গণআদালত থেকে গণজাগরণের বাংলাদেশ
ফকির ইলিয়াস
==================================
অনেকদিন পর আবার স্লোগান দিলাম। প্রচন্ড বরফ পড়েছে নিউইয়র্কে ৯ ফেব্রুয়ারি। ১০ ফেব্রুয়ারি রোববার নিউইয়র্কে ছিল সমাবেশ। শত শত অভিবাসী জ্যাকসন হাইটসের চত্বরে অবস্থান নিয়েছিলেন। সমাবেশে যাবার আগে ফোন দিলাম কবি শহীদ কাদরীকে।
তিনি আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষ। অনেক কিছুই তাঁর সাথে শেয়ার করি। জানতে চাইলাম দেশে বিদেশে এই যে গণজাগরণ এ বিষয়ে কিছু বলুন। শহীদ কাদরী নির্ভীক মানুষ। এখনো তাঁর কথা আমাকে শাণিত করে।
শহীদ কাদরী মুখ খুললেন। বললেন, শাহবাগ প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা আমাকে আবারো চমকে দিয়েছে। যেমনটি আমি একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালির মাঝে দেখেছিলাম। কবি বলেন, আমি ভেবে পাই না একাত্তর পরবর্তী সময়েই কেন এসব ঘাতক-দালালদের ফাঁসিতে ঝুলানো হয়নি। তিনি বলেন, বাংলাদেশে কি এমন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না, যারা কাদের মোল্লার মতো একজন খুনিকে হত্যা করতে পারলো না! ভেবে অবাক হই, এমন চিহ্নিত একজন ধর্ষক কিভাবে এতোদিন বেঁচে আছে! তাঁর কথা শুনে শিউরে উঠি।
কবি শহীদ কাদরী বলেন, আমরা জানি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ন্যুরেমবার্গ ট্রায়েল হয়। সেখানে নাৎসিদের কিভাবে বিচার করা হয় তা আমরা জানি। সেই সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের শয্যা সঙ্গিনী হয়েছিল যেসব গণিকাÑ তাদেরও হত্যা করা হয়। এটাই ইতিহাস। বাঙালিরা একাত্তরের ধর্ষকদের সেই শাস্তি দিতে পারেনি বলেই- আজ আমাদের এই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
কবি বললেন, আমি আজকের এই প্রজন্মের কাছে ঋণ স্বীকার করে বলতে চাই, আমি খুব হতাশ হয়ে গিয়েছিলাম এই ভেবে যে- বাঙালি কি আর ঘুরে দাঁড়াবে না! আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করে বাংলাদেশের প্রতিটি এলাকার মানুষ এক কাতারে দাঁড়িয়েছে। আমি খুবই আশান্বিত। তিনি বলেন, সরকারের উচিত অতি দ্রুত এই গণদাবি মেনে নিয়ে বিচারের রায় ত্বরান্বিত করা। কারণ ‘রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ’ এই প্রজন্মের প্রাণের দাবি। ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ রোববার বিকেলে নিউইয়র্কে যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে মহাসমাবেশের আয়োজন চলছিল-ঠিক সেই মুহূর্তে তাঁর এই কথা অনেক প্রবাসীর জন্য ছিল প্রেরণার উৎস।
কবি বলেন, আমি সমাবেশে যেতে পারবো না ঠিকই- কিন্তু আমার আত্মিক সমর্থন থাকছে এই আন্দোলনের সঙ্গে। আমি জানি, বাঙালির জয় সুনিশ্চিত। খুব দৃঢ়তার সাথে বলেন কবি শহীদ কাদরী। বিকেল চারটায় সমাবেশে পৌঁছি। সাথী বন্ধুরা সেøাগান ধরেন।
বরফের হিম আমাদের কণ্ঠ রোধ করতে পারে না। সেদিনই জাতীয় সংসদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ শুনলাম টিভিতে। শেখ হাসিনা সেদিন ছিলেন আবেগ আপ্লুত। তিনি বলেছেন, ‘তাদের শপথের প্রতিটি বাক্য শুনেছি। তাদের প্রতিটি বাক্য যুক্তিযুক্ত।
