আমরা জানি একদিন আমরা মরে যাব এই জন্যেই পৃথিবীটাকে এত সুন্দর লাগে। যদি জানতাম আমাদের মৃত্যু নেই তাহলে পৃথিবীটা কখনোই এত সুন্দর লাগতো না
সুপার শপ। যার অপর নাম এক ছাদের নিচে সব নিত্যপণ্যের বাজার। অন্য নাম ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে ঘর-গৃহস্থালির সবকিছুই পাওয়া যায় যেখানে।
শহরের অভিজাত শ্রেণীর ক্রেতাদের টার্গেট করে একসময় রাজধানীতে এ ব্যবসা স্বল্প পরিসরে শুরু হলেও আজ তা অনেক বিস্তৃত। খাদ্য নিরাপত্তা, উন্নত মান, ন্যায্যমূল্য ও মনোরম পরিবেশে কেনাকাটার আশায় এখন অনেকেই ছোটেন এসব চেইন সুপার মার্কেটে। কিন্তু যেসব নিশ্চয়তার কথা মাথায় রেখে ক্রেতারা নিত্যদিন সুপার শপগুলোতে ভিড় করছেন তারা কি সেখান থেকে প্রতিশ্র“ত সেবা ও পণ্য পাচ্ছেন? ক্রেতারা যে বিশ্বাস আর আস্থা নিয়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এই নামধারী বাজারগুলোতে যাচ্ছেন তাদের সেই আস্থার আড়ালে কোনো প্রতারণা নেই তো? এমন সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যুগান্তরের পক্ষ থেকে জনস্বার্থের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে গত তিন মাস ধরে ব্যাপক অনুসন্ধান চালানো হয়। অনুসন্ধানে যেসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে তা রীতিমতো বিস্ময়কর তো বটেই, অনেক ক্ষেত্রে ভয়ংকরও। যার প্রতিটি ক্ষেত্রে ধরা পড়েছে জাল-জালিয়াতির নানা চিত্র।
এ বিষয়ে ধারাবাহিক রিপোর্টের আজ প্রথম পর্বে থাকছে সুপার শপগুলোতে থরে থরে সাজিয়ে রাখা মাছ-মাংসের অজানা সব তথ্য।
স্বপ্নর জবাইখানার খোঁজে : চেইন সুপার শপ স্বপ্নর রামপুরা শাখা। এখানে বড় বড় ফ্রিজে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ২৪৩ টাকা কেজি দরে। কিন্তু স্বপ্নর এ শাখা থেকে ৫ মিনিটের পায়ে হাঁটা দূরত্বে রামপুরা কাঁচাবাজার। কিন্তু সেখানে গরুর মাংসের কেজি ২৯০ টাকা।
মান ও নানা দিক বিচার-বিশ্লেষণে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুপার শপে এই মাংসের দর তো খোলা বাজারের চেয়ে কম হওয়ার কথা নয়। এ প্রশ্ন আর সন্দেহের উত্তর খুঁজতে শুরু হল অনুসন্ধান।
এ বিষয়ে আগে স্বপ্ন কর্তৃপক্ষের অফিসিয়াল বক্তব্য নিতে যুগান্তর প্রতিবেদক যান স্বপ্ন সুপার শপের প্রধান কার্যালয় তেজগাঁওয়ের নভোটাওয়ারে। এখানকার কর্মকর্তারা যুগান্তরকে বলেন, উন্নত জাতের গরু কিনে এনে স্বপ্নর নিজস্ব আধুনিক জবাইখানায় জবাই করে মাংস বিক্রি করা হয়। এ কারণে স্বপ্ন কম দামে উন্নতমানের মাংস বিক্রি করতে পারছে।
খুব ভালো কথা; কিন্তু কোথায় যেন একটা খটকা থেকে যাচ্ছে। কর্মকর্তাদের জবানির সত্যতা যাচাই করতে স্বপ্নর আধুনিক জবাইখানার অনুসন্ধান করা হয়। পরদিন জবাইখানার তথ্য জানতে যুগান্তরের অনুসন্ধান টিম হাজির হয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে। এখানকার ভেটেরিনারি কর্মকর্তা ডা. এসএম আমিনুল ইসলাম বাদল জানান, বিভিন্ন সময়ে সুপার শপগুলোকে নোটিশ দিয়ে জানতে চাওয়া হয়েছে তারা কোথা থেকে মাংস কেনে বা কোথায় জবাই করা হয় এবং স্বাস্থ্যসম্মত জবাইখানা আছে কিনা? কিন্তু তাদের কেউ কেউ জবাব দেয়ার প্রয়োজনও বোধ করেননি। কেউ দেন দায়সারা জবাব।
