একটা ঐতিহাসিক দিনে (৭ই নভেম্বর) আমি যাত্রা শুরু করেছি পূন্যভুমি (গাড়ির সুপারভাইজারের জ্ঞানগর্ভ আলোচনার প্রেক্ষিতে) সিলেটের উদ্দেশ্যে। উদ্দেশ্য ওখানে আমাদের সংগঠনের একটি কার্যালয় আছে এবং কিছু সহকর্মী আছেন তাদের কার্যাবলী পরিবীক্ষণ (মতান্তরে একটু চাবী দিয়ে আসা) করা। তবে কাজের কাজ যাই হোক আমার বেড়ানোটা হয় এবং আমি এটা খুবই ভাল পাই।
যাই হোক আমি এখন সিলেটের পথে। আমার জীবনে একটা মহান ট্র্যাজেডি হলো, যেখানে যত সুন্দর সুন্দর দৃশ্য আমি দেখেছি বলে মনে করি তার কোন বাস্তব দলিল আমার কাছে নেই।
আমার হাতে কখনই কোন ক্যামেরা থাকেনা। ফলে আপনারা (পাঠক) বঞ্চিত হচ্ছেন জেনেও আমার করার কিছুই নেই।
সিলেটে যেখানে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে তার খুব কাছেই হযরত শাহজালাল (রহ)-র মাজারের পেছনের গেট। আমি যখন গাড়ি থেকে নেমে হোটেলে আসছি তখন দেখেছি অসম্ভব রকমের জ্যাম। ভাবলাম, কোথায় এলাম (!)।
ঢাকার বিশ্ববিখ্যাত জ্যাম ছেড়ে এসে আবার এখানে জ্যামের মধ্যে হাঁফ ছাড়বো কোথায়। পাক্কা আধঘন্টা জ্যামে আটকে থেকে হোটেলে পৌঁছুলাম। একটু হাত-পা ছাড়ার পর আমার সহকর্মী নিহারদা-কে ফোন করে বল্লাম, দাদা, আমি আইসা গেছি। উনি বল্লেন, আমি আসবো আপনার হোটেলে। সন্ধ্যে ৭:৩০ নাগাদ নিহারদা এসে পড়লেন।
খুচরা কথার ফাঁকে বল্লেন, ভাই আপনি একটা দারুণ সময়ে এসেছেন। আজ -কাল- পরশু এ তিনদিন হযরত শাহজালালের ওরস চলবে। চলেন, আপনাকে দেখাই কি মহাদক্ষযজ্ঞ ব্যাপার।
যেই কথা, সেই কাজ। আমরা এখন মাজারে।
মাজারে পা ফেলার জায়গা নেই। নিহারদা বল্লেন, ভাই দেখেছেন কত মানুষ। এর অন্তত দশগুন আসবে আগামী দুদিনে। দাদা আমাকে দেখালেন মানুষের থাকার জায়গা। খোলা মাজার উঠোন।
সেখানে নারী ও পুরুষ উভয়েরই অবস্থান। হিন্দু-মুসলমান তো আছেই, অন্যরাও থাকতে পারেন। এভাবেই এরা আগামী দুদিন থাকবেন। এরপর আমরা গেলাম মালখানা দেখতে। থরে থরে সাজানো পেঁয়াজ, রসুন আদা মরিচ, ঘি, তেলসহ অন্যান্য তৈজসপত্র ও খাদ্যবস্তু।
৬/৭ জন বৃদ্ধ ও আধাবৃদ্ধ লোককে দেখলাম চেয়ার পেতে পা টান করে বসে আছেন। একজন অতিবৃদ্ধকে দেখলাম লুঙ্গি পরে বসে আছেন চেয়ারে। লোকজন তাঁর সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় পায়ে হাত বুলিয়ে সালাম করে যাচ্ছে। একজনকে দুবার সালাম করতে দেখলাম।
মালখানা থেকে বের হয়েই টাল খেয়ে গেলাম।
