এডিট করুন
""দুইটি মানুষ""
এক
|| দুই ||
১৯৫০ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী। এ দূর্ভাগ্য দেশে আবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুন দাউ দাউ জ্বলিয়া উঠিয়াছে। এবার সে বহ্নিশিখায় অগণ্য স্ফুলিঙ্গ শহরের সীমা ছাড়াইয়া দিকে দিকে পল্লীর শান্তিময় অঙ্গনে ছড়াইয়া পড়িয়াছে, সে স্ফুলিঙ্গ হইতে পল্লীর মাঠেঘাঠেও দাবানলের সৃষ্টি হইয়াছে।
বরিশাল। একটি মুসলমান অফিসারের বাসা।
বাসায় কোন পুরুষ নাই; আছেন একটি মাত্র মহিলা - তাহারও বয়স মাত্র উনিশ বছর। তাঁহার সাথে দুইটি শিশু কন্যা।
সেদিন দুপুর বেলায় দশজন হিন্দু দাঙ্গার ভয়ে এই বাসায় আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছে। মহিলাটি তাহাদিগকে অভয় দিয়া এক নির্জন ঘরে লুকাইয়া রাখিয়াছেন।
দিন ফুরাইয়া আসিল।
পশ্চিম গগন অস্তগামী সূর্যের রক্তিম প্রভায় রঞ্জিত হইয়া উঠিল। মহিলাটি সেদিকে চাহিয়া সহসা শিহরিত হইয়া উঠিলেন। ভাবিলেন - এ কি! মানুষের এ নির্মম হানাহানির করুণ দৃশ্য কি অবশেষে আকাশের চোখেও রক্তাশ্রুর সঞ্চার করিয়াছে?
পাখীরা ধিরে ধীরে নীড়ে ফিরিয়া আসিল। ক্রমে গোধূলীর আলো রাতের অন্ধকারে মিলাইয়া গেল। আকাশের শামিয়ানার তলে হাজার হাজার তারার বাতি জ্বলিয়া উঠিল।
অকস্মাৎ অফিসারের বাসার সম্মুখে একদল লোক আসিয়া হাযির হইলঃ তাহাদের কাহারও হাতে লাঠি, কাহারও হাতে রামদা, কাহারও হাতে বা সড়কী। তাহারা বাসার মহিলাকে লক্ষ্য করিয়া গর্জন করিয়া উঠিল। বলিল, "হন্দু কয়টিকে আমাদের হাতে দিয়ে দিন - এক্ষুণি, নইলে ভাল হবে না, এ নিশ্চিত জানবেন। "
মহিলাটি পর্দানশীনঃ রাস্তাঘাটে কালে-কস্মিনে স্বামীর সহিত বাহির হইয়া থাকেন; কিন্তু এমন উত্তেজিত জনতার সামনে কখনও বাহির হন নাই।
আজ মহিলাটির সে পর্দার বাঁধন টুটিয়া গেল।
তিনি বাড়ীতে এক ছিলেন। মাথায় কাপড় দিয়া বাহিরে আসিলেন। ঘরের বাহিরের বারান্দায় দাঁড়াইয়া বলিলেনঃ
"ভাই সকল!"
উৎক্ষিপ্ত জনতা হুঙ্কার ছাড়িয়া উঠিল। বলিল, "সে মানুষগুলি কোথায়, আমরা তাই শুনতে চাই। "
"সেই কথাই আমি বলতে এসেছি।
"
"না, আমরা কোন কথা শুনতে আসি নাই ; আমরা মানুষ চাই। "
"কি করবেন সে মানুষগুলিকে দিয়ে?"
"আমাদের যা খুশি তাই করব---আপনার কাছে তার কৈফৎ দিতে আসি নাই। বলুন, তাদেরকে দিবেন কিনা। "
"না, দিব না। "
"কারণ? কারণ শুনতে পারি?"
"কারণ অতি সহজ---তারা আমার আশ্রিত---আমি তাদের দিব না।
"
"ইস! ভারী ধার্মিক হয়ে গেছেন তো!"
