১.
বাংলা ভাষার আশা কী? এই ভাষাকে কেন্দ্র করে যে জনগোষ্ঠী, তারই বা ভরসা কী?
কিংবা প্রশ্নটাকে অন্যভাবেও করা যায়: বাংলাভাষার আলাদা করে কোন আশা থাকার দরকারটা কী? আমরা তো এখন বিশ্বায়নের যুগে বাস করি, পুরো পৃথিবীটাই নাকি একটা গ্রামস্বরূপ। সেখানে ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত কয়েকটা আন্তর্জাতিক ভাষা তো আছেই, আর দেশের মেধাবী ছেলে-মেয়েরা তো সেগুলো শিখে দেশ-বিদেশে ভালোই আছে, তারা গবেষণা করছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে এবং পড়াচ্ছে, এমনকি মূর্খ-অজ্ঞ সাধারণ লোকজন পর্যন্ত দেশের বাইরে গিয়ে সেখানকার ভাষা শিখে গতর খাটিয়ে বেশ দু’পয়সা আয় রোজগারও করছে।
কথাটাকেই আরেকটু প্যাচ কষে এভাবেই বলা যায়: বাকি দুনিয়া আমাদের থেকে কতদূর এগিয়ে! আমাদের ভাষা যতই স্নেহ-মধুর হোক, ‘মা’ বুলির মাধুর্য নিয়ে কবিরা যতই হৈ চৈ বাধিয়ে দিক, আবেগ দিয়ে কি দিন চলবে? বিজ্ঞান কী দর্শনের জটিল ভাব কি বাংলায় প্রকাশ করা যাবে? ব্যক্তিগতভাবেও কেউ সফল হতে চাইলে বিদেশী ভাষায়, বিশেষতঃ ইংরেজিতে কাবিল না হলে চলবে কী করে?সংক্ষেপে প্রশ্নটা দাঁড়িয়েছে এই: বাংলাভাষা কি জনতার আটপৌরে ভাষা হিসেবেই রয়ে যাবে, কিংবা কোন এক দূর অন্তিমে কি তা প্রত্মবস্তুতে রূপান্তরিত হবে? নাকি এরও মতা আছে তাকে কেন্দ্র করে যে জনগোষ্ঠী, তার কোন বিপ্লবী রূপান্তরের ভাষা যোগাবার; এমন রূপান্তর যা সেই জনগোষ্ঠীর সকল অষ্ফুট কিংবা এখনও কল্পনাতীত সকল সম্ভাবনায় এমন আশ্চর্য যাদুর ছোঁয়ায় প্রাণ সঞ্চার করবে যে, ইতিহাসের ঘটে যাওয়া মহৎ পর্বগুলোর দিকে তাকিয়ে আমরা যেমন বলে থাকি, তেমনটিই আবারও বলব: তাইতো, এটাই তো ঘটার ছিল! তাইতো, তাইতো!!
২.
