ইচ্ছেমতো লেখার স্বাধীন খাতা....
পরদিন আবার সময় মতো গাড়িতে চড়ে বসলাম। পৌঁছানোর পরে রেস্টুরেন্টের লোকজন আমাকে প্রথমেই লেবু কাটতে বললো। বিভিন্ন পানীয়ের সাথে লেবু দিতে হয়। লেবু কাটার মধ্যেও অনেক কিছু শেখার আছে। নিজের ইচ্ছেমতো কাটলে হবে না।
প্রতিদিন তারা যেই আকারে কাটে ঠিক সেই আকারে কাটতে হবে। রেস্টুরেন্টের মালিক আমাকে এগুলো শেখাতে লাগলো।
এর মধ্যে নতুন এক সমস্যা দেখা দিলো। গতকাল যেসব পানিয়ের নাম শুনেছিলাম সেগুলো আজকে অনেকখানি ভুলে গেছিলাম। কয়েকশ অপরিচিত বোতলের নাম একবার শুনেই মনে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব না।
কর্মচারীরা এগুলো নিয়ে আমাকে কথা শোনাতে লাগলো। বাধ্য হয়ে তাদের জানালাম যে, আমার স্মৃতিশক্তি খুব খারাপ। এজন্যই এই অবস্থা।
এ রেস্টুরেন্টটি মোটামুটি একটা অভিজাত এলাকায় অবস্থিত হওয়ায় এখানকার কাস্টমাররা সবাই মোটামুটি ধনী বৃটিশ। এশিয়ান বা অন্য কোনো জাতির মানুষ এখানে খুব কমই দেখা যায়।
বৃটিশরা খাওয়াদাওয়ার পরে বিলের পাশাপাশি বেশ মোটা অঙ্কের একটা টিপস বা বখশিস দেয়। কিন্তু সে টিপসগুলো কোনো কর্মচারীর হাতে দেয়া হলেও তা কর্মচারীরা তা নিতে পারে না। কোনো ওয়েটারকে টিপস দিলেই তা ওয়েটাররা ক্যাশ কাউন্টারে নিয়ে আসে। মালিক সব সময় দূর থেকে টিপসের উপর নজর রাখে। একটা বাক্সের মধ্যে সবগুলো টিপস জমা করা হয়।
মালিক রাতে সেগুলো গুনে হিসাবে তুলে রাখে। ওই বখশিসের টাকা দিয়েই অধিকাংশ ক্ষেত্রে কর্মচারীদের বেতন হয়ে যায়।
ওয়েটাররা অর্ডার নেয় দুটো স্লিপে। একটা ড্রিংক্সের জন্য অন্যটা খাবারের জন্য। কাস্টমার আসলে ওয়েটাররা তাদের কাছে গিয়ে প্রথমেই জিজ্ঞাসা করে, "কি কি ড্রিংক্স খাবেন?" সেগুলো ড্রিংক্সের জন্য আলাদা স্লিপে লেখা হয়।
এর পর খাবারের মূল তিনটা ভাগে (স্টার্টার, মেইন কোর্স, ডেজার্ট) খাবার অর্ডার অন্য স্লিপে নেয়া হয়। ড্রিংক্সের অর্ডার নেয়ার পর তারা সেটা কোনো রকমে বারে ফেলে রেখে কিচেনে চলে যায়। বারে আমার কাজ হলো সেই স্লিপ দেখে দেখে একটা ট্রেতে ড্রিংক্সগুলো সাজানো।
স্লিপগুলোতে তারা খুবই সংক্ষিপ্তাকারে ড্রিংক্সগুলোর নাম লিখে রাখে। যেমন,
PTL -1
DWW – 2
HEN - 3
আমার মতো নতুন মানুষের পক্ষে এমন সাঙ্কেতিক ভাষা পড়া অসম্ভব ব্যাপার ছিল।
পরে আস্তে আস্তে শিখতে শুরু করলাম PTL মানে পাইন্ট অফ লাগার (বড় গ্লাসগুলোতে ভর্তি করে লাগার নামের পানীয় দিতে হবে), DWW মানে ড্রাই হোয়াইট ওয়াইন, আবার HEN কিন্তু কোনো অদ্যাক্ষর ভিত্তিক নয়। ওল্ড স্পার্কল হেন নামে একটা বিয়ার আছে। সেটাকেই সংক্ষিপ্তাকারে HEN লিখে তারা। এগুলোর পাশে লেখা নাম্বারটা হচ্ছে এগুলোর গ্লাস সংখ্যা।
এখানে বেশ কয়েক ধরনের চা ও কফি বানানো হয়।
সাধারণ চায়ের পাশাপাশি আছে মাসলা টি। এ চায়ে কয়েক ধরনের মসলা দেয়া হয়। চা বা কফির ডেকোরেশনটা এখানে বেশ নজর কাড়া। প্রতি কাপ চা বা কফির সাথে একটা করে চকলেট, তিন কোনা করে ভাজ করা টিসু পেপার ইত্যাদি দেয়া হয়। এছাড়া দুধ, চিনি চামচ ইত্যাদিরও নির্দিষ্ট মাপ আছে।
মালিক ও হেড ওয়েটার প্রতিনিয়ত এগুলোর মনিটরিং করে।
কফি বানানো হয় বহু ধরনের। ফ্লোটা কফি সবচেয়ে আকর্ষণীয় মনে হলো। এ কফিতে দুটো লেয়ার থাকে। প্রথমে একটা বড় কাপে অর্ধেক পরিমাণ কফি বেশী করে চিনি দিয়ে নাড়তে হবে।
তারপর একটা কৌটায় মিল্ক ক্রিম নিয়ে তা ঝাকিয়ে ফেনা বানাতে হবে। কফির উপর দিয়ে সেই মিল্ক ক্রিম আস্তে আস্তে এমনভাবে ঢালতে হবে যেন তা আলাদা লেয়ার হয়ে থাকে। শায়খ ভাই এসে আমাকে বেশ যত্ন করে এ কফি বানানোর নিয়ম শিখিয়ে দিল। বেশ কয়েক কাপ ফ্লোটা কফি বানালাম। এক কাপ ফ্লোটা কফি কাস্টমার খাবার পরে ফেরত আসার সময় দেখি কফির পিরিচে কয়েক পাউন্ড বখশিস রাখা।