গত বছর ২৩ মে সিটি কর্পোরেশনের পাঠানো নোটিশের জবাবে স্বপ্ন সুপার শপের আইন কর্মকর্তা অমিতাভ বিশ্বাস লিখিতভাবে ডিসিসিকে জানান, যাত্রাবাড়ীর সুতিখাল এলাকায় তাদের একটি মিনি স্টোর আছে। কিন্তু সেখানে মাংস জবাই করার কোনো সনদ নেই। সনদ নেয়ার জন্য তারা সাত দিনের সময় চেয়ে আবেদন করে। ওই কর্মকর্তা জানান, এক বছর পার হয়ে গেলেও তাদের এক সপ্তাহ শেষ হয়নি। অথচ স্বপ্ন সুপার শপে প্রতিদিন হাজার কেজি মাংস বিক্রির জন্য মজুদ করা হয়।
এসব মাংস অদৃশ্য জবাইখানা থেকে আসছে।
ডিসিসির ভেটেরিনারি বিভাগের পরিদর্শকরা যুগান্তরকে জানান, বহু চেষ্টা করেও সুপার শপগুলোর জবাইখানা তারা খুঁজে পাননি। এক প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, আরে ভাই জানেন না ওরা কত প্রভাবশালী। ওদের জবাইখানা নিয়ে বেশি ঘাটাঘাটি করা যায়? চাপাচাপি করে একটু খোঁজ নিতে গেলে আমাদের হয়রানিমূলক বদলি করে দেয়া হয়। কারও কারও বিরুদ্ধে ঘুষ চাওয়ার মিথ্যা অভিযোগও আনা হয় ।
এসব কারণে অনেক কর্মকর্তা ঝামেলা এড়াতে চোখ-কান বন্ধ রাখার কৌশল বেছে নিয়েছেন।
যেখান থেকে মাংস আসে : সিটি কর্পোরেশন চুপ থাকলেও সুপার শপগুলোর সেই অদৃশ্য জবাইখানার খোঁজে ব্যাপক তথ্যানুসন্ধান করা হয়। এক পর্যায়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য মেলে। জানা যায়, স্বপ্ন, আগোরা, নন্দন ও মীনা বাজারসহ বিভিন্ন সুপার শপ কিছু গোপন জবাইখানা থেকে সস্তায় নিুমানের মাংস কিনে আনে। এসব গোপন জবাইখানা গড়ে উঠেছে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প, মিরপুর ১১নং সেকশন, দক্ষিণ বাড্ডা আইস ফ্যাক্টরির গলি, হাজারীবাগ ও মিরপুর শেওড়া পাড়ায়।
জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ রেজিস্টার্ডবিহীন এসব জবাইখানায় গভীর রাতে পশু জবাই হয়। দিনের আলো ফোটার আগেই সেখান থেকে গোপনে নিজস্ব গাড়িতে করে মাংস নিয়ে যায় বেশ কয়েকটি নামিদামি সুপার শপ। প্রক্রিয়াটি সরেজমিন পর্যবেক্ষণের জন্য বেছে নেয়া হয় মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্প। সাংবাদিক পরিচয় গোপন করে মাংস ব্যবসায়ী সেজে গত ২১ জুন যুগান্তরের অনুসন্ধান টিম হাজির হয় ঘটনাস্থলে। রাত তখন ৩টা।
বাবর রোড সংলগ্ন জেনেভা ক্যাম্পের ভেতরে সরু গলিগুলোতে হাঁটার উপায় নেই। জবাইয়ের অপেক্ষায় সারি সারি গরু বেঁধে রাখা। গরুগুলোর বেশিরভাগ রুগ্ণ এবং হাড্ডিসার। একটার পর একটা গরু আনা হচ্ছে আর মাত্র দুই/তিনজন মিলে বিশেষ কায়দায় গরুকে ধরাশায়ী করে দ্রুত জবাই করছে। প্রায় প্রতিটি গলিতেই একাধিক পশু জবাই করে অন্ধকারের মধ্যে দ্রুত হাত চালিয়ে চামড়া ছাড়ানো হচ্ছে।