মানবিক উৎকর্ষগুলোর মাঝে শ্রেষ্ঠ গুণ ভাষা। একদিন মানুষ পশুকূলের অন্যান্যদের মতই ভাষাহীন ছিল। কিন্তু মানুষই একমাত্র প্রাণী যে প্রকৃতির ওপর সচেতন ক্রিয়ায় সম, যেখানে আর সকলেই প্রকৃতির শৃঙ্খলে বন্দী।
প্রকৃতির ওপর ক্রম কর্তৃত্বের আয়োজনের সাথে সাথে, নিত্য নতুন হাতিয়ার ও সামাজিক সম্পর্কের বিবর্তনের পথে পরস্পর যোগাযোগ অধিকতর গূরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, ভাষারও কাঠামো জটিলতর হয়ে উঠল। এক একটি স্বতন্ত্র এলাকায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠী এভাবে স্বতন্ত্র ভাষার জন্ম দিল, আর উৎপাদন সম্পর্ক ও সাংস্কৃতিক ঐক্যের ভিত্তিতে ভাষা জন্ম দিল এক একটি জাতিগোষ্ঠীর। ভাষার বিকাশের এই পর্বটি অনেকটাই সহজাত, স্বতঃস্ফূর্ত। মানুষ তখন উৎপাদনের ক্ষেত্রে জটিল কোন হাতিয়ার ব্যবহার করতো না, ফলে উৎপাদনও ছিল সীমিত। সবগুলো ভাষাই আদি পর্বের এই সহজাত বিকাশের স্তর পাড়ি দিয়ে এসেছে।
সঙ্গত কারণেই, সীমানাবর্তী জনগোষ্ঠীগুলোর ভাষার মাঝে সাদৃশ্যও থাকত প্রচুর।
ভাষার বিকাশের বিকাশের দ্বিতীয় পর্যায়টিতে ঘটে রাজনৈতিক অভ্যূদয়। এই পর্বটি উৎপাদন পদ্ধতির আরও বিকাশ ও বাড়তি সম্পদ সৃষ্টির সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। যেমন প্রাচীন মিশরে কৃষির বিস্তারের সাথে সাথে সেচব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে যে ব্যবস্থাপক-নেতাদের আবির্ভাব ঘটায়, কালক্রমে তাই আদি ক্ষুদ্র সর্দার বা ক্ষুদ্র রাজতন্ত্রে পর্যবসিত হয়। তারপর প্রথমে কয়েকটি বৃহৎ প্রতিযোগী রাজবংশ দাঁড়ায়, পরিশেষে একটিমাত্র কেন্দ্রীয় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়।
এক্ষেত্রে কিন্তু মিশরের বাকি এলাকাগুলোর ভাষা আঞ্চলিক ভাষায় পর্যবসিত হয়। একটি কেন্দ্রীয় ভাষাও তৈরি হয়, তৈরি হয় কেন্দ্রীয় ধর্ম ও মতার বিধি। শুধু কি তাই? এই উৎপাদনের বিকাশের পর্যায়টিতে বাড়তি জনশক্তির প্রয়োজনে দুর্বল বহু জাতিকে আংশিক বা পূর্ণঙ্গভবে দাসেও পরিণত করা হয়। এই পুরো রাজনৈতিক ঐক্যের প্রক্রিয়াই আবার উল্টোদিকে ভাষায় ধর্ম, রাজনীতি, প্রযুক্তি, শাসন ও শৃঙ্খলাবিধি সম্পর্কে নতুন নতুন ধারণা ও পদ্ধতির, নতুনতর শব্দের জন্ম দেয়। ক্রমে ভাষা এত জটিল হয়ে ওঠে যে, আগের মত আর সহজাত ভাবে তার পুরোটা আয়ত্ব করা যায় না, নিয়ন্ত্রণ এবং শৃঙ্খলার প্রয়োজন হয়।
