প্রীতি ছড়িয়ে দিন বিশ্বময়...
এবারের জাতীয় শিক্ষানীতিতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর একটি প্রয়াস লক্ষ্য করা গেছে। শিক্ষানীতির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, বাস্তবায়নের কৌশল এবং প্রস্তাবিত নব অবকাঠামোর শিক্ষাব্যবস্থার সিলেবাসে বেশ যুগোপযোগিতা রয়েছে। এগুলো যদি রাজনৈতিক দলের ইশতেহারের মতো কথাসর্বস্ব না হয়ে সত্যিই বাস্তবায়িত হয়, তবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিক ও যথেষ্ট মানসম্পন্ন হবে বলে আশা করা যায়। শিক্ষানীতিটি খসড়া হওয়ায় এতে বেশ কিছু গলদ রয়েছে; থাকাটাই স্বাভাবিক। বিভিন্ন মহল থেকে এসব অপূর্ণতার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য দেয়া হচ্ছে।
মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী এবং শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্যদের বক্তব্য অনুসারে যেকোনো গলদের ব্যাপারে জনমতকে গুরুত্ব সহকারে দেখবার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। সেই প্রতিশ্রুতির প্রতি আস্থা রেখেই মাদরাসা শিক্ষার কয়েকটি মৌলিক ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
শিক্ষানীতিতে মাদরাসা শিক্ষার দু’টি লক্ষ্য-উদ্দেশ্য উল্লেখ করা হয়েছে। ১. আল্লাহ-রাসুলের প্রতি অটল বিশ্বাস গড়ে তোলা হবে, আচারসর্বস্ব না করে শিক্ষার্থীদেরকে ইসলামের প্রকৃত মর্মার্থ অনুধাবনে সক্ষম করা হবে এবং জীবনের প্রতিক্ষেত্রে যেন তারা ইসলামী আদর্শ ও মূলনীতির প্রতিফলন ঘটাতে পারে তার ব্যবস্থা নেয়া হবে। ২. সাধারণ বা ইংরেজি মাধ্যমে পড়–য়া ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার লক্ষ্যে অন্যান্য ধারার সঙ্গে মাদরাসা শিক্ষায় অভিন্ন বিষয়সমূহ বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানো হবে।
কিন্তু মাদরাসা শিক্ষার প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে যে সিলেবাস করা হয়েছে, তা উল্লিখিত লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের প্রথমটি বাস্তবায়নে বিজ্ঞানসম্মত হয় নি। মাদরাসার প্রাথমিক পর্যায়ে যে সিলেবাস রাখা হয়েছে, তা ইসলামের প্রকৃত মর্মার্থ অনুধাবন কিংবা বাস্তব জীবনে ইসলামী আদর্শের প্রতিফলন ঘটাতে তেমন একটা সহায়ক হবে না। খসড়া শিক্ষানীতির সিলেবাস অনুসারে প্রাথমিক পর্যায়ে সকল ধারার শিক্ষাব্যবস্থার আবশ্যিক বিষয়গুলো (বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, জলবায়ু পরিবর্তন, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা ইত্যাদি) অভিন্ন রাখা হয়েছে। প্রাথমিক স্তরে মাদরাসা ও সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার সিলেবাসে পার্থক্য সূচিত হয়েছে কেবল একটি ‘ঐচ্ছিক’ বিষয়ের ক্ষেত্রে। প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থার সিলেবাসে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে রয়েছে ললিতকলা ও ইংরেজি মাধ্যমের জন্যে তাদের উপযোগী বিষয়।
আর মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার ‘ঐচ্ছিক’ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ইসলামের মর্মবাণী উপলব্ধিতে সহায়ক এমনসব বিষয় যেগুলো মাদরাসা শিক্ষার স্বাতন্ত্র্য বহন করে। বিষয়গুলো হলো- আরবি ১ম পত্র, আরবি ২য় পত্র, কুরআন, আকাঈদ-ফিকহ ইত্যাদি। এই শিক্ষানীতি অনুসারে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত মাদরাসা ছাত্রদের এই ‘ঐচ্ছিক’ বিষয়গুলোর একটি পড়বার সুযোগ থাকবে মাত্র। এখন প্রশ্ন হলো, শিক্ষানীতির চূড়ান্ত খসড়ায় মাদরাসায় ইসলামী শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য হিসেবে আল্লাহ-রাসুলের প্রতি অটল বিশ্বাস গড়ে তোলা এবং আচারসর্বস্ব নয় বরং ইসলামের মর্মবাণী অনুধাবনের সক্ষমতা অর্জনের যে মহান উদ্দেশ্য ব্যক্ত করা হয়েছে, তা কি মাত্র একটি ঐচ্ছিক বিষয় পড়ে অর্জিত হওয়া সম্ভব?
