অতীত খুড়ি, খুঁজে ফিরি স্বজাতির গুলিবিদ্ধ করোটি
চলে গেলেন আমাদের আরেক পরম সুহৃদ সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি । দুভাই সাবেক প্রেসিডেন্ট জনএফ কেনেডি ও সিনেটর রবার্ট কেনেডির মতো অপঘাতে নয়। ব্রেন টিউমারে ভুগে গত ২৫ আগস্ট মারা গেছেন টেড নামেই বেশী পরিচিত এই মার্কিনী। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতে বাঙালী শরণার্থী শিবিরগুলোতে ঘুরে ঘুরে পূর্ব পাকিস্তানে বিভীষিকার সত্যিকার ছবিটি তুলে ধরেছিলেন তিনি । পাকিস্তান তাকে ভিসা দেয়নি।
শরণার্থীদের মুখেই শুনেছেন তাদের ওপর নির্দয় অত্যাচারের কথা। কথা বলেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। দেশে ফিরে দায়িত্ব নিয়েই বলেছেন : পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চলছে ।
মুক্তিযুদ্ধে আমাদের প্রবল প্রতিপক্ষ শুধু পাকিস্তান সেনাবাহিনীই ছিলো না। তাদের ওপর ছায়া হয়ে ছিলো মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও তার মন্ত্রদাতা হেনরী কিসিঞ্জার।
সাধারণ মার্কিনীদের সকল প্রতিবাদকে পায়ে দলে তারা পক্ষপাত করেছিলেন পাকজান্তা ইয়াহিয়া খানের। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে তা দ্য টিল্ট নামে কুখ্যাত। আর তার প্রমাণ ২৮ এপ্রিলের এক গোপন দলিলে নিক্সনের সেই কালো সই- যাতে স্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ইয়াহিয়াকে যে কোনো মূল্যে সহায়তার।
এই সহায়তার নানা চিত্রই আমরা দেখেছি। জাহাজ বোঝাই অস্ত্র এসেছে বাঙালীকে রক্তে রাঙাতে।
এসেছে কোটি ডলারের আর্থিক সহায়তা। এসেছে সাহায্য-সেবা ও তার দেখভালের নামে গুপ্তচরের দল। আমাদের আজকের কাহিনী এদের নিয়েই। মার্কিন প্রশাসন যন্ত্রের অন্যতম এক অস্ত্র সিআইএর এক ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা যা ফাঁস করে দিয়েছিলেন টেড কেনেডি।
জুনের মাঝামাঝি পাকিস্তানের মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস ফারল্যান্ড একটি বিশেষ সুপারিশনামা পাঠান দেশে।
২৫ জুন, ১৯৭১ পাঠানো সেই তারবার্তাটিতে (টিল্ট ডকুমেন্টে স্থান পায়নি এটি, বলতে পারেন হঠাৎ আবিষ্কার সিআইএ দলিলপত্র ঘেটে) ফারল্যান্ড পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশ বাহিনীর দুর্দশার বর্ণনা দিয়েছেন। সেই বর্ণনা তিনি শুনেছেন পূর্ব পাকিস্তানে পুলিশের ইন্সপেক্টর অব জেনারেল এম এ কে চৌধুরীর কাছে। নানা কথাবার্তার শেষভাগেই টেলিগ্রামে ফারল্যান্ডের ভয়ঙ্কর সেই সুপারিশ, যার কাছাকাছি বাংলাটা : পুলিশের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাটা দুতাবাস এবং ঢাকা কনসুলেটের জন্য ভালোই হবে। তবে ঠিক কি পর্যায়ে সেটা বজায় সম্ভব হবে তা অনিশ্চিত। আর তা বের করার সেরা উপায় হতে পারে সাময়িকভাবে হলেও আমাদের নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাকসনকে পূর্ব পাকিস্তানে ফেরত আনা।
তার দায়িত্ব হবে আগের যোগাযোগ পুনঃস্থাপনের চেষ্টা এবং পরবর্তী ৯০ দিনের সম্ভাব্য কর্মসূচীর মূল্যায়ন। পুরো ব্যাপারটা খুব গোপনে করা সম্ভব বলে মনে হয় কারণ বিষয়টা স্পর্শকাতর যা পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের জন্য বিব্রতকর হয়ে দাঁড়াতে পারে।
