বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার কারণ ও আমাদের করণীয়:
সব বিভাগের প্রায় সকল শিক্ষার্থীরই তথ্য প্রযুক্তির প্রতি মোহ থাকে। মোবাইল পেলেই নেট ব্যবহার করে, কম্পিউটার পেলেই কেহ গেইম খেলে, কেহ ফেসবুকে ঢুঁ মারে, মেয়েরা আঁকিবুকি করে। ব্যাপারটি আমাদের জন্য আনন্দের। তবে, তথ্য প্রযু্িক্তর এই যুগে প্রায় সকল পর্যায়ে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের প্রধান্য বিস্তার লক্ষ্যনীয়। তাই মানুষের কল্যাণে প্রযুক্তি ব্যবহারের উৎকর্ষতার জন্য বিজ্ঞান বিভাগে আমাদের শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়বে এমনটিই স্বাভাবিক।
কিন্তু বর্তমানে গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ বিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষার্র্থীর সংখ্যা তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। ককসবাজার সদরে এমনও বিদ্যালয় দেখা গেছে যেখানে বিজ্ঞান বিভাগ চালু আছে, বিজ্ঞানের শিক্ষক আছেন কিন্তু বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী নেই একজনও। বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে ব্যাপারটি আমাদের জন্য লজ্জাকর এবং জাতির জন্য হতাশার। এহেন পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য আমরা শিক্ষকরা দায় এড়িয়ে যেতে পারিনা। শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতা জীবনের প্রায় সব দিনই সময় দেয়া শিক্ষক হিসেবে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার পেছনে বেশ কিছু বিষয় আমার নজরে এসেছে।
১। অষ্টম শ্রেণির সাধারণ বিজ্ঞান বিষয়টিতে পদার্থ, রসায়ন, জীব ও ভুগোলের মত বেশ কিছু জটিল বিষয় রয়েছে বলে তা সঠিক পাঠদান কৌশল ব্যবহার করে পড়ানো না হলে শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানের আসল স্বাদ পায়না। ফলে, নবম শ্রেণিতে উঠে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোকে রসকসহীন মনে করার সুযোগ পায়। অপরদিকে, অষ্টম শ্রেণির সাধারণ বিজ্ঞান বিষয়টি যারা ভালভাবে পড়ার সুযোগ পেয়েছে তারা নবম শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিষয়েই পড়াশোনা করে। আমি উপলব্ধি করেছি, যদি প্রধান শিক্ষক সাধারণ বিজ্ঞানের শিক্ষক নিধারণের ক্ষেত্রে একটু সাবধানী হন তাহলে অষ্টম শ্রেণিতেই শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানের প্রতি উৎসাহী হয়ে ওঠবে।
২। নবম শ্রেণিতে ওঠে শিক্ষার্থীরা পদার্থ, রসায়ন ও জীব বিজ্ঞান বিষয়ের জন্য সপ্তাহে ২ দিন করে সময় পায়। বিভিন্ন উৎসব আয়োজন, পাবলিক পরীক্ষা কিংবা শিক্ষক ছুটিতে থাকার কারণে অনেক সময় সেই দিনগুলোতেও শিক্ষার্থীরা স্যারদের সান্নিধ্য পায়না। দেখা গেছে, প্রথম সাময়িক পরীক্ষা শুরুর পূর্ব পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ক্লাস হয় মাত্র ১০/১২ দিন। ফলে, সঠিক সময়ে সিলেবাস শেষ করা হয়না কিংবা সিলেবাস শেষ করতে গিয়ে দ্রুত পড়ানোর করানে আমরা সঠিক নিয়মে সৃজনশীল পদ্ধতির সঠিক প্রয়োগ করতে পারিনা।