"ধার্মিক আমি নই---কিন্তু আমার ধর্মের খবর আমি কিছু রাখি। আমার ইসলাম বলে--- দুর্বলকে রক্ষা কর, জান দিয়ে হলেও আশ্রিতকে বাঁচাও। "
"শুনুন, ও-সব ধর্মের কাহিনী আমরা শুনতে চাই না। আমরা এখন চললাম। রাত বারোটায় ফের আসবো।
তখন ওদের চাই ; অকারণে নিজের মৃত্যু ডেকে আনবেন না। "
জনতা চলিয়া গেল। হিন্দু কয়েকজন এতক্ষণ ভিতর হইতে সমস্ত শুনিতেছিল। মহিলাটি অন্দরে যাওয়া মাত্র তাহাদের কয়েকজন তাঁহাকে ঘিরিয়া ধরিল, কাঁদিতে কাঁদিতে কহিল, "মা, আমাদের জন্য আপনি বিপদ ডেকে আনবেন না---খালি বাড়ী, ওরা আবার এলে কে আপনাকে রক্ষা করবে? আমাদেরকে ছেড়ে দিন। আমাদের প্রাণ যাক, আপনি বেঁচে থাকুন।
"
মহিলা উত্তরে বলিলেন, "না, না তা হয় না, তা হতে পারে না। এ আমার ঈমানের পরীক্ষা ; এ পরীক্ষায় যদি হেরে যাই, তার চেয়ে আমার পক্ষে মৃত্যুই শ্রেয়।
মহিলাটি বসিয়া ভাবিতে লাগিলেন। তাঁহার মনে হইল, "আচ্ছা ,ওদেরকে ঘরে রেখে আমার জীবন না হয় দিলাম, কিন্তু তাতে ওদের ফায়দা কি?" তিনি আবার ভাবিতে লাগিলেন।
তাহার পর তাঁহার বোরখাটা গায় দিয়া তিনি পাছ বাড়ীর পথে গোপনে বাহির হইয়া গেলেন এবং একজন পদস্থ অফিসারের নিকট যাইয়া তাঁহার সাহায্যে হিন্দু কয়েকজনকে অন্য কোন নিরাপদ স্থানে সরাইয়া ফেলিলেন।
কিছুক্ষণ পরেই জনতা ফিরিয়া আসিল ; চিৎকার করিয়া বলিল, "লোকগুলিকে এইবার বের করে দিন---নইলে ঘরে আগুন দিয়ে আপনাকেসহ সবাইকে পুড়িয়ে মারব। "
মহিলাটি আবার বাহিরে আসিলেন। বলিলেন,"হিন্দুগুলি এখানে নাই, তাদের আমিই সরিয়ে দিয়েছি। "
"খুন করব---আপনাকে খুন করব। " এক সঙ্গে অন্তত দশজনে গর্জন করিয়া উঠিল।
মহিলাটি কোথা হইতে কি শক্তি পাইলেন ; তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত না হইয়া পরম শান্ত কন্ঠে বলিলেন, "হ্যাঁ, ভাইসকল, আমাকে খুন কর---আমি হাযির ; তবু আশ্রিত, দুর্বল প্রতিবেশীকে খুন করেছ, এ বদনাম যেন তোমাদের না হয়। "
মহিলার সেই প্রশান্ত কন্ঠে কি ছিল, তাহার দুর্নিবার প্রভাবে জনতা মুহূর্ত মধ্যে নীরব হইল। তাহার পর তাহারা ধীরে ধীরে চলিয়া গেল।
কিন্তু মহিলাটির ভঙ্গুর দেহে এই ঘটনার আঘাত সহিল না। তিনি শয্যাগ্রহন করিলেন।
স্থানীয় চিকিৎসায় তাঁহার কোন উপকার না হওয়ায় তাঁহাকে উত্তর কলিকাতার একটি হাসপাতালে ভর্তি করিয়া দেওয়া হইল।
এই হাসপাতালের প্রবাস তাহাকে বেশী দিন সহিতে হইল না। একদা প্রভাতে তিনি পরম পথে যাত্রা করিলেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।