আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কুসংস্কারঃ মানব সৃষ্ট সমস্যা ও প্রগতির চরম অন্তরায়!!! শেষ পর্ব



প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কুসংস্কার, ক্ষতিকর ও মিথ্যে ধারনা গুলিকে সমগ্র সমাজের বিশেষতঃ নিপীড়িত জনগনের সর্বনাশ করলেও এসবের উপর এই দরিদ্র নিপীড়িত মানুষই বেশী নির্ভর করে, কারন সামাজিক ও প্রাকৃতিক প্রতিকূল শক্তির কাছে এরাই বেশি অসহায়। তাই সর্বশক্তিমান অলৌকিক শক্তির কাছে নালিশ জানায়,সমাজে অত্যাচারী কেউ যখন অন্যায়ভাবে প্রতারিত করে, তখন নিজেরা তাকে শাস্তি দিতে না পেরে, তাকে সৃষ্টিকর্তা শাস্তি দেবেন__ এই মিথ্যা স্তোক বাক্যে শান্তনা লাভের চেষ্টা করে। দারিদ্র, অপুষ্টি, সামাজিক বৈষম্য, ইত্যাদির ফলে অকাল মৃত্যু বা পারিবারিক দুর্দশাকে 'পূর্ব-জন্মের কর্মফল বা সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা'- এই ধরনের ধারণা করে সান্তনা পাওয়ার চেষ্টা করে চলে। তাই অসম্পূর্ন জ্ঞান, অশিক্ষা, দারিদ্র ও দুর্দশার সঙ্গে কুসংস্কার হাতে হাত মিলিয়ে টিকে থাকে। সমস্যাবলীর স্বরুপ জানা ও তাকে দুর করার উপায় খোঁজা থেকে, এইসব ভ্রান্তবিশ্বাস দুরে রাখাই ঠিকই__ কিন্তু অসহায় সান্তনা দেয় বলেই কুসংস্কার টিকে থাকে।

অন্যদিকে বিত্তশালীদের মধ্যেও কুসংস্কারের প্রভাব কম নয়। তারও কারণ প্রাকৃতিক ও সামাজিক প্রতিকূল শক্তির প্রভাব। অর্জিত সম্পদ ও স্বাচ্ছন্দ্যের স্হায়িত্ব নেই এই সমাজ ব্যবস্হায়, সবসময় একটি অনিশ্চয়তা ও দোদুল্যমানতা কাজ করে। ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্হা পুঁজিপতিদের পুঁজির স্হায়িত্ব ও ক্রমবর্ধমান অগ্রগতিকে সুনিশ্চিত করে না, তাই একই ভাবে এদের মধ্যেও একট অতিপ্রাকৃতিক অলৌকিক শক্তির উপর নির্ভর বজায় থাকে। আধুনিক চিকিৎসা সুবিধাবন্চিত মানুষ অসুস্হ হলে ঝাঁড়-ফুক, পানিপড়া বা শীতলা মায়ের থানে ঢেলা বাঁধে, সেই একই মানুষিকতায় সর্বাধুনিক চিকিৎসা সুযোগ পাওয়া ধনী মানুষেরা দান, সদগা, মিলাদ, গুরু না দেবতার কাছে বহু অর্থ ব্যয়ে প্রণামী বা পূজা দিয়ে থাকে।

ব্যাপারটি এমনই সর্বব্যাপী এবং অর্থনীতি, সমাজনীতি ও জাতীয় সংস্কৃতি ইত্যাদি সব কিছচুর সাথে এমন জটিল ও সংপৃক্তভাবে যুক্ত যে, দীর্ঘস্হায়ী ও সুদীর্ঘ আলোচনা করা সম্ভব নয়। তাই যান্ত্রিকভাবে কুসংস্কারের শুধু বৈজ্ঞানিক ব্যাক্ষা দেওয়া নেহাতই প্রাথমিক কাজ____ তাকে সমাজ অর্থনীতি ও রাজনীতির বিচারে করা উচিৎ, একটির গুনগত আমুল পরিবর্তন অন্যটির পরিবর্তন ছাড়আ সম্ভব নয়। দারিদ্রের জন্য প্রাচ্যের অনুন্নত দেশগুলির কুসংস্কারের জন্য মানুষই দায়ী। আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার মত পাশ্চাত্যের দরিদ্র দেশগুলির নিপীড়িত জনসাধারনের মধ্যে বহু কুসংস্কার রয়েছে, অনেক শিক্ষিত ও ধনী মানুষেরাও এর শিকার। ভারতবর্ষ সহ প্রাচ্যের প্রাচীন সভ্যতা অতীতে যে ঐতিহ্যময় দর্শনের জন্ম দিয়েছে, সেই যুগের সীমাবদ্ধ জ্ঞান, ঐতিহাসিক পরিস্হিতি ও প্রভাবে সেই দর্শন একটি কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিল।

