মিলে মিশে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ!
কাজের ফাঁকে ফাঁকে হঠাৎ হঠাৎ এমন কথা মনে পড়ে, নিজেই অবাক হয়ে যাই মাঝে মাঝে। মস্তিষ্কের কোন গহব্বরে কথাগুলো জমে থাকে? চকিতে মনকে নাড়া দিয়ে যায়।
১
বাচ্চাদের যখন মোটামুটি সাড়ে তিন বছর তখন বাসায় বাঁধা কাজের লোক রাখা ছেড়ে দিয়েছি, নিরাপত্তা সংক্রান্ত জটিলতায়। বাচ্চারা থাকতো ডে-কেয়ারে, সকালে অফিসে যাবার সময় দিয়ে যেতাম, আসার সময় নিয়ে আসতাম। আর সন্ধ্যায় ছুটা বুয়া এসে কাজ করে দিয়ে যেতেন।
একবার এক বুয়া ছিল, কাজ বেশ পরিষ্কার আর আন্তরিকতার সাথেই করতো। তার এক মেয়ে, এক ছেলে। মেয়েটি গার্মেন্টেসে কাজ করে, আর ভাইটি ছোট। আমার বাচ্চাদের বয়সী। আমার বাসায় আসার সময় বাচ্চাকে বোনের কাছে রেখে আসতো।
কয়েকদিন পর দেখি ছেলেটাকে নিয়ে আসা শুরু করেছে, আমি কিছু বলিনি, কিন্তু স্বাভাবিক একটা চিন্তা থাকে বাচ্চাদের দুষ্টুমী নিয়ে, নিজের দুইজন আছে, সঙ্গী বাড়লো আরো একজন। তিনজনে মিলে বা একা একা কখন যে কি করে, কি ভাঙ্গে, কোন দুর্ঘটনা ঘটায়.........এসব আর কি। সন্ধ্যায় আমরা যখন নাস্তা খেতাম, বুয়া আর ছেলেটাকেও খাবার দিতাম প্রতিদিন, এটা কতটা চ্যারিটি, আর কতটা স্বার্থ মাঝে মাঝে ভাবতাম, যদিও শেষ সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম না। কয়েকদিন পর লক্ষ্য করি ছেলেটি আমার বাসায় আসার পরেই কান্নাকাটি, চিৎকার শুরু করতো মা ক্ষিদা লাগছে, ভাত খামু.........। আমি ভাবতাম ছোটমানুষ, হয়তো বিকেলে বেশী দৌড়াদৌড়ি করেছে, তাই যা নাস্তা দেই তাতে কুলাচ্ছে না।
মাঝে মাঝে যদি ফ্রিজে ভাত থাকতো বুয়াকে তরকারীসহ দিতাম গরম করে ছেলেকে দিতে, অথবা নাস্তা আরেকটু বাড়িয়ে দিতাম। একটা সময় লক্ষ্য করলাম তার কান্নাটা যেন ঠিক আসল না, অভিনয়। একদিন ডেকে জিজ্ঞ্যেস করলাম, কিরে তোর দেখি এখানে আসার পরই ক্ষিদে পায়? বাসায় ভাত খাসনি?
- খাইছি।
>কখন?
- দুপুরে।
>আজকে মা কি রান্না করছে?
-শাকভাজি, ডাল।
>আচ্ছা।
মাঝখানে মা বলে উঠলো কিছুটা লজ্জিতভাবে, দেখেন তো আফা, একটু আগেই তারে খাওয়াইয়া আনছি, এখন বলে আবার ক্ষিদা লাগছে।
- আচ্ছা, আপনি যে সারাদিন আরো কয়েক বাসায় কাজ করেন তখন হৃদয়কে (ছেলের নাম) কি করেন?
