এডিট করুন
ইব্রাহীম খাঁর লেখা "ইতিকাহিনী" বইটা কিনি ক্লাস এইট বা নাইনে পড়ার সময়, পল্টন থেকে। পুরান বই, দাম ছিল পনের টাকা। কিন্তু এই বইটা আমার কাছে অমূল্য একটা বই। বইটা হাতে নিলেই চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে আসে। যতবার পড়ি ততবার কাদি।
আমার আবেগে সরাসরি আঘাত করে বলেই হয়তো এমন হয়। এ নিয়ে আমার কোন লজ্জা নেই।
ইতিকাহিনীর একটা গল্প সরাসরি তুলে দিলাম। এটা হয়তো অন্যায়, কিন্তু এ অন্যায়টুকু আমি করলাম।
""দুইটি মানুষ""
|| এক ||
১৯৪৬ সাল।
কলিকাতা। হিন্দু মুসলমানে তুমুল দাঙ্গা। সে দাঙ্গার প্রমত্ত আহবানে মানুষের ভিতরের সুপ্ত শয়তান অকস্মাৎ জাগিয়া উঠিয়াছে। কোনদিন কোন পরিচয় নাই, কোনকালে কলহের কোন কারণ ঘটে নাই, উভয়েই মানুষ, শুধু বাহিরের একটি চিহ্ন - একটি টুপি কিংবা একটি টিকি, কেবল ইহারই জন্য আজ একে অন্যের বুকে নির্মমভাবে ছুরি বসাইতেছে। অথবা হয়তো পরিচয় আছে, হয়তো গত দশ বছর যাবৎ ইহারা এক পথে চলে, এক বাজারে খরিদ করে, এক হোটেলে বসিয়া চা খায়, গল্প করে, হাসি তামাশায় মাতিয়া উঠে, সেই দীর্ঘ-পরিচিত অন্তরঙ্গ তাহারাই আজ সহসা শয়তানের ইশারায় একে অন্যের গলা কাটে, বাড়িতে আগুন দেয়, নিরপরাধ দুধের বাচ্চাকে পর্যন্ত মায়ের বুক হইতে ছিন্ন করিয়া আনিয়া স্পষ্ট দিবালোকে প্রকাশ্যে রাজপথে হত্যা করে।
রক্ত, ভষ্ম, মৃত্যু রাজধানীর পথে পথে হাহাকার করিয়া বেড়ায়।
একটি মধ্যবয়সী মুসলমান- মুখে দাড়ি, মাথায় টুপি, পরনে লুঙ্গি। কয়েকজন হিন্দু দিনের বেলায় তাহাকে রাস্তায় ধরিয়া বাড়ীতে আনিয়া লুকাইয়া রাখে, সন্ধার পর অন্ধকারে আত্মগোপন করিয়া তাহাকে এক মন্দিরে লইয়া যায়। পুরোহিতকে ডাকিয়া বলে, "ঠাকুর বলির জন্য এনেছি, তার ব্যাবস্থা করুন। "
ঠাকুর নীরবে বলির জীবকে দেখেন; তাহার পর স্থিরকন্ঠে আগন্তকদিগকে বলেনঃ " তোমরা বেশ করেছ; একটা শত্রু বিনাশও হবে; মা কালীর পূজাও হবে।
আচ্ছা, ভাই, তোমরা এখন ওকে রেখে যাও, নইলে কে তোমাদেরকে কোথা হতে দেখে ফেলবে। পাঁজিপুথি দেখে শুভলগ্নে আমি ওর যথাযোগ্য বলির ব্যবস্থা করে নিব। "
আগন্তুকরা তুষ্ট হইয়া চলিয়া গেল; বন্দী মন্দিরের এক কোণে বসিয়া কাঁপে আর মনে মনে 'আল্লাহ আল্লাহ' করে।
সময় যায়। রাত্রী গভীর হইতে গভীরতর হইয়া আসে।
মন্দির প্রাঙ্গণ হইতে একে একে পূজারীরা নিজ নিজ ঘরে যায়। পুরোহিত বাহিরে আসিয়া এদিক ওদিক লক্ষ্য করেন; দেখেন কোথাও কেহ নাই। তখন তিনি মুখ তুলিয়া আকাশের পানে চান - বিষ্ময়ে ভাবেন, এ কি! আজ তারাদের চোখে এত জল! তাঁহার আত্মা হাহাকার করিয়া উঠে; আর্তস্বরে জিজ্ঞাসা করেঃ "কেন? কেন? কেন?"