কে এই জ্যাকসন? কোথায় ছিলেন তিনি? কেনো তাকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছিলো? জবাবের জন্য আরেকটু অপেক্ষায় রাখি পাঠকদের। তবে উপাত্তের ভিত্তিতে এক জ্যাকসনের উপস্থিতি ছিলো ঢাকা দুতাবাস অফিসে। পাকিস্তানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষপাত মূলক আচরণে ঘৃণা জানিয়ে কনসাল জেনারেল আর্চার ব্লাডের নেতৃত্বে ঐতিহাসিক ডিসেন্ট টেলিগ্রামে সাক্ষর করেছিলেন যারা , তাদের মধ্যে রবার্ট জ্যাকসন নামটাও ছিলো।
তবে তার পদবীর কোন উল্লেখ সেখানে ছিলো না। সেই ঘটনার পর আর্চার ব্লাডকে প্রত্যাহার করে নেয় নিক্সন প্রশাসন। একই ভাগ্য বরণ করতে হয়েছিলো সাক্ষরকারী বাকীদেরও।
জ্যাকসনের সত্যিকার পরিচয় পরিষ্কার হয়েছে আরো পরে। তবে তার আগে একই উৎসে ফারল্যান্ডের টেলিগ্রামের একটি ফলোআপ পাওয়া গেছে।
এক্ষেত্রে এমএকে চৌধুরীর সঙ্গে কথাবার্তা বলেছেন ঢাকা দুতাবাসের নতুন কর্মকর্তা। ২৩ জুলাই পাঠানো কার্ল নামে সাক্ষরিত এই তারবার্তায় পুলিশের অবস্থা আরো উন্নত হয়েছে বলে জানা যায়। প্রচুর বিস্ফোরকসহ একজন মুক্তিযোদ্ধা গ্রেফতারের সংবাদও রয়েছে। আর শেষ লাইনে রয়েছে আইজির আশাবাদ : তিনি আশা করছেন শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সহযোগিতার পুরানো সম্পর্কটা আবার চালু হবে।
ফারল্যান্ডের সুপারিশ কতখানি গৃহীত হয়েছিলো বা সে অনুযায়ী কি পদক্ষেপ নিচ্ছিলো তার কোনো দলিল মেলেনি।
তবে যা মিলেছে তাকে বোমা বললেও কম বলা হয় যা ফাটিয়েছিলেন টেড কেনেডি। ২৩ জুলাই নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে গোপন দলিলপত্রের দোহাই দিয়ে কেনেডির বরাতে বলা হয়: যুক্তরাষ্ট্র সরকার পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্রোহ দমনে পাকিস্তানকে সাহায্য করার জন্য পুলিশ বিশেষজ্ঞ রবার্ট জ্যাকসনকে ঢাকায় পাঠানোর পরিকল্পনা করছে। জ্যাকসনকে ২৫ মার্চের গোলযোগের পর প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। কাউন্টার ইনসার্জেন্সিতে বিশেষজ্ঞ জ্যাকসন ঢাকায় দায়িত্ব নেওয়ার আগে ভিয়েতনাম ও ব্রাজিলে কর্মরত ছিলেন। এনিয়ে বিব্রত সরকারী কর্মকর্তাদের পাশাপাশি গোয়েন্দা বিভাগে অস্বীকার করা হয় যে পূর্ব পাকিস্তানে মার্কিন পুলিশ টিম পাঠানোর কোনো পরিকল্পনা হয়েছে।
তবে এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের ডিরেক্টর অব সাউথ এশিয়ান অপারেশনস জন রীস স্বীকার করেছেন যে রবার্ট জ্যাকসনকে ঢাকা পাঠানোর আবেদন করা হয়েছিলো।
ঘটনার সত্যতা মিলেছে অন্য সূত্রেও। ৮ আগস্ট লন্ডন অবজারভারে তাদের মস্কো প্রতিনিধির বরাতে বেরোয় একই খবর : Moscow has been even more disturbed than Delhi by reports reaching here that Washington has assigned to Dacca, a Mr. Robert Jackson, a counter-insurgency-expert with wide experience in Vietnam. This suggests to Moscow that Washington is now heading towards the Vietnamisation of East Bengal conflict. Whether or not Mr. Jackson will be anymore successful in East Bengal than in Vietnam, Moscow believes this move foreshadows a prolonged conflict in East Bengal in which China might be tempted to join America in playing a bigger physical role.
