আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কমরেড অমূল্যনাথ লাহিড়ীঃ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা।

মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত।

পরধীন ভারতকে স্বাধীন করার জন্য যে সমস্ত বিপ্লবী জীবনবাজী রেখে লড়াই-সংগ্রাম করেছেন, তাঁদের মধ্যে কমরেড অমূল্যনাথ লাহিড়ী অন্যতম। ভারত মাতাকে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর শাসন-শোষণ থেকে মুক্ত করার জন্য তিনি মাত্র ১৪ বছর বয়সে প্রথম জেলে যান। তিনি ৮৮ বছর বেঁচে ছিলেন। এই ৮৮ বছর জীবনের মধ্যে ব্রিটিশ – পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ আমলে ৩০ বছর জেলে কাটিয়েছেন।

অমূল্যনাথ লাহিড়ীর জন্ম ১৮৯৮ সালের ২১ আগষ্ট। সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাহপাড়া উপজেলার লাহিড়ী মোহনপুর গ্রামে। বাবা দ্বারকনাথ লাহিড়ী, মা সারদা লাহিড়ী। অমূল্যনাথ লাহিড়ীরা দুই ভাই। ছোট ভাইয়ের নাম অনাথ লাহিড়ী।

পিতা দ্বারকনাথ লাহিড়ী ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ সার্ভিস বিভাগের একজন অফিসার ছিলেন। এই চাকরিসূত্রে তিনি কলকাতার বেলেঘাটায় বসবাস শুরু করেন। এখানেই অমূল্যনাথ লাহিড়ীর শিক্ষাজীবন শুরু হয়। মা সারদা লাহিড়ী অগ্নিযুগের সশস্ত্র বিপ্লববাদী দল অনুশীলনের সদস্য ছিলেন। তিনি অনুশীলন দলের বিপ্লবীদের নানা কাজে সহযোগীতা করতেন।

অমূল্যনাথ লাহিড়ী শিশুকাল থেকে মায়ের সংস্পর্শে থাকার কারণে তিনিও অনুশীলন দলের কর্মীতে পরিনত হন। সেই কিশোর বয়সেই তিনি অনুশীলন দলের সংবাদ এবং অস্ত্রবাহক হিসেবে ভারতবর্ষের সর্বত্র বিচরন করতেন। পুলিশ অফিসারের সন্তান, সুদর্শন ওবং স্মার্ট হওয়ার কারণে ইংরেজ ঘাটিগুলোতে অবাধে প্রবেশ করতে পারতেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি ১৯১২ সালে প্রথম জেলে যান। তিনি ১৯৩৮ সালে ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন।

কর্মচাঞ্চল্য ও প্রচারবিমুখ সাদাসিধে জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। অল্পভাষী অথচ দারুণ দৃঢ়চেতা স্বভাবের এই মানুষটি জমিদারের সন্তান হয়েও কৃষক - শ্রমিক - মেহনতী মানুষের আপন জন ছিলেন। তিনি ১৯৬৬ সালের তেভাগা আন্দোলনের নিজের পরিবারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কৃষকদের দাবি আদায়ে সংগ্রাম চালান। এ আন্দোলনের কারণে তিনি তার পরিবারে কৃষকদের দুধ সরবরাহ করতে নিষেধ করে দেন। জমিদার বাড়ির শিশুদের দুধ খাওয়া বন্দ হয়ে যায়।

শেষ পর্যন্ত জমিদারের সাথে কৃষকদের দশ আনা ছয় আনা চুক্তি হয়। সেই সময়ে লাহিড়ী মোহনপুর গ্রামে ১৮ জন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিল। ১৮ জনের মধ্যে ৮ জন নারী ছিলেন। এরা সবাই ছিল কৃষকের মেয়ে-বৌ। কমরেড অমূল্যনাথ লাহিড়ী ১৯৫৭ সালের পর স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত পাবনা জেলার ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি ছিলেন।

১৯৫৪ সালে তিনি যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহন করেন। এরপর তিনি কৃষকসমিতির সাথে যুক্ত হয়ে কৃষকদের সংগঠিত করেন। ১৯৬৪ সালে তার নেতৃত্বে মোহনপুরে বিশাল কৃষক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। লক্ষাধিক কৃষকের এ সমাবেশে মাওলানা ভাসানী ও নাপ নেতা ইসহাক অংশ গ্রহণ করেন। এই সমাবেশে মুসলিমলীগ পুলিশের সহয়তা নিয়ে হামলা চালায়।

কমরেড লাহিড়ীর নেতৃত্বে কৃষক সমিতির স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী হামলা প্রতিহত করে অস্ত্রধারী পুলিশকে আটক করে। এই সমাবেশে অমূল্যনাথ লাহিড়ী ন্যাপ নেতাদের উপস্থিতিতে বলেছিলেন- বাঙালী পাকিস্থানে থাকবে না, বাঙালী স্বাধীন হয়ে যাবে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। এই বয়সে তিনি পায়ে হেঁটে সিরাজগঞ্জ থেকে ঈশ্বরদী পর্যন্ত পার্টি নেতাকর্মীদের যুদ্ধের কাজে সংগঠিত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের জন্য পশ্চিম বঙ্গের করিমপুরে তিনি ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি এবং ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করেন।

পার্টির নেতা কর্মীদের প্রতি তিনি ছিলেন অসাধারণ দরদী। প্রত্যেক কর্মীর যাবতীয় খোজখবর রাখতেন এবং তার সুখে দুঃখে সাথে থাকতেন। কোনো কর্মী অসুস্থ হলে তাকে সুস্থ করে তুলতেন। সবার সাথে তাঁর পরমাত্মীয়ের সম্পর্ক ছিল। রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামের পাশাপাশি তার ছিল প্রচণ্ড সামরিক জ্ঞান।

এই জ্ঞান তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়েছেন। কিভাবে পশ্চাৎপসারণ করে পুনরায় আক্রমন চালাতে হবে সে সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধাদের পরামর্শ দিতেন। মুক্তিযোদ্ধারাও তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করতেন। ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির অমূল্যনাথ লাহিড়ীর সাথে আলোচনায় বসে। এই আলোচনায় পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি একসাথে স্বাধীনতা যুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করবে।

সেই সিদান্ত অনুযায়ী পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি বৃহত্তর পাবনাঞ্চলে সিপিবি’র সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। কমরেড অমূল্যনাথ লাহিড়ী ১৯৮৬ সাকের ২৪ আগষ্ট মারা যান।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।