আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলদেশ কি সমুদ্রসীমা রক্ষা করতে পারবে?

Right is right, even if everyone is against it; and wrong is wrong, even if everyone is for it

বাংলাদেশ পৃথিবীর বৃহত্তম ব দ্বীপ। ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে দক্ষিণ-এশিয়ার একটি গুরুত্বপুর্ণ এলাকা। প্রায় তিন দিক দিয়ে ভারত ও সামান্য কিছু এলাকা মায়ানমার দিয়ে ঘেরা থাকলেও বাকী এক দিক সমুদ্র বেষ্টিত। তাই ছোট্ট এ ভূখন্ডটির সমুদ্রসীমা প্রায় ৭১২কি�মি�। ভূখন্ডটি ছেট্ট হলেও একদিক সমুদ্র বেষ্টিত থাকার কারণে স্থলভূমির সমান প্রায় জলভূমির মালিকানা রয়েছে।

প্রায় তিন দশক ধরে সমুদ্র আইন হলেও বাংলাদেশ তার পার্শ্ববতী দেশ ভারত ও মায়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ মীমাংসা এবং নিজেদের প্রাপ্য গভীর সমুদ্র সীমা নির্দ্ধারন করতে সক্ষম হয়নি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর সমুদ্র সম্পদ এবং জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনা করে অনেক দেশই বিরাট সমুদ্র উপর সার্বভৌমত্ব দাবী করে। ১৯৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ২০০ মাইল সমুদ্র এলাকার উপর দখল প্রতিষ্ঠা করে। এ ধরনের বিরোধ নিস্পত্তি এবং সমুদ্র এলাকায় সকলের চলাচল ও মাছ ধরার অধিকার নিশ্চিত করতে ১৯৫৮সালে জাতিসংঘ �প্রথম ইউনাইটেড ন্যাশনস কনভেনশন অন দি ল অব দি সি� সংক্ষেপে আনক্লস-১ এর কনফারেন্স আহ্বান করে। এর মধ্যে হাই সিজ, কন্টিনেন্টাল সেলফ, টেরিটোরিয়াল সি এবং সামুদ্রিক ফিশিংয়ের উপর চারটি কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়।

যা জাতিসংঘের সদস্য দেশসমূহ অনুমোদন করে। ১৯৬৬ সাল নাগাদ চারটি কনভেনশন আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনে পরিণত হয়। ১৯৬৬ সালে আনক্লস-২ এর কনভেনশন কোন সিদ্ধান্ত গ্রহন ছাড়াই সমাপ্ত হয়। ফলে ১৯৬৭ সাল নাগাদ ২৫টি দেশ ৩ মাইল, ৬৬ টি দেশ ১২ মাইল এবং ৮ টি ২০০ মাইল টেরিটোরিয়াল সি দাবী করে । এই পরিপেক্ষিতে ১৯৭০ সালে জাতিসংঘ আনক্লস-৩ অনুমোদন করে।

১৯৭৩সালে ঐক্যমতের ভিত্তিতে সমুদ্রে বিভিন্ন মেরীটাইম সৃষ্টির বিষয়ে সদস্য রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে আলোনা শুরু করে। দীর্ঘ ৯ বছর পর আনক্লস-৩, ১৯৮২ জাতিসংঘের অনুমোদন লাভ করে। একই বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সহ ১১৯ টি দেশ ঐ সনদে স্বাক্ষর করে। পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালের ১৬ই নভেম্বর এই সনদটি আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয়। সমুদ্র সীমানা নিয়ে আন্তর্জাতিক আইনে আভ্যন্তরীন বা ইন্টারনাল ওয়াটার, টেরিটোরিয়াল সি, কন্টিগিওয়াস জোন, এক্লোসিভ ইকোনমিক জোন কন্টিনেন্টাল সেলফ এবং হাই সিজ নামে ৬ টি মেরিটাইম জোন সৃষ্টি করা হয়েছে।

