সংস্কারের দাবী বড় নাকি জীবনের দাবী বড়???
এ প্রসঙ্গে বেশীর ভাগ মানুষই স্বীকার করবে যে জীবনের দাবী বড়। কিন্তু প্রাচ্যের তথাকথিত উন্নতিশীল দেশগুলোতে ''আধ্যাতিক চেতনা সম্পন্ন জনগণ'' ঈশ্বর তথা অলৌকিক শক্তির উপর যথেষ্ট নির্ভরশীল। এটিকে প্রাচ্যের মহান ঐতিহ্য, প্রাচীন সংস্কৃতি ও দর্শন ইত্যাদি নাম দেওয়া হয় ও অনুসরন করাহয়। কিন্তু আবার ঐ সব দেশেই পরস্পর বিরোধী বিজ্ঞান নির্ভর কাজও পাশাপাশি করা হয়। যেমন_ ভারত ও শ্রীলংকায় অনাবৃষ্টি হলেই ব্যাপক ভাবে বরুন দেবতা সহ নানা দেব-দেবীর আরাধনা করা হয়, বাংলাদেশেও বন্যা কিংবা খরার ফলে বিভিন্ন ধর্মালয়ে বিশেষ মোনাজাতের মধ্য দিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে গম্ভীর ও কাতর প্রার্থনা জানায়, নির্বোধের মত ব্যাপক সংখ্যক অজ্ঞ ব্যক্তিরা আদৌ চিন্তা করে না এসবে কোন কাজ হবে কিনা!!! তথাকথিত উচ্চ শিক্ষিতরা, রাজনৈতিক নেতারা, শিক্ষবিদরা এই ধরনের অর্থহীন কুসংস্কারাচ্ছন্ন অনুষ্ঠানকে প্রশ্রয় দেন ও প্রত্যক্ষ ভাবে সাহায্য করেন।
অন্যদিকে কৃত্রিম বৃষ্টির জন্য বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালানো হয়। বন্যার জন্য বন্যা নিয়ন্ত্রণ, প্রতিরোধ ও প্রতিকারের ব্যবস্হা নিয়ে থাকেন।
যে সরকার শিক্ষাব্যবস্হা, প্রচারমাধ্যম, সরকারী কর্মসূচী, সদস্যদের দৈনন্দিন কাজকর্ম ইত্যাদির মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে নানা সম্প্রদায় ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মন্ত্রপূজা, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিরোধ, অবতার ইত্যাদিকে সমর্থন করছেন__ সেই সরকারই ধর্মীয় দাঙ্গা ইত্যাদির জন্য কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন দেন, শুধুমাত্র ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস না করে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, আবহাওয়ার পুর্বাভাস, অধিক শষ্য ফলানোর জন্য বাস্তব ও বৈজ্ঞানিক লাগসই প্রযুক্তির শরনাপন্ন হন, ফুটবল, খেলার আগে গোলপোষ্টের পুজা করার মত হাস্যকর কাজ যেমন করা হয়, তেমনি খেলার মান উন্নত করার জন্য খেলোয়ারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ভোটের আগে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের মাজার যেয়ারত বা তথাকথিত পীর বা ভ্ন্ড বাবা'র শরনাপন্ন হতে দেখা যায়, তারপরেও তাদের কে জনগনের বাড়ী বাড়ী ঘুরে ভোট ভিক্ষা করে থাকেন। বিভিন্ন ঐশ্বরিক বা অলৌকিক শক্তির দ্বারা উদ্দেশ্য সফল হবে না তা উপলব্ধি করেও নিছকই অন্ধ বিশ্বাসের জন্য এবং মূলগতভাবে শ্রেণীস্বার্থ বজায় রাখার উদ্দেশ্যে কুসংস্কারকে আঁকড়ে রাখা হয়।
কিন্তু এই ধরনের কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাস সমাজ ও প্রগতির পক্ষে ক্ষতিকর। কুসংস্কারগুলির পিছনে যে শ্রম, অর্থ ও উদ্যোগ ব্যয় করা হয়,
