সাগর সরওয়ার
কর্ণেলকে আমি মনে রেখেছি-৪ লিপি চলে গিয়েছিল। আমার দিকে একবার কেবল তাকিয়ে ছিল অদ্ভুত চোখে। আমার জানা নেই সেই চোখের চাহনির মানে। পাহাড়ী দোকানের চা খেয়ে আমি আর মুস্তাফিজ ভাই আবার হাটতে শুরু করলাম। বান্দরবানের সন্ধ্যা রাতে কোন রিকশা নেই।
কোমল বাতাস বইছে। দূর থেকে কোন এক অজানা পাখির আওয়াজ আসছে। দূর পাহাড় থেকে ভেসে আসছে বুনো গয়ালের ডাক। হাটতে হাটতে মনে পড়ছে একটি হরিণের কথা।
সেবার রাতে একটি জিপ নিয়ে বেরিয়েছি।
রাঙ্গামাটির পর্যটন এলাকায় একটা হোটেল আছে। সেখানে খাবো। টেলিফোনে আগেই বলা ছিল, মানে খাবারের র্অডার দেয়া ছিল। একটি বন পাহাড়ের পাশ দিয়ে যেতে হবে। হঠাৎ আমার গাড়ি থেমে গেলো।
ড্রাইভার বললো, একটু অপেক্ষা করেন। এখান দিয়ে হরিণের পাল যাবে। এই সময়ে তারা এই রাস্তা পাড় হয়। আমরা গাড়ির ষ্টার্ট বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছি। চুপচাপ।
মিনিট পাঁচেক পর একের পর এক হরিণ। অন্ধকারের আলো থাকে, সেই আলোতে তাদের চলে যাওয়া দেখলাম। আহা এমন দৃশ্য আমি আগে কোনদিন দেখিনি।
আবার গাড়ি চালু করলাম। হেড লাইট জ্বলে উঠলো।
ঠিক তখনই তার সঙ্গে দেখা সে পিছিয়ে পড়েছিল। হেড লাইটের তীব্র ঝলসানো আলো তার চোখে .... সে দাঁড়িয়ে গেল। তার চোখ চকচক করছে। অবাক। কি করবে বুঝতে পারছে না।
মায়াবি ঐ চোখকে পিছনে ফেলে আমরা চলে গেলাম। ওর ওই চোখকে আমি কোনদিন ভুলতে পারিনি। পারবোও না....
কাল আমাকে কর্ণেল আওয়ালের সঙ্গে দেখা করতেই হবে। হোটলেটি ছেড়ে দিয়েছি আগেই। এরপর আমাদের থাকার জায়গাটি ঠিক করে রাখা হয়েছে আগেই।
বন বিভাগের একটি রেষ্ট হাউজ। বড় বড় ঘর। ভালোই লাগলো। একটিই সমস্যা গরম পানি নেই। চুলোয় কিছুটা পানি গরম করে শান্তি চুক্তি পরর্বতী পার্বত্য চট্টগ্রামের কথা ভাবতে ভাবতে গোসল সেরে নিলাম।
মুস্তাফিজ ভাই কোথা থেকে যেন এক বোতল দোচোয়ানি যোগাড় করেছেন। আমি গরুর মাংসের সঙ্গে সেই পানীয়তে চুমুক লাগালাম। রেষ্ট হাউজের বাবুর্চি হালিম ব্যাপারি দারুন রেধেছে। সবচেয়ে ভালো হয়েছে ঘন ডাল। খেয়ে দেয়ে ঘুম।
..................................................
সকালে আমার দরজায় কড়া নাড়লো। মুস্তাফিজ ভাই তার খাট থেকে নেমে নিজেই গিয়ে দরজা খুললেন। ঘড়িতে সকাল সাড়ে সাতটা। ঢাকায় থাকতে কখনো এত সকালে ঘুম থেকে উঠিনা। আমি উঠিনা .. মানে উঠতে চাই না।
: সাগর সাহেব আছেন?
:আছেন:
আমি উঠে এলাম। দেখি উর্দি পরা এক লোক দাড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই বললেন....
: আমি মেজর মাহবুব। স্যরি আপনাকে এত সকালে ঘুম থেকে উঠালাম বলে। কমান্ডার স্যার আপনাকে নিতে আমাকে পাঠিয়েছেন।
আপনার সঙ্গে নাস্তা করবেন। আমি বসার ঘরে বসছি। দয়া করে রেডি হয়ে নিন।
আমরা ঝটপট রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বিডিআরের জিপে চড়ে সোজা নাইক্ষ্যংছড়ি রিজিওন ক্যাম্পে।
গেট দিয়ে ঢোকবার সঙ্গে সঙ্গেই বোধ হয় কর্ণেল আওয়াল জেনে গিয়েছিলেন। তার কোর্য়াটারের সামেন আমাদের অভিবাদন জানালেন এই বীরপ্রতিক।
: কেমন আছেন?
: ভালো, আপনি...
