যে নদীর গভীরতা বেশি, তার বয়ে চলা স্রোতের শব্দ কম।
রুনীর খুব কড়া করে এক কাপ চা খেতে ইচ্ছে করছে। ওর শরীর গুলিয়ে আসছে। বমি বমি লাগছে। এ অবস্থা প্রায়ই হয়।
কী করে যেন ও আবিষ্কার করেছে চা খেলে বমি ভাব দূর হয়ে যায়। কড়া লিকার চা। দেড় চামচ চিনি। চায়ের দোকানদাররা অবশ্য চিনি ঠিকমত দিতে পারে। যখন বলা হয় চিনি কমিয়ে দিও।
তখন চা হয়ে যায় শরবত। দুধ চিনি বাড়িয়ে দিতে বললে সেই চা মুখে তোলা যায় না। বিস্বাদ লাগে।
রুনীর বমি ভাবটা প্রকট হয়।
ও ল্যাম্প পোস্টটা ধরে বসে পড়ে চা পান সিগারেটের টং দোকানটার পাশে।
ওয়াক ওয়াক শব্দ করতে থাকে। গলা দিয়ে অবশ্য কিছু আসে না। ও চেষ্টা চালিয়ে যায় এবং অনুভব করতে পারে রাস্তার লোকজন বিরক্ত হয়ে ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
ক্ষেপে ওঠে অবশ্য পান দোকানদার বশির মিয়াও। “এই খবরদার এখানে বমি করবি না খবরদার যা এখান থেকে বলে চেঁচিয়ে উঠে বশির মিয়া।
রুনী হাঁপাচ্ছে। দুর্বল শরীর। এক সপ্তার উপরে হয়। গোসল করেনি ও। রাতে ঘুম হয় না।
শরীর তো দুর্বল হবেই তাছাড়া ওর তের চৌদ্দ বছরের জীবনে ধকলও কম যায়নি।
ল্যাম্প পোস্টটা ধরে কোন রকম ওঠে দাঁড়ায় রুনী। বশির মিয়া মিয়া ত্যক্ত বিরক্ত চোখে তাকাচ্ছে ওর দিকে। সেই বিরক্তিতে আরো বাড়িয়ে দিল, বললো
বসির ভাই, একজগ পানি নেই?
পানি? বিরক্তি আর রাগ দুইই বশিরের কণ্ঠে। পানি কি তোর (অশ্লীল কথা) কিন্না দ্যায়? পানি রাখতে ট্যাকা লাগনো?
একটু কুলকুচি করবো।
অনুনয় করে রুনী।
ঠিক আছে-কম করেন।
রুনী জগ দিয়ে ড্রাম থেকে পানি ওঠায়। পানি তোলার সময় স্পষ্ট দেখতে পায় ড্রামে জীবাণু কিলবিল করছে। সেই পানি দিয়েই কুলি করেও।
মুখে পানির ঝাপটা দেয়। অনেকটুকু পানি খেয়েও নেয়। এখন কিছুটা হালকা লাগছে ওর। বমি ভাবটা কেটে গেলেও টক ঢেঁকুর ওঠা শুরু হয়েছে। ও বশির মিয়ার দোকানের বেঞ্চিতে বসে পড়লো।
ময়লা ওড়না দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে অর্ডার দিল
বশির ভাই একটা রং চা।
রং ভাল হইবো না। আদা নাই।
কথার পিঠেই জানিয়ে দিল বশির।
আদা লাগবেনা।
শুধু লিকার দ্যাও। চিনি দেড় চামচ।
ইশ কি আমার মহানারীর। চিনি দেড় চামচ অই তোর কি ডায়াবেটিস হইছে বড় লোকের বউগো মত? চিনি কম খাবি ক্যা?
