সাগর সরওয়ার
কর্ণেলকে আমি মনে রেখেছি- ১
আমার ভয় ডর নেই এ কথা সত্যি নয়। অসিম সাহসী কোন সাংবাদিক আমি নই। ৯৭ -৯৮ সালের দিকে হরতালের সময়ে ঢাকার নয়াবাজারে সবচেয়ে বেশী পিকেটিং হতো। বোমা পড়তো। টিয়ার গ্যাস ফাটতো।
পুলিশের লাঠিচার্জ হতো। এমন সময়ে আমি এগিয়ে যেতাম যেদিকটা থেকে বোমা বা ইট পাটকেল ছুড়ে দেয়া হতো সেই দিকটায়। কি কারনে যেতাম..... উত্তর খুঁজে দেখেছি... মুলত ভালো কোন সংবাদের ক্লুর আশায় চলতো আমার ছুটে চলা। আমি ছুটে চলতাম এখান থেকে সেখানে। যেখানে সংর্ঘষ সেখানেই আমি।
কিন্তু আমি ক্রাইম রিপোর্টার না। সাধারণ একজন রিপোর্টার। আমারও ভয় আছে। আমি অনেক চেষ্টা করেও ঢাকা মেডিকেলের লাশ ঘরে গিযে মানুষের শরীর থেকে হৃদয় খোলা দেখতে পারি নাই। আমি পারি না।
আমার সে সাহস নেই। ওয়্যার জার্মালিজমে একটা কথা আছে সেফ ফার্ষ্ট। নিজে না বাঁচলে খবর যাবে কি করে মানুষের কাছে!
তবুও আমি দরজা খুললাম!
দেখি সামনে দাঁড়িয়ে আছেন একজন সেনাবাহিনীর পোশাক পরা ভদ্রলোক। তার পিছনে আরও দুই জন। পিছনের লোকজনের হাভাব দেখে বুঝলাম ইনি তাদের বস।
ইতিমধ্যে আমাদের আশ্রয়দাতা এসে পৌঁছেছেন। হাত বাড়িয়ে দিলেন
: আমি আব্দুল আওয়াল, বীর প্রতিক। আপনি আমার খোঁজে এসেছিলেন।
:জ্বি। আসুন।
তিনি ঘরে ঢুকলেন। কোণার চেয়ারে বসলেন। আমাদের আশ্রয়দাতার দিকে তাকিয়ে বললেন...
:স্যার, আমাকে কিছু খেতে দিতে পারেন। আমার খুব ক্ষূধা লেগেছে। খাগড়াছড়ি থেকে আসার সময়ে কিছু খেয়ে আসতে পারিনি।
আমাদের আশ্রয়দাতা ভদ্রলোক এক চিলতে হেসে চলে গেলেন। অনেক রাত কি খাবার দেবেন সেই চিন্তাই তিনি করছেন হয়তো। আমি কোন কথা বলছি না। আমি কযেকটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি। প্রথম প্রশ্রের উত্তরটি টিকচিহ্ন দিয়ে উত্তর দেযা যাবে না।
সেটি হলো আব্দুল আওয়াল কি করে জানলো আমি এই বাড়িতে আছি?
:সাগর সাহেব, আমি জানি আপনি কি ভাবছেন। আপনি ভাবছেন তো আমি কি করে জানলাম আপনি কোথায় আছেন... ঠিক না।
আমি মাথা দুলিযে উত্তর দিলাম। তিনি বললেন,
: আপনি যখন এখানে এসেছেন.. তখনই আমার কাছে খবর এসেছে। আমি জানি আপনি কোথায় কোথায় গেছেন।
আর কার কার সঙ্গে কথা বলেছেন। আমার লোক যে আপনার সঙ্গে ছায়ার মতো লেগেছিল। আপনার নিরাপত্তার বিষযটিও তো আমাকে লক্ষ্য রাখতে হয়! কি বলেন...
: না আপনি আমার নয়, আপনার নিজের জন্যই লোক লাগিযে রেখেছেন? কেন করছেন এমন সব। এ দেশ আমার। এটা স্বাধীন দেশ।
আমি সকলের সঙ্গে কথা বলতে পারি। সর্বত্র যেতে পারি এটা আমার সাংবিধানি অধিকার। এটি স্বাধীন দেশ।
: এই দেশটিও আমারও। এখানে ভারতের সহযোগিতায় সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চলতে দেয়া যায় না।
: ভারত আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে সহায়তা করেছিল....
