তার নিঃসঙ্গতার বয়স একশো বছরেরও বেশি।
বন্ধু থেকে পরিজন, কেউ নেই তার। সম্ভবত তার সঙ্গেই হারিয়ে যাবে আস্ত একটা প্রজাতি!
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কিছু বুনো ঘাস, ইতস্তত আগ্নেয়শিলার স্তূপ আর কর্দমাক্ত একটা ডোবা। একাকিত্বের এই চেনা চৌহদ্দিতে কখনও বা ভুল করেই ঘাড় উঁচিয়ে নিকটাত্মীয়ের খোঁজ করে সে। তারপর ফের সেঁধিয়ে যায় তার প্রাচীন খোলসে।
লোনসাম জর্জ। পৃথিবীর আদিমতম প্রাণীকুলের এক মাত্র জীবিত সদস্য পিন্টা প্রজাতির কচ্ছপটিকে এ নামেই সবাই চেনেন।
ইকুয়েডরের ওই কচ্ছপের সঙ্গিনীর খোঁজে সারা পৃথিবী ঢুঁড়ে ফেলছে চার্লস ডারউইন ফাউন্ডেশন। কিন্তু ‘পাত্রী’ কোথায়?
লোনসাম-এর এই নিরবচ্ছিন্ন একাকিত্ব মুছতে সম্প্রতি বিশ্বের তাবড় চিড়িয়াখানাগুলিতে বার্তা পাঠিয়েছে ওই ফাউন্ডেশন। কলকাতার আলিপুর চিড়িয়াখানাতেও এসেছিল সে বার্তা।
ফাউন্ডেশনের সচিব রসলিন ক্যামারুন বলছেন, “লোনসাম জর্জের স্বগোত্রের না-হলেও কলকাতা চিড়িয়াখানার সুপ্রাচীন যে প্রাণীটি তার অন্তত বন্ধু হতে পারত, সেই অদ্বৈত বছর তিনেক আগে মারা গিয়েছে শুনে খুব খারাপ লাগল। মনে হচ্ছে, কোনও নিকটাত্মীয়ের দেখা না পেয়েই শেষ পর্যন্ত হারিয়ে যাবে লোনসাম!”
আক্ষেপ যাচ্ছে না আলিপুর চিড়িয়াখানার অধিকর্তা রাজু দাসেরও। তাঁর কথায়, “লোনসাম জর্জের একটা সঙ্গিনীর যদি খোঁজ দেওয়া যেত, কী অভাবনীয় ব্যাপারটা হত বলুন তো! একটা দুর্লভ ঘটনার সাক্ষী থাকতে পারতাম আমরা। ”
কে এই লোনসাম জর্জ?
ইকুয়েডরের প্রায় সাড়ে ছ’শো মাইল উত্তরে গ্যালাপাগোসের ছোট্ট দ্বীপ পিন্টা। প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা গোটা আঠারো দ্বীপের একটি।
গ্যালাপাগোসের অতিকায় কচ্ছপকুলের এগারোটি প্রজাতির মধ্যে পিন্টাও(জিওসেলোনে এলিফ্যান্টোপাস এবিনডোনি)অন্যতম একটি প্রজাতি। কিন্তু গত কয়েক দশক ধরে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে তারা। মৎস্যজীবী, তিমি শিকারি কিংবা ওই পথে পাড়ি দেওয়া নাবিকেরা প্রায়ই গ্যালাপাগোসের ওই কচ্ছপ-খ্যাত দ্বীপগুলিতে জাহাজ ভিড়িয়ে সংগ্রহ করে নিতেন তাঁদের সফরের রসদ-কচ্ছপের সংখ্যা কমে যাওয়ার সেটাও একটা কারণ।
কচ্ছপের মাংস তাঁদের কাছে নিছক সুস্বাদু খাবার হিসেবেই সমাদৃত ছিল না। দীর্ঘ সাগরযাত্রায় জাহাজের খোলে চাপিয়ে তাদের বহনেও নাবিকদের বাড়তি সুবিধা ছিল।