নিরাপত্তা উপদেষ্টা নামের নিরীহ পদবীর আড়ালে কাউন্টার ইনসারজেন্সি এক্সপার্টদের দায়িত্ব আসলে ভয়ঙ্কর। এর একটা উদাহরণ হতে পারে ইন্দোনেশিয়া । পিকেআই (ইন্দোনেশিয়ার কম্যুনিস্ট পার্টি) যাদের নামের তালিকা তৈরি করে তাদের অবস্থানসহ নির্মূল করার পুরো নকশাটাই সিআইএ করে দিয়েছিলো।
কিভাবে অত্যাচার ও জেরা করে পুরো দলের নাম ও অবস্থান জানা যাবে এ ব্যাপারে ভীষণ দক্ষ ছিলো তারা। গেরিলা দমনের নামে চরম নৃশংসতা। ভিয়েতনাম , ব্রাজিল সবখানেই ছিলো একই কাহিনী। জ্যাকসন ঢাকায় দায়িত্ব সূচারুরূপে পালন করলে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের বরাতেও জুটতো একই নৃশংসতা। আর তাতে লাশের সংখ্যাটা হয়তো বাড়তো আরো।
যুদ্ধ হতো আরো প্রলম্বিত, কারণ পুলিশের পর নিশ্চিতভাবেই মার্কিন সেনারাও আসতো। অবশ্য সবই নেহাতই সম্ভাবনা যা ঠেকিয়েছিলেন সিনেটর কেনেডি। তবে ভারতীয় এক সাবেক সেনাকর্মকর্তা ক্যাপ্টেন এস কে গার্গ তার স্পটলাইট: ফ্রিডম ফাইটার্স অব বাংলাদেশ বইয়ে উল্লেখ করেছেন জ্যাকসনের। বুচার বা কসাই বিশেষণ করে তার পরিচিতি দেওয়া হয়েছে একজন সাবেক ইউএসএইড অফিসিয়াল হিসেবে। এবং ২৫ মার্চের গণহত্যার রাতে নিহত বুদ্ধিজীবিদের নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনাটাও তার মাথা থেকেই বেরিয়েছিল বলে লিখেছেন তিনি :
টেড কেনেডি কিভাবে এসব ডকুমেন্ট হাতে পেয়েছিলেন সেটা এক অন্য গল্প।
নিক্সন প্রশাসনের জন্য রাহু হয়েই এসেছিলেন সাংবাদিক জ্যাক এন্ডারসন । তবে কেনেডি মিডিয়াতে ব্যাপারটা ফাঁস করে দেওয়ার পর সেই একই প্রতিবেদন লেখা হয়েছিলো পরিকল্পনাটি অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার লক্ষ্যেই পাবলিক রেকর্ডে কেনেডি এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।
কতভাবেই আমরা কেনেডির কাছে কৃতজ্ঞ। তবে মার্কিন জনমত আদায়ে সহায়তার পাশাপাশি এই খুনে নীলনকশা ঠেকানোর জন্যও স্যালূট তাকে।
কৃতজ্ঞতা : সুশান্ত দাস গুপ্ত (অনেকগুলো কপিরাইটেড আইটেম তার সহায়তায় কেনা হয়েছে)
সূত্র : নিউইয়র্ক টাইমস
লন্ডন অবজারভার
সিআইএ দলিলপত্র
মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি (১৯৬৯-৭৬) দলিলপত্র
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।