যুগোপযোগী ও মানবিক জাতি গঠনের জন্য সুশিক্ষার অবদান সর্বজনবিদিত। মানুষকে সুশিক্ষিত করে আলোকিত সমাজ বিনির্মাণের জন্য তাই পৃথিবীর কল্যাণকামী মানুষগুলোর চেষ্টার কমতি নেই। ভৌগলিক সীমারেখা ও পরিবেশভেদে বিভিন্ন দেশে শিক্ষা বিস্তারের বিভিন্ন পদ্ধতি প্রচলিত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষা গুরুদের সাহচর্যে রেখে সুশিক্ষিত করার প্রাণান্তকর চেষ্টাই আমাদের দেশে শিক্ষা বিস্তারের মূখ্য পদ্ধতি। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাগুরুদের আন্তরিক প্রচেষ্টা, ম্যানেজিং কমিটির নির্মোহ ও নির্লোভ সহযোগিতা, শিক্ষার্থীদের প্রকৃত জ্ঞান পিপাসা সৃষ্টি, অভিভাবকদের তদারকিসহ বেশ কিছু বিষয় সুশিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
শিক্ষার্থীদেরকে একটু বেশিদিন সময় দেওয়া শিক্ষক হিসেবে আমারও এমন কিছু বিষয় দেখা হয়ে গেছে যা আমাদের আন্তরিকতায় শোধরানো গেলে তা আমাদের সুশিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টিতে কাজে লাগবে বলে আমি মনে করি। লেখার ক্ষেত্রে নিজ বিদ্যালয় কিংবা পাশ্ববর্তী বিদ্যালয় সমূহের কোন তথ্য উদাহরণ হিসেবে এসে পড়লে গঠনমূলক সমালোচনা মনে করে শোধরানো গেলে লেখাটি পূর্ণতা পাবে।
ভর্তি প্রক্রিয়াঃ
সরকারী হিসেবে ৭ম থেকে ১০ম শ্রেণিতে বছরের প্রথম দিন আমাদের ক্লাস শুরু হয়। জানুয়ারী মাসের সুবিধাজনক সময়ে আমরা অনেক বিদ্যালয় পি.এস.সি পাস শিশুদের মধ্য থেকে অপেক্ষাকৃত ভাল শিক্ষার্থীদেরকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর জন্য ফরম বিক্রি ও নানা রকম ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ভর্তি প্রক্রিয়ার আয়োজন করি। প্রতিটি বিদ্যালয় যেহেতু ভাল ভাল শিক্ষার্থীদেরই নিতে চায়, সেহেতু পি.এস.সি পরীক্ষায় ভাল ফলাফলকারী শিক্ষার্থীদের ভর্তি করালেই উদ্দেশ্য হাসিল হবার কথা।
কিন্ত অনেক সময় দেখা যায়, প্রথম বিভাগে পাশ করা একজন শিক্ষার্থী অন্য এক তৃতীয় বিভাগ পাওয়া শিক্ষার্থীর চেয়ে বিচক্ষনতা আর সৃজনশীলতায় পিছিয়ে থাকে। তাই মেধাবী অন্বেষণে ভর্তি প্রক্রিয়ার মত বিষয়টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এ ক্ষেত্রে মেধাবী শিক্ষার্থী ভর্তির অভিলাষ পূরনের ক্ষেত্রে পি.এস.সি পরীক্ষার ফলের পাশাপাশি ভর্র্তি পরীক্ষার নম্বর যোগ করে মেধাক্রম নির্ধারণ করাই যৌক্তিতাপূর্ণ। কিন্তু ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পূর্বেই যখন লম্বা ফর্দ্দ দেখা যায় যাদের ভর্তি করাতে হবে তখন ভর্তি প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এর মাধ্যমে ছোটবেলা থেকেই আমরা শিক্ষার্থীদের শিখিয়ে দিলাম, মামা থাকলে, বাবার পরিচিতি থাকলে ভর্তি প্রক্রিয়ায় পাস না করলেও ভর্তি হওয়া যায়।
ফলে, শিশুটি বড় হয়ে ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে তার প্রভাব প্রতিপত্তি খাটিয়ে সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে বাঁধার কারণ হয়ে দাঁড়ালে আমাদের অবাক হওয়ার কিছুই থাকে না। আবার অনেক বিদ্যালয় কেবলমাত্র রোল নং নির্ধারনের জন্যও ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করে থাকে এবং আগ্রহী সব শিক্ষার্থীদেরকে ভর্তির সুযোগ দেয়। বিদ্যালয়ের উন্নয়নে টাকা খরচের চিন্তা কিংবা পার্শ্ববর্তী বিদ্যালয়ে কম শিক্ষার্থী ভর্তি হোক এমন ধৃষ্টতায় জানুয়ারী মাসেই আবার কিছু বিদ্যালয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ভর্তি প্রক্রিয়া চলে, ভর্তি পরীক্ষা হয়। পরীক্ষার খাতায় শুন্য না পাওয়া সকল শিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ দিয়ে আমরা মানবিকতার (?) পরিচয় দিই। কিন্তু ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য সুশিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারলে আমাদের সেই মানবিকতা শুদ্ধতার পরীক্ষায় টিকে না।