কারণ এক থেকে সোয়া বছর খাদ্য তো দূরের কথা জল না চেখেও দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে এই সব কচ্ছপেরা।
পাশাপাশি, দ্বীপের বাসিন্দা না-হলেও আশপাশের সাধারণ চাষিরা এই জনমানবহীন দ্বীপগুলিতে শুরু করেছিলেন ছাগল প্রতিপালন। মাসান্তে জাহাজ নিয়ে এসে তাঁরা নিখরচায় সেই গবাদি পশু নিয়ে যেতেন দ্বীপগুলি থেকে। দ্রুত বংশবৃদ্ধি ঘটানো ছাগলের পাল কয়েক বছরের মধ্যেই দখল নিল কচ্ছপের খাদ্য সম্ভারের। ফলে এবার খাবারের টান পড়তে শুরু করল গ্যালাপাগোসের কচ্ছপদের।
উনিশ শতক জুড়ে এই ‘সাঁড়াশি’ আক্রমণের জেরে ক্রমেই হারিয়ে গিয়েছে গ্যালাপোগাসের ইসাবেলে কিংবা উলফ দ্বীপের কচ্ছপেরা।
১৯০৬সালে পিন্টা দ্বীপে গবেষণা করতে গিয়ে ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাকাডেমির গবেষকেরা তিনটি পুরুষ কচ্ছপ উদ্ধার করেছিলেন। সেই শেষ। পিন্টা প্রজাতির কচ্ছপের গায়ে যখন ‘নিশ্চিহ্ন’ তকমা প্রায় এঁটে বসেছে, তখনই ১৯৭১সালে, স্থানীয় বনকর্মীরা দ্বীপ পরিদর্শনে গিয়ে আচমকাই দেখতে পান প্রায় নির্জীব অতিকায় এক পিন্টা কচ্ছপ। তখনই তার বয়স একশো ছাড়িয়েছে।
হেলিকপ্টারে চড়িয়ে দ্রুত তার ঠিকানা বদলে যায় প্রথমে সান দিয়াগো চিড়িয়াখানায়। সেখান থেকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ওই ফাউন্ডেশনে। সরীসৃপ বিশেষজ্ঞ এডওয়ার্ড লেনিস পৃথিবীর প্রায় সব প্রজাতির কচ্ছপের ডিএনএ পরীক্ষা করে দেখেছেন, কিন্তু পিন্টা প্রজাতির কচ্ছপের জিনের সঙ্গে তা কোনও ভাবেই মেলেনি। সঙ্গে সঙ্গে নাম রাখা হয় ‘লোনসাম জর্জ’। কেন?
পঞ্চাশের দশকে আমেরিকার ছোট পর্দার জগতে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন জর্জ লেসলি গোবেল।
কখনও রেডিও জকি, কখনও বা টেলিভিশনে রগুড়ে অ্যাঙ্কর জর্জ নিজেকে বলতেন ‘লোনসাম। ’ গোটা আমেরিকা সেই সময়ে সারা সন্ধ্যা টেলিভিশনের সামনে বসে থাকতো, কখন জর্জ এসে গিটার হাতে তাঁর শো শুরু করবেন। নিজেকে চিনিয়ে দেবেন, ‘হিয়ার ইজ লোনসাম জর্জ...। ’ জর্জের কথা মনে রেখেই ডারউইন ফাউন্ডেশনের কর্তা পিন্টা কচ্ছপটির নামকরণ করেন লোনসাম জর্জ।
প্রতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অন্তত পাঁচ লক্ষ দর্শনার্থী আসেন আদিমতম প্রাণীটিকে দেখতে।
ঝোপের আড়াল থেকে সে-ও দেখে তাঁদের। কিন্তু চেনা পরিজন? লোনসাম ফের খোলসে লুকিয়ে ফেলে নিজেকে। ।
আনন্দবাজার; ১৯/১১/০৯।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।