প্রাথমিক স্তরে যে সিলেবাস প্রণয়ন করা হয়েছে, তাতে মাদরাসা ও অন্যান্য শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে কেবল একটি ঐচ্ছিক বিষয় ছাড়া আর কোনো পার্থক্য থাকবে না। এর ফলে মাদরাসা শিক্ষার স্বাতন্ত্র্য কেবল ক্ষুণœই হবে না বরং মাদরাসা পড়ৃয়া ছাত্রও কমে যাবে আশঙ্কাজনক হারে।
কেননা, মাদরাসায় সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি ইসলামী শিক্ষা দেয়া হয় বলেই অভিভাবকমহল তাদের সন্তানদের মাদরাসায় পাঠিয়ে থাকেন। কেবল সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত করবার উদ্দেশ্য থাকলে তারা মাদরাসায় না পড়িয়ে সন্তানদের স্কুলেই পড়াতে পারতেন। সুতরাং, যে ইসলামী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তা করে তারা তাদের সন্তানদের মাদরাসায় পাঠান, সেই শিক্ষাঙ্গনে ইসলামী শিক্ষার সব বিষয়গুলিকে যদি ঐচ্ছিক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়, এবং সেই তালিকা থেকে মাত্র একটি পড়বার সুযোগ থাকে, তাহলে সন্তানকে মাদরাসায় পাঠিয়ে অভিভাবকদের ‘ইসলামী শিক্ষা’ শেখানোর উদ্দেশ্য কতটা বাস্তবায়িত হবে? বরং এ ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই অভিভাবকবৃন্দ তাদের সন্তানদের মাদরাসায় পড়ানো থেকে সরে আসবেন। কেননা, অবকাঠামো ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার কমতির কারণে মাদরাসায় সাধারণ শিক্ষা যেমন ইংরেজি, বাংলা, গণিত ও বিজ্ঞানের শিক্ষক স্কুলের তুলনায় কম মানসম্পন্ন হয়ে থাকবেন। মাদরাসা ও স্কুল শিক্ষার পার্থক্য যেখানে মাত্র একটি ঐচ্ছিক বিষয়ে সীমাবদ্ধ, সেখানে নিশ্চয়ই আবশ্যিক বিষয়গুলোতে মানসম্মত শিক্ষার ব্যাপারেই বেশি জোর দেবেন অভিভাবকবৃন্দ।
আর সেক্ষেত্রে শিক্ষক ও অবকাঠামোগত দিক থেকে এগিয়ে থাকবার কারণে মাদরাসার পরিবর্তে স্কুলেই সন্তানকে পাঠাবেন তারা।
মাদরাসার মাধ্যমিক পর্যায়ের (নবম-দশম শ্রেণীর) সিলেবাস প্রাথমিক পর্যায়ের সিলেবাসের সাথে একেবারেই অসঙ্গতিপূর্ণ। প্রাথমিক পর্যায়ে যেসব বিষয়কে ঐচ্ছিক রাখা হয়েছে, তার তিনটিকে (কুরআন, হাদিস-ফিকহ, ও আরবি) মাধ্যমিক পর্যায়ে আবশ্যিক করা হয়েছে। এর ফলে মাধ্যমিক পর্যায়ে একজন মাদরাসা ছাত্র বড় ধরনের হিমশিম খাবে। বিষয়টা খোলাসা করা প্রয়োজন।
প্রাথমিক পর্যায়ের সব ক্লাসেই ঐচ্ছিক বিষয়ের তালিকা থেকে শিক্ষার্থীরা যেকোনো একটি বিষয় বাছাই করবে। বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোনটি সহজতর বিষয়, তা অবশ্যই বিবেচ্য হবে। কেননা, ঐচ্ছিক তালিকায় থাকবার কারণে বিষয়টির ওপর তেমন কোনো গুরুত্ব দিয়ে থাকেনা শিক্ষার্থীরা। সে হিসেবে একজন ছাত্র তার প্রাথমিক পর্যায়ের প্রতিটি ক্লাসে আরবি কিংবা আকাইদ ফিকহ’র মতো ‘একটি’ বিষয় (যেটি তার কাছে সহজতর) নির্বাচন করে অষ্টম শ্রেণী পাশ করবে। এরপর যখন সে মাধ্যমিক পর্যায়ের নবম-দশম শ্রেণীতে উঠে দেখবে যে প্রাথমিক পর্যায়ের ‘ঐচ্ছিক’ তালিকার তিনটি বিষয় এখানে ‘আবশ্যিক’ বিষয় হিসেবে পড়তে হবে, তখন সে চরম হতাশায় ভুগবে।
কেননা, এই বিষয়গুলির যেকোনো একটিতে তার ভিত্তি রয়েছে মাত্র, বাকি দু’টিতে নেই। এখন যে ছাত্রটি পূর্বে কেবলই ‘আকাইদ-ফিকহ’ বিষয়টি পড়েছে, মাধ্যমিক পর্যায়ের উপযোগী আরবি সাহিত্য ও ব্যাকরণ কিংবা কুরআন-হাদিস তার কাছে কি সহজবোধ্য হবে? স্কুলপড়–য়া ছাত্রদের কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো দুঃশ্চিন্তা নেই। নবম-দশম শ্রেণীতে যেসব বিষয় তারা ‘আবশ্যিক’ পড়বে, তার সবগুলোই প্রাথমিক পর্যায়েও ‘আবশ্যিক’ হিসেবেই পড়ে আসতে হবে তাদের। এর ফলে স্কুল শিক্ষার তুলনায় মাদরাসার মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাগ্রহণ অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে শিক্ষার্থীদের জন্যে।