বর্তমানে অনেক বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে দুটি শাখা চালুর অনুমোদন থাকলেও অনেক বিদ্যালয়ে তিনটি শাখা চালু আছে। একটি শাখা বেশি হওয়ার কারণে পর্যাপ্ত শ্রেণি কক্ষের স্বল্পতা, শিক্ষকের অপ্রতুলতা সুশিক্ষা বিতরনের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যুক্তরাজ্যের দারহাম রাজ্যের এডুকেশন কনসালটেন্ট মিস্টার কিথ টেইলর যখন আমাদের স্কুলে আসেন তখন তাঁর মুখে আমাদের শিক্ষকবৃন্দ এবং শিক্ষার্থীরা জেনে গেছেন তাদের বিদ্যালয় সমুহের প্রতি ক্লাসে ২০/২৫ জনের বেশি ছাত্র থাকে না। কিন্তু আমাদের দেশে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের কারণে আমাদের সরকার সেই সংখ্যা কে ৬০ জনে উন্নীত করলেও আমাদের অতবেশি সমস্যা হয় না। কিন্তু ৬০ জনের জায়গায় যখন কোন ক্লাসে ১৮০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয় তখন সুশিক্ষা বিতরণের ব্যাপারটি কঠিনতর হয়ে পড়া-ই স্বাভাবিক।
কারণ ১৮০ জনের ক্লাস মেইনটেইন করার কলাকৌশল আমাদের আয়ত্তে থাকলেও তা সুশিক্ষা বিতরনের ক্ষেত্রে টেকসই হয় না। আমাদের বেতন দেয় সরকার। সেই সরকার বলছে, প্রতি ক্লাসে অনধিক ৬০জন শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে। আমাদেরও উচিত ৬০ জন শিক্ষার্থীই ভর্তি করিয়ে তাদের আলোকিত মানুষে পরিনত করার পথ সুগম করা। হ্যাঁ, আমরা জানি প্রতি বৎসর ভাল প্রতিষ্ঠানের আসন সংখ্যার তুলনায় অনেক শিক্ষার্থী পাশ করে।
কিন্তু গ্রামে গঞ্জে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করাতে আমরা অনেক অভিভাবক আগ্রহ দেখাই না। সবাই চাই, ভাল প্রতিষ্ঠানে সন্তানদের ভর্তি করাতে। কিন্তু ভাল প্রতিষ্ঠানগুলোতে আসন সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি শিক্ষার্থী ভর্তির কারণে আমাদের সন্তানেরা যে সঠিক শিক্ষা পাচ্ছে না সে ব্যাপারটি আমরা অনেক অভিভাবকরাই বুঝি না। আমাদের উচিত, সরকার নির্ধারিত নিদ্দিষ্ট সংখ্যক ছাত্র ভর্তি করানো। ফলে, অবহেলিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের পদচারনায় মুখরিত হবে।
আমাদের সন্তানরা মানুষ হবে। ছোট্ট একটি উদাহরণ দিই, আমরা ককসবাজার সরকারী কলেজে পড়ার সময় ঈদগাহ ফরিদ আহমদ কলেজ কিংবা ককবাজার সিটি কলেজে ভর্তি হবার জন্য শিক্ষার্থীদের আগ্রহে ভাটা পড়তো। সবাই মনে করতাম সরকারী কলেজে শিক্ষা ঝরে ঝরে পড়তেছে, গিয়ে একটু কুড়িয়ে নিয়ে আসি। ফলে, ঈদগাহ্ ফরিদ আহমদ কলেজের স্যারদের দেখা যেতো শিক্ষার্থী বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন কৌশল হাতে নিতে, বিভিন্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষার্থীদের ঠিকানা সংগ্রহ করতে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় নামী দামী কলেজগুলোতে নিদ্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি করানোর ফলে একসময় শিক্ষার্থী স্বল্পতায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন শিক্ষার্থীদের পদচারনায় মুখর।
যে সিটি কলেজে আমরা ভর্তি হতে আগ্রহ দেখাতাম না সেখানেও যে সুশিক্ষার পরিবেশ পেয়ে মানবিক বিভাগ থেকে এ+ পায় এ বছর তা আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখলাম। তাছাড়া, আমাদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর আসন সংখ্যার তুলনায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হলে তাদের ভতির জন্য সরকার কিংবা সমাজের বিত্তবান ও শিক্ষানুরাগীরা এগিয়ে এলে নতুন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করাও অসম্ভব নয়। ফলে, বেকারত্ব করবে, শিক্ষার্থীরা সুন্দর পরিবেশ পাবে। অবাক করার মতো বিষয়, বেসরকারী বিদ্যালয় সমূহে অতিরিক্ত শিক্ষার্থী ভর্তি করালেও শিক্ষা প্রশাসনের কোন প্রতিক্রিয়া চোখে পড়ে না। আমি বিশ্বাস করি, শিক্ষা বিতরনের খাস নিয়ত আমাদের হৃদয়ে থাকলে এবং অধিক টাকার লোভ আমরা সংবরণ করতে পারলে আমরাও এক সময় আমাদের সাধ্যের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করবো না, অহেতুক আমাদের সন্তানদের সুশিক্ষা গ্রহণের মৌলিক অধিকারকে জলাঞ্জলি দেব না।
আমাদের ভেতরের ‘আমি’ জেগে ওঠুক, শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। (চলবে)
নূরুল ইসলাম
সহকারী শিক্ষক(কম্পিউটার)
ঈদগাহ আদর্শ শিক্ষা নিকেতন
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।