আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দৃকের ঘটনায় চীন বা তিব্বত নয়, সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে মামলাটা সরকারের সঙ্গে

হাঁটা পথে আমরা এসেছি তোমার কিনারে হে সভ্যতা। আমরা সাত ভাই চম্পা মাতৃকাচিহ্ন কপালে দঁড়িয়েছি এসে _এই বিপাকে, পরিণামে। আমরা কথা বলি আর আমাদের মা আজো লতাপাতা খায়।

দৃক কাণ্ডে বুঝলাম বুদ্ধিজীবিতার মুড়িঘন্টে ঝোলের ঢলে মাছের মুড়োটাই ভেসে গেছে। এবং এও বুঝলাম, কর্মহীন ‘সঠিক চিন্তা’ দায়িত্বহীনও হতে পারে।

তাই প্রতিবাদহীন ফাঁকা মাঠে পুলিশ এসেছে, প্রদর্শনী বন্ধ হয়েছে, দৃকের দরজায় তালা পড়েছে। সুকুমার রায় লিখেছিলেন, ছিল একটা রুমাল হয়ে গেল বেড়াল। চীনা দূতাবাসের লাল রুমাল চোখের পলকে স্বদেশি স্বরাষ্ট্র দপ্তরের রক্তচু শাঁসানি থেকে নিষেধাজ্ঞা হয়ে যেতে আইন লাগলো না, লাগলো যাদু। যাদুবলেই দেশটা ভারত-আমরিকার পাশাপাশি চীনেরও হয়ে গেল। প্রশ্নটা তাই, সখী তুমি কার? তিব্বত তুমি কার? দৃক তুমি কার? পুলিশ তুমি কার? চিন্তাবিদ তুমি কার? ভারতের, চীনের, আমেরিকার না বাংলাদেশের? ঘটনা যে আকাশ থেকে পড়ে না তা তো আমরা জানিই।

ল্যাম্পপোস্টকে ভারতীয় দূতাবাসের সামনে প্রতিবাদ করতে দেওয়া হলো না। অকথ্য জুলুম-নির্যাতন হলো। মার্কিন-ব্রিটিশ তেলকোম্পানির স্থানীয় এজেন্ট পেট্রোবাংলার সামনে প্রতিবাদ করায় বেদম পিটুনি খেতে হলো আনু মুহাম্মদসহ তেল-গ্যাস কমিটির অজস্র কর্মীকে। ফরহাদ মজহারের ঢাকা কাবে ঢুকতে না পারার বিরুদ্ধে তাঁর ক্ষোভ ও তাঁর লুঙ্গি পরাকে ‘মৌলবাদী’ বলে বদনাম দেওয়া হলো। সমুদ্রের গ্যাস ইজারার বিরুদ্ধে জনআন্দোলন থেকে শুরু করে গার্মেন্ট শ্রমিকদের ন্যায্য আন্দোলনকে সরকারের মন্ত্রীরা বললেন ‘ষড়যন্ত্র’।

এখন দৃকের ফটকে তালা ঝুললো। এগুলো কীসের আলামত? এসবের যে কোনোটির সঙ্গে যে কারোরই দ্বিমত এমনকি বিরোধ থাকতে পারে, কিন্তু প্রহার করা, পা ভেঙ্গে দেওয়া কিংবা তাদের ঘরবাড়ি-প্রতিষ্ঠানে তালা দেওয়া, বদনাম দিয়ে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করা ফ্যাসিবাদী খাসলত। এইটা ভুললে চলবে না। ঠিক যে চীন-ভারত বুঝা দরকার। তবে তার জন্য তিব্বত বা কাশ্মীর যাওয়ার দরকার নাই।