রুনী কোন জবাব দেয় না। বশির মিয়া চা বানানো শুরু করছে।
তার চা বানানোর আলাদা একটি স্টাইল আছে। পরিচিতদের জন্য চা বানালে চায়ের কাপ থেকে সে কিছু ঢেলে রাখে নিজে খাওয়ার জন্য। এটা কেন তেল কাস্টমাররা পছন্দও করে। রুনী চায়ে চুমুক দিল। নাহ, শরবত হয়ে গেছে।
অন্য সময় হলে বলতো, বশির ভাই, একটু চা পাতি ঢেলে দাও। আজ আর কিছু বললো না। দুই চুমুক খেয়ে চা রেখে দিল। টাকা খুঁজলো পাজামার পকেটে। কিছু টাকা থাকার কথা পকেটে সবাই অবশ্য বলে মেয়েদের পকেট থাকে না।
কথাটি ঠিক না। রাস্তার মেয়েরা হাতে ভ্যানটি ব্যাগ নিয়ে ঘুরে বেড়ায় না। ওদের পকেট থেকে কোমরের কাছে। ছেলেদের বুক পকেটের বদলে মেয়েদের কোমর পকেট।
রুনী পকেট হাতড়ে এক টাকার তিনটা কয়েন পেল।
বশিরকে দিতেই বশির বশির ভ্র“ কঁচকে বললো
রং চা তো চার ট্যাকা।
তিন ট্যাকাই রাখো বশির ভাই চায়ে আদাতো দ্যাও নাই।
আদা ছাড়াও চা চার ট্যাকার বেচি। সব জিনিস পাতির বেজায় দাম, বুঝছস?
রুনী মাথা নাড়ায়, ওর শরীরটা আবার গুলিয়ে উঠতে শুরু করেছে। চেহারায় ক্লান্তি আর অবষাদের ছাপ।
চেহারার ভাষা বশির মিয়া পড়তে পারলো কিনা কেন জানে, সহনুভূতির সুরে বললো
কোন সমস্যা আছে না কিরে? ট্যাকা পয়সা লাগবো?
কথার ফাঁকে বশির আশপাশে তাকিয়ে দেখে কেউ তাদের কথঅ শুনছে কিনা। না। এই ঢাকায় কে কার কথা শুনো? বশির গলা নামিয়ে বলে
ট্যাকা লাগলে রাত্রে আসিস। আজ বাসায় যামু না। দোকানেই ঘুমামু।
রুনী ইতস্তত বোধ করে।
হয় বশির ভাই, শরীরটা খারাপ। রাত্রে আসতে পারমু না।
শরীর খারাপ? রুনীর দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায় বশির মিয়া। শরীর খারাপ মানে কিরে? পেট টেট বাধাইয়া ফেলাইচস নাকি?
রুনী জবাব দেয় না।
আশ্বিন মাসের দুপুরের রোদ। ওর কিশোরী মুখে ঝিলিক দিয়ে যায়। মাথা ঘুরাচ্ছে ওর। কোথাও গিয়ে শুয়ে পড়তে হবে। রোড ডিভাইডার, কমলাপুর ঘুবাবে অথচ আজ আসিফের সাথে দুপুরে একসাথে ওর খাবার কথা।
আসিফ কমলাপুর কুলিগিরি করে। বয়স বাইশ তেইশ হবে। ওরও কোন পরিবার নেই। রোজ যাা কামায় বিড়ি গাঞ্জা খেয়ে সব উড়ায়। রুনীর খুব ইচ্ছে আসিফের সাথে ঘর বাঁধার।
রুনী অবশ্য একদিন এ ব্যাপারে কথাও বলেছিল আসিফের সাথে।
সেদিন দু’জন মিলে হাটখোলার এক সিনেমা হলে ছবি দেখেছিল বারোটার শোতে। তিনটার দিকে সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে ভাণ্ডারী হোটেল দুজন তেহারী খেল। সিনেমা-খাবার-রিকশা ভাড় সব অবশ্য রুনীই দিচ্ছে। কিবেলে মহানগর নাট্যমঞ্চের পাশে দীর্ঘক্ষণ দু’জন পার্কে বসে সময় কাটালো।
কত গল্প! কত স্বপ্নের বুনন! কথার এক ফাঁকে রুনী আসিফের একটা হাত ধরে টেনে আনলে ওর বুকের কাছে। বললো Ñ
আসিফ ভাই, তুমি আমারে বিয়া কর।
আসিফ মুচকি মুচকি হাসে। রুনীর বুকে হাত রেখে মাথার উপরে গাছের ফাঁকে পাখিদের জটলা দেখে।
রুনী আবারও বরে
আমারে কথা দ্যাও আসিফ ভাই আমার নিয়া তুমি ঘর বাঁধবা।
আসিফ হাসে। বলে
দুর পাগলি! আমি ঘর বাঁধমু ক্যামনে? আমি কি ঘরের মিস্ত্রি?