তাদের এই শপথ বাস্তবায়নে যা যা করার দরকার করবো। ’ শাহবাগের প্রেরণায় সারা দেশে আন্দোলনের বিস্তারকে ‘অভূতপূর্ব’ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অদ্ভুত ঘটনা ঘটিয়েছে। অদ্ভুত জাগরণ ঘটিয়েছে। প্রতিটি গ্রামে জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। আমি যখন দেখি তরুণ প্রজন্ম কিভাবে জেগে উঠেছে, আমারো মন ছুটে যায়।
’ পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশাররফের সঙ্গে সাক্ষাতে একাত্তরে পাক বাহিনীর বর্বরতার কথাও জানানোর কথা বলেন শেখ হাসিনা।
‘তাকে বলেছিলাম, আমরা ক্ষমা করতে পারি। কিন্তু, আমরা ভুলবো না। জাতিসংঘে দেখা হয়েছিল। তাকে আমি এই কথা বলেছিলাম।
’ প্রধানমন্ত্রী বলেন- ‘বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে যাবে। এখন আমি স্বস্তিতে মরতে পারবো, শান্তিতে মরতে পারবো। ’ আমরা দেখছি, ইতোমধ্যে মন্ত্রিপরিষদ আইন সংশোধনীর উদ্যোগ নিয়েছেন। জাতীয় সংসদে তা পাস হবার পর নতুন আইন কার্যকর হবে। অন্যদিকে এই গণজাগরণকে থামিয়ে দেবার জন্য তৎপর রয়েছে একটি মহল।
এরা যে সব বিষয় বলতে চাইছে তার আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে আলবদর রাজাকারদের বাঁচানো। এসব রাজাকার দোসরদের বক্তব্যের কিছু সার সংক্ষেপ এখানে তুলে ধরা দরকার মনে করি। তারা বলছেÑ
১. দেশকে বিভক্ত করা ঠিক হবে না। ৪২ বছর পর মিলেমিশে দেশ চালানো দরকার। ২. দেশ দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, খুন, রাহাজানি, রাজনৈতিক পীড়ন ইত্যাদিতে সয়লাব।
এগুলো দূর না করে সরকার কেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে চাইছে? ৩. এই গণজাগরণের দাবির সাথে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু’ যোগ করা দরকার। সরকার শাহবাগ আন্দোলনকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। ৪. ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ এই আন্দোলনের বেনিফিশিয়ারি হতে চাইছে। ইত্যাদি।
তাদের এই ফর্দ দীর্ঘই হচ্ছে।
কারণ তারা এখন দিশেহারা। বিএনপির হান্নান শাহ, কিংবা সাদেক হোসেন খোকার মতো নেতারা এখনো পরোক্ষভাবে রাজাকারদের পক্ষ নিচ্ছেন। আর মওদুদ আহমদ, আব্দুল্লাহ আল নোমানের মতো নেতারা সরাসরি সমর্থন দিচ্ছেন আলবদরদের। এটা খুব নিশ্চিত, বেগম খালেদা জিয়াই আলবদরদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। তিনি তার তনয় তারেক রহমানকে সেভাবেই গড়ে তুলতে চাইছেন।
ভাবতে অবাক লাগে আজ বিশ্বজিৎ হত্যাকারীদের চিহ্নিত করার নামে ঘাতক দালালদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে প্রধান বিরোধী দল। অবশ্যই বিশ্বজিৎ হত্যাকারীদের বিচার দেশবাসী চান। কিন্তু তার অর্থ এই নয় বিএনপি, একাত্তরের পরাজিত আলবদরদের কোলে নিয়ে তাদের পারপাস সার্ভ করবে। বিএনপির কোনো কোনো নেতা বলছেন, আওয়ামী লীগ জামাতকে নিয়ে প্যারালাল আন্দোলন করেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ তো এখন তাদের অবস্থান পরিষ্কার করে সামনে এগিয়েছে।
বিএনপি এখনো রাজাকারদের সাথে গভীর মিত্রতা ছিন্ন করতে পারছে না কেন? ১১ ফেব্রুয়ারি সোমবার চ্যানেল আই-এর ‘তৃতীয়মাত্রা’ অনুষ্ঠানে তরুণ প্রজন্মের ছয়জন ব্লগার ও অ্যাকটিভিস্টকে আনা হয়েছিল। এরা সকলেই শাহবাগের আন্দোলনের সাথে যুক্ত। এই তরুণরা বলেছেন, তারা সব সমস্যারই সমাধান চান। তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুটি সব কিছুর আগে। আমরা দেখছি কেউ মওদুদীর সাথে শেখ মুজিবের ছবি ফেসবুকে প্রচার করছে।