এই জোনগুলোর পরিসর নির্দ্ধারনের জন্য মেরিটাইম বেইজ লাইন অঙ্কনের প্রস্তাব অনুমোদন কর হয়। মেরিটাইম বেইজ জোনগুলির সীমানা এই বেজ লাইন থেকে নির্দ্ধারিত হবে। টেরিটোরিয়াল সি ১২ মাইলের উপর উপকূলীয় রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ সার্বভৌমত্ব থাকবে। কন্টিগিওয়াস জোন ২৪ মাইল হবে যার মধ্যে স্মাগলিং, ড্রাগ, অস্ত্র-সস্ত্র ও বৈধ অভিভাসন ইত্যাদি উপকূলীয় রাষ্ট্র তদারক করবে। এক্লোসিভ ইকোনমিক জোন ২০০ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত হবে।

এই ২০০ মাইলের ভিতর সকল খনিজ পদার্থের উপর উপকূলীয় রাষ্ট্রের অধিকার থাকবে। এর পর ৩৫০ মাইল হবে উপকূলীয় রাষ্ট্রের কন্টিনেন্টাল সেলফ এরপর হবে আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীম যেখানে সকলের চলার স্বাধীনতা থাকবে। পাশাপাশি এই আইনে বিরোধ মীমাংসার জন্য আলোচনা এবং অনেক ট্রাইবুনাল সৃষ্টি করা হয়। ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমানা আইন নিয়ে আলোচনা শূরু হওয়ার পরপর ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ টেরিটোরিয়াল ওয়াটার্স এবং মেরিটাইম জোনস এ্যক্ট নামে একটি আইন পার্লামেন্টে পাশ হয়। এই আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ৬০ ফুট গভীর উপর বেইজ লাইন নির্দ্ধারন করে।

ঐ বেইজ লাইন থেকে ১২ মাইল টেরিটোরিয়াল ওয়াটার্স , ৬ মাইল কন্টিগিওয়াস জোন, ২০০ মাইল ইকনমিক জোন, এবং কন্টিনেন্টাল সেলফ দাবী করে। ঐ সময়ে কিসের ভিত্তিতে বেইজ লাইন তৈরী করা হয়েছিল তা এখনও জানা যায়নি। এ নিয়ে পার্শ্ববর্তী কোন দেশের সাথেও আলোচনা করা হয়নি। বাংলাদেশ কর্তৃক নির্দ্ধারিত বেইজ লাইন ভূ-ভাাগের কোন অংশ স্পর্শ না করায় তা আন্তর্জাতিক আইন সম্মত হয়নি বলে ভারত প্রতিবাদ করে। ভারত আরও অভিযোগ করে যে, বাংলাদেশের সৃষ্ট বেইজ লাইন ভারতের সীমানার ২১ মাইল অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে।

একই সাথে তারা বাংলাদেশের বেইজ লাইনের অভ্যন্তরে সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য যে ৬ টি বিদেশী কোম্পানীকে কাজ দিয়েছিল সে ব্যাপারেও চরম আপত্তি তোলে। এ ব্যাপারে তাদের সাথে আলোচনা করে কোন সমাধান তখন করা হয়নি। ১৯৭৩ সাল হতে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনের খসড়া তৈরীর প্রতিটি অধিবেশনে যোগদান করেও নিজেদের প্রতিবেশীদের সাথে সমস্যা সংক্রান্ত কোন বিষয় আইনে অন্তর্ভূক্ত করাতে পারেনি। দীর্ঘ ৮ বছরেও নিজেদের বেইজ লাইন গ্রহন করাতে পারেনি। ১৯৮২ সালে সমুদ্র আইন পাশ হওয়ার পর বাংলাদেশ জাতিসংঘকে চিঠি দিয়ে জানায় যে, আমাদের বেইজ লাইন ঠিক আছে।