আমার আর কচুরিপানার মত ভাসমান জীবন ভাল্লাগে না আসিফ ভাই আসো আমরা বিয়া কইরা বস্তিতে রুম ভাড়া নিয়া থাকি। দুইজনে কাম কইরা সুন্দর সংসার সাজায়া নিব।
আসিফ তবুও হাসে। হাসতেই থাকে।
যেন খুব মজার কোন কথা শুনছে।
রুনী বোঝে, আসিফ ওকে আসলে অবজ্ঞাই করে। যখন প্রয়োজন, ওর সাথে এসে শোয়। ভালবাসার কথা বলে। কিন্তু মনে মনে বড় লোকের মেয়ে ভুলিয়ে ভালিয়ে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখে।
রুনী কারোর মনের উপর জোর খাটাতে পারে না। কষ্ট পায়। তবু এই কপারটাকেই ওর বাস্তাব বলে মেনে নেয়।
মানুষের বাবা মা ভাই বোন আত্মীয় স্বজন কত কিছু আছে। রুনী বুঝে ওঠার পর থেকে ওকে রাস্তার মেয়ে হিসেবে আবিষ্কার করেছে।
শৈশব মনে নেই। কোন আপন মানুষের চেহারা মনে নেই। মনে পড়ে শুধু কিছু আবছা অন্ধকার। সমাজের কাছে, মানুষের কাছে ওর কোন দাম নেই। ওর দাম ওঠে সন্ধ্যের পর রাত বাড়ার সাথে সাথে।
ঢাকার আশ্রয়হীন অনেক রিকশা ভ্যান চালক, কুলি, পকেটমার রাতে আশ্রয় খোঁজে। একজন রাতের সঙ্গী খোঁজে। রুনী তাদের সঙ্গী হয়। চেহারা খুব বেশি সুশ্রী নয় ওর। তবে মায়াবী চাহিনী আছে।
রাস্তার ফুটপাথে ওরা শয্যা পেতে নেয়। নিজেদেরকে আড়াল করে নেয় পুরনো ব্যানারের কাপড় দিয়ে। রাত শেষে পঞ্চাশ টাকা। এর থেকে টহল দেয়া পুলিশকে দিতে হয় কিছু। তিন বেলা খাবার।
অসুস্থ-সুস্থ। বছরে অন্তত একটা পুরান জামা। এসবই বেঁচে থাকার লড়াইয়ের রসদ।
বশিরের দোকান থেকে উঠে হাঁটছিল আর ভাবছিল রুনী। হাঁটতে হাঁটতে কমলাপুর রেলস্টেশন চলে এলো।
দুপুরে আসিফকে খুঁজে বের করা কঠিন। এ সময় খুব ব্যস্ত থাকেও। ট্রেন আসে। ও মাল পত্তর নামাতে বগির দিকে ছোটে। রুনী ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে তাকাতে লাগলো চার পাশে।
কপাল খুবই খারাপ রুনীর।
আর কোনদিন আসিফের সাথে ওর দেখা হবে না। আসিফের পরিচিত এক কুলীর কাছ থেকে রুনী জানতে পারলো, সকালে আসিফকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে। মাস দুয়েক আগে রেলস্টেশনের এক গার্ড খুন হয়েছিল। লাশ খুঁজে পাওয়া গেছে জবাই করা অবস্থায়।
তিন-চার টুকরা। খুনীদের দলে নাকি আসিফও ছিল।
রুনীর তীব্র মাথা ধুরছে। গা আবারো গুলিয়ে উঠছে। দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে খুব।
গলা শুকিয়ে এসেছে। বারবার আসিফের হাসি মাখা মুখটা মনে পড়ছে ওর। টলতে টলতে ও একটা হোটেলে গিয়ে ঢুকলো। পরপর দু’গ্লাস পানি খেয়ে বের হতে না হতেই বমি ভরে ভাসিয়ে দিল সব। হয়তো মনের কষ্টগুলোকেও।
দুই.
