আমি সত্যে বিশ্বাসী।
বিয়ে-শাদী এমন একটি পবিত্র বন্ধন ব্যবস্থা। যে ব্যবস্থার ফলে সুস্থ, সুসংহত এবং শান্তিপূর্ণভাবে জীবন-যাপন করার নিশ্চয়তা লাভ করে সমাজ। মানুষের পারিপাশ্বিকতাই মানুষকে সুস্থ মানুষ হিসাবে গড়ে তোলে। আর সুস্থ পরিবেশের প্রথম ধাপই হচ্ছে সংসার জীবন।
শৈশবে পিতা-মাতার স্নেহ বন্ধন কাটিয়ে কৈশোরে পরবর্তীকাল অর্থাৎ যৌবনে নারী-পুরুষে বিয়ে বন্ধনের মাধ্যমে সংসার ধর্মে পদার্পণ করে।
বিয়ে বন্ধন ব্যবস্থা বিভিন্নভাবে সম্পূর্ণ হয়ে থাকে। ইসলাম ধর্মে বিয়ে বন্ধনকে অত্যন্ত উঁচু মর্যদায় অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। বস্তুত ইসলামের সব ক’টি বিধানই নির্ভুল আর সর্বাঙ্গীন সুন্দর মানবতা, ন্যায় ও মূল্যবোধের বিশ্বজনীন পরম সত্যের ঘোষণা নিয়ে জীবনকে শুভ, পবিত্র ও সুন্দর করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইসলামকে ব্যাপক গভীর এর সুদূর প্রসারী ভূমিকা রেখে এসেছে সে কথা বলাই বাহুল্য। অথচ এই শান্তিপূর্ণ বিয়ে বন্ধনের মাঝে অস্বস্তিকর যে ব্যবস্থাটি আমাদের সমাজ শক্তভাবে আসন গেড়েছে- তা’হলো বিয়ে ব্যবস্থায় যৌতুক প্রথা।
কালের আবর্তে সমাজে এই যৌতুক ও পণপ্রথার জন্ম। এতে ইসলামে আল্লাহর নির্দেশিত বিয়ে প্রথা চরমভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। যৌতুকের ভয়াল গ্রাসে পিতা-মাতা হয়েছে সর্বশ্বান্ত ও কন্যাদায় গ্রস্ত। ইসলামে যৌতুক লেন দেনের স্থান নেই। প্রাকইসলামিক যুগে কন্যা সন্তানকে পিতৃ সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হতো।
তাই পিতার সম্পত্তির একটা অংশ উপহার হিসাবে বিয়েতে প্রদান করা হতো। হিন্দু বিধান মতে এবং বিয়ের সময় কন্যাকে পিতার অর্থ সম্পদ যা যৌতুক হিসাবে এখন সমাজে প্রচলিত বিধান হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অনৈসলামিক বিধি ব্যবস্থা ও বিয়ে কর্মকান্ড থেকেই যৌতুক প্রথার উৎসারণ। অন্যদিকে আমাদের মুসলিম সমাজে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী নববধূর দ্রব্য সামগ্রী প্রথম পিতৃ গৃহ থেকে স্বামীর গৃহে গমনকালে প্রয়োজনীয় সাজ-সরঞ্জাম গহনাপাতি দান জেহজ রূপে প্রদান করা হয়। এখানে শর্ত জরবদি কিংবা দর কষাকষির কোন বালাই নেই।
স্ব-ইচ্ছায় ও সুন্তষ্ট চিত্তে এসব দান-জেহাজ দেয়া হয়ে থাকে। এছাড়া ইসলামে বিয়ে বন্ধনে মোহরানার গুরুত্ব অনেক। এটি ইসলামের জন্ম থেকেই মুসলীম সমাজে কড়াকড়িভাবে আরোপিত। মোহরানা কন্যার প্রাপ্য। এই মোহরানা কেবল বর কর্তৃক অনেকে স্বেচ্ছাকৃত উপহার হিসাবে প্রদান করা হয় বা স্ত্রীর নিজস্ব সম্পত্তি হিসাবে গণ্য হয়।