ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কেরানি সৃষ্টির তাগিদেই মূলত এ দেশে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন হয়। ক্রমবর্ধমান কেরানির চাহিদা পূরণের জন্য সুদূর বিলাত থেকে তাদের নিয়ে আসা ব্যয় এবং কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এর ফলেই এ দেশের কৃষক-মজুরের ছেলেদের কেরানি হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়ে যায়। কোম্পানির কেরানি হয়ে নিজের বাবাকে খুবই আনস্মার্ট, আনকুথ লাগে। বাপ-দাদার পেশার সাথে সাথে তাদের আচার-আচরণ, বোধ-বিশ্বাস সব কিছুর প্রতি অবজ্ঞা জন্মে।
সুচতুর ইংরেজ অত্যন্ত সচেতনভাবেই বাঙালি মুসলমানদের মনে এই হিনম্মন্যতার বীজটি ঢুকিয়ে দিয়েছিল।
ধীরে ধীরে এই হিনম্মন্যতা সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আবরণে বৃদ্ধি পেতে থাকে। মাঝখানে মার্কসবাদ ও লেনিনবাদ এটাকে একটা দার্শনিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দেয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অনেক কেরানি নিজের বাপকে বাসার চাকর বলে পরিচয় দিয়েছে। সেই একই ধারার মার্কসীয় তাত্ত্বিকের কাছে নিজের বাপ-দাদাকে আফিমখোর বলে মনে হতে থাকে।
কারণ ধর্ম হলো আফিমস্বরূপ।
‘আফিমখোর’ বাপদাদার পালিত কোনো আচার-অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া বা তার স্বার্থে দুয়েকটি কথা বলাকে এই গোাষ্ঠীটি পশ্চাৎপদতা বলে গণ্য করেন। কিন্তু অন্য আফিমখোরদের (অন্য ধর্মের) কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া বা তার স্বার্থে কথা বলতে পারলে প্রগতিশীল বলে পূলক অনুভব করেন। আগাছা তোলার নামে এরা প্রায়ই আমাদের বোধ-বিশ্বাসের মূল শেকড়টিই উপড়ে ফেলতে চায়।
১৯৭১ সালে মুসলিম লীগসহ সব ধর্মভিত্তিক দল পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান করায় এই মহলটির জন্য অবারিত সুযোগ সৃষ্টি হয়।
এর ফলে ধর্মের বিরোধিতাকে সহজেই রাজাকার বিরোধিতার আবরণে ঢেকে ফেলা সম্ভব হয়েছে। এ দেশে রাজাকার না থাকলে এরা কখনোই কুকুরের মাথায় টুপি পরাতে সাহস করত না। এরা মনে করে, শেখ মুজিব সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে মারাত্মক ভুল করেছেন। কিন্তু ভারতের দরকষাকষির স্বার্থে চিহ্নিত ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে ছেড়ে দিয়ে সঠিক কাজটি করেছেন।
শত শত বছর যুদ্ধবিগ্রহে কাটিয়ে ইউরোপের দেশগুলো এখন মিত্র সেজে সামনে অগ্রসর হচ্ছে।
