মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসঃ বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম শক্তিমান লেখক
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস শুধু বাংলাদেশের কথাসাহিত্যেই নয়, সমগ্র বাংলা সাহিত্যেরই একজন প্রথিতযশা কথাসাহিত্যিক। তিনি কখনোই লেখক হওয়ার জন্য লেখেননি। তাঁর লেখা বা সৃষ্টির পরিমান খুব বেশী নয়। তবে তাঁর সৃষ্টির গুণগতমান শিল্প-বিচারে বিশ্বমানের।
মানুষের যাপিত জীবনের বাহিরেও যে আরো কত কিছু দেখবার ও বুঝার আছে তা আমরা তাঁর গল্প ও উপন্যাস পড়ে পাই। গভীর জীবনবোধ ও তীক্ষ্ণ হাস্যকৌতুকের সাক্ষাত্ মিলে তাঁর লেখায়। তার লেখায় নায়ক নেই, আছে সামগ্রিক সমাজের উচ্চারণ। সেই উচ্চারণের মধ্যদিয়ে তিনি বলতেন অধিকারহীন মানুষের বেঁচে থাকার কথা। আর এই সব কিছু মিলিয়ে তিনি ছিলেন বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম শক্তিমান লেখক।
আখতারুজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াসের জন্ম ১৯৪৩ সালের ১২ ফেবু্রয়ারি। বর্তমান গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থানার গোটিয়া গ্রামে মাতামহের বাড়িতে। বাবা- বিএম ইলিয়াস। মা মরিয়ম ইলিয়াস। বাবা তাঁকে আদর করে মঞ্জু বলে ডাকতেন।
তার পুরো নাম আখতারুজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস। মা-বাবার প্রথম সন্তান তিনি। বাবা ছিলেন বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তিনি রাজনীতি করতেন। ১৯৪২-৪৩ সালে তিনি ছিলেন পূর্ববাংলা মুসলিম লীগের বগুড়া জেলার সাধারণ সম্পাদক।
মা ছিলেন গৃহিণী।
তাদের আদি বাড়ি ছিল বগুড়ার সারিয়াকান্দি থানার চন্দনবাইশা গ্রামে। এরপর ইলিয়াসের দাদা বগুড়া শহরের করতোয়া নদীর তীরের নারুলি গ্রামে বাড়ি করেন। নারুলি গ্রামেই কাটে ইলিয়াসের শৈশব। তাঁর ছোট তিন ভাই।
১৯৪৬ সালে ইলিয়াসের বাবা বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৯ সালে প্রাদেশিক আইন পরিষদের পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। ওই সময় ইলিয়াসের বাবা সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন।
পড়াশুনার হাতেখড়ি পরিবারে। তারপর ১৯৪৯ সালে পুরান ঢাকার সেন্ট ফ্যান্সিস জেভিয়ার্স স্কুলে।
এরপর ১৯৫০ সালে ঢাকার কেএল জুবিলি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করানো হয় ইলিয়াসকে। তৃতীয় শ্রেণীতে না পড়েই ১৯৫১ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। ১৯৫৪ সালে তাঁর পরিবার ঢাকা থেকে বগুড়াতে চলে যায়। আবার স্কুল পরিবর্তন। এরপর তিনি ভর্তি হন বগুড়া জেলা স্কুলে।
১৯৫৮ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাসের স্বীকৃতি অর্জন করার পর আবার ঢাকায় চলে আসেন। ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। পরিবারের সবাই বগুড়াতে থাকার কারণে তিনি ঢাকা কলেজের নর্থ ছাত্রাবাসে ওঠেন। ১৯৬০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আইএ পাসের স্বীকৃতি অর্জন করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন।
এ সময় ফজলুল হক মুসলিম ছাত্রাবাসে ওঠেন তিনি। ১৯৬৪ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এম এ ডিগ্রী অর্জন করেন।
স্কুলে পড়ার সময় থেকেই প্রচুর পড়ার নেশা ছিল তার। আর লেখালেখিতেও হাতেখড়ি ওই সময়ে। দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় সওগাত এ তার প্রথম ছোটগল্প ছাপা হয়।