- আমার সাথে নিয়ে যাই, অমুক বাসার খালাম্মা, তার ছেলেমেয়েরা অনেক বড় বড়, চাকরী করে, ওরে একটা রুটি খাইতে দেয় সকালে। দুপুরে বাসায় আইসা আমি যখন যা পারি রান্না-বান্না করি, ছেলেরে নিয়া খাই। মেয়েতো সকালে যায়, রাতে আসে, রাতের বাসি ভাত সকালে গরম করে ওরে দিয়া দিই।
সেটাই খায়। আপনের বাসায় আসার আগে মা-ছেলে মিইল্ল্যা কিছু মুড়ি খাইয়া আসি।
> হুমম। কালকে থেকে দুপুরে একটু বেশী ভাত রান্না করে হৃদয়কে বিকেলেও একবার ভাত খেতে দিবেন, দৌড়াদৌড়ি করে তো, তাই বেশী ক্ষিদা লাগে।
এবার নিশ্চয়ই পাঠকরা বলবেন, আপনি তো কিপটা আছেন।
বুয়াকে দিয়ে আপনার বাসায়ও তো ভাত রান্না করে ছেলেটাকে খেতে দিতে পারেন। ওরা তো গরীবই।
এখানে আমার কিছু ভিন্নমত আছে। আমি হয়তো পারতাম মা-ছেলের একটা পরিবারকে মাসের ত্রিশদিনই নাস্তা না খাইয়ে পেট পুরে ভাত খাওয়াতে। সেটুকু সামর্থ্য আমার ছিল।
কিন্তু কেন তা করিনি? কারণ, ঐ কান্নার মধ্যে আমি কিছুটা শঠতা দেখেছি। কিছুদিন পর্যবেক্ষণেই আমি দেখেছি মা ছেলেটিকে ইশারা দিলে ছেলেটি কান্না শুরু করতো। আসলে প্রকৃত ক্ষিদে লাগেনি। আমার কাছে মনে হয়েছে এই ছোট বাচ্চাটিকে এখন থেকেই মিথ্যা শেখানো হচ্ছে, এটা কম শিক্ষিতদের বেলায় হতেই পারে, কিন্তু আমি জেনেশুনে ঐ মিথ্যাকে প্রশ্রয় দিতে পারি না।
বলবেন তো আপনার কোন কাজ আটকে গেলে ঘুষ দেননি কখনো? আমি বলবো বাধ্য হয়ে দিতে তো হয়েছে, ইনকাম ট্যাক্সের লোককে না দিলেও পাসপোর্টের পুলিশ ভেরিফিকেশনের সময় তো চেয়েই বসেছে, না দেই কেমন করে? তাহলে তো পাসপোর্ট যে সময়মতো পাওয়া যাবে না, বরং আরো কি ভোগান্তি পোহাতে হয় কে জানে? তাহলে, এ ছেলের মিথ্যা অভিনয়টা আপনার কাছে বড় কেন? গরীব বলেই কি?
হয়তো দুর্বলের কোন পাত্তা নেই আমাদের কাছে, ক্ষমতাশীলদের কাছেই আমাদের যত হাত বাঁধা।
কিন্তু আমার কাছে যেটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে সেটা হলো বড়দের দুর্নীতির চেয়ে ছোটর দুর্নীতি। একটা ছোটছেলে এ বয়সেই মিথ্যা বলা শিখে যাবে বা হয়তো শিখে গেছে, তাহলে বড় হবার পর কি হবে? কেমন মানুষ হবে সে? যে মা সন্তানদের ভাল শিক্ষা দেবার কথা, সে মাই মিথ্যা বলা শেখাচ্ছে? তাইতো সরাসরি না বললেও আমি বুঝিয়ে দিয়েছি তোমাদের মিথ্যা আমি বুঝেছি, আর অমন করো না। আর গরীব হলেই আত্মমর্যাদাহীন হতে হবে এমন তো নয়। মা-মেয়ে মিলে যা রোজগার করতো তাতে তিনজনের ভালই চলে যেত, হয়তো প্রাচুর্য ছিল না, মাছ-মাংস হয়তো প্রতিবেলায় পাতে জুটতো না, কিন্তু না খেয়ে থাকতে হতো না, বা মাসে কয়েকবেলা আমিষ জুটতো বই কি। আমি কাজের বুয়াদের আবদার রক্ষা করতে পারি সামর্থ্য অনুযায়ী, কিন্তু মিথ্যা বলা সহ্য করতে পারি না।