এক কালের চরম শত্রু জাপান ও আমেরিকা সব ভুলে গিয়ে উন্নয়ন সহযোগী ও বন্ধু হয়ে পড়েছে। যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট পরস্পরিক ঘৃণা ও বিদ্বেষ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এরা বহন করছে না। এদের রাজনীতি আবর্তিত হয় জনগণের কোয়ালিটি অব লাইফ বা জীবন-মানের উন্নয়নের জন্য। ওদের সংস্কৃতি, ওদের সাহিত্য নিবেদিত সেই একই উদ্দেশ্যে। ওদের সামাজিক ঘৃণার কামানটিও তাক করা আছে দুর্নীতিবাজ, লুটেরা ও আইনের শাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া গণশত্রুদের বিরুদ্ধে।
আমাদের এখানে ‘নূরজাহান’ নাটক একবার শুরু হলে তা শেষ হতে চায় না। নূরজাহান যেভাবে এত বড় থুথুটি রাজাকারের মুখে নিক্ষেপ করে,তা দেখে বমি করে দেয় ভাত খেতে খেতে সিরিয়াল দেখা অনেক বাঙালি বধূ। সামাজিক ঘৃণার এক নম্বর কামানটি তাক করা রাজাকারদের পানে। তার মধ্যে আবার ফরিদপুরের নুরু রাজাকারেরা এই নিশানার বাইরে। শুধু তাক করা আছে একই ফরিদপুরের অন্য ঘরানার বাচ্চু রাজাকারদের পানে।
যিনি ছিলেন জেলার রাজাকার সর্দার তার নামাঙ্কিত রাস্তা দিয়ে বুক ফুলিয়ে হেঁটে যান ফরিদপুরবাসী। আর যিনি ছিলেন ইউনিয়নপর্যায়ের তার ফাঁসির আদেশ শুনে মিষ্টিমুখ করেন সেই একই ফরিদপুরবাসী। ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বদৌলতে সেই মিষ্টি খাওয়ার ধুম পড়ার দৃশ্য দেখেন বিশ্ববাসী।
রাজাকারদের প্রতি এদের ঘৃণার রঙটি বুঝতে নিচের ঘটনাটি আরেকটু সহায়ক হতে পারে। আমেরিকার অনেক নেতা এই দেশ সফর করেছেন।
অনেকের সফরের জন্য তীর্থের কাকের মতো আমরা বসে থাকি। তাদের কাউকে দেখে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের ১৯৭১ সনে আমেরিকার ভূমিকার কথা কখনোই স্মরণ হয়নি। কিন্তু আমেরিকান মুসলিম সম্প্রদায়ের এক নেতা বাংলাদেশ সফরে এলে তাদের সেই ভূমিকাটির কথা স্মরণ হয়ে যায়। যদিও ১৯৭১ সালে কিংবা তার সফরকালীন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন বা পলিসি মেকিং লেবেলে সেই নেতার যৎসামান্য ভূমিকাও ছিল না। তার পরেও একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক জোট এটা নিয়ে বেশ হইচই শুরু করেছিল।
ঘটনাগুলো যত মজাদারই হোক না কেন, এই মহলটি যখন কোনো বিষয় নিয়ে জিকির তোলে তখন তার বিরুদ্ধে কথা বলা সত্যিই দুরূহ ব্যাপার। কারণ যুক্তি নয়, এদের অস্ত্র হলো আবেগ। কেউ কেউ এদেরকে বলেছেন বুদ্ধিবৃত্তিক লাঠিয়াল। এদের অনেক কিছুই মর্মে উপলব্ধি করা যায়। কিন্তু মুখ ফুটে বলার সাহস কারো হয় না।
দজ্জাল শাশুড়িরা যেমন বলে, ‘বউমা, তোমাকে কিছু বলতে হবে না। যা বলার আমিই বলব। ’ একই কায়দায় এই সুশীলগণ জনগণের মুখ থেকে কথা টেনে নিয়ে নিজেরাই বলে দেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, গুম, হত্যা, টেন্ডারবাজি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি, কুইক রেন্টাল ইত্যাদি কোনো সমস্যাই নয়। এখন মনে হচ্ছে দেশের এক নম্বর সমস্যা যুদ্ধাপরাধী সমস্যা।
নতুন বউয়ের মতো বিভিন্ন কারণে দ্বিধাগ্রস্ত জনগণ মনের কথাটি আর প্রকাশ করতে পারে না।
