইলে হেসে বলে- আমার কাজ আমি করছি-তুমি তোমারটা গুছিয়ে নাও,শেষে এটা ওটার জন্য দেরী না হয়। তবু বউ এর সন্দেহ যায়না। তার ওপর সেদিন বাবার কাছ থেকে হজ্বের নাম করে এক লাখ টাকা বেশী চেয়ে নিল।
কেন নিল?
তারপর একদিন বড়ো চলে গেল হজ্ব ক্যাম্পে বউকে নিয়ে। বাবা ছোটকে প্রশ্ন করলেন-
তোর হজ্ব ক্যাম্প, ফ্লাইট এসব কিছুই তো বললিনা। মক্কায় কাথায় থাকবি তা ঠিক হয়েছে?
ছোট হেসে বলে- ক্যাম্পে\কেন যাব! বাড়ি থেকে সোজা হজ্বে যাবার ব্যবস্থা সবই হচ্ছে, তুমি নিশ্চিন্তে থাক তো বাবা।
তারপর ছোটও যাবার দিন এলে। যাবার সময় বাবা বুকে জড়িয়ে দোয়া করলেন, মা অশ্র“সিক্ত চোখে ছেলে বউয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
গাড়িতে উঠে বসল দুজন। গাড়ি চলতে শুরু করলে ছোট বউ স্বামীকে বলল-
আমরা কোথায় যাচ্ছি গো?
কোথায় আবার হজ্বে যাচ্ছি।
এভাবে কেউ হজ্বে যায়? আসলে কোথায় যাচ্ছি সত্যি করে বলো না?
ছোট হেসে বলল- হজ্বেই যাচ্ছি। সবুর করো একটু পরেই দেখতে পাবে।
গাড়ি এসে দাঁড়াল বাস স্টেশনে।
বৌ বলল-
এ তো বাস স্টেশন!
হ্যাঁ বাস স্টেশনই তো!!
বাসে করে হজ্বে যাচ্ছি?
হ্যাঁ এবার তোমাকে নিয়ে উড়াল দেব মরাল হয়ে। তারপর আল্লা- রসূলের সামনে দাঁড়াব দুজনে, একেবারে সামনাসামনি। পথে কিছু কষ্ট হবে করতে পারবে তো?
আমরা হজ্বে যাচিছনা। বাসে করে কেউ হজ্বে যায়না। বাবাকে এভাবে ঠকালে কেন?
কাউকে ঠকাইনি।
এবছর যদি করো হজ্ব কবুল হয় তো আমারই হবে ইনশাআল্লাহ। ওখানে গিয়ে বলতে হবে- লাব্বায়েক।
জানি। কিন্তু লাব্বায়েক মানে কি?
লাব্বায়েক মানে হল আমি হাজির। অর্থাৎ হে আল্লাহ তুমি ডেকেছ, এই যে আমি হাজির হয়েছি।
ড্রাইভার বাসে মালামাল তুলে দিয়ে বলল-
আপনারে হাজার সালাম সাব। অ্যামতেই ধীরে ধীরে মুসলমানের চক্ষু খুইলা দিব আল্লায়।
ছোট বলল- সব রওনা হয়ে গেছে ঠিক মতো? পরের এক লাখ টাকাও?
ড্রাইভার বলল- হ সার। শ্যাষের চালানটা আমি নিজে পাঠাইছি।
বউ এবার সরাসরি প্রশ্ন করল-
কোথায় যাচ্ছি আমরা?