এটা কি কোনো বিষয় হলো? মওদুদী ও শেখ মুজিব দুজনের পথ দুদিকে গিয়েছে বেঁকে। শেখ মুজিব কী মওদুদীর চিন্তা-চেতনা লালন করতেন? নাকি তা প্রতিষ্ঠা করেছেন? এসব নাদানদের তা কে বুঝাবে? না আমরা আশাহত হচ্ছি না। আমরা জেনেছি, শাহবাগ আন্দোলনের জন্য চারুকলায় রাত জেগে চলছে জাহানারা ইমামের প্রতিকৃতি তৈরির কাজ। একদল তরুণ-তরুণী আপন মনে তৈরি করছে বিশাল এক প্রতিকৃতি। সারাদিন আন্দোলন আর রাত জেগে প্রতিকৃতি তৈরির বিনিময়ে তারা চান শুধুই ফাঁসি।
গণজাগরণ চত্বরে তরুণ তরুণীরা এসেছেন প্রত্যন্ত এলাকা থেকে। এরা পূর্ব পরিচিতও নন। প্রত্যেকে আন্দোলনকে উজ্জীবিত করার স্বার্থেই এ কাজে অংশ নিয়েছেন। ফেইসবুকে ও বিভিন্ন ব্লগে প্রতিকৃতিটি বানাতে অংশ নেয়ার আহ্বান দেখেই তারা একসঙ্গে এসেছেন। এখানে অর্থের জোগানে কোনো রাজনৈতিক হাত নেই।
প্রত্যেকে নিজেদের পকেট থেকে চাঁদা তুলে এ প্রতিকৃতিটি তৈরি করেছেন। প্রতিকৃতি নির্মাণকারীরা বলেছেন, ‘আন্দোলনের আয়োজক ও ব্লগারদের উদ্যোগেই জাহানারা ইমামের এ প্রতিকৃতি তৈরি করা হচ্ছে। এখানে সবাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ব্লগ থেকে খবর পেয়ে। ’
হ্যাঁ, ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তার জাগরণ ঘটতে লেগেছে একুশ বছর। আর বাঙালি এভাবেই ঘুরে দাঁড়াতে জানে।
যার প্রমাণ আজকের শাহবাগ থেকে গোটা বাংলাদেশ। যে কথাটি না বললেই নয়, তা হচ্ছে- ব্লগ ও অনলাইনে অ্যাকটিভিটি আমাদের ছেড়ে দিলে চলবে না। কারণ আমরা দেখছি একটা গ্রুপ এখন নানা কথা বলে অনলাইনের দখল নিতে চাইছে। তারা মহানবী (সাঃ)-এর প্রসঙ্গ তুলে ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে চাইছে। আমরা দেখছি শোলাকিয়ার মহামান্য ইমাম মওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসুদ গণজাগরণে এসেছেন।
সেখানে দোয়া মাহফিল হয়েছে। মুসল্লিরা নামাজ আদায় করেছেন। তারপরও ঐসব কুলাঙ্গাররা বসে থাকবে না। তাই সবাইকে সতর্ক হতে হবে। যে বিষয়টি আমাদের ভাবাচ্ছে, তা হচ্ছে সাগর-রুনি হত্যাকা- ইস্যুতে বাংলাদেশের সকল সাংবাদিক এক হলেও গণজাগরণ ইস্যুতে বিএনপি-জামাতের কিছু সাংবাদিক পক্ষান্তরে আলবদর রাজাকারদের পক্ষ নিয়েছেন।
তা এখন খুব স্পষ্ট। একটি রাজনৈতিক দলপ্রধানের একজন উপদেষ্টা প্রকাশ্যে বিরোধিতা করছেন। এদের বিষয়েও সাবধান থাকা জরুরি। কারণ ‘ওয়াশিংটন টাইমস’-এর নেপথ্য লেখকরা নানাভাবেই ছোবল দিতে চাইছে- চাইবে। সবচেয়ে বড় বিষয়টি হলো গণসংহতি।
গণজাগরণে, সম্প্রীতি-সৌহার্দ্য বজায় রাখতে হবে। যে চেতনা নিয়ে জাতীয় টিমের ক্রিকেটাররা ছুটে এসেছেন, সেই চেতনা সবাইকে ধারণ করতে হবে। দলীয় স্বার্থ কিংবা নেতৃত্বের স্বার্থ নয়, দেশপ্রেমকে জাগ্রত করে এগিয়ে যেতে হবে। যে দেশপ্রেম থেকে এগিয়ে এসেছিলেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।
----------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ // ঢাকা // : শনিবার, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৩
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।