দৃকে গেলেই চলতো। দৃক এলিট পেইন্ট না বার্জার পেইন্ট না রক্সি পেইন্ট সেটা পরের আলোচনা। এই দুইকে এক নিঃশ্বাসে করলে অনেক সময় কিংকর্তম্যবিমূঢ় হতে হয়। একাত্তরে অনেকে এরকম দশায় পড়েছিলেন। আমাদের অধিকার রয়েছে ইরাক-আফগানিস্তান-ফিলিস্তিন বা তিব্বত-মণিপুর-কাশ্মীর কিংবা মাওবাদী-তালেবান কিংবা মার্কিন-ভারত-চীন বা ইসরায়েলের বা যে কারো পে বা বিপে মতপ্রকাশ করবার।

কে ভুল বা কে সঠিক তা নিয়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মধ্যে বিতর্কও চলতে পারে। এটুকু আইনী স্বাধীনতা নাগরিক অধিকারের গোড়ার শর্ত। এটুকু হলো পায়জামার ফিতা, এটা না থাকলে কোনো গেরো দিয়েই সংবিধানের লজ্জাস্থান ঢাকবার কোনো সুযোগই পাবে না বুর্জোয়া আইন ও নৈতিকতা। নাগরিকের বিবেকের জিম্মাদার রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠান নয়, ব্যক্তি বা সমাজ স্বয়ং। এ চিন্তা ছাড়লে বিপদ।

কথা হলো, রাষ্ট্রযন্ত্র বলপ্রয়োগের মাধ্যমে একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী বন্ধ করে দিয়েছে। এর জন্য কোনো অজুহাত দেখানোরও দরকার মনে করে নাই তারা। ১৯৯৩ সাল থেকে অন্তত হাজার দুই প্রদর্শনী হয়েছে সেখানে। সারাদেশে অহরহই তা হয়ে আসছে। তবে কি সবই বেআইনী? পুলিশ না বললেও আমরা জানি, ভারতের সঙ্গে যে মৈত্রী চুক্তি করা হয়েছিল শেখ মুজিব আমলে, পরের সব সরকার যা নবায়ন করেছে এবং সংসদে যা বিধানের মর্যাদা পেয়েছে; সেখানে এরকম ধারা আছে যে, বন্ধুরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না।

আর কার সঙ্গে এরকম চুক্তি করা আছে কে জানে? এটা গেল একটা দিক। মামলাটা তাই আগে রাষ্ট্রের সঙ্গেই মীমাংসা করে নেওয়া দরকার। এই রাষ্ট্র আজ সাম্রাজ্যবাদের আড়কাঠি বনে গেছে। একে মুক্ত করতে হলে জনগণের বিরুদ্ধে এর যে দাঁতনখ সেটাকে চিনতে হবে, ঠেকাতে হবে। রাষ্ট্রকে জনগণের অধীন করা ছাড়া বাইরের চাপ বা আঘাত কিছুই মোকাবেলা করা যাবে না।

কারণ, টিকে থাকতে গেলে রাষ্ট্র প্রয়োজন। সেকারণেই তার ওপর নিজেদের অধিকার ও ক্ষমতাকায়েম ছাড়া উপায় নাই। দৃক এখানে একাই ভিক্টিম হয়নি, ভিক্টিম হয়েছে স্বাধীন নাগরিক তৎপরতা। দৃক বা এর কর্ণধার শহীদুল আলমের পোস্টমর্টেম করে এ দিকটা ঢাকা যাবে না। বরং অবৈধ চাপের কাছে নতিস্বীকার না করে শহীদুল আলম রাষ্ট্রের অন্যায় ক্ষমতাপ্রয়োগকে উদোম করে দিয়েছেন।