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, তোমরা নারী দিগকে মোহরানা প্রদান করো, সূরা নেসায় বলা হয়েছে, পুরুষরা নারীদের ভরণ পোষণ, লালন-পালন সংরক্ষণ তথা সবকিছুর জন্য দায়ী। আল-কোরআনে আরো সুস্পষ্ট ঘোষিত হয়েছে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে কোন কিছু দেয়াই রীতি সংগতভাবে বিয়ে শাদীর ক্ষেত্রে মোহরানা নির্ধারণি অতি অপরিহার্য্য। পবিত্র কোরআন, হাদীস এবং ফেকাহ শাস্ত্রবিদদের মতে, বিয়ে-শাদীতে মোহরানা প্রদান অত্যাবশ্যকীয় শর্ত। এখানে দরাদরি বা চাওয়া বা পাওয়া শরীয়তের বিধানে অনুপস্থিত।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, বদর যুদ্ধে মালে গণীমতের অংশ রূপে হযরত আলী (রাঃ) যে বর্মটি পেয়েছিলেন তা বিক্রয় করে তিনি একশত পঁচিশ দেরহাম হযরত ফাতেমা (রাঃ) কে মোহরানা হিসাবে প্রদান করেন।
হযরত আলী (রাঃ)-এর মোহরানা দেয়ার মতো কোন সম্পদ ছিল না। হযরত ফাতেমা (রাঃ) ও হযরত আলীর এই পবিত্র শাদী মোবারকে হযরত রাসূলে কারীম (সাঃ) স্ব-ইচ্ছায় প্রণোদিত হয়ে গৃহস্থালির কিছু সরঞ্জাম উপহার দেন। এখানে বিশেষভাবে অনুধাবনযোগ্য যে, হযরত রাসূলে পাক (সাঃ)-এর এই উপহারকে যৌতুকের পর্যায়ভূক্তকরণ নিঃসন্দেহে ইহা বোকামির নামান্তর মাত্র।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, মানব সমাজ আজ বিয়ে শাদীতে যৌতুকের শিকারে পড়ে যে বিষ্ময় তথা অভিশপ্ত, কলঙ্কজনক অধ্যায় সৃষ্টি করে চলেছে তা বলাই বাহুল্য। যৌতুক গ্রহণ ও প্রদান দণ্ডনীয় আইন থাকা সত্ত্বেও (অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বিবেচিত হওয়া সত্ত্বেও) এর ফাঁকে ফাঁকে যৌতুকী বিয়ে সম্পাদিত হচ্ছে।
পরিণামে মা বোন হচ্ছে লাঞ্ছিত অনেকেই করছে আত্মহত্যা, চলছে নির্মম হত্যাযজ্ঞ। যদিও নারী সমাজ এ ব্যাপারে সোচ্চার হয়ে উঠেছে তথাপি পুরুষ সমাজের তথাকথিত স্বার্থান্বেষী মহলের মন মানসিকতার কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় নি। যা অতীব দুঃখজনক। প্রসঙ্গতঃ আমি ব্যক্তিগতভাবে মনেকরি যৌতুক প্রতিরোধে দেশের গোটা আলেম সমাজই হচ্ছে নায়েবে রাসূল। সমাজ যখন বিপথগামী, পরস্পর হানাহানি দ্বন্দ্ব কলহে নিত্য-নিয়ত ব্যস্ত হয়ে পড়েছে তখন আলেম ওলামা ও ইমাম সমাজই এর প্রতিরোধে কেবল এগিয়ে আসতে পারে।
এবং এজন্য বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ তাঁদের দ্বারাই বিয়ে-শাদীর কার্যাদা সম্পন্ন হয়ে থাকে। আমাদের প্রিয় ভূমি এই বাংলাদেশে প্রায় সত্তর হাজারের মতো গ্রাম রয়েছে- এতে রয়েছে লক্ষ লক্ষ মসজিদ -এবং প্রতিটি মসজিদে, রয়েছে ইমাম তথা আলেম সমাজ। এই কু-অভিশপ্ত প্রথা সমাজ থেকে উচ্ছেদের ব্যাপারে সঠিক কর্মকাণ্ড পথ নির্দেশনা অন্যদের থেকে অনেক অনেক বাস্তব সম্মত হবে- বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তাই আমি দেশের বৃহত্তর আলেম সমাজ নারী, ইমাম, পীর-মাশায়েখ এবং ইসলামী সামাজিক সংগঠনসমূহ তথা সরকারের কাছে কয়েকটি প্রস্তাব পেশ করছি।