জানি না চ্যারিটির চেয়ে কাজটা কম মহৎ কিনা, খারাপ কিনা কিন্তু আমার যেভাবে ভাল মনে হয়েছে, করেছি।
২
আরেকদিন রান্নাঘর থেকে রুমে এসে দেখি আমার দুইজনসহ হৃদয় বিছানার উপরে ইচ্ছামত লাফালাফি আর হৈ চৈ করছে, ঐ বিছানায় রাতে ঘুমাই বাচ্চাসহ, মাঝে মাঝে সন্ধ্যায় শুয়েও বিশ্রাম নেই। আমার তো চোখ ছানাবড়া , তাড়াতাড়ি ধমকে তিনজনকে নামালাম বিছানা থেকে। সবার পা চেক করে দেখি আমার বাচ্চাদের পা পরিষ্কার হলেও হৃদয়ের পা মারাত্মক ময়লা, সারাদিন কোথায় কোথায় ঘুরেছে কে জানে! নাকে সর্দির পানি পড়ছে, প্যান্টের পিছনে অনেক ময়লা, মাটিতে গড়াগড়ি করে খেলেছে হয়তো।
এ অবস্থায় আপনারা কি করতেন? নিশ্চয়ই অনেক উদার আপনারা।
আমিও খুব সহজে বাচ্চাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে পারি, পরিষ্কার না হলে কাপড় দিয়ে মোটামুটি পরিষ্কার করিয়ে কোলে নিতে পারি। কিন্তু অপরিচ্ছন্নতা তেমন পছন্দ করি না, নিজের বাচ্চাদের বেলায়ও না, তাইতো তিনজনকেই খাট থেকে নামালাম। এরপর বুয়াকে ডেকে বললাম ওকে পা ধুইয়ে দিতে, নাক-মুখ পরিষ্কার করাতে, এরপর এখানে আসার আগে যেন একটু পরিষ্কার প্যান্ট পরিয়ে আনে। এরপর থেকে আমার বাচ্চারা খাটে বসার অনুমতি পেলেও ঐ বাচ্চাটিকে অনুমতি দিলাম না। বলতে পারেন ঘৃণা হচ্ছে? না, ঠিক ঘৃণা না, মায়ের স্বভাবসুলভ যে বৈশিষ্ট্য সেটা, আমার বাচ্চাদের পরিষ্কার বিছানায় বসা, অপরিচ্ছন্নতা থেকে দূরে রাখা।
সাবধান করে দেয়া, ও নোংরা হলে ওর সাথে খেলো না, পরিষ্কার থাকলেই খেলবে। এ বিছানা ঘুমানোর জন্য, খেলার জন্য নয়।
তবুও হয়তো কেউ কেউ বলবেন, না ওটা আপনার ঘৃণা, গরীবের প্রতি সামর্থ্যবানদের নাক সিটকানো। বাইরে আমরা কত বড় বড় বুলি ঝাড়ি, আসলে ভিতরে সবাই ঐ স্বার্থপর, নিজেরটাই বুঝি। হয়তো সেটাই সত্যি, আবার হয়তো আমার ধারণাটাও কিছুটা সত্যি, বড়ই কনফিউশন!!
৩
আরেকদিন শুনি বাচ্চাটা মাকে কিসব বাজে গালি দিচ্ছে।
>কি ব্যাপার, কি হলো?
-খালি জ্বালায়, এতো দুষ্টামি করে সারাদিন, হাড়টা জ্বালায় খায় আমার, মাঝে মাঝে সহ্য করতে পারি না, তাই একটা থাপ্পড় দিছিলাম। দেখলেন কি বেয়াদ্দপ!! একটুও ডরায় না, আবার আমারে গালি দেয়!
এভাবে কয়েকদিন।
বুঝলাম বস্তিতে থেকে এর চেয়ে ভাল কিছু আর কি শিখবে এ বাচ্চাগুলো। যেখানে শিক্ষার আলো খুব কম, সচেতনতা অনেক কম, দুবেলা খাবার জোটাতে সারাদিন হাড়খাটুনি বাবা-মাদের, বাচ্চাদের আদব-কায়দা শেখানোর সময় কই? আর যেখানে বড়রাই ঝগড়া লেগে গেলে হাজারটা গালি ছুড়ে দেয়, সেখানে ছোটরা শিখবে না কেন?
