http://joyodrath.blogspot.com/
সোয়াইন ফ্লু-এর জুজুবুড়ি অবশেষে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে লাশ গুনতে শুরু করেছে! এ পর্যন্ত গোটা চব্বিশজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে, যদিও ১২০ কোটি মানুষের দেশ ভারতে এটা কোনো সংখ্যাই নয়। সোয়াইন ফ্লু দিয়ে গোটা ভারতে আক্রান্ত হয়েছে হাজার খানেকের বেশি নয়। এরই মধ্যে পুনা বন্দরের রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে গেছে, মুম্বাইয়ের স্কুলগুলোতে ছুটি চলছে, অন্য অনেক শহরে স্কুল-কলেজ-শপিংমল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, এ বছর শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী উৎসব বাতিল ঘোষণা করেছে মুম্বাই কর্তৃপক্ষ, দিল্লির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় “সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং” অর্থাৎ একে অপরের থেকে যথাসম্ভব দূরে থাকার আহ্বান জানিয়েছে, গোয়া-র রাজ্য সরকার তার নাগরিকদের অত্যাবশ্যক কারণ ছাড়া অন্যান্য রাজ্যে ভ্রমণ না-করার পরামর্শ দিয়েছে, তামিল নাড়– এবং রাজস্থানের বাসিন্দাদের মহারাষ্ট্র থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছে স্থানীয় সরকারগুলো। সোয়াইন জুজুবুড়ির আতঙ্কে এ বছর ঘরে খিল লাগিয়েই স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করেছে ভারতবাসী।
এ হেন আতঙ্কের উৎস কি? যে দেশে প্রতিবছর মৌসুমী জ্বরজারিতে ৫০,০০০ মানুষের প্রাণহানি হয়, যক্ষ্মাসহ অন্যান্য পরিচিত অসুখবিসুখে যেখানে প্রতিদিন গড়ে একহাজার মানুষের মৃত্যু হয়, সেই ভারত কেন সোয়াইন ফ্লু নামক জুজুবুড়ির আতঙ্কে কাঁপতে শুরু করলো?
গার্ডিয়ানের সাইটে কপিল কমিরেড্ডি চমৎকার লিখেছেন এ নিয়ে।
তাঁর মতে, এই মহামারী যতটা না সোয়াইন ফ্লু নামক রোগের, তারচে অনেক বেশি সোয়াইন ফ্লু-আতঙ্কের। ফলত প্রাণনাশের চেয়ে দ্রুতগতিতে ঘটছে বুদ্ধিনাশ। আর অত্যন্ত দায়িত্বহীনভাবে এই বুদ্ধিবিনাশী আতঙ্কের প্রেক্ষাপট তৈরি করছে সংবাদমাধ্যমগুলো। এই ডামাডোল থেকে পুরোপুরি ফায়দা নিচ্ছে রকে (Roche) নামক সুইটজারল্যান্ড-ভিত্তিক বহুজাতিক অষুধ কোম্পানি। সোয়াইন ফ্লু-র অষুধ “টেমিফ্লু” ক্যাপসুল বিক্রি করে গত জুলাই মাসেই তারা এক বিলিয়ন ডলার কামিয়েছে বলে জানা যায়।
ভারত সরকার কিনেছে এক মিলিয়নের মত ক্যাপসুল, বাংলাদেশ সরকারের স্টকে আছে ২৪,৯০,০০০ এর মত, বিডিনিউজ-এর সংবাদ অনুযায়ী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী এ পর্যন্ত সোয়াইন ফ্লু বহনকারী ভাইরাস এইচ-ওয়ান এন-ওয়ান দিয়ে বিশ্বের ১৬১ টি দেশে মোট ১,৩৪,৫০৩ লোকের আক্রান্ত হবার খবর পাওয়া গেছে এবং এদের মধ্যে মারা গেছে মাত্র ৮৬১ জন। প্রতিটি মৃত্যুই বেদনার, উপেক্ষার নয়। তারপরও পরিসংখ্যান থেকে শিক্ষা নেয়ার আছে। সঙ্গত কারণেই সংস্থাটির একজন কর্তাব্যক্তি ড. জয় নারায়ন মনে করেন যে, রোগের বাস্তবতা আর রোগবিষয়ক আতঙ্কের বাস্তবতা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
সোয়াইন ফ্লু নামক রোগ যা ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রেই কোনোরকম অষুধপত্র ছাড়া ভালো হয়ে যায়, এতে যারা মারা গেছেন তাদের বেশিরভাগেরই অন্য অনেক রোগশোক ছিল বলে জানা গেছে, সেটা নিয়ে এই আতঙ্কের বিস্তারকে করপোরেট উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে সন্দেহ করার সঙ্গত কারণ আছে। জেনেরিক মালিকানা থাকায় রশে (Roche) কোম্পানি টেমিফ্লু বিক্রির ব্যবসা একচেটিয়া করছে, যদিও ভারতের অষুধ কোম্পানিগুলো এর বখরা পাবার জন্য সরকারকে লাইসেন্স কিনতে চাপ দিচ্ছে । আশা করা যায় বাংলাদেশও পিছিয়ে থাকবে না। কপিল অনুমান করছেন যে, অষুধ বানাতে বানাতে বা কিনে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই দেখা যাবে এই ভাইরাসের প্রতিরোধ তৈরি হয়ে গেছে মানব শরীরে। অথবা আমাদের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) এর মহাপরিচালক মাহমুদুর রহমান যেমন বলছেন: হয়তো সোয়াইন, বার্ড এবং হিউম্যান ফ্লু-র ভাইরাসের সংমিশ্রণে আরেকটা নতুন ধরনের ভাইরাসের আলামত হাজির হবে সমাজে।
ফায়দা নেবে অন্য কোনো রকে কোম্পানি!