কাজেই এই যুদ্ধাপরাধের বিচারটি হয়েছে মহাজোট সরকারের জন্য একটা সুমিষ্ট কাঁঠাল ফল। যাদের নাকের ডগার ওপর দিয়ে (জামায়াত) কিংবা শরীরের পাশ দিয়ে (বিএনপি) এই কাঁঠাল ফলটি টেনে নেয়া হবে কাঁটার গুঁতোয় সবাই ‘উহ আহ’ করবে। এই সুমিষ্ট ফলটির প্রতিটি অঙ্গই সরকারের কাজে লাগছে। এই বিচারটির জন্য কোনো আন্দোলন নিয়ে অগ্রসর হতে পারছে না বিরোধী দল।
যা করে তাই যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালের ষড়যন্ত্র বলে গণ্য হয়। অর্থাৎ সরকারের সব বালা-মুসিবতে রক্ষাকবচ হিসেবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে এই বিচারটি।
বর্তমান সরকারের সময় পুলিশ লীগ ও বিচারপতি লীগ নামে দু’টি নতুন শব্দ বাংলা অভিধানে যোগ হয়েছে। শাহবাগ স্কয়ার থেকে আরো একটি নতুন লীগ অর্থাৎ সুশীল লীগের অস্তিত্ব ও কর্মকাণ্ড স্পষ্ট হয়েছে। সরকারকে রক্ষা করতে সব লীগ যখন অপারগ হয়ে পড়েছে, তখন এগিয়ে এসেছে সুশীল লীগ।
আওয়ামী লীগ ও সুশীল লীগের সম্পর্কটি নাতি ও দাদীর সম্পর্কের ন্যায় মধুর। ছেলে বিয়ের জন্য পাগল কিন্তু লজ্জায় বলতে পারছে না। বিভিন্ন ইঙ্গিত দিয়ে বুঝালেও বাবা বিয়ের প্রয়োজনীয়তাটুকু বুঝতে চাচ্ছে না। নিজের ছেলে ও নাতির এই ক্লাইমেক্সে বাড়ির বুড়ি বেটি পুরোপুরি নিরপেক্ষ। তবে নিজের গরজেই বায়না ধরেছে নাতবউয়ের হাতের রান্না না হলে সকালের নাস্তাই তিনি আর খাবেন না।
এমনই দরদি দাদীর ভূমিকায় সর্বদা থাকে এই সুশীল লীগ। আর উৎসাহী ঘটক বরাবরের মতোই মিডিয়ার বড় অংশ। দেশবাসীকে অন্ধের মতো হাতি দেখায় এই মিডিয়া ঘটক। কাজেই হাতিটি খাম্বার মতো হবে নাকি কুলার মতো হবে, তা নির্ভর করে এই মিডিয়ার ইচ্ছার ওপর।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় ইস্যু হওয়ার কথা ছিল পদ্মা সেতু থেকে বিশ্বব্যাংকের লোন প্রত্যাহার।
কিন্তু জাফর ইকবাল, আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, প্রাণগোপাল দত্ত ও আনোয়ার হুসেনের নেতৃত্বাধীন সুশীল লীগ মিডিয়ার বদৌলতে পুরো দৃশ্যপট পাল্টে দিয়েছে। আজ পদ্মা সেতু থেকেও অনেক ওপরে উঠে গেছে জামায়াতের কিছুটা পেছনের সারির নেতা কাদের মোল্লা। এখন মনে হচ্ছে, এই ধরনের একটা রায় সরকারের জন্য কতই না দরকার ছিল।
তাহরির স্কয়ার ছিল একটা ফ্যাসিস্ট সরকার ও নির্যাতনকারী সিস্টেমের বিরুদ্ধে গণবিস্ফোরণ। বিশ্বের সবাই জানেন যে, তাহরির স্কয়ারের পেছনের মূল রাজনৈতিক শক্তিটি ছিল মুসলিম ব্রাদারহুড।
আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ সুশীল শ্রেণী মুসলিম ব্রাদারহুডের স্টাইল ও নামটি হুবহু কেন অনুকরণ করল, তা বিরাট এক প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। এটা কি নিজেদের অজ্ঞতা থেকে করেছেন, নাকি দেশবাসী ও বিশ্ববাসীকে অজ্ঞ ও উজবুক ভেবেছেন ?