কিন্তু তাই বলে তো নিজের বাসায় এ চর্চা চলতে দেয়া যায় না। আমার বাচ্চারাও তো এগুলো শিখে ফেলবে! একবার শিখে গেলে কখন কার সামনে বলে বসে, সহজে কি আর বদভ্যাস দূর হয়? তাই তো একদিন মাকে বললাম, আপনি একটু কষ্ট করে তাকে তার খালার কাছেই রেখে আসেন, দুই ঘন্টার ব্যাপার তো।
আমার বাচ্চারা গালি শিখুক, এটা চাই না।
বুয়া বললেন, আচ্ছা।
জানি বুয়ার হয়তো মন খারাপ হয়েছে, হয়তো ছেলের জন্য কিছুটা বিব্রত হয়েছে, কিন্তু আমি মা আর কি করতে পারতাম? আমাকে কি আপনারা রক্ষণশীল বলবেন, বেশী সাবধানী মা বলবেন, বাড়াবাড়ি হয়েছে বলবেন? যা বলার বলুন, আমি মা হয়তো একটু স্বার্থপরই। কিন্তু আমার বাচ্চা যখন গালি শিখতো, স্বভাবদোষে নোংরা হয়ে চলতো, এই আপনারাই কি বলতেন না, মা টাই বা কেমন, ছেলেমেয়ের যত্ন নেয় না, কি শিখছে না শিখছে কিচ্ছু খেয়াল করে না, যাকে তাকে গালি দেয়.........। কি বলতেন না?
৪
লেখাটা শুরু করেছি কি বলতে, আর কি গল্প জুড়ে দিলাম! আজ থেকে সাত বছর আগে এইদিনে একজন নারী দুইজন ফুটফুটে বাচ্চার মা হয়েছিল।
এর আগে প্রথম প্রথম যখন পেটে দুটো হার্টবিট টের পেত, সে নারীটি বুঝতে পারতো না কেন এমন হচ্ছে? আগে তো কোন অভিজ্ঞতা ছিল না!! সাত মাসের সময় যখন আল্ট্রাসনোগ্রাম করা হলো তখনই ব্যাপারটা বোঝা গেল। ব্যাপারটা যতটা আনন্দের ছিল, তার চেয়ে বেশী ছিল ভয়ের, আশংকার। কি করে দুজনকে সামলাবে, এ-তো সোজা ব্যাপার নয়। লেবার রুম থেকে বের করার পর মায়ের অবস্থা একেবারেই কাহিল, ঠিক অজ্ঞান নয়, সবই শুনতে পাচ্ছে, কিন্তু রেসপন্স করতে পারছে না, ডাক্তার তাড়াতাড়ি স্যালাইন দিলেন, এর মধ্যে মিল্কভিটা খাওয়ানো হয়েছে একবার। বাচ্চাদের বাবা আল্লাহ্র অসীম রহমতে সুস্থ বাচ্চাদের বাবা হয়ে খুশী হলেও ঠিক যেন আনন্দটা উপভোগ করতে পারছে না।
বাচ্চার মায়ের পাশে এসে বসে আছে উৎকন্ঠায়, মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে বারবার। মা হেসে বলতে চাচ্ছে, আরে আমার কিছু হয়নি, আমি ঠিক আছি, সব কথাই তো শুনতে পাচ্ছি। তুমি বরং বাচ্চাদের দেখো, ওদের মনে হয় ক্ষুধা পেয়েছে। ওদিকে বাচ্চারা তাদের নানী, বড়মার কোলে। দেখতে দেখতে সাতটি বছর কেটে গেল।
বাচ্চারা তোমরা ভাল থাকো, সুস্থ থাকো, মানুষের মতো মানুষ হও, সুশিক্ষায় শিক্ষিত হও, বাবা-মাকে ভুলে যেও না কখনো। মা তোমাদের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে, ওরা অপেক্ষায় আছে মায়ের হাতে লেখা চিঠির।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।