পুরোহিত বন্দীর আছে আসেন। বলেন, "এস প্রস্তুত হও। " বন্দী শিহরিয়া ওঠে; ভাবে, তার জীবনের চরম মুহূর্ত বুঝি উপস্থিত।
আভিভূতের মত পুরোহিতের সাথে সাথে চলে।
খানিক দূর আসিয়া মন্দিরের দেয়ালের একটা ভাঙ্গা অংশ দেখাইয়া পুরোহিত বলেন - "ওঠ, ঐখান দিয়ে পালিয়ে যাও। " বন্দী পুরোহিতের দিকে অপার বিস্ময়ে চায় - তাহার চোখ ছলছলিয়ে ওঠে; বলে "অনেক উঁচু যে!" পুরোহিত বলেন, "আমার কাঁধে পা দিয়ে ওঠ। " বন্দী ইতস্তত করে। পুরোহিত আদেশের সুরে বলেন- "জলদি কর, ভাই, এক মুহূর্তও আর দেরী করতে পারবে না।
"
বন্দী পুরোহিতের কাঁধে চড়ে; তাহার ভারে পুরোহিতের ক্ষীণ দেহ কাঁপে; কিন্তু তাহার বুকে উৎসারিত হইয়া উঠে অমানুষিক বল; তিনি ঠিক দাড়াইয়া থাকেন।
কিন্তু হায়! ইহাতেও যে দেয়ালের ফাটল নাগালের বাহিরেই থাকিয়া যায়। পুরোহিত ভাবেন, তবে কি ব্রাহ্মণের এই তপস্যা আজ ব্যর্থ হইবে?
সহসা পুরোহিতের নজরে পড়ে মন্দিরের কালী-মূর্তি। তিনি তাহাই টানিয়া আনিয়া দেয়ালে হেলান দিয়া দাঁড় করান ; বন্দীকে বলেন, " মূর্তি আমার চেয়ে উঁচু, এরই মাথায় পা দিয়ে পালিয়া যাও। "
"কিন্তু এ যে তোমাদের দেবতার মূর্তি!" - বন্দী বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করে।
"আমি মরব, তবু তোমার দেবতার মাথায় পা দিতে পারব না" - বন্দী কাঁদিয়া ফেলে।
ঠাকুর চাপা কন্ঠে বলেন, " হ্যাঁ , এ সত্যি আমার দেবতার মূর্তি। কিন্তু ভাই, ছোটবেলায় মা কখনো তোমাকে কোলে কাখেঁ মাথায় তোলে নাই? আজ যদি মা কালী তা না পারেন তবে তিনি কিসের মা?"
বন্দী পুরোহিতকে জড়াইয়া ধরে। পুরোহিত বন্দীকে বুকে জড়াইয়া ধরেন ; উভয়ের বুক ভাসিয়া যায়। এক দেশের সন্তান - এক স্রষ্টার সৃষ্টি।
খস- খস--ধপ--বাহিরে শব্দ হয়। বন্দী ফাটল-পথে ওপাশে নামিয়া চলিয়া যায়।
পুরোহিত আসিয়া মন্দিরের দুয়ার খোলেনঃ বাহির হইতে স্নিগ্ধ হাওয়া ভাসিয়া আসে; তাহার দেহ মন জড়াইয়া যায়। তিনি মুখ তুলিয়া আকাশের পানে চান ; দেখেন, তারাদের চোখে তৃপ্তির হাসি।
পুরোহিত মন্দিরের দুয়ারে অর্গল দিয়া ভিতরে আসেন।
চোখে পড়ে সেদিনের স্তুপীকৃত ফুল। তাহার মনে হয় সমস্ত ফুল মিলিয়া হইয়াছে একটা বিরাট সুন্দর তোড়া ; সেই তোড়া উৎসর্গীকৃত বিশ্ববিধাতার উদ্দেশ্যে আর তোড়ার ফুলের প্রতি দলের বুকে জাগিয়া উঠিয়াছে নিশীথের সেই মুক্ত বন্দীর স্মিত মুখচ্ছবি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।