দেখলাম একজন ২০/২৪ বছরের নারী সপাটে তাঁর হাত চালালেন সুন্দর মতো, স্বাস্থ্যবান, টুপিওয়ালা এক যুবকের গালে। শত শত মানুষ স্থানু কয়েক সেকেন্ড। চড় খেয়ে হতভম্ব ছেলেটিও পরমূহুর্তে পাল্টা আক্রমণে গেল একই রকম চড়ের মাধ্যমে। তারপর লোকজন দুজনকেই সরিয়ে দিয়েছে। মেয়েটির কথা হলো, কে যেনো ভিড়ের মধ্যে তাঁর গায়ে হাত দিয়েছে এবং তিনি দেখেছেন ছেলেটি তার পাশে তাই তিনি ছেলেটিকেই চড় মেরেছেন।
অন্যদিকে ছেলেটির বক্তব্য হলো যে হাত দিয়েছে, সে পালিয়েছে। লোকজন ছিঃ ছিঃ ও বাহবা উভয়ই দিয়েছে মেয়েটিকে। আমিও মনে মনে বলেছি, ধন্যি মেয়ে! দাদা কানে কানে বললেন, আগামী দুদিনে আরও অনেক কিছু ঘটবে।
মালখানায় টাল খেয়ে এবার গরু দেখতে গেলাম। প্রায় ৫০টি বিভিন্ন প্রজাতির গরু বাঁধা।
শুনলাম বিভিন্ন ভক্ত এগুলো পাঠিয়েছেন। আরও গরু আসবে। দাদাকে বল্লাম আর কিছু দেখবোনা। চলেন ফিরি। ফেরার পথে দাদা বল্লেন, ভাই এবারের ওরস থেকে মাজার কর্তৃপক্ষের কমপক্ষে এককোটি টাকা আয় হবে।
আমি টাসকি খেলাম। এককোটি টাকা!
গরুখানা থেকে ফিরে আসছি হঠাৎ শুনি মিছিলের আওয়াজ। একটু হতচকিত হলাম। মাজারে মিছিল কেনো! দাদাও একটু অবাক দেখলাম। বল্লাম, চলেন দেখি।
মূল চত্তরে আসতেই মিছিলের দেখা। ৩০/৪০ জন সবুজ কাপড় পরা মানুষ মিছিল করছে। তাদের কাপড়ে লেখা রয়েছে 'স্বেচ্ছাসেবক'। তাদের মুখে একটাই শ্লোগান, 'শাহজলাল, শাহজলাল, লালে লাল শাহজলাল'।
ফিরে আসছি।
রাস্তার দু’ধারে অসংখ্য ছোট ছোট অস্থায়ী দোকান। লোকজন কেনাকাটা করছে। তখনও অনেক মানুষ আসছে। শ'খানেক বাস দাড়িয়ে আছে সংলগ্ন মাদ্রাসা মাঠে। আরো নাকি আসবে।
হাঁটতে হাঁটতে দাদার এক বন্ধুও জুটে গেল। কথায় কথায় তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ভাই আগে কখনও শাহজালাল (রহ) - র ওরসে এসেছিলেন? আমি বলি, না। দাদার বন্ধু আবার জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি আপনাদের ধর্মে আছে? । আমি বলি, দাদা, ধর্ম ও অধর্ম দুটো জমজ। আর জমজ বলেই আমরা ঠিকমতো চিনতে পারিনা কোনটা আমি ধর্ম মানছি, আর কোনটা অধর্ম।
দাদা চুপ। দাদার বন্ধু চুপ। আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। কিন্তু আমার কানে বাজছে শ্লোগানটা, 'শাহজলাল, শাহজলাল, লালে লাল শাহজলাল'। এই শ্লোগানের মানে কি? কেযেনো বলেছিল,
'দয়াল দাতা, কেবলা বাবা, আয়নার কারিগর
আয়না বসাইয়া দিছে কলিজার ভিতর।
'
এবার মানে খোঁজার পালা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।