বুঝলাম ফ্লোটা কফি বানানোতে নিশ্চয়ই দক্ষতা অর্জন করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় বখশিসগুলো আমার নেয়ার কোনো উপায় নেই। টিপসের জন্য নির্ধারিত বক্সেই সেগুলোর জায়গা হলো।
এদিন রেস্টুরেন্টে ভিড় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন জিনিস লেখা স্লিপ পেতে থাকলাম। এমনও স্লিপ আসলো যেগুলোর কোনো কিছুই আমি আগে দেখিনি।
এ কারণে স্লিপ নিয়ে ওয়েটারদের কাছে দৌড়াতে লাগলাম। এটা কি, ওটা কি ইত্যাদি। ওয়েটাররা যে কথাগুলো খুব সহজে বলে দিলেই আমি শিখে নিতে পারি। কিন্তু তারা কখনোই ব্যাপাটা সহজে বলে না। শায়খ ভাই ও সুজা ভাই এর মধ্যে ব্যতিক্রম।
তাই তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করে করে অর্ডার দেয়া শুরু করলাম। কিন্তু ভিড় বাড়ার সাথে সাথে তাদের দুজনকে পাওয়া কঠিন হয়ে গিয়েছিলো। কাউকে না পাওয়া গেলে হেড ওয়েটার ও মালিকের কাছে জিজ্ঞাসা করা লাগছিলো। এর মধ্যে মালিক আবার আমার কাছে ওয়েটারদের চেয়ে একটু বেশী নৃশংস হয়ে ধরা দিলো। সে আমাকে কোনোটাই বলে না।
প্রতিটা অর্ডারের জন্য সে আমাকে বলে নিজে খুজে বের করতে। ভুল হলে হোক। আমি তার কথায় পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে যাই। ফ্রিজ, শেলফ ইত্যাদির দিকে তাকিয়ে হাজার হাজার বোতলের লেবেল খেকে একটা নির্দিষ্ট নাম খুজে বের করার চেষ্টা করতে করতে যখন হাবুডুবু খাওয়ার অবস্থা হয় তখন সে বোতলটার নামটা আমাকে দেখিয়ে দেয়। এতে কাজ শিখা সহজ হয়ে আসলেও কয়েক মিনিটের মানসিক চাপটাও কম নয়।
তার পরেও সব মিলিয়ে বেশ কয়েকটা পানীয়ের সংক্ষিপ্ত সংক্ষিপ্ত নাম শিখলাম। এগুলোর মধ্যে RW = Red Wine, MW = Medium Wine, OJ = Orange Juice, SPW = Sparkle Water/ Spring Water, SW = Soda Water ইত্যাদি।
অন্যদিকে হেড ওয়েটারকে কয়েকটা জিনিস জিজ্ঞাসা করেছিলাম তাই সে আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা শুরু করলো। এদিনের ভিড়ের সময় ক্রমাগত এসব মানসিক অত্যাচারে আমি জর্জরিত হয়ে গেলাম।
এ রেস্টুরেন্টে কোনো কাস্টমার যদি পানি চায় তাহলে তাকে খালি গ্লাসে পানি দেয়া হয় না।
গ্লাসের উপরে এক টুকরো লাইম, এক টুকরো লেমন ও কয়েক টুকরো বরফ দিয়ে তারপর পরিবেশন করা হয়। এগুলো সাজানোর ঝামেলাও কম না।
রাত সাড়ে এগারোটার দিকে রেস্টুরেন্ট ক্লোজিংয়ের (বন্ধ করার প্রক্রিয়া) কাজ শুরু করা হলো। দৈনন্দিন কাজের চেয়ে ক্লোজিংয়ের ঝামেলা আরো বেশী। কারণ বহু গ্লাস নতুন করে ধোয়া লাগে, কয়েকটা সেল্ফ সহ সম্পূর্ণ বার পরিষ্কার করা লাগে এরপর কয়েকটা বালতি, বোতল আনা নেয়ার কাজে ব্যবহৃত ট্রে সবকিছুই নতুন করে গরম পানিতে ধুয়ে আবার শুকনো কাপড় দিয়ে মুছে রাখা লাগে।
এভাবে প্রতি রাতে ভালোভাবে ধোয়ার পরে মুছে রাখার ফলে জিনিসগুলো বছরের পর বছর নতুনের মতো ঝকঝকে থাকে।
সবকিছু শেষ করে মনে হলো যেন একটা যুদ্ধ শেষ করলাম। কর্মচারীদের মানসিক অত্যাচারে মন মেজাজ খারাপ ছিল। অবশ্য রাতেই কাজ শেষ হওয়া মাত্র বেতনের পঞ্চাশ পাউন্ড হাতে পাওয়ার পরে মনটা আবার কিছুটা ভালো হলো।
রাতে গাড়িতে করে নামিয়ে দেয়ার সময় মালিক জানালো, আগামী সপ্তাহের কাজ শুরুর আগেই যেন ধবধবে সাদা রঙের একটা শার্ট কিনে নেই।
আগামী সপ্তাহ থেকে সাদা শার্ট, টাই ও কালো প্যান্ট পড়ে কাজে আসতে হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।