১৯৫৮ সালে ঢাকা কলেজে পড়ার সময় তিনি অবিরত গল্প লিখতেন। যা বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠাতেন। ছাপা হতো দু’একটা। ১৯৬১ সালে চিকেন পক্সে আক্রান্ত হয়ে বেশ কিছুদিন মিডফোর্ড হাসপাতালে ছিলেন। এ সময় ‘অতন্দ্র’ নামের একটি গল্প লেখেন।
১৯৬৪ সালে তিনি সাহিত্যবিষয়ক পত্রিকা স্বাক্ষর এর সঙ্গে যুক্ত হন। ওই বছর আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত সাম্প্রতিক ধারার গল্পনামক একটি গ্রন্থে ইলিয়াসের ‘স্বগত মৃত্যুর পটভূমি’ নামে একটি গল্প ছাপা হয়। ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে লিটল ম্যাগাজিন ‘আসন্ন’তে ‘চিলেকোঠায়’ নামে তাঁর একটি গল্প প্রকাশিত হয়। ১৯৭৫ সালে চিলেকোঠায় নামে তাঁর প্রথম উপন্যাস দৈনিক সংবাদ-এর সাহিত্য পাতায় ধারাবাহিকভাবে ছাপা শুরু হয়। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’।
ওই বছরের জুলাই মাসে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত সংবত শীর্ষক একটি লিটল ম্যাগাজিনে গল্পকার হাসান আজিজুল হক গ্রন্থটির সমালোচনা লেখেন। এছাড়া মাহবুবুল আলম, সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়, মুনতাসীর মামুন, আবুল হাসানাত এবং মাজহারুল ইসলাম বিভিন্ন দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় গ্রন্থটির উপর আলোচনা করেন। সৈয়দ শামসুল হকও টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠানে তখন বইটির প্রশংসা করেন। ১৯৮১ সালের জানুয়ারিতে সাপ্তাহিক রোববার পত্রিকায় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘চিলেকোঠার সেপাই’ ধারাবাহিকভাবে ছাপা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের জানুয়ারিতে সাপ্তাহিক রোববার-এ চিলেকোঠার সেপাই ছাপা শেষ হয়।
১৯৮২ সালের সেপ্টেম্বরে রাজশাহীর তরঙ্গ প্রকাশনী হতে তার গল্পগ্রন্থ ‘খোঁয়ারি’ প্রকাশিত হয় ৷ ১৯৮৫ সালে ‘দুধ ভাতে উত্পাত’ শিরোনামে তাঁর আরেকটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ১৯৮৬ সালের অক্টোবরে ঢাকা ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড হতে বই আকারে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘চিলেকোঠার সেপাই’। ১৯৮৯ সালে তাঁর আরেকটি গল্পগ্রন্থ ‘দোজখের ওম’ প্রকাশিত হয়। ১৯৯২ সালে ইলিয়াসকে নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে এজাজ ইউসুফ সম্পাদিত লিরিকসাহিত্য পত্রিকার একটি বিশেষ সংখ্যা বের হয়। ১৯৯৩ সালের জানুয়ারি মাসে ইলিয়াসের পঞ্চাশ বছরপূর্তি উপলক্ষে কলকাতার একুশে প্রকাশনী প্রকাশ করে তাঁর একটি গল্প সংগ্রহ গ্রন্থ।
১৯৯৪ সালে দৈনিক জনকন্ঠ-এর সাহিত্যপাতায় উপন্যাস ‘খোয়াবনামা’ ধারাবাহিকভাবে ছাপা হতে থাকে। এক পর্যায়ে রাজনৈতিক কারণে জনকন্ঠকর্তৃপক্ষ খোয়াবনামা ছাপা বন্ধ করে দেয়।
১৯৬৫ সালে শুরু হয় কর্ম জীবন। প্রভাষক হিসেবে তিনি যোগ দেন করটিয়া সা’দত কলেজে। ওই বছর আগস্ট মাসে তিনি প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন পুরান ঢাকার জগন্নাথ কলেজে।
১৯৬৬-৬৯ সালের গণআন্দোলন যুক্ত ছিলেন তিনি। প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক মিটিংয়ে তিনি ছিলেন সক্রিয়। বিশেষত মওলানা ভাসানীর প্রায় প্রতিটি মিটিংয়ে উপস্থিত থাকতেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে তিনি পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। তাঁর বাড়ি মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল ছিল।