( যেমন____ পূজা-আচ্চা, শ্রাদ্ধ-শান্তি-স্বস্তয়ন, চল্লিশা ও মৃত্যুবার্ষকী, নামাজ পড়া বা প্রার্থনা করা,কোরান পাঠ) তা সামাজিক প্রগতি ও উৎপাদনের পিছনে ব্যয় করলে স্বাভাবিকভাবেই সমগ্র মানবসমাজই উপকৃত হবে। তা না করে সব মিলিয়ে বিপুল পরিমান শক্তি অর্থহীন, উৎপাদনহীন কাজে নষ্ট হচ্ছে। অন্ধবিশ্বাসীকে কিছু মানসিক সাহস দেওয়া ছাড়া এই ধরনের কুসংস্কারের কোন বাস্তব ভুমিকা নেই। একইভাবে প্রচীন উৎকৃষ্ট শিল্পের নির্দশন হিসেবে কয়েকটি ছাড়া, পৃথিবীর সমস্ত মন্দির-মসজিদ-গির্জা-প্যাগোডা ইত্যাদিতে যদি গৃহহীনদের থাকার ব্যবস্হা করা হয় বা অন্য কাজে লাগানো হয়, তবে তা গৃহ সমস্যার আংশিক হলেও সমাধান করা যেতে পারে।
অলৌকিক বা ঐশ্বরিক শক্তিতে বিশ্বাস ও নির্ভরতা, বিপুল সংখ্যক মানুষকে উদ্দ্যোগহীন, নিস্ক্রিয় করে তোলে। সবই 'তার ইচ্ছা' বা 'যাই কর না কেন সবই পূর্ব জন্মের ফল' ইত্যাদি হাজার ধরনের বিশ্বাস মানুষকে তার জীবনকে উন্নততর করার সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করে, দৈনন্দিন জীবনের সামাজিক নানা সমস্যার সমাধানের চাবিকাঠি যে জনগণের হাতে, সেই বোধটিকে আন্তরিকভাবে অনুধাবন করতে দেয় না। মনে হয়, এ সবই ঈশ্বর সৃষ্ট। দারিদ্র, বৈষম্য, অস্বাস্হ্য, অকাল মৃত্যু ইত্যাদি সহ বন্যা, ঝড় ও ভূমিকপের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলি _____ এ সব কিছুকেই মানুষ এখন সামাল দিতে সক্ষম। দারিদ্রই মানুষকে মহান করে তোলে বা ঈশ্বরের প্রকৃত ভক্ত কখনো সামান্য অর্থের জন্য লালায়িত হয় না।
এ প্রসংগে একটা গল্প বলি________ রাঁকা ও বাঁকা নামে দুই ঈশ্বর ভক্ত অতি দরিদ্র অবস্হায় দিন কাটাতেন। স্বর্গদুত ঈশ্বরকে অনুরোধ করে বল্ল, 'ওরা এত বড় ভক্ত কিন্তু ওদের কেন সুখে রাখা হয় না'? ঈশ্বর স্বর্গদুতকে কিছু স্বর্ণমূদ্রা দিয়ে বল্ল রাঁকা ও বাঁকার পথে ছড়িয়ে দিতে। কিন্তু রাঁকা ও বাঁকা এইগুলি দেখে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করলেন ও বললেন, এইগুলা নিশ্চয়ই শয়তানের কাজ, শয়তান অর্থ দিয়ে তাদের ঈশ্বরের একাগ্র আরাধনা থেকে বিচ্যুত করতে চাইছে। ভক্তের প্রকৃত রূপ প্রকাশিত হল। বহু ধর্মে এই ধরনের অজস্র গল্প রয়েছে।
ভক্ত এত কষ্ট করলেও ঈশ্বর কিন্তু অঢেল সম্পদ, স্ফুর্তি ও নাচগানের মধ্য দিয়ে দিন কাটাচ্ছে। ঈশ্বরের পরিবর্তে রাজা, পুরোহিত বা শাসক শ্রেণীকে, রাঁকা-বাঁকা'র পরিবর্তে হতদরিদ্র জনগণকে ধরলে এ ধরনের কল্পকথার হীন উদ্দেশ্যটি বোঝা যাবে। সমস্ত লোকগাঁথাই সমাজের বা সাধারন মানুষের স্বার্থবিরোধী নয়। অনেকগুলাই লোকশিক্ষার মাধ্যমে নৈতিকতা বা মানবিকতার আদর্শ তুলে ধরে। সাধারন মানুষের বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করেও তাদের সচেতন করা ও নৈতিক অধঃপতন থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করা হয়, যেমন__ সাক্ষী গোপালের গল্প।
একজনকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা রক্ষা না করা যে অমানবিক এবং এর জন্য অপেক্ষাকৃত গরীব ও নিম্নবর্ণের সঙ্গেও কন্যার বিবাহ দেওয়া যে ন্যায় তা বোঝানোর জন্যই এই গল্পের সৃষ্টি।