বাংলাদেশের এ চিঠি প্রেরণের পর পর ভারত ও মায়ানমার এর প্রতিবাদ করে। যদিও বেইজ লাইন সমুদ্র সীমা নির্দ্ধারনের মূল লাইন তথাপি বিগত ৩৫ বছরেও বাংলাদেশ সরকার এটা নির্দ্ধারনের জন্য প্রতিবেশীদের সাথে আলোচনার কোন উদ্যোগ নেয়নি। ২০০১ সালে প্রায় ১৯ বছর পর আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন রেফিটাই করা হয়। নিয়ম অনুযায়ী আন্তর্জাতিক আইন রেফিটাই করার পর প্রত্যেক দেশ তাদের জাতীয় আইন সংশোধন করবে। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারেও কোন উদ্যোগ নেয়নি।

এমনকি দেশীয় আইনে ৬ মাইল কন্টিগিওয়াস জোনের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক আইনের ২৪ মাইল এলাকার বিষয়টি পর্যন্ত সংশোধন করা হয়নি। এছাড়া ২০১১ সালের মধ্যে ৩৫০ মাইল কন্টিনেন্টাল সেলফ যথাযথ সার্ভের মাধ্যমে নির্দ্ধারন করে দাবী করতে না পারলে বাংালাদেশের প্রায় ২ লক্ষ বর্গমাইল সমুদ্র্র এলাকা আন্তর্জাতিক সমুদ্র এলাকার মধ্যে গণ্য হয়ে যাবে। ১৯৭০ সালে প্রথমবারের মত ভারত বাংলাদেশের দক্ষিণে তালপট্টি দ্বীপের মালিকানা দাবী করে। প্রথমে ভারতের ভূ-ভাগের সাথে সংযুক্ত এবং পরে সীমান্তবর্তী নদী মূল স্রোত দ্বীপের পূর্বদিকে পূর্বদিকে প্রবাহিত বলে সার্বভৌমত্ব দাবী করে । কিন্তু তালপট্টি দ্বীপের পূর্বদিকে হাড়িয়াভাঙ্গা ও রায়মন্ডল নদীর মিলিত স্রোত প্রবাহিত হওয়ার ফলে পানির গভীরতা বেশী হওয়ায় এবং দ্বীপের পশ্চিমে হাড়িয়াভাঙ্গার স্রোত বিদ্যমান থাকার কারণে ভারতের দাবী গ্রহনযোগ্য হয়নি।

এদিকে ভারত বাংলাদেশ উভয়েই তালপট্টিকে দ্বীপ হিসাবে দাবি করলেও আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা অনুযায়ী এটি একটি ভাটার দ্বীপ এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এর মালিকানা বাংলাদেশের। এই দ্বীপের মালিকানা ভারতের হাতে চলে গেলে বাংলাদেশ বিরাট সমুদ্র এলাক ও বিশাল মৎস্য সম্পদ হারাবে। এছাড়াও তালপট্টি দ্বীপের পশ্চিমে পূর্বাশা নামে একটি ভাটার দ্বীপ আছে। এ দ্বীপটি নিয়ে ভারতের সাথে আলোচনা হতে পারে সমুদ্র সীমানা বিষেষজ্ঞরা মনে করেন । ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ মায়ানমারের মধ্যবর্তী নাফ নদীর মধ্যভাগ অর্থাৎ সেন্টমার্টিন ও ওয়েস্টার দ্বীপের মধ্যভাগে দুই দেশের আন্তর্জাতিক সীমানা নির্দ্ধারণ করা হয়।

সেন্টমার্টিন দ্বীপটি জনবহুল ও ওয়েস্টার দ্বীপটি একেবারে জনমানবশুন্য বলে এ সীমা গ্রহণযোগ্য নয়। মায়ানমার এ সীমা নির্দ্ধারণে ইকুইডিসটেন্স লাইন অনুসরণের প্রস্তাব দেয় এবং এ নিয়ে অনেক আলোচনা করেও কোন ফল হয়নি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এ নীতির পরিবর্তে ইকুইটেবল নীতি অনুসরণ করা না হলে বাংলাদেশ বিশাল সমুদ্র সীমা হারাবে। ১৯৭৪ সালে ৬ টি বিদেশী আন্তর্জাতিক কোম্পানীর সাথে সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের চুক্তি হয়। কোম্পানীগুলো হলো আটলান্টিক রিচফিল্ড, ইউনিয়ন অয়েল, এ্যসল্যান্ড, কানাডিয়ান সুপিরিয়র অয়েল, বিওডিসি, ইনা নাফতালিন।