: ভালো... আবার দেখা হলো। চলুন খেতে খেতে কথা বলি।
সাদা লালের পোশাক পরা, হাতে গ্লোভস পরা এক লোক আমাদের খাবার পরিবেশন করছে।
: আমি আসলে আপনার একটি সাক্ষাৎকার নিতে চাই।
: আমি জানি। হেড অফিসের সঙ্গে আপনার বিষয়ে অনুমতি নিয়েও নিয়েছি।
: আপনি জানলেন কি করে এ কথা, যে আমি আপনার ইন্টারভ্যু নেব
: সাগর সাহেব... আপনাকে আমি চিনি। আপনি এখানে এসেছেন, আমার সঙ্গে এমুনি এমুনি পরোটা খাবেন .. তা আপনি করবেন না।
আমি জানি । কাল আপনার সঙ্গে সেই পাহাড়ী মেয়েটির দেখা..এর আগে এখানকার পদ্ম পুকুরের ছবি তোলা.. সন্ধ্যায় রিকশা না পাোয়া... বন বিভাগের বাংলো..... আমাকে সব খবর রাখতে হয় সাগর সাহেব।
: ধন্যবাদ। আপনি আমাদের খবর রাখছেন বলে। এভাবে সকলের খবর রাখেন?
: চেষ্টা করি।
: তাহলে শুরু করি....
: একটু পরে ... ব্রেকফাষ্ট শেষ করুন। তারপর চলুন আমার অফিসে। সেখানেই কথা হবে।
.................................................................
তাগড়া গুফো কর্ণেল আওয়াল বীরপ্রতিক। বয়স পঞ্চাশ এর কাছাকাছি।
অফিসে বসলেন। দু তিনটি ফাইল সই করলেন। তার পর তিন কাপ কফি এলো। আমি আমার রেকডার রের করলাম। উনার সাক্ষাৎকারের পর আমাকে আরেক জনের সাক্ষাৎকার নিতে হবে।
................................................................
:কেমন আছেন?
: ভালো
: শান্তি চুক্তিতে আপনারা খুশি?
: এটা শান্তি চুক্তি নয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর এটি সই হয়। সেখানে এর নাম পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি। শান্তি চুক্তি নয়...
: পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে আপনারা খুশি.....
: আমি ভাঁড় নই, যে হাসবো বা হাসাবো...
: আপনারা কি হাসতে ভুলে গেছেন?
: না ভুলে যাইনি।
তবে আমাদের কে সেই পথেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
: কি করেছেন আপনারা এখানে?
: দেখুন...পার্বত্য চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম ৩ আগস্ট ১৯৭৩ সালে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার জন্য সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়৷ সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে ‘সন্ত্রাস' দমনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে ৷ ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার এবং জনসংহতি সমিতির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে দীর্ঘ প্রায় দুই যুগের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অবসান ঘটে৷আপনারা তো তাই বলছেন। আমরা এ এলাকার সন্ত্রাস দমনের পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও সাধারণ জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছি৷
১৯৭১ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন অপারেশনে সাহসিকতাপূর্ণ অবদানের জন্য পার্বত্য এলাকায় কর্মরত ১ জনকে বীরউত্তম, ১১ জনকে বীরবিক্রম, ৬৮ জনকে বীরপ্রতীক পদকদেয়া হয় এবং ৮৫ জন সেনাসদস্য সেনাপ্রধানের প্রশংসাপত্র অর্জন করেন৷ চুক্তির পর বর্তমান ‘অপারেশন-উত্তরণ' এর আওতায় আমরা খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি এবং বান্দরবান পার্বত্য জেলায় শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে সরকার এবং অন্যান্য সংস্থাগুলোকে সহায়তা করছি৷
এই সময় ‘সন্ত্রাসীদের' সাথে যুদ্ধে এ পর্যন্ত আমাদরে ১৭৮ জন সেনাসদস্য প্রাণ হারিয়েছেন, আহত হয়েছেন মোট ২১১ জন, এ হিসাব সরকারের৷
: যাদের কে সন্ত্রাসি বলছেন... সেই পাহাড়ীদের কত জনকে হত্যা করেছেন...?
এই প্রশ্নের উত্তরের আগে প্রায় ঠান্ডা হয়ে যাওয়া কফিতে চুমুক দিলেন কর্নেল আওয়াল...ঠান্ডা তেঁতো কফির মতো তার চেহারাও কেমন যেনো তেঁতো দেখালো.......
( এটি একটি উপন্যাসের অংশ। তবে এতে অনেক ঘটনাই সত্য। কিছু নাম কারও কারও সঙ্গে মিলে যেতে পারে।
এরা সকলেই উপন্যাসের চরিত্র)
ফুট নোট: কর্ণেলকে আমি মনে রেখেছি উপন্যাসটির পঞ্চম পর্ব অনেকদিন পর লিখতে পারছি। প্রায় ছয় মাস পর.....
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।