চলো আবার সবুজ গড়ি
পিসির ঘড়িটা একঘন্টা পেছানো তাই কখন যে সাড়ে ন’টা বেঁজে গেলো মাহমুদ তা টেড়ই পেলোনা। একটু পড়েই সম্মতি ফিরে পেয়ে এক ঝটকায় কাপড় চোপোড় পড়ে ব্যাগে প্রয়োজনিয় বই নোট নিয়ে প্রস্তুত হলো। চাবিটা কোথায় গেলো... এই পর্যন্ত কত হাজার বার যে চাবিটা হাড়িয়েছে তার সঠিক গননা করা আদৌ সম্ভব নয়। এই তো সেদিনও শ্যামলা গঢ়নের রোগা সেই মিস্ত্রি এসে চল্লিশটাকার বিনিময়ে তালাটি খুলে দিয়ে গেলো। অথচ তালার দামই পঞ্চান্ন টাকা।
তার কয়দিন পরেই তিনটা চাবির শেষ চাবিটাও পালিয়ে গেলো কোথায়... শেষ পর্যন্ত পাশের রুমের একজনের কাছে পুরোনো পিতলের একটি চাবি পাওয়া গেলো যেটাকে ঢুকিয়ে একটু কসরত করলেই খুলে ফেলা সম্ভব এই হতভাগ্য তালাটি। আর সেই পিতলের চাবিটাও এখন খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। চাবি ই মনে হয় পৃথিবীর একমাত্র জিনিস যা কিনা শত যত্নে রাখলেও হাড়িয়ে যায়। নাকি শুধু মাহমুদের বেলায়ই এমনটা হয় তা বুঝা আসলেই কষ্ট সাধ্য। অবশেষে খুঁজে পাওয়া গেলো।
সাড়ে দশটায় ক্লাশ। হাতে এখনো পয়তাল্লিশ মিনিট সময় আছে। ভোরের এই সময়ে উত্তরা থেকে বনানী যেতে প্রায় এক ঘন্টার কাছাকাছি লেগে যায়। সকাল বেলা সব মানুষদের খুবই ব্যাস্ত একটা সময়। কাউন্টারে যাবার পথেই ফুটপাথে ভির করে বসে আছে একুশ শতকের দাসেরা।
ওদের কেনা বেচা হয়। সবারই হাতে একটা করে হাজি। এদের মধ্যে পুরুষ মহিলা কোনো ভেদ নাই। প্রত্যেকেই পুরুষ। কারন ওদেরকে পুরুষের মত পরিশ্রম করে রাতের খাবার যোগার করতে হয়।
কয়েকজনকে দেখা যাচ্ছে বেশ আমুদে চেহারায় গল্প করে যাচ্ছে। দাঁড়িতে হালকা পাঁক ধরেছে এমন একজন সস্তা বিড়িতে লম্বা একটা টান মেরে ফুসফুসের আয়ুটাকে কমানোর চেষ্টা করছে। সপ্রসান্ত গতিতে নিকোটিন গড়ে তোলে তার আপন মৃত্যুর ইমারত। কয়েকজন হাড়জিড়জিড়ে মহিলা ও একজন মোটা মহিলা মিলে পান খাচ্ছে। আর নিচু স্বরে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কি যেনো গোপন কথা বলে চলেছে।
তার মাঝে একজন মধ্য বয়স্কার যেনো কোনো আকর্ষনই নেই ওদের কথায়। এমন সময় মেট্রো মেট্রো বলে কেঁদে উঠলো যেনো কেউ... না... আসলে ছেলেটির গলার স্বরটাই এরকম তাই অনেকটা কান্নার মতো মনে হয়েছিলো।
মনজিল বাস কাউন্টারের সামনে এসে ব্যাস্ত নারী পুরুষদের ভিরে মাহমুদ দাড়িয়ে কি যেনো ভাবছে... ডান হাতটা পকেটে রাখা। ওখানে বয়সের ভারে একপাশের চামড়া খয়ে যাওয়া মানিব্যাগটার অস্তিত্ত বিরাজমান। সবাই এই টাকার থলেটাকে পেছনের পকেটে রাখে।
কেউ কেউ আবার শরীরের পেছনের অংশটাকে উচু করার উদ্দেশ্যে এটা করে থাকে। কিন্তু ওর এই ডান পকেটে রাখাটা অভ্যাসে পরিনত হয়ে গেছে। ওখানে একশত টাকার তিনটা নোট আর কিছু খুচড়া টাকা আছে। বাসের দরজায় তাকিয়ে সেই টাকার নোটগুলোর কথা চোখে ভেসে উঠলো। আজকে মাসের উনিশ তারিখ।