জবাইয়ের ক্ষেত্রে ধর্মীয় রীতি মানার কোনো বালাই নেই। একদিকে জবাই, অন্যদিকে একটি গরুকে ৪/৫ টুকরা করে একপাশে জড়ো করা হচ্ছে। যেখানে রাখা হচ্ছে সেখানকার পরিবেশও অনেকটা গা ঘিন ঘিন করার মতো। পয়ঃনিষ্কাশনের ড্রেনের পাশে গরুর মাংস আর ময়লার সহাবস্থান।
রাত ৩টা ২০ মিনিটে স্বপ্ন সুপার শপের একটি বিশাল কাভার্ডভ্যান ঢুকে গেল জেনেভা ক্যাম্পের ৫নং গলিতে।
গাড়ির নম্বর ঢাকা মেট্রো-শ-১১-১৩২৪। গাড়ি থেকে বেশকিছু কাগজপত্র হাতে করে নেমে এলেন ৩ জন। তাদের আসতে দেখে মাংস জবাইরত কসাইদের ব্যস্ততা আরও বাড়লো। একজন কসাই তার সহকর্মীকে তাড়া দিয়ে বললেন, আলামিন স্যার এসে গেছেন, তাড়াতাড়ি হাত চালা। জানা গেল এই আলামিন স্যার স্বপ্ন সুপার শপের মাংস ক্রয় বিভাগের কর্মকর্তা।
তিনি এখান থেকে নিয়মিতই কয়েক টন মাংস নিয়ে যান। তার হাতে এসিআই কোম্পানির কম্পিউটার প্রিন্ট করা অফিসিয়াল অর্ডারসিট। তিনি এসে দাঁড়ালেন নোংরা ড্রেনের পাশে জমা করে রাখা একটি বড় মাংসের স্তূপের কাছে। তার হাতে থাকা কোম্পানির বিভিন্ন অর্ডারশিটে ফটাফট কয়েকটি টিক চিহ্ন দিলেন। এরপর কসাইরা ওজন করে মাংস তুলে দিলেন স্বপ্ন সুপার শপের কাভার্ড ভ্যানে।
ভোর হওয়ার আগেই মাংস বোঝাই গাড়িটি বেরিয়ে গেল জেনেভা ক্যাম্পের গলি থেকে।
এখানকার অবাঙালি মাংস ব্যবসায়ী গুর্দান মিয়া জানান, স্বপ্ন সুপার শপের কর্মকর্তারা প্রতিদিন তার কাছ থেকে ২/৩শ কেজি মাংস কিনে নিয়ে যান। তিনি প্রতি কেজির দর নেন ২১০ থেকে ২১৫ টাকা। তার মতো জেনেভা ক্যাম্পের আরও ৪/৫ জন মাংস ব্যবসায়ীর (কসাই) কাছ থেকে মাংস কিনে থাকে স্বপ্ন। এত কম দামে কীভাবে মাংস বিক্রি করেন জানতে চাইলে গুর্দান মুচকি হাসেন।
এ প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে তিনি মাংস কাটার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তবে স্বপ্নতে মাংস সরবরাহ করেন এমন আরেক মাংস ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কম দামে মাংস বেচতে গেলে তো কম দামে গরুও কিনতে হয়। আর কম দামের গরু মানে তো না বোঝার কথা নয়। জেনেভা ক্যাম্পের কসাইরা জানান, অপেক্ষাকৃত রোগা ও অসুস্থ গরু কম দামে কিনে এনে জবাই করা হয় এসব কসাইখানায় । এছাড়া পরিবহনের সময় বা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পাচার করে আনার সময় অনেক গরু গুরুতর আহত হয়।
এগুলো মরে যাওয়ার আগেই জবাই করে ফেলা হয়। সেসব মাংসও দেয়া হয় সুপার শপগুলোতে।
জেনেভা ক্যাম্পের কসাইরা জানান, এসব জেনেশুনেই মাংস কেনে নিয়ে যায় স্বপ্নসহ বেশ কয়েকটি সুপার শপ। ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের কয়েকজন হাসিল (পশু জবাইয়ের সরকারি ফি) আদায়কারী জানান, মীনা বাজারেও জেনেভা ক্যাম্প থেকে মাংস যায়। মীনা বাজারে মাংস দেয় জেনেভা ক্যাম্পের অবাঙালি মাংস ব্যবসায়ী গোলাম হোসেন।