এক বছর পরের গল্প।
একটি জোছনা রাত।
একটি ল্যাম্প পোস্ট।
এবং ল্যাম্প পোস্টের সাথে হেলান দেয়া একটি মেয়ে। শাড়ী পরা।
কম বয়সী মেয়েরা শাড়ী পরে ঠোঁট লাল করে পান বিচালে তাকে অন্যরকম সুন্দর লাগে। জোছনা রাতে মেয়েটিকে অপ্সরার মত লাগছিল। মেয়েটির পাশ ঘেঁসে অনেকেই হেঁটে যাচ্ছে। কেই কেউ আড় চোখে তাকাচ্ছে। কেউ ফিরেও তাকাচ্ছে না।
পুরুষ মানুষগুলো সব ‘হাজীসাব’ হলে গেল নাকি? সমানে দিয়ে যাওয়ার সময় ভার্সিটি পড়–য়া টাইপ একটি ছেলে তাকালো।
মেয়েটি নীচু স্বরে জানতে চাইলো
ভাই, টাইম কত?
ছেলেটি অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। ল্যাম্প পোস্টের আলোয় ঘড়ি দেখে আমতা আমতা স্বরে বললো
সাতটা চল্লিশ।
বলেই হনহনিয়ে হাঁটা শুরু করলো। মনে মনে কষে একটা বিশ্রী গালি দিল মেয়েটি।
“... ... বাচ্চা। আমি কি তোরে সময় কইতে কইছি? কইছি সারারাত কাটাইয়া কত দিবি? শর্টকাট কথা বুঝস না। শালা বেকুরের বাচ্চা?”
এক দলা পানের পিক ফেললো মেয়েটি।
ইদানীং ওর চাহিদা কমে এসেছে।
মাস চারেক হলো বাচ্চা ডেভিভারি হয়েছ।
ঢাকা মেডিকেলের গাইনী ডাক্তার অবশ্য চটেছিলেন মেয়েটির উপর।
ফাজিল মেয়ে! এখনো নাক টিপলে দুধ বেরোবে। আর সে চাচ্ছে মা হবে! যদি বিপদ আপদ একটা হয়ে যেত?
আফা গরীরে বিপদ আল্লাহ পাক দেখেন।
জবাব দিয়েছিল সে।
হ্যাঁ আল্লাহ পাক দেখেছেন।
নইলে মা-মেয়ে দুজনেই মরতে। এখন বাচ্চা কী করবে? বাপের তো নিশ্চয়ই ঠিক নেই। এতিমখানায় দিবে?
দেখি আল্লাহপাকের কী ইচ্ছা!
মেডিকেল থেকে বেরিয়ে কন্যা সন্তান নিয়ে একটুও ভাবতে হয়নি ওকে। রাত হয়ে এসেছিল। ও নাড়ী ছেঁড়া শিশু কন্যাটিকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বশিরের দোকানের কাছে চলে এলো।
তখন মাঝ রাত। রাস্তার মানুষেরা সবাই ঘুমে। ও চুপি চুপি নিষ্ঠুর কাজটি করলো। বশিরের দোকানের পাশে ঘুমন্ত শিশুটিকে রেখে ও কেটে পড়লো। বশিরের বউয়ের ছেলে পুলে হবে না বলে সংসার ভাঙ্গার উপক্রম।
এই মাসুম কন্যা শিশুটির ভাগ্য যদি ওর মত না হয়, তাহলে বেঁচে থাকলে পরিচয় দেয়ার মত কিছু বলতে পারবে। বশিরকে বাবা বলে জানবে। আর ভাগ্য খারাপ হলে কে জানে? হয়তো ওরই মত অন্য কোন এক রুগী হবে।
রুগীকে এখন জীবন বাঁচাতে সন্ধ্যের পর পথে নামতে হয়। এক ভদ্রলোকের সুনজরে পড়ে ও ভাল কিছু পোশাক আশাকে পেয়েছিল।
সেই দামী পোশাক পড়লে ওকে চেনা যায় না।
ও এখন প্রতিদিন গুলশানের বিভিন্ন রাস্তার পাশে খদ্দের খোঁজে। প্রতিদিন রূপ বদলাচ্ছে। প্রতিনিয়ত।
জোছনার মত।
জোছনা প্রতিনিয়ত নিজের আবহ বদলায়। এই মুহুর্তের জোছনার সাথে পরের মুহুর্তের জোছনার কিছুটা পার্থক্য তৈরী হয়ে যায়। আলাদা-আলাদা পরিবেশে জোছনার রুপ আলাদা রকমের হয়।
রুনী দেখতে পেল ল্যাম্প পোস্টের আলোয় জোছনার রং কীভাবে ফিকে হয়ে আসছে।
ও ল্যাম্প পোস্টের পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
ল্যাম্প পোস্ট কিংবা জোছনার আলোয় ওর চোখ চিকচিক করে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।