: এর বিনিমযে ভারত অনেক কিছুই পেয়েছে। দেখুন আর্ন্তজাতিক রাজনীতির জন্য এই পাহাড়কে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এমন সময়ে শিক্ষক ভদ্রলোক চা নাস্তা নিয়ে আসলেন। খুবই বিনয়ে হাসি দিলেন কমান্ডার। পাকোড়া জাতীয় কিছু একটা খেতে খেতে চায়ের কাপটি হাতে নিয়ে বললেন...
:স্যার... আপনারর লেখালেখি কেমন চলছে
:ভালো।
: এক সময় আমাকে একটু পড়তে দিবেন। আমার জানার অনেক প্রয়োজন। আপনার লেখা থেকে মানে আপনার ডয়েরি থেকে আমি জানতে পারবো।
: আপনি কিভাবে জানলেন.....
''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''
জুন ১৯৭১। দেরাদুন ট্রেনিং সেন্টার।
কুমিল্লা থেকে একটি বালক সীমান্ত পেরিয়ে এসে পৌছালো সেই ট্রেনিং সেন্টারে। সুবেদার হরিপদ দাস। ভারতীয় বাঙ্গালী। ট্রেনার। বাংলাদেশ থেকে আসা তরুণদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
ঠোটের একটু উপরে হালকা গোফ ওঠা ছেলেটিকে দেখে বললো
: তোর শিনার মাপ ঠিক নাই। যুদ্ধ করতে হলে দম চাই। তোর বুকে দম থাকবে না। দৌড়াতে পারবি না। তাছাড়া কাঠির মতো এমন স্বাস্থ্য নিয়ে লড়া যাওয়া যায় না।
তারচে বাড়ি ফিরে যা।
: দম বুকে থাকে না। থাকে মনে। যুদ্ধ করতে কাঠি শরীর নয়। লাগে বুদ্ধি।
উত্তর শুনে থমকে গেলেন সুবেদার। কি যেনো ভাবলেন... তারপর বললেন,
:ঠিক আছে। চল আমার সঙ্গে। দশবারো জনের একটি নতুন রিক্রুট করা দলের সঙ্গে ভিড়িয়ে দিলেন্ সবাই তাকে দেখে হাসি ঠাট্টা করছে। এই পুঁচকে কি করবে।
দেরাদুনে ছেলেটির ট্রেনিং শেষ হলো। এরপর তাকে ছেড়ে দেয়া হলো মুক্তিবাহিনীর কমান্ডে। সেখান থেকে এই ছেলেটির পোষ্টিং রাঙ্গামাটি। ছেলেটি জানে না কেমন আছে তার মা । কেমন আছে তার বাবা।
তার শুধু জানা আছে যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধ এগিয়ে যাবে। সামনে লক্ষ একটি। স্বাধীনতা। বিজয়।
বাংলাদেশ। সবুজের মধ্যে লাল পতাকার মধ্যে হলুদ বাংলাদেশের মানচিত্র আকাশের বুক ফুটো করে বাতাসে উড়ে বেড়াবে।
যুদ্ধ চলছে। রাঙ্গামাটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কমান্ডর তাকে দায়িত্ব দিয়েছে খবর পৌছানোর। মুক্তিযোদ্ধাদের এক একটি দলের কাছে যেতে হবে।
সংবাদ এখান তেকে সেখানে পৌছাতে হবে। ছেলেটির হাটুর নীচে সবসবময় একটি ছোট্ট ছিমছাম কিন্তু ভয়ঙ্কর রিভলভার।
পাহাড়ের নীল আর বুনো গন্ধ ছেলেটিকে পাগল করে রাখে। রাত দিন নেই সে ছুটে চলে। এখান থেকে সেখানে।
এমনি একদিন রাঙ্গমাটি থেকে কাপ্তাই লেক দিয়ে মহালছড়ি পৌছাতে হবে। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী আর তাদের সমর্থকরা কড়া নজরদারি। ছেলেটির ছোট্ট ব্যাগে যুদ্ধের নতুন কৌশল ম্যাপ। ছেলেটি পথ বদলে নিল। কিন্তু যেতে যেতে রাত গভীর।
পাহাড়ের শীত তাকে জেকে ধরেছে। তার ঘুম পাচ্ছে। শীত লাগছে। গায়ে জ্বর। একটি বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল।
একটু আশ্রয় পাওয়া গেলে মন্দ হয় না। বাঁশের বেড়ার একটি ঘরের দরজায় কড়া নাড়লো সে।
বেশ কিছুক্ষণ পর এক লোক দরজা খুললেন, তার হাতে একটি কালি কলম। অতিথি দেবতা।
সেই দেবতার গায়ে হাত দিয়ে মানুষটি দেখলো জ্বরে দেবতার গা পুড়ে যাচ্ছে।
ছেলেটি ঘরে ঢুকেই বেহুশ।
পরদিন যখন ছেলেটির ঘুম ভাঙ্গলো তখন দুপুর। লোকটি পাশে বসে কি যেনো লিখছে। ছেলেটির জেগে ওঠা দেখেই বললো..