এ ছাড়া আগোরা সুপার শপ মাংস কিনে নিয়ে যায় মেরুল-বাড্ডার কসাই দেলোয়ারের কাছ থেকে। উত্তর বাড্ডার কয়েকটি জবাইখানা থেকেও আগোরা মাংস নেয়। মিরপুরের প্রিন্স বাজার সুপার শপ মাংস কেনে মিরপুর ১১নং সেকশনের মাংস ব্যবসায়ী কাল্লু মিয়া ওরফে বিহারি কাল্লুর কাছ থেকে। নন্দন, নান্দানিক বাজার, কেরি ফ্যামিলি ও আমানাসহ অন্যান্য সুপার শপেও এভাবেই অপরিক্ষিত মাংস রাতের আঁধারে পৌঁছে যায়। যেগুলোকে সুপার শপ কর্তৃপক্ষ নিজেদের ফার্মের উন্নত স্বাস্থ্যবান গরুর পরিক্ষিত নিরাপদ মাংস বলে বিক্রি করে।
আর তাদের কথা বিশ্বাস করে এসব সুপার শপ থেকে মাংস কিনে প্রতিনিয়ত প্রতারিত হন উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ক্রেতারা।
অপরিক্ষিত মাংসের ঝুঁকি : সিটি কর্পোরেশনের সাবেক ভেটেরিনারি কর্মকর্তা ডা. আজমত আলী যুগান্তরকে বলেন, সুপার শপগুলোতে মাংস ফ্রিজিং করে বিক্রি করা হয়। কিন্তু রোগাক্রান্ত পশুর মাংস ফ্রিজিং অবস্থায় রাখলে মাংসে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়াল টক্সিন জন্ম নেয়, যা খাওয়ার পর মানুষের পাকস্থলীতে প্রদাহ হতে পারে। মায়ের দুধের মাধ্যমে শিশুর শরীরে এর ভাইরাস সংক্রামিত হলে শিশুর মৃত্যু ঝুঁকি থাকে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম যুগান্তরের কাছে খোলামেলা স্বীকারোক্তি দেন।
তিনি বলেন, বেশিরভাগ সুপার শপে যেসব মাংস বিক্রি করা হয় সেগুলো প্রকৃতপক্ষেই খাওয়ার অযোগ্য। এগুলো খোলাবাজারে বিক্রি করতে গেলে মাংস ব্যবসায়ীরা পিটুনি খাবেন। তিনি জানান, মাংস ব্যবসায়ী সমিতির পক্ষ থেকে অসুস্থ গরু জবাই করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা আছে। কিন্তু কিছু অসাধু মাংস ব্যবসায়ী সুপার শপগুলোর প্রলোভনে পড়ে বেশি লাভের আশায় রাতের আঁধারে অসুস্থ গরু জবাই করে মাংস বিক্রি করছে। এসব বন্ধ করতে সিটি কর্পোরেশনের আরও কার্যকর ভূমিকা রাখা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন ।
পচা মাংসের ক্রেতা : সুপার শপে প্রতিদিনকার পচনশীল পণ্য প্রতিদিন সব বিক্রি হয়ে যায় না। অবিক্রীত মাছ-মাংসে পচন ধরলে সেগুলো কি করা হয়, তা জানার জন্য পৃথকভাবে অনুসন্ধান করা হয়। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখা থেকে জানা যায়, ২০১১ সালের ১৪ জুন রাজধানীর কড়াইল বস্তিতে বিপুল পরিমাণ পচা মাংস বিক্রির সময় খালেক, ফারুক ও রানু বেগম নামে তিন মাংস বিক্রেতা র্যাবের হাতে ধরা পড়ে। ৪০ টাকা কেজি দরে পচা মাংসগুলো বিক্রি করা হচ্ছিল। খবর পেয়ে কড়াইল বস্তিতে অভিযান চালিয়ে ৯৫ কেজি পচা গরুর মাংস জব্দ করে র্যাব।