তাই, প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় অধিকাংশ শিক্ষার্থী বিজ্ঞানের বিষয়গুলো পাস করতে ব্যর্থ হয় এবং মনে মনে বিতৃষ্ণা অনুভব করে। একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি, বিভাগ নির্বাচন ও ঐচ্ছিক বিষয় নির্বাচনে শিক্ষার্থীরা তাদের উপরের শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পরামর্শ নেয়। বিজ্ঞানের ভীতি কাটিয়ে না ওঠা বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা তখন তাদের ছোট ভাইদের অনেক ক্ষেত্রে বিজ্ঞান না নেওয়ার জন্য পরামর্শ দেয়। আমার মনে হয়েছে প্রধান শিক্ষক বিজ্ঞানের শিক্ষকদের সাথে পরামর্শ করে বৃহস্পতিবারেও যদি নবম শ্রেণির বিজ্ঞানের বিষয়গুলো পড়ানোর ব্যবস্থা করেন কিংবা রুটিন কাস্টমাইজ করে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর জন্য যদি সপ্তাহে অন্তত একটি দিন বাড়িয়ে দেন তাহলে এ বিষয়টি অনেকটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। কারণ সপ্তাহে ২ দিন পড়িয়ে বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলোর উপর টেকসই পাঠদান ও সিলেবাস শেষ করা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনা।
৩। এস.এস.সি পরীক্ষার ব্যবহারিক পরীক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট আমরা অনেক বিজ্ঞানের শিক্ষক আত্ম অহমিকার কারনে ব্যবহারিক পরীক্ষার নম্বর দিতে কার্পন্যতা দেখাই। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের তাদের ভাল ফলাফল অর্জনের ক্ষেত্রে ব্যবহারিক পরীক্ষার নম্বরগুলো বিরাট ভমিকা রাখে অস্বীকার করার জো নেই। আমি মোটেও বলছি না যে যারা ব্যবহারিক পরীক্ষায় সঠিক পারদর্শিতা দেখাতে পারবে না তাদেরকেও পূর্ণ নম্বর দেওয়া হোক। ভাল, কম ভাল সবাইকে পূর্ণ নম্বর দেওয়া হলে শিক্ষার্থীরা ব্যবহারিক পরীক্ষা সঠিক নিয়মে সম্পাদনের মজা পাওয়ার প্রতি উদাসীন হয়ে ওঠবে।
আমি ককসবাজার সরকারী কলেজে পড়া অবস্থায় রসায়ন বিষয়ে ভালভাবে ব্যবহারিক করাতেন শ্রদ্ধেয় আবু সাঈদ স্যার। দেখা যেতো, শহরাঞ্চলের অনেক শিক্ষার্থী ব্যবহারিক কাজে খুব পারদর্শি। আমরা যারা তাদের সাথে পাল্লা দিতে পারিনি তারা স্বভাবতই নিজ স্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষকদের ব্যবহারিক পরীক্ষার বিষয়ে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ তুলি। আমি দেখেছি, অনেক বিদ্যালয়ে শোকেজ ভর্তি ব্যবহারিক পরীক্ষার উপকরণ রয়েছে কিন্তু প্রতি মাসে এমনকি প্রতি সাময়িক পরীক্ষাতেও ব্যবহারিক পরীক্ষার স্বাদ শিক্ষার্থীরা পায়না। আবার এমন বিদ্যালয়ও রয়েছে যেখানে ব্যবহারিক পরীক্ষার উপকরণ অপর্যাপ্ত কিন্তু শিক্ষক-শিক্ষার্থী ব্যবহারিক পরীক্ষা সম্পাদনের জন্য অতি উৎসাহী।
এক সময় এমনও চোখে পড়েছে, ক্লাস রুটিনের মধ্যে বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর ব্যবহারিক অংশটি অন্তর্ভূক্ত নেই অথবা থাকলেও রুটিনানুযায়ী ব্যবহারিক পরীক্ষা সম্পাদন হয়না। আমরা চাই, এক্ষেত্রে ম্যানেজিং কমিটি, প্রধান শিক্ষক ও বিজ্ঞানের শিক্ষক মিলে যথা সময়ে ব্যবহারিক পরীক্ষা সম্পাদনের জন্য ব্যবহারিক অংশটি রুটিনভূক্ত করে তা সঠিক নিয়মে সম্পাদন হচ্ছে কিনা আন্তরিকভাবেই তদারকি করা উচিত। আমরা দেখতে চাই, প্রতি বিদ্যালয়ে ব্যবহারিক পরীক্ষার উপকরণ পর্যান্ত পরিমানে আছে, প্রতি টার্মেই ব্যবহারিক কাজ হয়, সাময়িক পরীক্ষার রুটিনে ব্যবহারিক পরীক্ষা সংযোজিত হয় এবং তদনুযায়ী সব পরীক্ষা শেষে এস.এস.সি’র ব্যবহারিকের মতো হাতে-কলমে ব্যবহারিক অংশ সম্পাদিত হয়।
লেখক ঃ কম্পিউটার শিক্ষক, ঈদগাহ আদর্শ শিক্ষা নিকেতন ও ‘ইত্যাদি’ ব্যক্তিত্ব।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।