ওই বছরের মাঝামাঝি সময়ে ইলিয়াস তাঁর জগন্নাথ কলেজের সহকর্মী কথাসাহিত্যিক শওকত আলীর বাসায় ভাড়া থাকতেন।
১৯৭৩ সালে তিনি সুরাইয়াকে সহধর্মিণী করেন। স্ত্রীও ছিলেন পেশায় একজন শিক্ষিকা। তিনি বিয়ের পর সিরাজগঞ্জের মহিলা কলেজ থেকে চাকরি ছেড়ে স্বামীর কাছে ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৭৪ সালে তাদের সংসারে জন্ম নেয় প্রথম সন্তান আন্দালিব।
১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমান বাকশাল গঠন করার পর সরকারি কলেজের শিক্ষক হিসেবে তিনি বাকশালে যোগ দেননি। ১৯৮৪ সালে তিনি জগন্নাথ কলেজে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান। ১৯৮৭ সালের জানুয়ারিতে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। ওই বছর ডিসেম্বরে সরকারি সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ১৯৯৪ সালে তিনি ঢাকা কলেজের অধ্যাপক হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন খুবই জনপ্রিয়।
১৯৮৪ সালে তিনি বাংলাদেশ লেখক শিবিরেযোগ দেন। লেখক শিল্পীদের অধিকারপ্রতিষ্ঠা আন্দোলনে আমৃত্যু কাজ করে যান। ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় তিনি সরাসরি ত্রাণ কাজে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ লেখক শিবিরের তিন দিনব্যাপী জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনেও তিনি মূখ্যভূমিকা পালন করেন।
১৯৯৪ সালের জুলাই মাসে লেখক- শিল্পীদের ওপর ধর্মীয় ফ্যাসিবাদীদের আক্রমণ ও ব্লাসফেমি আইন প্রণয়নের চক্রান্তের বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়ান। ১৯৯৫ সালের ফেবু্রয়ারি মাসে স্ত্রীর চিকিত্সার করাবার জন্য কলকাতায় যান। এ সময় তিনি শান্তিনিকেতন ভ্রমণ করেন। অক্টোবরে তাঁর মা মারা যায়। মায়ের মৃত্যুর পর পরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ে।
পায়ের তীব্র ব্যথা উপেক্ষা করে তখন দিনরাত ‘খোয়াবনামা’ লিখছিলেন। ওই বছর ৩১ ডিসেম্বর প্রচন্ড পায়ের ব্যথা নিয়ে তিনি খোয়াবনামা উপন্যাসটি লেখা সমাপ্ত করেন। ১৯৯৬ সালের ১৩ জানুয়ারি তাঁর পায়ের হাড়ে ক্যান্সার ধরা পড়ে। ক্যান্সারের কারণে ২০ মার্চ তাঁর ডান পা সম্পূর্ণ কেটে ফেলা হয়। ওই বছর বই আকারে প্রকাশিত হয় তাঁর কালজয়ী উপন্যাস ‘খোয়াবনামা’।
২৭ এপ্রিল কলকাতা থেকে দেশে আসেন।
পুরস্কার
১৯৭৭ সালে হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার। ১৯৮৩ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। ১৯৮৭ সালে আলাওল সাহিত্য পুরস্কার। ১৯৯৬ সালের এপ্রিলে মাসে খোয়াবনামার জন্য পান প্রফুল্ল কুমার সরকার স্মৃতি আনন্দ পুরস্কার।
এছাড়া তিনি ‘সাদাত আলী আকন্দ’, পুরুষ্কার পান। ওই ‘কাজী মাহবুব উল্লাহ’ স্বর্ণপদক নামে আরেকটি পুরষ্কার পান তিনি।
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ
১। অন্য ঘরে অন্য স্বর খোঁয়ারি ২। দুধভাতে উত্পাত ৩।
জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল ( মৃত্যুর পরে প্রকাশিত) ৪। দোজখের ওম
প্রবন্ধের বই
১। সংস্কৃতির ভাঙা সেতু (মৃত্যুর পরে প্রকাশিত)
উপন্যাস
১চিলেকোঠার সেপাই ২। খোয়াবনামা
১৯৯৭ সালের ৪ জানুয়ারী আখতারুজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস মারা যান।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।