আজ ১৫ সেপ্টেম্বর ২০০৯ বাংলা কথা সাহিত্যের দিকপাল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ১৩৩ তম জন্ম জয়ন্তী। আজ অবধি একজন কথা সাহিত্যিক হিসাবে শরৎচন্দ্রে বিচরণ কাল দুই বাংলায় শুধু দীর্ঘই নয়, সমাজের আনাচে কানাচে তার অবাধ বিচরণ। শরৎ চন্দ্রের সাহিত্য সমাজের উচ্চ মহলের ড্রই রুমের বুক শেলফের যত টা না শোভা বর্ধন করেছে তার থেকে অনেক বেশি আদৃত হয়েছে সমাজের নিন্মবর্গের শিক্ষিত-স্বল্প শিক্ষিত মানুষের কাছে। যুগে যুগে শহর থেকে প্রতন্ত গ্রামের রক্ষণশীল সমাজের অসূর্য্যস্পর্শা গৃহবধুটি কে তিনি তাঁর কথামালায় শুধু অশ্রুসিক্তই করেননি, একই সাথে একই সময় নিজ অন্তরের শক্তিতে বন্দিনী নারী কে শিকল ভাঙ্গতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন ।
ভারতীয় রেনেঁসার মহান সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে ভারত বর্ষের বিখ্যাত মাক্সীয় দার্শনিক ও ভারতের ' Socialist Unity Center of India (SUCI) এর প্রতিষ্ঠাতা কমরেড শিবদাস ঘোষের '' শরৎ মূল্যায়ণ প্রসঙ্গ '' পুস্তিকা থেকে অংশ বিশেষ উদৃত্ত করলাম।
****************************************************
শরৎ মূল্যায়ণ প্রসঙ্গ
..............এই মানুষ কে বাংলা সাহিত্যের একজন সমালোচক বলে বসলেন , ' পাকশালার সাহিত্যিক'!আজকাল শরৎচন্দ্র সম্পর্কে এই ধরণের সমালোচনাই স্কুল-কলেজের ছেলে মেযেরা পড়ছে। বিদ্যাদিগ্বজ না হয়ে কি তাদের উপায় আছে! শরৎসাহিত্যের পিছনে নাকি কোন তত্ত্ব এবং সুচিন্তিত কোনও জীবনদর্শন নেই। তিনি মানুষের মনে রস সৃষ্টির মাধ্যমে ব্যথা-বেদনা সৃষ্টি করে বড় চিন্তা বা ভাবণার বিষয় বস্তুগুলোকেই গেঁথে দিতে চেয়েছেন যাতে বুদ্ধির দরজায় আশ্রয় নিতে না হয়।
যাঁরা বুদ্ধি দিয়ে গ্রহণ করতে পারেন তাঁদের জন্য তো তত্ত্বের আকারে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বই রয়েছে। তাহলে সাহিত্যের আর প্রয়োজন কী? সাহিত্যের দরকার তো এইখানেই - তত্ত্ব বিচারের মাধ্যমে যে সত্যোপলব্ধি ও উন্নত ভাবনা- ধারনাগুলো গড়ে উঠেছে, রসোত্তীর্ণ করে তাকে গল্পের মাধ্যমে নানা ডালপালায় খেলাবার জন্য এবং মানুষের সূক্ষ্ম অনুভূতির মধ্যেও তার জায়গা করে দেবার জন্য।
যাঁরা তেমন শিক্ষার বুনিয়াদ এবং ক্ষমতা না থাকার জন্য যুক্তি বা বুদ্ধি দিয়ে বড় কথাগুলো গ্রহণ করতে পারেন না- রসসৃষ্টির মাধ্যমে ব্যথা-বেদনা জাগিযে দিযে তাঁদের মনেও সেটা খানিকটা গেঁথে দেওয়া। এই কাজটি করার জন্যই তো সাহিত্যের প্রয়োজনীয় তা।
যেমন ধরুণ, মানবতাবাদ এক সময় ' এথিকাল মাদারহুড' এর ধারনা নিযে এসেছে। শরৎচন্দ্র জানতেন যে, এইসব তত্ত্ব কথা তো তত্ত্বের নানান বইতেই লুকিযে আছে- মানুষ যে গুলো পড়েও অনেক সময় আসল জিনিসটা ধরতে পাবে না। তিনি জীবনকে কেন্দ্র করে যে ঘাত-প্রতিঘাতের সৃষ্টি হয়,মানুষের সম্পর্কের মধ্যে যে জটিলতা গড়ে ওঠে, মানুষের মনে যে অনুভুতি এবং হৃদয়াবেগ জন্ম নেয়, তার উপর ক্রিয়া করে সূক্ষ্ম রসের উপলব্ধি ঘটিয়ে এবং ব্যথা-বেদনা জাগিয়ে দিয়ে মাসুষের মনে সেই যুগের বড় তত্ত্বগুলোকেই গেঁথে দিতে চেয়েছেন- বুদ্ধি দিয়ে পড়াশুনা করে যাঁরা বুঝতে পারবেন, তাঁরা তো পারবেনই, কিন্তু যাঁরা সেই ভাবে পারেন না, জনসাধারণের সেই বিরাট অংশটা যাতে রসের মাধ্যমে বড় তত্ত্বের হদিশ পেতে পারেন।