পরে ভারতের বাধার কারণে কোম্পানীগুলোর কাজ বেশী দূর আগায়নি। ২০০১ সালে হাইকোর্টের এক নিষেধাজ্ঞায় অনুসন্ধানের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এ নিষধাজ্ঞার বিরুদ্ধে কেবল পেট্রোবাংলা হাইকোর্টে আবেদন করে এবং অনুসন্ধানের কাজ শুরুর অনুমতি পায়। ২০০৬ সালের ১৬ ই জুলাই পেট্রো বাংলা গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের অনুমতি পায়। অনুমতি পাওয়ার আগেই ২০০৫ সালে পেট্রোবাংলা অনুসন্ধানের কাজ শুরু করে।

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, ২০০৭ সালের এপ্রিলে বঙ্গোপসাগরের গভীর সমুদ্রে তৃতীয়বারের মত তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। একই সাথে চুড়ান্ত করা হয় উৎপাদন বন্টন চুক্তির (পি�এস�সি)মডেল। এ মডেল তৈরীতে সহায়তা করেন ড� কামাল হোসেন। এ চুক্তির ব্যাপারে বিতর্ক থাকলেও সংসদে আলোচনা ছাড়াই এ চুক্তির অধীনেই চলতি বছরের ১৫ ই ফেব্রুয়ারী সরকার এ চুক্তির মাধ্যমেই গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে। সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ড�ইয়াজউদ্দিন আহমেদ সমুদ্র সীমা নিদ্ধারণের ব্যবস্থা গ্রহনের নির্দেশ দেন।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় হতে রাষ্ট্রপতিকে জানানো হয় যে, বাংলাদেশের ৩৫০ নটিক্যাল মাইল সমুদ্র সীমা নির্দ্ধারণে আগামী অক্টোবর মাসের মধ্যে সব উপাত্ত জমা দেওয়া হবে। রাষ্ট্রপতি পার্শ্ববর্তী দেশের সাথে সমুদ্র সীমা নিয়ে অমীমাংসিত বিষয়টি দ্রুত নিস্পত্তির নির্দেশ দেন। স্বাধীনতার পরে সমুদ্রসীমা নির্দ্ধারণ করতে প্রথমে আমেরিকার একটি বিশেষজ্ঞ দল বাংলাদেশে আসে ১৯৭২ সালে। এর কয়েক বছর পর জার্মনীর একটি বিশেষজ্ঞ দল বাংলাদেশে আসে। কিন্তু দুটি দেশের কারও কাছ থেকে জরিপের কোন ফলাফল পাওয়া যায়নি।

সম্প্রতি ফ্রান্সের একটি বিশেষজ্ঞ দল গত বছরের শেষর দিকে বাংলাদেশে আসে। তারা চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত গভীর সমুদ্রে সীমানা নির্ণয়ে কাজ চালায়। চলতি বছরের শেষে ফান্সের জরিপের ফলাফল পাওয়া যাবে বলে জানা যায়। এ ছাড়াও কয়েকটি সরকারী প্রতিষ্ঠান ও নানা রকম জরিপ করছে। ২০১১ সালে জাতিসংঘের অধিবেশনে নিজেদের ৩৫০ নটিক্যাল মাইল কন্টিনেন্টাল সেলফ দাবী করতে হবে।

অন্যথায় ১৫০ নটিক্যাল মাইল আন্তর্জাতিক সমুদ্র সীমা হিসাবে গণ্য হয়ে যাবে। এ সকল বিষয় বিবেচনা করে বাংলাদেশ জাতিসংঘে নিজেদের দাবী উপস্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এজন্য পার্শ্ববর্তী দেশের সাথে আলোচনা করে বিরোধ মীমাংশা করা হবে, তা না হলে বাংলাদেশ নিজেদের দাবীই জাতিসংঘে উপস্থাপন করবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।