অনেক ক্ষেত্রে প্রাচীন চিন্তাগুলি ভ্রান্ত হলেও বহু ক্ষেত্রেই যুক্তি ও বিজ্ঞানের স্হানও ছিল। আমাদের উচিত, প্রাচীন ঐতিহ্য ও জ্ঞানকে কর্ষিত করে____বর্তমান জ্ঞানের আলোয় সেগুলির উৎকর্ষ সাধন করা এবং সেগুলির সম্পুর্ন ভ্রান্ত ও অবৈজ্ঞানিক দিকগুলিকে দ্বিধাহীন ভাবে বিসর্জন দেওয়া। মানুষের সমাজ ও সভ্যতা তথা পৃথিবী ও বিশ্বব্রম্হ্মান্ডের প্রতিটি বস্তুই পরিবর্তনশীল। একইভাবে এসবের প্রতিফলনকারী দার্শনিক চিন্তাগুলিও পরিবর্তনশীল,। এই পরিবর্তন মানব সভ্যতার প্রয়োজনেই।

পুর্বপুরুষদের প্রতি অন্ধশ্রদ্ধায় তাদের মত গুহায় থাকা, অর্ধসিদ্ধ মাংস ভোজন বা অর্ধোলঙ্গ থাকাকে যেমন কোন সুস্হ মস্তিস্ক ব্যাক্তি উচিত বলে মনে করে না, তেমনি জাতিয় ঐতিহ্য, প্রাচীন দর্শন ও সভ্যতার প্রতি অন্ধ মোহে, অপ্রাসঙ্গিক ও অপ্রয়োজনীয় ও ক্ষতিকর হলেও সগুলিকে টিকিয়ে রাখা সুস্হ মস্তিস্কের লক্ষন নয়। অতীতের জ্ঞানের গর্ভেই বর্তমানের জন্ম, অতীতের সঠিক দিকগুলি নিয়ে ও ভ্রান্তধারণাকে বিসর্জন দিয়ে মানবিক ও বৈজ্ঞানিক দর্শনই মানব জাতির জন্য প্রগতি আনবে__ এই দর্শনে যুক্তিবোধহীনতা ও কুসংস্কারের কোন স্হান নেই। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা ও দৈনন্দিন জীবন যাপন প্রণালীর মধ্য দিয়ে মানুষ খুঁটিনাটি হাজার আচার আচরন তথা সংস্কার ও সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে ও অনুসরন করেছে। এর সবগুলি যুক্তিহীন নয়, যেমন_ কবরস্হান বা শশ্মান থেকে ফিরলে নিমপাতা খাওয়ার সংস্কার। কারন নানা রোগে মারা যাওয়া মৃতদেহের সমাবেশের কারনে।

বিশ্বাস, নিম রোগজীবানু ধ্বংস করতে পারে, তাই নিমপাতা খেলে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ব্যাপারটি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতেও উন্নত করা যায়। গরু অর্থনৈতিক ভাবে একটি অতি গুরুত্বপুর্ণ প্রানী__ কি কৃষিকাজে, কি খাদ্য সরবরাহে, তাই তার সংখ্যা বৃদ্ধির প্রয়োজনে গরুকে দেবতার আসনে বসান হল ও তার মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ হল। এই ধরনের অজস্র সংস্কারের বহু কিছুই সামগ্রিকভাবে মানবজাতির সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের জন্য অপ্রয়োজনীয়, কার্যকরী ভূমিকাহীন এবং কখনো কখনো ক্ষতিকর হয়ে উঠেছে, সাধারন ভাবে এইগুলিই কুসংস্কার। কুসংস্কার টিকে থাকার পিছনে অসম্পুর্ন জ্ঞান ও সমাজ ব্যবস্হা দায়ী এবং কুসংস্কার সমাজ ও প্রগতির পক্ষে বাধাস্বরূপ ঠিকই, কিন্তু শুধু কুসংস্কারাচ্ছন্ন, অবৈজ্ঞানিক বিশ্বাসগুলিই প্রগতির একমাত্র বাধা নয়।