আর রসোপলব্ধির মাধ্যমে সত্যকারের বড় জিনিসের হদিশ যদি কোন মানুষ একবার পেয়ে যায়, তবে কিছু না বুঝেও সে খানিকটা পাল্টে যাবে।
মেয়েরা 'এথিকার মাদারহুড' কী, সে সম্পর্কে তত্ত্ব জানার অর্থে একটি কথাও না জেনে 'এথিকাল মাদারহুড'-এর গুনাবলীর দিকে আকর্ষিত হতে থাকবেন। গল্পের মধ্য দিযে এই 'এথিক্যাল মাদারহুড' -এর ধারনাকে কেন্দ্র করে যে সব চরিত্র গড়ে উঠেছে, সেই ' বিন্দু'র দিকে তাঁদের আকর্ষণ হবে, সাথে সাথে যাদবের দিকে তাদের আকর্ষণ হবে, মাধবকেও তাঁরা বুঝতে চাইবেন। এই ভাবে শরৎচন্দ্র ব্যথা-বেদনা জাগিয়ে দিযে এবং বড় কে পাওয়ার জন্য মানসিক অভাববোধ গড়ে তুলে সমস্যাটি ধরবার চেষ্টা করেছেন। পাতার পর পাতা ব্যাখ্যা করে তাঁর লেখাকে ভারাক্রান্ত করে তুলেন নি।
য়েমন ধরুণ, শিক্ষিত মেয়েরা, 'এথিকস' কী, 'এথিক্যার মাদারহুড' কী, তার উপর হাজার বক্তৃতা শুনেও যে জিনিস আয়ত্ত করতে পারবেন না- 'মেজদিদি'র হেমাঙ্গিনী, 'বিন্দুর ছেলে'র বিন্দুবাসিনী এবং 'রামের সুমতি'র নারায়ণী তা আয়ত্ত করেছে মনের সম্পদে দিযে। নারায়ণীর স্বামী এবং মা এর থেকে তাকে বিচ্যুত করতে পারে না, কোন হীন স্বার্থবোধই এর থেকে তাঁকে বিচ্যুত করতে পারে না। শরৎ সাহিত্যের এই সমস্ত নারী চরিত্র রক্তের কোন সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও, যাদের সন্তান হিসাবে দেখেছে, সেই সন্তানের প্রতি তারা সমস্ত দায়দায়িত্ব পালন করেছে। বিনিময়ে সত্যিকারের ' ইমপারসোনাল মাদারহুড' এর আস্বাদটি তারা পেয়েছে। শরৎচন্দ্র যে সব দিকগুলোর এ সব গল্পের মধ্য দিয়ে তুলে ধরতে চেযেছেন, তা হ'ল , একটি মেয়ে যদি সত্যই জীবনে নৈব্যক্তিক মাতৃত্বের সন্ধান পায়- তবে তার প্রকৃতি এবং রূপ-রস-গন্ধ কী রকম হয়, নিজের সন্তান এবং পরের সন্তানের মধ্যে ভেদাভেদই বা তার কাছে কী রকম দাঁড়ায়- এ সব তিনি স্তরে স্তরে দেখাতে চেষ্টা করেছেন।
এগুলো কি শুধুমাত্র গল্প? গল্পগুলোর মধ্যে দিয়ে নারীর মর্যাদাবোধের যে ছবি আঁকা হয়েছে, তা সবারই ভাল লাগে। কোন মেয়েই ' মেজদিদি' পড়ে মেজদিদির বড় জায়ের চরিত্র অনুসরণ করতে চাইবে না। মেয়েরা হেমাঙ্গিনী বা নারায়ণীর মতো হতে পারুক আর নাই পারুক , এ গল্পগুলি পড়লেই তাদের নারায়ণী মতো বা মেজদিদির মতো হওয়ার আকাঙ্খা জাগবে। এই আকাঙ্খা জাগার অর্থ কী? মেজদিদি এবং নারায়ণীর মত চরিত্রিক মান অর্জণ করার জন্য ঘরের বৌ-ঝিদের মধ্যে যদি প্রবল আকাঙ্খা জাগে - তাঁরা এই রকম হওয়া উচিত বা একেই যদি ভাল মনে করেন- তাহলে সমস্ত পরিবারের মধ্যেই নারীজাগৃতির একটি সত্যিকারের আন্দোরন ঢুকে গেল।
সমালোচকরা এসব দেখতে পান না।
শরৎসাহিত্যে কোন তত্ত্ব নেই বলে তাঁরা সমালোচনা করেন। আর সেই তত্ত্বের কথাগুলোই যখন শরৎচন্দ্র এমন অপূর্ব কৌশলে ঘরের ঢুকিযে দিলেন , তা হয়ে গেল তত্ত্ববিবর্জিত! এ এক বিচিত্র অন্তঃসারশুণ্য ইনটেলেকচুয়াল মানসিকতা।
http://www.ganadabi.in/works3/sarat_b.pdf
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।