মাদরাসা শিক্ষার মাধ্যমিক পর্যায়ের একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর সিলেবাস ও মানবণ্টনে গলদ রয়েছে।
এই পর্যায়ের মানবিক, বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শাখার সিলেবাস ও মানবণ্টন পুনর্বিবেচনা করতে হবে। যেমন, মানবিক শাখার মানবণ্টনের ক্ষেত্রে ‘ইসলামের ইতিহাস’ ও ‘বালাগাত-মানতেক’ বিষয়ে ২০০ নম্বর করে রাখা হয়েছে, যা বাস্তবসম্মত নয়। এ দুটো বিষয়ে ১০০ নম্বর রেখে অন্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যোগ করা যেতে পারে। ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে অর্থনীতিকে ‘ইসলামী অর্থনীতি’ নামকরণ করা হয়েছে। বিষয়টির নাম কেবল ‘অর্থনীতি’ রাখাই ভালো।
কারণ, শুধু ‘ইসলামী’ নামটির কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এটিকে ‘অর্থনীতি’ বিষয় হিসেবে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। ফলে মাদরাসা ছাত্ররা সেখানে ‘অর্থনীতি’ বিভাগে ভর্তি হতে পারছে না। এরকম আরো নানা সমস্যা রয়েছে সিলেবাস ও মানবণ্টনে। চূড়ান্ত শিক্ষানীতি প্রকাশের আগে মাদরাসার বিদগ্ধ শিক্ষকদের মতামতের ভিত্তিতে এর সংস্কার হওয়া উচিত।
কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় মাদরাসার সাধারণ বিষয়গুলো (বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ইত্যাদি) মূল্যায়নের ক্ষেত্রে মাদরাসা শিক্ষকদের অধিকার রাখা হয় নি।
এতে শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্যদের মাদরাসা শিক্ষার প্রতি বৈষম্যই প্রকাশ পেয়েছে। মাদরাসা শিক্ষকদের যোগ্যতাকেও খাটো করে দেখা হয়েছে এর ফলে। পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা একজন শিক্ষকের জন্যে মর্যাদাকর একটি ব্যাপার। মাদরাসা শিক্ষকদের তা থেকে বঞ্চিত করা হলে দক্ষ ও মানসম্মত কোনো শিক্ষক মাদরাসায় চাকুরি করতে চাইবেন না। ফলে সাধারণ বিষয়গুলোতেও মাদরাসা শিক্ষার মান কমে যাবে।
ফলে মাদরাসা শিক্ষার ব্যাপারে যে দু’টি লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের কথা ব্যক্ত করা হয়েছে, তার দ্বিতীয়টিও বাস্তবায়িত হবে না।
মাদরাসা শিক্ষার প্রতি সরকারের আন্তরিকতা কেবল এই শিক্ষানীতির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকুক, আমরা তা চাই না। মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার ব্যাপারে আরো বিজ্ঞানসম্মত সিলেবাস প্রণয়ন করা উচিত। এজন্যে দেশের বিদগ্ধ আলেমদের সমন্বয়ে একটি পৃথক কমিটি করা যেতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে সাধারণ বিষয়গুলোর সাথে মাদরাসা-সংক্রান্ত বিষয়গুলোকেও আবশ্যিক করতে হবে।
এক্ষেত্রে মাদরাসার বর্তমান প্রাথমিক স্তরের সিলেবাসও সামনে রাখা যেতে পারে। বর্তমানে এই স্তরে মাদরাসায় সাধারণ বিষয়গুলো হুবহু স্কুলের পাঠ্যপুস্তক থেকেই পড়ানো হয়। পাশাপাশি ইসলামী বিষয়গুলোকেও আবশ্যিকভাবে পড়ানো হয়ে থাকে। বর্তমান শিক্ষানীতিতেও এই নীতি অনুসরণ করা উচিত। নয়তো মাদরাসা শিক্ষা তার স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ফেলবে।
মাদরাসার স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করা এবং সাধারণ বিষয়গুলোতে মানসম্মত শিক্ষা দু’টোই নিশ্চিত করতে হবে। এজন্যে মাদরাসার অবকাঠামোগত উন্নয়ন, মানসম্মত শিক্ষক ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।