এই তিনশ টাকাই বাকি আছে। এটা দিয়েই চলতে হবে মাস শেষ হওয়া পর্যন্ত। বাবা বলে দিয়েছেন টাকা পাঠাতে বেশ কিছুদিন দেরি হবে।
এই বাবা মানুষটা এতো কষ্ট করছেন। প্রতি মাসে এতোগুলো টাকা তাকে তার সন্তানের জন্য পাঠাতে হয়।
তার কোমোরের ব্যাথাটা আবার বেড়েছে। গত বছর ছয় মাস অসুস্থতার দরুন তিনি কোনো কাজ করতে পারেননি। সংসারে খরচ করতে হয় পয়সা গুনে গুনে। বয়সের ছাপ চেহারায় পড়তে শুরু করেছে। তার ভেতোরের যৌবনটা ধিরে ধিরে তাকে ছেড়ে তার সন্তানদের দেহে প্রবেশ করছে... সবই তিনি টেড় পাচ্ছেন।
কিন্তু সময় যে বড্ড বেয়াড়া।
কাউন্টারের এই বাসগুলোর অবস্থা দেখলে আর উঠতে ইচ্ছা করেনা। কি লাভ? এই বাসে বনানির টিকিট নেবে ১০ টাকা আর সেই সাথে চাঁপাচাঁপি ফ্রী। তার চেয়ে বলাকাই ভালো। ভাড়া নেয়ার সময় ষ্টুডেন্ট বললে তিন টাকা রাখে সেই সাথে চাপাচাপি ফ্রী।
সেই চিন্তা করে বলাকায় উঠার জন্য ওভারব্রীজের নিচে চলে আসে মাহমুদ। কাঁধে সেই পুরোনো ব্যাগটাই ঝুলছে। যেটা ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার সময় কিনেছিলো। তিন বছর বয়স হয়েছে। একটু বয়সের ছাপ পড়েছে, অবশ্য কয়েকটা যায়গায় সেলাই খুলে সুতো গুলো ঝুলছে।
বাহিরে বেড় হলেই মনে পড়ে রুমে বসে এই সুতো গুলো কেচি দিয়ে কেটে রাখা উচিত ছিলো। কিন্তু রুমে ফিরলে আর তা মনে থাকেনা। বাস থামার আগেই কয়েকজন তার দরজার সাথে সাথে হাটতে থাকে। নামা হলেই হুড়মুড় করে সবাই একই সাথে ঢুকার চেষ্টা করে। মাহমুদও এরই ফাঁকে ঢুকে ছাদের সাথে লাগানো হাতল ধরে দাঁড়িয়ে যায়।
সেই একই পরিচিত দৃশ্য... ড্রাইভারে উদ্দ্যেশ্যে যাত্রিদের কাঁদা ছোড়াছুড়ি। আর কন্ট্রাক্টরের সাথে ঝগড়া। কি নিয়ে?
অনেক পথ শেষে বনানীর আগে আগে এসে সামনের চেয়ারটা খালি হয়। মাহমুদ বসে পড়ে। হাটুগুলো ব্যাথা করছে।
অনেক্ষন দাঁড়ীয়ে থাকার কারনে, তাছাড়া আগে থেকেই হাটুতে একটু সমস্যা আছে যার কারনে বেশি সময় দাড়িয়ে বা বসে থাকলে ব্যাথা শুরু হয়। এমন সময় একজন মহিলা এসে ঢুকলেন বাসে। মধ্যবয়ষ্ক শ্যামল গড়নের মহিলার মুখ বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছিলো। তার বাদামি রঙের বোরখায় তাকে অনেক সম্মানিত লাগছিলো। মাহমুদ উঠে দাড়িয়ে মহিলাকে বসার যায়গা করে দিলো।
আবার ছাদের হাতলে হাত রেখে জানালা দিয়ে দুরের আকাশে তার দৃষ্টিরা ছড়িয়ে পড়লো... এক অজানা ভালো লাগা আর তৃপ্তির পরিপূর্ণতা তাকে জড়িয়ে ধরলো। মোবাইলটা বের করে দেখলো দশটা পয়ত্রিশ বাঁজে।
১৯,১০,০৯
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।