পচা মাংস বিক্রেতা রানু বেগম র্যাবের কাছে স্বীকারোক্তি দেয়, তার স্বামী আলতাফ হোসেন পচা মাংস কেনাবেচার ব্যবসা করেন। বিভিন্ন সুপার শপে জমে থাকা মাংসে পচন ধরলে সেগুলো তার স্বামী স্বল্প দামে কিনে আনেন। সন্ধ্যার পর বিভিন্ন বস্তির সামনে তিনি সেগুলো ফেরি করে বিক্রি করেন। আবার বেশি মাংস পাওয়া গেলে তারা সেগুলো বড় খাবার হোটেলেও সরবরাহ করেন। অনুসন্ধানকালে স্বপ্ন কর্তৃপক্ষের কাছে পচা মাংস বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে তারা দাবি করেন র্যাবের জব্দ করা পচা মাংসগুলো স্বপ্ন সুপার শপের ছিল না।
গত ১৫ জুলাই স্বপ্নর জনসংযোগ কর্মকর্তা আফতাবুল করিম তানিম যুগান্তরকে বলেন, র্যাবের হাতে ধরা পড়া মাংসগুলো স্বপ্নর ছিল না। তিনি বলেন, স্বপ্ন কখনই এত নোংরা কাজ করতে পারে না। তথ্যানুসন্ধানে র্যাব সদর দফতর থেকে পচা মাংস বিক্রির ওই রশিদটির কপি সংগ্রহ করা হয়। তাতে দেখা যায়, ২০১১ সালের ১৪ জুন স্বপ্ন সুপার শপের কাজিপাড়া আউটলেট থেকে এসিআই কোম্পানির প্যাডে লিখিতভাবে ৯৫ কেজি পচা মাংস বিক্রি করা হয়। যুগান্তরের হাতে আসা স্বপ্ন সুপার শপের নিজস্ব প্যাডে ম্যানেজারের স্বাক্ষরিত ওই রশিদে লেখা আছে ওয়েস্টেজ বিফ সেল (নষ্ট গরুর মাংস বিক্রি) ৯৫ কেজি।
র্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান কর্নেল জিয়াউল আহসান যুগান্তরকে বলেন, ওই অভিযানে স্বপ্নর পচা মাংস বিক্রির সময় বিক্রেতা রানুকে গ্রেফতার করে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তার কাছ থেকে পচা মাংসের ব্যবসা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী পুরো চক্রটিকে ধরতে গোয়েন্দা অনুসন্ধান অব্যাহত আছে।
মাছ বিক্রিতেও প্রতারণা : মাংসের পাশাপাশি সুপার শপগুলোর ফ্রিজে হরেক রকম মাছ থরে থরে সাজিয়ে রাখা থাকে। ভালো মানের আশায় ক্রেতারা সাধারণ বাজার থেকে কয়েক গুণ বেশি দামে সুপার শপ থেকে মাছ কিনে থাকেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিষাক্ত লেগুন ও ড্রেনে চাষ করা মাছও অনায়াসে ঢুকে যায় সুপার শপগুলোতে। আর কারওয়ান বাজার থেকে প্রতিদিন কয়েক টন মাছ কিনে সুপার শপে ঢুকিয়েই বলা হয়, ওই সব মাছ তারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে নদী, বিল ও হাওড় থেকে সংগ্রহ করেন। চাষ করা হাইব্রিড জাতের সিং, মাগুর ও কই মাছকে দেশী জাতের বলে উচ্চমূল্যে বিক্রি করা হয়।
সরেজমিনে সুপার শপের মাছ সংগ্রহের চিত্র দেখার জন্য গত ১৯ আগস্ট ভোর সাড়ে ৫টায় কারওয়ানবাজার গেলে দেখা যায়, বিজিএমইএ ভবনের সামনে মাছের পাইকার ও বিক্রেতার হাঁকডাকে জমজমাট পরিবেশ। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেয়া যায়, স্বপ্ন সুপার শপের নিজস্ব কয়েকটি কাভার্ড ভ্যান (ঢাকা মেট্রো ম-৫৪-১৩১৩, ঢাকা মেট্রো চ-১১-১৩২৩)।
ভ্যানগুলো মাছ বোঝাই করে পালা করে চলে যাচ্ছে আবার আসছে। স্বপ্ন সুপার শপের গাড়িতে মাছ তুলে দিচ্ছিলেন এসিআই কোম্পানির বাইং কোয়ার্ডিনেটর সাঈদ। যুগান্তরের অনুসন্ধান টিম তার মুখোমুখি হয়। সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে সাঈদ কিছুটা হকচকিয়ে যান। তিনি দাবি করেন, কারওয়ানবাজার ঘুরে তারা ভালো মাছ কিনছেন।