দালাইলামার নির্বাসনে যাওয়ার ছবি দেখানোর ইচ্ছা জেগেছিল যে ফটোগ্রাফারের, চাপের মুখেও তিনি তাঁর নাম-ধাম-নিবাসের তথ্য এসবি-কে দেননি। এটা যদি কৌশলী চালও হয়, সেটা তাঁরই বাহাদুরি। পুলিশের কর্ডনের মাঝখানে শহীদুল আলমের একা দাঁড়িয়ে থাকা এ ক্ষেত্রে আলোকচিত্রী, আলোকচিত্র এবং মতপ্রকাশের অধিকারের প্রতি পিতৃসুলভ দায়িত্বের পরিচয়ই মনে হয়। আর আমরাও জানলাম কোন ‘গণতন্ত্রের’ সামিয়ানা তলে আমাদের বাস। কাশ্মীর বা মণিপুর বা আসামের স্বাধীনতা আন্দোলনে নানান শক্তির ‘হাত’ থাকতে পারে, কিন্তু মোটাদাগে এগুলো কারো পকেটের আন্দোলন নয়।

কিন্তু দালাইলামা ভারতের পকেটে বসে আন্দোলন চালাচ্ছেন। সম্প্রতি তিনি ওবামার কাছে সাম্রাজ্যের কৃপা প্রার্থনাও করে এসেছেন। ভারতের অরুণাচলের ধর্মশালায় তাঁর আস্তানাটি আর কিছু নয় ‘র’ ও সিআইএ-র আখড়া। অর্থের যোগানও কম নয়। ধর্মশালার বিক্ষোভকে তিব্বতের রাজধানী লাসা’র বিক্ষোভ হিসেবে দেখানোয় সিএনএন-এর জারিজুরিও ফাঁস হয়ে গিয়েছে।

তার মানে এই নয় যে, তিব্বতে চীন বর্বর দখলদারি বজায় রাখেনি। ঠিক ভারত যেমনটা করছে কাশ্মীরে-মণিপুরে। দক্ষিণ এশিয়া উত্তপ্ত ও অস্থির হয়ে উঠছে। বাঙলাদেশেরো এক সীমান্তে চীন-মায়ানমার আর বাকি তিন দিকে ভারতের তুমুল উত্থান ঘটছে। বাংলাদেশ যেন আটকে পড়ছে এ দুটি পর্বতের মাঝখানের চিপা গিরিখাতের মধ্যে।

দুটি চলন্ত জাহাজের মাঝখানে পড়া ডিঙিনৌকার মতো বাংলাদেশ উথাল-পাথাল দুলছে। বিশ্বের পরাশক্তিগুলো দুনিয়াকে নিজেদের মতো সাজাতে গিয়ে যুদ্ধের ঝড় জাগাচ্ছে, অর্থনীতিতে ঘটাচ্ছে ভূমিকম্প। এসবের ঝাপট আর কম্পনে আমরাও কম কাঁপছি না। ভারতীয় দূতাবাসের নির্দেশে নির্যাতিত ও বন্দী হওয়া ছাত্রছাত্রীরা কিংবা মার্কিন-ব্রিটিশ কোম্পানির স্বার্থে নিপীড়িত তেল-গ্যাস রা আন্দোলনের কর্মীরা সেই পরাকম্পনের আঘাত নিজেদের দেহে অনুভব করেছেন। দৃকের ঘটনায় চীনা ড্রাগনের হল্কাও টের পাওয়া গেল।

আর টের পাওয়া গেল যে, দেশ আর দেশ নাই। এইটা এখন প্রদেশ। প্রদেশের মেজাজ থেকে নয়, হবুচন্দ্র কি গবুচন্দ্র পরাশক্তির চাওয়া-পাওয়ার বাইরে এই দেশ, এর মানুষ এবং এর রাজনৈতিক গন্তব্যের নিরিখেই ঘটনার বিচার করা উচিত। যে চিন্তা ও তৎপরতা বাস্তব মানুষের স্বার্থের মধ্যে তার নোঙর পাতে না, তার সঙ্গে মরিয়ার্টি বা পিনাক বা কোনো চীনা অংবংচং-এর খুঁটির জোরে নড়া ছাগমন্ত্রীদের কী তফাত?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।