নানা ধরনের কুসংস্কার বিশ্বাস বিভিন্ন ধর্ম পুস্তকের মাধ্যমে বহুযুগ ধরে জনগণের মধ্যে দৃঢ়মুল করে দেওয়া হয়। সাধারন মানুষ তার দারিদ্রকে আশীর্বাদ বা ভবিতব্য ধরে নিয়ে ঈশ্বরের আরাধনায় সময় কাটানোর মধ্যে শান্তি খোঁজা ও দুঃখ ভুলে থাকার চেষ্টা করে, অন্যদিকে রাজা, পুরোহিত বা শাসক শ্রেণী দেবতার প্রতিভূ হিসেবে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শোষনের ফলে পাওয়া বিপুল সম্পদের মধ্যে ভোগবিলাসিতায় সময় কাটায়।
প্রাকৃতিক বিষয়গুলি ঐশ্বরিক কোন ব্যাপার নয়। নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক নিয়মেই ঘটে থাকে।
এগুলি অনুধাবন করে আগে থেকে সতর্ক নেয়া, স্হায়ী প্রতিরোধ ব্যবস্হা, উপযুক্ত ত্রাণ ব্যবস্হা ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষকে বাঁচানো যায়, কিন্তু সরকার বা শাসক শ্রেণী ব্যর্থ হলে 'সৃষ্টিকর্তার মার' বলে চালিয়ে দেয়া হয়। মানুষের মধ্যে ঈশ্বর সম্পর্কিত কুসংস্কারের ফলে তারাও এই ধরনের ধোঁকার জন্য খুব একটা বিক্ষুব্ধ হয় না, ভ্রান্ত ও অবৈজ্ঞানিক মানসিকতা জনগণের হতাশা ও ক্ষোভকে নিস্ক্রিয় ও বিপথগামী করে দিয়ে শাসকশ্রেণী স্বার্থরক্ষা করে, প্রাচীন রাজা পুরোহিতদের প্রাধান্যের সময় থেকে এখনো একই ধারাবাহিকতা বজায় আছে__ বিশেষত অনুন্নত দেশগুলি। ফলতঃ এই জীবনের জন্য নয়, পারলৌকিক উন্নতি সাধনের জন্য চেষ্টা করার প্রবনতা গড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে মানুষের নিস্ক্রিয়তা, শাসক শ্রেণীর চরিত্র ও শোষন সম্পর্কে অসচেতনতা, নিজেদের সমস্যাবলীর স্হায়ী সমাধানের ক্ষেত্রে সঠিক দিশা না খোঁজার মানসিকতা ইত্যাদির জন্ম নেয়।
এই ধরনের দীর্ঘস্হায়ী ক্ষতির পাশাপাশি নানা ধরনের কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাস সমাজের মধ্য দিয়ে নানা ধরনের ক্ষতিকর প্রবনতার সৃষ্টি করে, পূজা-পার্বন উপলক্ষে চাঁদার জুলুম ও খুনোখুনি, ডাইনি সন্দেহে কোন মহিলাকে পিটিয়ে মারা, ভুতের ভর ভেবে অসুস্হ ব্যক্তির উপর শারীরিক অত্যাচার চালানো (যেমন_ হিস্টিরিয়া বা কোন মানুসিক রোগীকে ভুতের ভর ভাবা হয়, এবং তার জন্য তাকে ঝাটাপেটা করা হয়, গরম লোহা দিয়ে ছেকা দেওয়া বা গায়ে পেরেক ফোটানো ইত্যাদি শারীরিক অত্যাচার করা হয়। এই অমানুসিক পদ্ধতি কোন কোন সময় shock therapy' র মত কাজ করে ও বিরল ক্ষেত্রে রোগের উপশমও ঘটায়,কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে shock therapy (ECT) প্রয়োগ করাই বান্ছনীয় কিন্তু Electro Convulsive Therapy (ECT) একটি অত্যন্ত ক্ষতিকর চিকিৎসা পদ্ধতি।
) মানুষের সরল বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে তাদের প্রতারিত করে অবতার ব্যবসা, বন্ধ্যা নারীকে সন্তান পাইয়ে দেওয়া নাম করে ধর্ষন করা, হরিজনদের পুড়িয়ে মারা, ধর্মের নামে জেহাদ করে মানুষ হত্যা করা, ইত্যাদি হাজার অসুস্হ ব্যাপার দুষ্টক্ষতের মত সমাজের বুকে টিকে আছে। , কুসংস্কারাচ্ছন্ন নানা বিশ্বাসের কারনেই। এইগুলিই বিপুল শক্তি, সম্পদ ও উদ্যোগকে নষ্ট করেছে_সর্বনাশ করেছে অসংখ্য মানুষের.....
পর্ব__এক
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।