আসে ব্যাকরণবিদ্যা। তবে, সবগুলো ক্ষেত্রে বিজয়ী গোষ্ঠীর ভাষাই মতার ভাষা হয়নি, বহুক্ষেত্রে শাসকরা শাসনের জন্য ভিন্ন কোন সুবিধাজনক ভাষাকেই বেছে নিয়েছে। যেমন মোঙ্গলরা মধ্য এশিয়া ও চীন উভয়টিই দখল করলে চেঙ্গিস খানের বংশধররাই তাদের প্রজাদের ধর্ম অনুযায়ী দুটি পৃথক গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়। চীনে তারা যেমন চীনা ভাষা ও সংস্কৃতি গ্রহণ করে, মধ্য এশিয়াতে তারা গ্রহণ করে ইসলাম ধর্ম ও প্রধানত ফার্সী ভাষা। আবার এই ফার্সী ভাষাও একটি বিশাল পর্ব জুড়ে তার চেয়ে কম ঐতিহ্য সম্পন্ন আরবী ভাষার ছায়াতলে থেকেও ক্রশশঃ ইসলামী আইন, বিজ্ঞান ও সাহিত্যের বাহনে পরিণত হয়, তার পুনর্জাগরণ ঘটে।
ভারতীয় উপমহাদেশে ভাষার এই রাজনৈতিক অভ্যুদয় পর্বের সাথে আর্য আগমনের প্রত্য সম্পর্ক রয়েছে। হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর নগরগুলোর পুরাতাত্তিক অনুসন্ধানে আর্যদের আগমনের আগেই নগর সভ্যতার অবয়ের সুস্পষ্ট ছাপ দেখা গিয়েছে। কিন্তু সকল বিচারেই বিজয়ী পশুপালক আর্যদের চেয়ে তারা সভ্যতায় বহুদূর অগ্রসর ছিল। আর্যদের আক্রমণে পতনোম্মুখ সিন্ধুসভ্যতার নগরগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে প্রাচীন অধিবাসীরা বিপ্তি হয়ে পড়ে। তাদের নগরগুলোর দূরবর্তী কোন কোনটি হয়তো টিকে যায়।
কালক্রমে আর্যরা নিজেরাও কৃষি ও নগর সভ্যতায় অভ্যস্ত হয়, তাদের অধীনস্ত অঞ্চলের সীমাও সিন্ধু ছাড়িয়ে ক্রমে মধ্য, পূর্ব ও দণি ভারতের সীমানা পর্যন্ত পৌছায়। এবার কিন্তু তারা নগর, কৃষি ও বাণিজ্যকেন্দ্রীক নতুন সভ্যতার জন্য প্রয়োজনীয় নতুন ধর্ম রাতারাতি তৈরি না করে পুরনো জাতিগুলোর রীতিই বহুলাংশে গ্রহণ করে। জাতি হিসেবেও আর্যরা এ পর্বে নিজেরাই আর কেন্দ্রীভূত থাকেনি। এই পরবর্তী পর্বে স্তরে সমরবলে নতুন নগর ও এলাকা অধিকৃত করারও বাস্তবতা আর পুরোপুরি অুন্ন থাকেনি। বরং আর্যদের এক ধরনের সাংস্কৃতিক আধিপত্য ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, সীমানাবর্তী বহু জাতি আর্য সংস্কৃতি, ধর্ম ও ভাষার কোন কোনটা গ্রহণ করে, নানান রাজনৈতিক হিসেব নিকেশ ও বাস্তবতা থেকে আর্যরাও তাদের নিজ বলয়ে অঙ্গীকৃত করে নেয়।
এভাবে ভারতবর্ষের ঐ পর্বে আমরা পাই আর্য সংস্কৃতির আধিপত্যযুক্ত অনেকগুলো আঞ্চলিক ভাষা, আর উচ্চতর প্রয়োজনে সাধারণ ভাষা হিসেবে সংস্কৃত-কে। কিন্তু একটি পর্বে সংস্কৃতের বন্ধন অনেকটাই ছিন্ন হয়ে আসে, মধ্যযুগে তুর্কীদের এদেশে আসার আগেই আমরা দেখতে পাই সংস্কৃত কাব্যে প্রবল আঞ্চলিক ঝোঁক। সেই যুগের সংস্কৃত ভাষায় লেখা বহু কবির কবিতাকে মনে হয় বাঙলা ভাষারই হাতছানি।
একই মূল ভাষার উপভাষাগুলোর মাঝে এই প্রতিযোগিতাগুলো কিভাবে চলে তার একটি দৃষ্টান্ত আরবী, অন্যটি রুশ ভাষা। পুরাকালে আরব সংস্কৃতির প্রধান কেন্দ্র ছিল আধুনিক ইয়েমেন।