সামাজিক বৈষম্য ও সমাজ ব্যবস্হা তথা সামন্ততান্ত্রিক, পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির প্রভাব ও শোষন অন্যতম প্রধান কারন; এরা নিজেদের স্বার্থে জনগণকে সমাজ সচেতন হতে বাধা দেয়, এর অন্যতম উপায় হিসেবে তারা অবৈজ্ঞানিক মানসিকতাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে। এই চিন্তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত প্রচার যন্ত্র, বইপত্র ইত্যাদির মাধ্যমে, চার্চ-মস্‌জিদ-মন্দির-প্যাগোডা তৈরী করা, ধর্মপ্রতিষ্ঠানগুলিকে উৎসাহিত করা ইত্যাদি নানা পদ্ধতিতে তারা এ কাজ করে থাকে। পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি পাশ্চাত্যের জনগনকে ব্যাপক শোষন করে। অনেক সময় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অবৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণাকে মদৎ দেয়। এইসব সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলিতে যান্ত্রিক বস্তুবাদী দৃষ্টভঙ্গীতে ও পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্হাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে বিজ্ঞানে চর্চা ও প্রয়োগ করা হয়, এরই অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেব ঐসব দেশের বহু মানুষ একদিকে যেমন এই তথাকথিত বিজ্ঞানের যান্ত্রিকতায় অসুস্হ হয়ে অবৈজ্ঞানিক মানুসিকতায় ( যেমন_ ঈশ্বর আরাধনা, তুরীয় ধ্যান, ধর্মীয় গুরুর শিষ্য হওয়া, ন্যাড়া হয়ে কৃষ্ণ নামপ্রচার ইত্যাদি) আশ্রয় খোঁজে, তেমনি অন্যদিকে ঐ ধনী, বিজ্ঞানে উন্নত দেশগুলির মানুষ ও দারিদ্র, সামাজিক বৈষম্য ইত্যাদির শিকার।

ঐসব পুঁজিবাদী দেশের পুঁজিপতিরা নিজেদের দেশের বাজারের বাইরে পৃথিবীর অনুন্নত দেশগুলির জনগনের মধ্যে বাজার খুঁজতে ও তাডের শোষন করতে বাধ্য হয়,__ মুমুর্ষ পুঁজিবাদকে জোর করে বাঁচিয়ে রাহার চেষ্টায় এবং পরিনত হয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিতে। কুসংস্কার একটি সামাজিক ব্যাধি__ তাই সমাজ তথা অর্থনীতি, রাজনীতি, সংকৃতি ইত্যাদির সাথে যুক্ত করেই তাকে দেখতে হবে। যুক্তবাদী ও বৈজ্ঞানিক মানসিকতা ও দৃষ্টভঙ্গী দ্বারা, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আন্দোলন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সংস্কৃতিক তথা সামাজিক আন্দলনের সাথে সংপৃক্তভাবে যুক্ত করই করতে হবে_ না হলে তার স্বার্থকতা ও সাফল্য নেই। অবাস্তব, অলৌকিক, অতিপ্রাকৃত ও কুসংস্কারের অন্ধকার থেকে পৃথিবীর মানুষ বেড়িয়ে আসবে আলোয়, পূর্বসুরীদের ত্রুটি ও অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে যুক্তিহীন গোঁড়ামী ও অসহায় ভ্রান্ত বিশ্বাস দুর করে প্রকৃত অর্থে মানবতাবাদী বৈজ্ঞানিক দৃষ্টভঙ্গী ও সমাজ ব্যবস্হা প্রতিষ্ঠা করবে, নিজেকে মুক্ত করবে সামাজিক বিভেদ-বৈষম্য, শোষন শৃঙ্খল থেকে, উন্নত করবে নিজেদের জীবনকে, সুনিশ্চিত করবে মানবজাতির অস্তিত্বকে। অস্তিত্বহীন ভূত-প্রেত-মন্ত্রশক্তি কে নয়, মানুষ ভয় করুক ও জয় করার চেষ্টা করুক প্রতিকূল, প্রাকৃতিক ও সামাজিক শক্তিগুলিকে, কাল্পনিক সৃষ্টিকর্তা বা কোন দেবদেবীকে নয়, মানুষ শ্রদ্ধা করুক ও ভালবাসুক মানুষকেই, অবতার গুরুজী তথা অলৌকিক, অতীন্দ্রিয় শক্তির উপর নয়, মানুষ নির্ভর করুক নিজেরই শক্তি ও সামর্থ্যের উপর।

্‌

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।