এরই মধ্যে বাংলাদেশে ৩৭ জনের সোয়াইন ফ্লু সংক্রমণের খবর জানা গেছে। এদের প্রায় সবাই সুস্থ হয়ে উঠেছেন। সরকার নৌ, বিমান এবং স্থলবন্দরগুলোতে স্বাস্থ্যপরীক্ষার উদ্যোগ নিয়েছে। হাসপাতালগুলোতে আলাদা করে সোয়াইন ফ্লু রোগীদের জন্য বহির্বিভাগ খোলার আদেশ দেয়া হয়েছে। জুজুবুড়ি আসবে, তাই মঞ্চ তৈরি।
দক্ষিণ এশিয়ায় সোয়াইন ফ্লু-র বিস্তারের রাজনীতিটা একটু অন্যরকম। এক ভারতে যত লোকের বাস, দুই আমেরিকা মহাদেশেও এত লোক থাকে না। গোটা দুনিয়ার পাঁচভাগের একভাগ লোক থাকে দক্ষিণ এশিয়ায়, আয়তনে যেটা যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেক। এর প্রায় ৪০ কোটি মানুষের কাছে সভ্যতার কোনো সেবা-ই পৌঁছায় না। এই সংখ্যাটি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বমোট জনসংখ্যার অর্ধেক কিন্তু! সোয়াইন ফ্লু-র জুজুবুড়ি এবার এল এমন এক অঞ্চলে যেখানে প্রায় ১৬ কোটি মানুষ এখনো “দলিত” বা স্পর্শযোগ্য নয় (আনটাচেবল)।
সোশ্যাল ডিসট্যান্সিং ছোঁয়াছুঁয়ি বাঁচিয়ে চলা যেখানে একটা ঐতিহাসিক প্রপঞ্চ, যার বিরূদ্ধে সমাজের শুভশক্তি ক্রমাগত লড়াই করে একটা সহনীয় জায়গায় পৌঁছাতে চাইছে সেখানে সোয়াইন ফ্লু সমাজে আবার ছুৎমার্গীয়পনাকেই আমন্ত্রণ জানাবে। তবে, পরিহাস হল, যেসব দেশে এখনো ম্যালেরিয়া কিংবা যক্ষ্মার মত প্রায়-পৌরাণিক রোগব্যাধিতে হাজার হাজার গরিব মানুষ প্রতিবছর মারা যায়, সমাজের ক্ষুদ্র একটা অংশ যেখানে এক ধরনের শ্রেণী-বেষ্টনীর মাঝে নিজেদের সংক্রমণহীনতা নিশ্চিত করে, সেখানে সোয়াইন ফ্লু কিন্তু প্রাথমিকভাবে গরিবের রোগ হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার সমাজে আসে নি। এসেছে বিশ্বায়ন এবং মবিলিটির উপকারভোগীদের রোগ হয়ে। বেশিরভাগ রোগীদেরই আমরা পাচ্ছি এয়ারপোর্টে। স্কুল-কলেজ-সিনেমা হল-শপিংমল বন্ধ করে ঘরে খিল লাগিয়ে কিংবা সার্জারি মাস্ক পরে টেমিফ্লু সেবন করে আবার বিশ্বায়নের এই উপকারভোগীরা হয়ত এই ভাইরাসের নাগাল থেকে বাইরে থাকতে পারবে।
কিন্তু রাত পোহালেই যাদের রাস্তায় নামতে হয় তাদের কী হবে? হাঁক না দিলে যে হকারের ব্যবসা মাটি, সে কি সার্জারি মাস্ক পরে থাকবে? ঘরে খিল লাগিয়ে পেটের খিল কিভাবে খুলবে রিকশাঅলা?
বিশ্বায়নের উপকারভোগীরা এই রোগের বাহক হলেও শেষমেষ তার ধারক কিন্তু হবে গরিব “সোয়াইন”রাই। তাদের বর্ষপুরাতন রোগের তালিকায় আরেকটা নাম যুক্ত হবে মাত্র। করপোরেটের ব্যবসাও চলমান থাকবে। গরিব খদ্দের ছাড়া বহুজাতিক করপোরেটের ব্যবসা তো অচল! সবই ঠিক আছে। পরিকল্পনামাফিক ঘটছে।
কিন্তু আজ সকালে আমার আট বছর বয়সী সন্তান যখন ভয়ে নীল হয়ে টেলিফোনে আমাকে বলছে সোয়াইন ফ্লু হলে সে মারা যাবে কিনা, আমি তার মধ্যে এই অহেতু এবং অন্যায্য আতঙ্কের বিস্তার ঘটানোর জন্য কাকে দায়ী করবো? সোয়াইন ফ্লু-কে, নাকি এর বহনকারী ভাইরাস এইচ-ওয়ান এন-ওয়ানকে, নাকি এই ভাইরাসের আতঙ্কবাহী হুজুগে সংবাদমাধ্যমগুলোকে?
১৭ আগষ্ট ২০০৯ দৈনিক প্রথম আলো
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।