ইথিওপিয়া, রোম ও ভারত ও পারস্যের সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক রতি হতো এডেন বন্দর থেকে। কালক্রমে সমুদ্র বাণিজ্য ধ্বংসগ্রস্থ হলে তার সমৃদ্ধি ক্রমে কমে আসতে থাকে, অন্যদিকে পূর্বে অগম্য মরুপথে উটের ক্যারাভানে মাল সরবরাহ শুরু হয়। এবার কিন্তু মক্কা একটি প্রভাবশালী বাণিজ্য পথ হিসেবে আবির্ভূত হয়, কাবার গূরুত্বও বৃদ্ধি পায়। একই সাথে ইয়েমেনি ধর্মীয় তীর্থস্থানগুলোরও রমরমা কমে আসে। প্রাচীন পৃথিবীতে সবগুলো গূরুত্বপূর্ণ মেলা ও বাণিজ্যকেন্দ্রই ধর্মীয় দিক দিয়েও গূরুত্বপূর্ণ ছিল।
ইয়েমেনের একটি মন্দিরের কথিত অবমাননার প্রতিশোধ নিতে আবরাহা বাদশার মক্কায় আগমনের ঘটনা এই বিরোধেরই জের। মক্কাবাসীদের কোন প্রতিরোধ না করে পলায়নও তাদের তখন পর্যন্ত তুলনামূলক হীনবল অবস্থাকেই প্রতিপাদিত করে। কিন্তু সমুদ্র বাণিজ্যের অধোগতি এক সময়ে ইয়েমেনের সকল যশকে অতীতে পরিণত করে, আরবী ভাষার পরবর্তী বিকাশের ইতিহাস যেমন ইসলাম ও তৎসংলগ্ন এলাকার আরবী বর্ণমালারই বিকাশের ইতিহাস।
কিন্তু শুধু আঞ্চলিক ভাষার প্রতিযোগিতার ইতিহাসেই নয়, বিশ্বইতিহাসেও ভাষার রাজনৈতিক অভ্যূদয়ের ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক আরবী ভাষার বিকাশ। মুসলমানরা মিশর, সিরিয়া, পারস্য দখল করে তাদের ভূ-সাম্রাজ্য স্থাপনের সাথে সাথে এমন প্রজাদের মুখোমুখি হল, যাদের রয়েছে অপোকৃত পুরনো ও দৃঢ়তর ধর্ম-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য।
একদিকে ধর্মীয় প্রশ্নে তাদের মোকাবেলা, অন্যদিকে উন্নতর প্রজাদের জ্ঞান-বিজ্ঞান আয়ত্ত করা শাসকদের জন্য একটি বিশাল প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। আরবী ভাষার গোটা একটি যুগকে তাই চিহ্নিত করা যায় তার দু’টি বৈশিষ্ট্য দিয়ে, একদিকে বিপুল পরিমাণ অনুবাদ কর্মের মাধ্যমে সারা পৃথিবীর জ্ঞান-দর্শন নিজের ভাষায় নিয়ে আসা; অন্যদিকে সমান গূরুত্বের সাথে নিজেকে খোঁজা, সারা দেশে প্রচলিত শব্দভাণ্ডার, ব্যবহারবিধি খুটিয়ে খুটিয়ে বের করা, সংস্কৃতি ও ঐহিহ্যের বিন্দুগুলোকে চিহ্নি করা। ঐ সময়ের দামেস্ক কিংবা বাগদাদ(এই পর্বটিই বেশি সমৃদ্ধ, যদিও পুরাতন পর্বেই কাজটি শুরু হয়) নগরে একদিকে যেমন দেখা যাবে সারা পৃথিবীর জ্ঞানী গুনীদের সমাবেশ, অনারব-আরব পণ্ডিতদের এক অভূতপূর্ব অনুবাদ-যজ্ঞ; একই সময়ে দলে দলে ছাত্ররা ছড়িয়ে পড়ছে বেদুঈন পল্লীতে, দিনের পর দিন তাদের মুখের শব্দমালা সংগ্রহ করে ফেরত আসছে শহরে। আরব ইতিহাসের গৌরবকাল বলতে আমরা যা বুঝি, তা আসলে এই পর্বের ভিত্তির ওপরই প্রতিষ্ঠিত।
চলবে...
প্রথম প্রকাশ দৃক, সাহিত্য-শিল্প বিষয়ক লিটল ম্যাগাজিন, ফেব্রুয়ারি, ২০০৮
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।