পরাজিত হতে হতে আমি উঠে দাড়িয়েছি এবার ফিরে যাবো না খালি হাতে, স্তব্ধতা আর সৌন্দর্যের পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই যে কবি সে কখনো খালি হাতে ফিরে যেতে পারে না ।
বিশ শতকের শুরুর দিকে মাহে রমজানে ঢাকার চিত্র কেমন ছিল ? কিভাবে পালন করা হতো ইফতার ও সাহরি ? এ নিয়ে লিখেছিলাম দশ বছর আগে ১২ জানু ১৯৯৯ তারিখে দিনকালে । এটি ২৯ অক্টোবর ২০০৪ তারিখে আমারদেশে পুনঃপ্রকাশিত হয় । নিচে লেখাটি শেয়ার করলাম ।
দীর্ঘকালের পরিক্রমায় ঢাকার অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে ।
সেকালে যেভাবে রোজা পালন করা হতো, একালে সেভাবে পালন করা হয়না । তবে ইফতারীর দিক দিয়ে প্রাচীন চকবাজারের ঐতিহ্য কিছুটা হলেও আজও আছে ।
সেকালে ঢাকায় প্রত্যেক জায়গায় শবে বরাতের পরই পবিত্র রমজানের আগমন হয়েছে বলে ধরা হতো । এ সময় মসজিদে মসজিদে পরিষ্কার পরিছন্নতা , চুনকাম, ধনীদের বাড়িতে রাজমিস্ত্রী এবং মজুরদের আসা দেখে বুঝে নেয়া হতো যে পবিত্র রমজান আসন্ন । অন্যদিকে যাদের তেমন সামর্থ্য ছিল না অর্থাৎ গরীব মানুষেরা পরিষ্কার মাটি দিয়ে ঘর -দুয়ার মুচে সুন্দর করে নিতো ।
কলসি , বাটি, গ্লাস পরিষ্কার করা হতো এবং রমজান উপলক্ষে কেনা হতে নতুন ঘড়া, মাটির তৈরি হুক্কা, নতুন নৈচা ইত্যাদি । এ সময় বালির তৈরি নতুন সুরাই এবং ছোলা কিনে রাখা হতো ।
পহেলা রমজানে অংকুরিত মুগ খাবার জন্য সাতাশে শাবানে নতুন হাড়িতে ভিজিয়ে রাখা হতো । ছেলেদের গোসল করানো হতো খৈল , সাজিমাটি এবং বেসন দিয়ে । এরপর প্রস্তুতি নেয়া হতো চাঁদ দেখার ।
পুরনো ঢাকার বড় কাটরা , ছোট কাটরা , হোসনী দালান, আহসান মঞ্জিলের মত উচু দালানে মুসল্লিরা উঠে চাঁদ দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতো । এছাড়া কিছু কিছু যুবক বুড়ুগঙ্গার মাঝখানে নৌকায় করে
চাঁদ দেখার চেষ্টা করতো ।
ঢাকাবাসীরা সেহেরীর জন্য কোর্মা এবং দুধের পায়েস বেশি পছন্দ করতো । সেহরীর জন্য খাবারের আইটেম কম থাকতো । সাধারণতঃ যে খাবার সন্ধ্যায় ভালো মনে হতো সেটায় সেহেরীর জন্য রেখে দেয়া হতো ।
সেকালে পান বা সিগারেট খাওয়া অবস্থায় কোন মুসলমানকে রাস্তায় দেখা যেত না । পহেলা রমজানের সেহরীতে প্রায় প্রত্যেক বাড়ীতে অবশ্যই কোফতা রান্না হতো । এছাড়া কোন কোন বাড়ীতে কোর্মা কালিয়া রান্না হতো । ঢাকাবাসীদের এগুলো খুব পছন্দের খাবার ছিল ।
জোহরের নামাজের পর ভেজানো ছোলা বের করে তা’ থেকে ডাল বের করা হতো বা ইফতারের জন্য আস্ত রেখে দেয়া হতো ।
ইফতারের সময়
দস্তরখানায় ডাল বুট ফুলরী গরম গরম পরিবেশন করা হতো । ইফতারীতে প্রত্যেক বাড়ীতে মুড়ি অপরিহার্য ছিল । মুড়ি, পিয়াজ মরিচ ও তেল সহযোগে মেখে খাওয়া হতো । ভাল ভাল গৃহে ভাজা মুড়ি ,পনির , ভাজা মাখনার খই ইত্যাদি ইফতারীতে খাওয়া হতো । ইফতারের সময় দস্তরখানায় আবে জমজমের পানি রেখে প্রত্যেকে যেন একটু পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখা হতো ।
আজান শোনার পর শরবতের সাথে আবে জমজমের পানি মিশিয়ে রোজা খোলা হতো । এসব খাওয়া সওয়াবের বলে ধারণা করা হতো ।
সেকালে ঢাকায় রমজানের সময় অনেক প্রকার শরবত তৈরী হতো । এছাড়া অনেকে ফালুদা বেশ পছন্দ করতো । সে সময় বেদেনার শরবতও প্রচলিত ছিল ।
প্রায় সব ঘরেই এ সময় পেয়াজু, ফুলুরী, সমুচা, কাচা ও ভাজা ডাল, মুড়ি, কয়েক প্রকার মিষ্টি, ফল ইত্যাদি ইফতারীতে পরিবেশন করা হতো । এছাড়া বাজার থেকে আনা হতো ভুনা চিড়া, দোভাজা, গোলাপি উখরে ( খৈ জাতীয় মিষ্টি এক ধরণের খাবার ), টেপিখুসুরি, মাসকালাইয়ের বড় ডালবুটও আসতো ।
মাগরিবের নামাজের পর রোজাদাররা পুনরায় দস্তরখানায় এসে বসতেন । সেখানে সাদা বা পনির যুক্ত বাকরখানির উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য । এছাড়া অবশ্যই থাকতো পছন্দনীয় কাবাব ও মৌসুমের বিভিন্ন ফল ।
সে আমলে মাহে রমজান যে মাস বা মৌসুমে হোকনা না কেন প্রত্যেক রমজানে আখ পাওয়া যেত । এই আখ টুকরো টুকরো করে কেওড়া ও গোলাপ জল দ্বারা সুবাসিত করে খাওয়া হতো । এ মাসে হুক্কার বিশেষ বন্দোবস্ত করা হতো । ধনী লোকেরা এ সময়ের জন্য মাটির হুক্কা ব্যবহার করতেন । তারা ইফতারের শেষে মিঠাকড়া এবং সেহেরীর পর কড়া তামাক পান করতেন ।
চকবাজারে ইফতারীর জমজমাট দোকান বসতো । মনে হতো যেন ভাল একটা মেলা বসেছে । প্রতিদিন সেখানে প্রচুর লোকের সমাগম হতো । বিভিন্ন মহল্লার মসজিদে ধনীদের গৃহ হতে ইফতারী পাঠানো হতো । যারা ইফতারী প্রতিদিন মসজিদে পাঠাতে পারতেন না তারা সপ্তাহে বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার মসজিদে ইফতারী পাঠিয়ে রোজাদারদের ইফতার করাতেন ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।