: এখন কেমন লাগছে।
: ভালো।
আমার খুব ক্ষিধে পেয়েছে। লোকটি উঠে গেলো.. তার ঠেটে এক চিলতে হাসি। ছেলেটি উঠে বসেছে। লোকটির খাতা খোলা। খুব সুন্দর হাতের লেখা।
খাতার পাশে নীল উইনসন কালির দোয়াত । খাতার দিকে তাকালো ছেলেটি
২৩ আগষ্ট, ১৯৭১
রাতে যে ছেলেটি এসেছে তার বয়স আর কত হবে। দশ বা বারো। আমি তাকে চিনি না। তবে বেশ বুঝতে পারছি সে মুক্তিযোদ্ধা।
তার কাছে একটি রিভলভার আছে। হয়তো ব্যাগে বাড়তি গুলিও আছে। আমার আর মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া হলো না। ছেলেটি যা পেরেছে আমি তা পারি নাই। আমি স্কুলে পড়ানো ছাড়া আর কিছুই পারি না।
এমন সময় লোকটি ঘরে ঢুকলো। বললো গোসল করে নাও। খাবার রান্না শেষ। মা রান্না শেষ করেছে। নাপ্পি শুটকি দিয়ে ভাত খাবে।
শরীরের সব ক্লান্তি শেষ। জ্বরও পালাবে। তোমার রিভলভার আর ব্যাটি আলমারিতে রাখা আছে। খাওযা দাওয়া সারার পর ছেলেটি বেরিয়ে যাবার আগে বললো....
: সবাই যুদ্ধে না গেলেও চলে। যুদ্ধের পর দেশ গড়তে তারা দায়িত্ব নেবে।
আপনি খুব সুন্দর লেখেন। যুদ্ধ শেষ হলে একবার এসে আপনার লেখাগুলো পড়ে যাবো। ছেলেটি আর আসেনি। পরে এক মুক্তিযোদ্ধা জানিয়েছিল..
ছেলেটি আহত হয়েছিল যুদ্ধে। তবে এখন ভালো আছে।
দেশের সবচেয়ে কম বযসের মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সে সবচেয়ে সাহসী। আর তাই ছেলেটিকে এখন বীরপ্রতিক..........
''''''''''''''''''''''''''''''''''''''''
আওয়াল সাহেবের গোফটি খুব সুন্দর। তাগড়া গোফ যাকে বলে। সেই রাতে আমরা অনেক বিষয়ে কথা বললাম। আমর নির্র্দিষ্ট বিষয়েও তার পক্ষের বেশ কিছু যুক্তি শুনলাম।
তবে এ সময়ের মধ্যে তিনি একবাবের জন্য আমাকে বলেননি ক্যান্টনমেন্টে যেতে। কেবল একটি মোবাইল নাম্বার দিয়ে বললেন... আমি যদি ঢাকা বা চট্টগ্রাম থাকি তাহলে এই নাম্বার খোলা থাকে।
ঐ নাম্বার আমি কখনো খোলা পাইনি। তিনি বদলি হলে চট্টগ্রামে এসেছিলেন বলে জেনেছিলাম। তারপর কোথায় গেছেন তা জানতাম না।
এবার চট্টগ্রামে এসে লে. কর্নেল আব্দুল আওয়াল নাম শুনে অবাক হলাম না।
কক্সবাজারের টিকেট কেটে চড়ে বসলাম। আমি আর মোস্তাফিজ ভাই। আমাদের চট্টগ্রাম অফিসের ফটোগ্রাফার। বাস চলছে।
নাইক্ষ্যংছড়িতে এই বাস যাবে না। আমরা পথে বসে নেমে একটি বেবিটেক্সি ধরলাম। সেটি ছুটে চলছে। পাহাড়ি আকাবাকা পথ। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে।
হঠাত টেক্সিটির কড়া ব্রেক......
: হল্ট .....
(ক্রমশ)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।