একটা ফ্যাসিস্ট ও দুর্নীতিবাজ সরকারকে নতুন জীবনদানের উদ্দেশ্যে এই স্কয়ার তৈরির উদ্দেশ্যটি ঢেকে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। সরকারের উদ্দেশ্যের সাথে এই জমায়েতকারীদের উদ্দেশ্যে দাড়ি-কমাসহ মিলে গেছে। এই স্কয়ার থেকে কখনোই ১৯৫ জন মূল যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিটি উত্থিত হচ্ছে না। সরকারের মধ্যে যে কোলাবরেটররা রয়েছে তাদের বিচারের দাবিও করা হচেছ না।
হানিফকে বোতল নিক্ষেপ করে এবং কয়েকজন মন্ত্রীকে গালিগালাজ করেই এই ‘স্কয়ার’ আত্মতৃপ্তিতে ভুগছে যে তারা নিরপেক্ষ।
তাহরির স্কয়ারের জনগণ দাঁড়িয়েছিল যুদ্ধের একটি উত্তপ্ত মাঠে। যেকোনো সময় তাদের শরীরটি গুলি বা বোমার আঘাতে ঝাঁঝড়া হয়ে যেতে পারত। সেই তুলনায় শাহবাগ স্কয়ারের জনতা আছে সত্যিই এক শাহি বাগানে। সরকারের অনুকম্পাপ্রত্যাশী বিভিন্ন সংস্থা খাবার-দাবারও পাঠিয়েছে।
পিকনিক বা উৎসবের আমেজ সর্বত্র।
এই স্কয়ার থেকে সরকারবিরোধী ও ভিন্নমতাবলম্বী কিছু পত্রিকা ও টিভি সেন্টার বন্ধের হুমকি দেয়া হয়েছে। সরকারের ফ্যাসিস্ট নীতির সাথে এই জমায়েতকারীদের নীতিও তাই পুরোপুরি মিলে গেছে। এই সমাবেশ থেকে বিভিন্ন বক্তা যেসব বক্তব্য দিচ্ছেন এবং বিশেষ কিছু টিভি যেভাবে তা তুলে ধরেছে, তা স্পষ্টভাবে গৃহযুদ্ধের উসকানি। বিরোধী পক্ষের ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠানসহ সব কিছু দখলের হুমকি দেয়া হচ্ছে।
এ ধরনের সমাবেশ করার বা অবস্থান করার সক্ষমতা আছে কমপক্ষে আরো দু’টি রাজনৈতিক দলের। সেগুলো থেকে একই ধরনের পাল্টা হুমকি এলে দেশটি গৃহযুদ্ধ থেকে আর বেশি দূরে থাকবে না।
এ ব্যাপারে নীরব না থেকে জাতির বিবেকবান অংশের এগিয়ে আসা উচিত। এখন দরকার প্রকৃত সিভিল সোসাইটি বা নাগরিক সমাজের উত্থান। সিভিল সোসাইটির বাংলা অনুবাদ করা হয় সুশীলসমাজ।
এটি একটি ত্রুটিপূর্ণ বা মতলবি অনুবাদ। এর প্রকৃত অনুবাদ হওয়া উচিত নাগরিক সমাজ, যাতে সমাজের প্রতিটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব বজায় থাকে। এইভাবে নাগরিক সমাজের ব্যাপ্তিটি ছড়িয়ে দিতে পারলে এই সুশীলদের বুদ্ধিবৃত্তিক উৎপাত কমানো সম্ভব হবে। সে জন্য যে যেখানে আছি, সেখান থেকেই আওয়াজ তুলতে হবে। আপনার ছোট্ট আওয়াজটিকে কখনোই নগণ্য ভাববেন না।
তা না হলে এদের চিকন বুদ্ধির দায় বহন করতে হবে সমগ্র জাতি ও অনাগত সব প্রজন্মকে। - মিনার রশীদ, ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।