(১) যৌতুক একটি বি-জাতীয় প্রচলন ও নারী নির্যাতনমূলক এক অভিশপ্ত প্রথা। এর বিরুদ্ধে গড়ে তোলার জন্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে ওয়াজ অনুষ্ঠান, আলোচনা সভা, সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে হবে। (২) যৌতুক লেন-দেন হয় এমন বিয়েতে কালেমা বা খুতবা পাঠ না করিয়ে সামাজিকভাবে যৌতুকী বিয়ে বয়কট করতে হবে। (৩) ওয়াজ মাহফিল ও জুমআর খুতবার সময় যৌতুক যে শরীয়ত পরিপন্থি কু-প্রথা এবং এর কুফল ও পরিণতি সম্পর্কে জনসাধারণকে অভিহিত করাও যৌতুক বর্জন করার প্রতি মন-মানসিকতা তৈরি করা। (৪) নিজ নিজ এলাকার সর্বস্তরের সমাজ কর্মীদের নিয়ে একটি শক্তিশালী যৌতুক প্রতিরোধ কমিটি গঠন করতে হবে।
(৫) যৌতুক বিরোধী আইন কঠোরভাবে প্রয়োগের দাবী বিশেষ করে কবিন নামা ফরমে যৌতুকের কোন দাবী নাই এই মর্মে আদালতগ্রাহ্য হলফ নামায় স্বাক্ষর দানের দারা প্রবর্ত্তনের দাবী সরকারের কাছে তুলতে হবে। (৬) কন্যা দায়গ্রস্থ গরীব পিতা-মাতার বিয়েযোগ্য কন্যাদের বিয়ে সুসম্পন্ন করার জন্য ধনাঢ্য বিত্তবান ও সরকারের যৌথ ব্যবস্থাপনায় মহিলা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করার দাবি করতে হবে। (৭) বেতার ও টিভি চ্যানেলসমূহে যৌতুক বিরোধী প্রচারণা ব্যাপকতর করতে হবে। এবং এর পরিণতিও কুফল সম্পর্কে জনসমক্ষে তুলে ধরতে হবে। (৮) এছাড়া অবিবাহিত শিক্ষিত যুবক দ্বারা যৌতুক লেনদেনকে চরম ঘৃণা করে তারা সমাজে যৌতুক বিহীন বিয়ে করে সমাজে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন।
(৯) এ কথা স্মরণ রাখতে হবে যে, বিয়ে-শাদী মানব জীবনের একটি পবিত্রতম শুভ কাজ। ধর্মীয় নীতিমালায় যৌতুক বিয়ে শাদীর কোন স্থান নেই। যৌতুকী বিয়ে সম্পূর্ণ পরিহারযোগ্য। অতএব, দেশের আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ, মসজিদের ইমাম, কাজীসহ সুধী, বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক সাংবাদিক তথা দেশের প্রতিটি সচেতনশীল নাগরিকের উচিত, এই অশুভ চরম ঘৃণিত পরিহার- যোগ্য অভিশপ্ত কু-প্রথার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের মনমানসিকতা গড়ে তোলা এবং এ দেশের পবিত্র ভূমি হতে যৌতুক শব্দটি চিরতরে বিদায় দেয়ার জন্য সকলকে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা চালানোর জন্যে জোর আহ্বান জানাচ্ছি।
উপসংহারে বলতে চাই, আসুন আল্ললাহ ও পরোকালে ভয় রেখে বিয়ে-শাদীতে যৌতুক লেন-দেন থেকে বিরত থাকি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।