রংপুর।
রং-পু-র? রংপুর কেন! ওখানে তো আমাদের কেউ নেই।
স্বামী দীর্ঘশ্বাসে শক্ত করে চেপে ধরল বৌয়ের হাত। শুধূ বলল- আমার হাত ধরে থাক। তুমি সাথে না থাকলে শক্তি পাইনা আমি। এবার বউও চেপে ধরল স্বামীর হাত।
সে বুঝল এবার কিছু একটা হতে যাচ্ছে যা আগে কখনো হয়নি।
দুপুরে বাস থেকে নেমে বেবিটাক্রিতে গ্রামের পথ। বিকেলে দূর গ্রামের কাছাকাছি আসতেই কানে এল জনতার হৈ চৈ। কাছে এসে বউ দেখল দাঁড়িয়ে আছে চাল ডাল আলু পেয়াজ ভর্তি তিনটে ট্রাক। ট্রাকের ওপর থেকে তরুন কিশোরেরা মহা উৎসাহে ক্ষুধার্ত লোকজনের মাঝ তা বিতরন করছে।
ভয়ংকর দূভির্ক্ষ চলছে কিছুদিন ধরে উত্তরবঙ্গে। আনাহারের আগুনে পুড়ে মরছে কোটি কোটি মানুষ। লুটিয়ে ঘুমিয়ে আছে হাড্ডিসার শিশু। রাস্তায় পড়ে থাকা কংকালসার মৃতদেহ। আতংকে ত্রস্ত ক্ষুধার্ত যুবতি, গত মঙ্গায় শরীর বিক্রি করার দুঃসহ স্মৃতি তার সামনে আবার ছোবল তুলছে কালনাগিনী হয়ে।
আনাহারে জর্জরিত অর্ধনগ্ন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, অনাহারে জর্জরিত নিরুপায় যুবক। ও যেন এদেশের নয়, ওরা যেন পরিত্যক্ত, ওদের দেখার কেউ নেই।
পলকের জন্য টলে উঠল বৌয়ের মাথার ভেতর।
কিন্তু এদিকে জনতার ক্ষুধিত আর্তনাদ বদলে হয়েছে উৎসবের চিৎকার। আনন্দিত মানুষের হর্ষধ্বনি।
বৌ মুগ্ধ চোখে দেখল মানুষের আনন্দ। তারপর দুষ্টমি করে বলল-
ও! হজ্বের টাকায় দান-ধ্যান হচ্ছে তাহলে?
দান? চকচক করে উঠল স্বামীর চোখ- কিসের? কাকে দান? আশরাফুল মাখলুকাত ওরা। আমি তে শুধু উপহার দিচ্ছে। মানুষের উপহার।
মুগ্ধ বৌয়ের মুখ থেকে বেরিয়ে এল- তুমি একটা ফেরেশতা।
না আমি তার চেয়েও বড়ো। আমি বনি আদম। ব্যবসায়ির ছেলে তো। বুঝলে না আল্লাহকে ধার দিচ্ছি। প্রচুর লাভ হবে বউ, গ্যারান্টেড।
আল্লাহকে ধার দিচ্ছ? তওবা তওবা।
তওবা মানো। আল্লা তো নিজেই আমদের কাছে ধার চেয়েছেন। পড়ে দেখ সুরা আত তাগাবুন, আয়াত সতেরো- যদি তোমরা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দান কর তিনি তোমাদের জন্য তা দ্বিগুন করে দেবেন। এই দশ ট্রাক ধার দিচ্ছে রোজ হাশরে বিশ ট্রাক সওয়াব পাব।
.... আজ রাতটা এখানে কাটিয়ে কাল অন্য গ্রামে যাব। যেখানে আমার ট্রাক এসেছে। সব মিলিয়ে দশ দিন। তারপর আমরা ফিরে যাব ঢাকায়। পারবে না।
পারব।
স্বামী আঁকড়ে ধরল বৌ এর হাত। এদিকে এসো বলে টেনে নিয়ে গেল ঝোপঝাড়ের ওইদিকে যেখানে কেউ নেই। সামনে ধূ ধূ খরা জমি আর ওপরে অবারিত আকাশ। পেছনে দুর থেকে এেস আসছে আনন্দিত মানুষের হর্ষধ্বনি।
মায়ময় গ্রাম বাংলার প্রান্তে নেমে আসছে মায়াময় সন্ধ্যা। বৌ চোখ তুলে দেখল স্বামীর দুচে খে জ্বলছে হাজার জোনাকি। সেই জোনাকি-চোথ বৌয়ের দুচোখে গেঁথে স্বামী বলল-
জানো নবীজি বলছেন যার প্রতিবেশী না খেয়ে থাকে সে মুসলমান নয়। নবীজি নিজে বলেছেন বউ। যে মুসলমান নয় তার আবার হজ্ব কিসের?
এবার বৌয়ের চোখেও জোনাকি জ্বলল।
ফিসফিস করে বলল
মঙ্গা ফি বছর থাকবেনা। মানুষ আবার উঠে দাঁড়াবে ফসল ফলাবে। আবার দুবেলা দুমুঠো খেয়ে পরে ভালোই থাকবে। তখন আবার আমরা হজ্বে যাব।
নিশ্চয়ই-অবশ্যই।
আবার দুজনে মিলে যাব ইনশাআল্লাহ।
তারপর তারা দুহাত সোজা করে আকাশের দিকে মুখ তুলে সর্বশক্তিতে চীৎকার করে উঠল- লাব্বায়েক...।
সুদুর পশ্চিমে তখন কাবা শরীফের চারধারে চলদমন্দ্রে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে লক্ষ কন্ঠের আকুতি-
লাব্বায়েক.....!
হাসান মাহমুদ রচিত- ’ বাংলার কথা কই’ বই থেকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।