দেশী জাতের কই, শিং ও মাগুর মাছ কেনা হয়েছে। তবে কারওয়ান বাজারের যে আড়ৎদারের কাছ থেকে এসব মাছ কেনা হচ্ছিল সেই আড়ৎদার বাবুল ওরফে সিলেটি বাবুল যুগান্তরকে বলেন, আরে ভাই দেশী জাতের না, চাষ করা কই, শিং ও মাংগুর এসিআই কোম্পানির কাছে বিক্রি করেছি।
মাছ কিনতে আসা আগোরা সুপার শপের লোগোযুক্ত বিশাল এক কাভার্ডভ্যান কিছুটা দূরে দাঁড়ানো। প্রিন্সবাজার সুপার শপের কাভার্ডভ্যান (ঢাকা মেট্রো ম-১১-১৫০০) নিয়ে মাছ কেনার জন্য এসেছেন চালক হারুন। দুটি গাড়ির সামনে বড় বড় ডিজিটাল ওজন মাপক যন্ত্র।
কয়েকজন কুলি মিলে মাছের বড় পেটি ওজন করে উঠিয়ে দিচ্ছেন আগোরা ও পিন্সবাজারের কাভার্ডভ্যানে। দুপুর ১২টায় আগোরার মগবাজার আউটলেটে গিয়ে বিক্রয় কর্মীদের জিজ্ঞেস করা হয় এসব মাছ কোথাকার। বিক্রেতারা অবলিলায় সাজানো কথা বলে যান। তারা বলেন, হাওড় ও নদীর মাছ কোম্পানির নিজস্ব সরবরাহকারীর মাধ্যমে কিনে আনা হয়েছে।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : এসব বিষয়ে গত রোববার স্বপ্ন সুপার শপের নির্বাহী পরিচালক সাব্বির হাসান নাসিরের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি যুগান্তরের কাছে স্বীকার করেন স্বপ্নর নিজস্ব কোনো জবাইখানা নেই।
প্রয়োজনীয় মাংস তারা বাইরে থেকেই সংগ্রহ করেন। উন্নতমানের মাংস কেনার জন্য তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, স্বপ্নর এখন যে সক্ষমতা তাতে নিজস্ব একটি আধুনিক জবাইখানা করা সম্ভব নয়। তবে স্বপ্ন ক্রেতাদের কাছে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তাই অচিরেই একটা আধুনিক জবাইখানা স্থাপনের কথা তারা ভাবছেন।
পচা মাংস বিক্রির অভিযোগ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, স্বপ্নর শ্যাওড়াপাড়া শাখা থেকে পচা মাংস বিক্রির অভিযোগ পাওয়ার পর ওই শাখার ম্যানেজারকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
রহিমআফরোজ সুপার স্টোরের (আগোরা) মার্কেটিং ম্যানেজার আশরাফুল হাসান গতকাল যুগান্তরকে বলেন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে কোনো পণ্য তারা বিক্রি করেন না। কারওয়ান বাজারের মাছকে নদী বা হাওড়ের মাছ বলে বিক্রি করা হয় না। তিনি দাবি করেন আগোরা পণ্য সংগ্রহের প্রতিটি ধাপে সর্বোচ্চ মানের নিশ্চয়তা বিধান করে।
নন্দন মেগাশপের ম্যানেজার (অপারেশনস) সমীর কুমার দাস যুগান্তরকে বলেন, তারা যাচাই-বাছাই করে মানসম্পন্ন মাংসই বিক্রি করেন।
মীনা বাজার সুপার শপের ম্যানেজার (অপারেশন) শামীম আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, তাদের নিজস্ব অত্যাধুনিক জবাইখানা রয়েছে। স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে ডাক্তারি পরীক্ষার পর সেখানে পশু জবাই করা হয়। এ কারণে অন্য যে কোনো সুপার শপের চেয়ে মীনা বাজারের মাংস অনেক বেশি নিরাপ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।